বিশ্বদীপ চক্রবর্তী
পূর্ব প্রকাশিতের পর
ছায়াপাখি
তিন.
দোতলা বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে হীরক ইতস্তত করছিল। লেখার কাছ থেকে ঠিকানা পেয়েছিল। এই বাড়িতেই থাকে রেখারা। এতদূর এসেও অনিশ্চয়তায় পা বাঁধছে। তার আসার কথা জানানো আছে। লেখা বলেছে। তবুও। কী হতে চলেছে কিছুই তো জানে না। শুধু জানে জীবনের কিছু সত্যি থেকে পালানোর দিন শেষ। মুখোমুখি হতেই হবে। এক যুগ কেটে গেছে। পাথরের মতো চেপে বসা এই ভার না সরাতে পারলে তার নিস্তার নেই।
লেখার প্রশ্ন মনে পড়ল। কেন দেখা করতে চাও হীরুদা? বিবেকদংশন থেকে মুক্তি পেতে? যাতে তারপরে নিজের জীবনের আনন্দধামে বসত করতে পারো বহাল তবিয়তে?
লেখা এইভাবে বলতেই পারে। হক আছে। কোনওভাবেই তো পাশে গিয়ে দাঁড়ায়নি সেদিন। কতরকমের যুক্তির বেড়াজাল সাজিয়ে নিজের পথ আলাদা করে নিয়েছে। তা না হলে সে কি আর একটু চেষ্টা করতে পারত না? ছুড়ে ফেলে দিতে পারত না নিজের লাভক্ষতির হিসাবনিকাশ? জানে সেটা হীরক। সেই অনুশোচনাই তাড়িয়ে নিয়ে বেরিয়েছে এতদিন।
—সত্যি হীরুদা? দিদির কথা এতদিন ভাবতে তুমি? আমার সঙ্গে দেখা হওয়াটা তো আচমকা, একদমই হঠাৎ। দেখা না হলে কী করতে?
লেখার কথাগুলো খুব ধারালো ছিল। তীব্র শ্লেষের তরবারি চালিয়ে ফালাফালা করে দিয়েছে তার সমস্ত আত্মপ্রবঞ্চনা। সেদিনের সেই ছোট্ট মেয়েটা যে হীরুদা হীরুদা বলে গলা ধরে ঝুলে পড়ত সে তো আর ছোট নেই। বয়সেও বড় হয়েছে, অভিজ্ঞতাতেও। সাফল্যেরও একটা শক্তি আছে। প্রখর দীপ্তি। সেই গনগনে আগুন পুড়িয়ে দেয়, জ্বালিয়ে দেয় মিথ্যার খোলস। কুঁকড়ে গেছিল হীরক। কিন্তু তবু পিছিয়ে আসেনি। সে তো জানতই এরকম কথা শুনতে হবে। তার উত্তর নিয়েও নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করেছে দিনের পর দিন।
সেই বিশ্বাসেই হীরক বলতে পেরেছিল, ঠিক বলেছিস লেখা। আমার বলার কোনও মুখ নেই। নিজের কাছ থেকে এতদিন পালিয়ে বেরিয়েছি। মনের মধ্যে আমার জানা, আমার দেখা রেখাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টায় আসল রেখার থেকে পালিয়ে বেরিয়েছি। সেই স্মৃতিতে রেখার কোনও বিকৃতি নেই, কোনও দাগ নেই।
হীরক যেন নিজেকেই বলছিল। আসলে বলেছেও তো কতবার। বহু বছর ধরে। নিভৃতে। ফারাক শুধু আজকে লেখার সামনে স্বীকার করছে। মনের মধ্যে বলা কথাগুলোকে অন্যের সামনে বের করে আনা সোজা নয়। কিন্তু হীরক সেটাই করতে চায়। এটাই তার প্রায়শ্চিত্ত। সেই জেদ নিয়েই বলল, নিজেকে ঠকানোর সেই খেলায় কোনও হারজিত হয় না রে। বরং মানুষ ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়ে এক মায়াজালে। কিন্তু নিজের থেকে তো পালিয়ে থাকা যায় না। আমি জানতাম আমাকে কিছু করতে হবে। করতে হতই। আজ না হোক কাল। তোর সঙ্গে দেখা হয়ে সেই প্রয়োজনটা হঠাৎ সামনে এসে গেল।
খুব আড়ম্বরের সঙ্গে হাততালি দিয়েছিল লেখা। গলায় বিদ্রূপ চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছিল। খুব গুছিয়ে কথা বলো তুমি হীরুদা। মনে হয় এইসব কথাগুলো নিজেকে বহুদিন শুনিয়ে শুনিয়ে পাকাপোক্তভাবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছ। এইভাবেই নিশ্চয় একসময় নিজেকে বুঝিয়েছিলে যে দিদিকে খুঁজে বের করবার কোনও দরকার নেই তোমার। দিদি যখন তোমার থেকে মুখ লুকিয়েছে, তোমার কি ঠ্যাকা পড়েছে তাকে নিজের গুছানো সংসারে প্রবেশ করানোর?
হীরকের কথাগুলো লেখার কেন, যে কারওই সাজানো মনে হতে পারে। কিন্তু হীরক জানে বানানো নয়। বহু বিনিদ্র রাতে এই ভাবনা, এই শব্দেরা ফিরে ফিরে এসেছে তার মনে। সেটা তো অস্বীকার করতে পারে না।
লেখা কোনও জবাবের প্রত্যাশা না করেই বলেছিল, আমার জানা দরকার দিদির সঙ্গে দেখা করে তুমি কী করবে। এতগুলো বছর নিজের সঙ্গে লড়াই করেছে দিদি। বাবা-মায়ের কাছ থেকেও কোনও শক্তি পায়নি। আমি অনেক কষ্টে দিদিকে আবার দাঁড় করানোর চেষ্টা করছি, চাই না তুমি দিদিকে আবার ভেঙে চুরচুর করে দাও।
—তোকে একটা সত্যি কথা বলি লেখা। আমি নিজেও জানি না রেখার সঙ্গে দেখা করার পর আমি কী করব। আমার কোনও স্কিম নেই। কোনও পরিণতি জানা নেই। কোনও নতুন আশার আলো জ্বালানো বাতিঘর নেই আমার কাছে। শুধু ওর সঙ্গে দেখা করাটা যে জরুরি সেই কথাটা জানি। তার জন্যে আজ আমার জীবনও বাজিতে চড়িয়েছি। সব ভালোবাসার পরিণতি তো হ্যাপিলি এভার আফটার না। কিন্তু কেউ তোকে ভালোবাসে সেটা জানাটাও একটা শক্তি। ঠিক যেমন কেউ প্রচণ্ড ঘৃণা করে জানাটাও ঘুণপোকার মতো ভেতর থেকে ঝাঁঝরা করে দেয়। সে যে কী কষ্ট, তোকে বোঝাতে পারব না রে লেখা।
হীরকের গলার ভাঙচুর লেখার কান এড়ায়নি। ভিতর থেকে বেরিয়ে আসা কথার একটা জোর থাকে। বিশ্বাস। মনে আছে লেখার দৃষ্টি একটু নরম হয়েছিল এরপর। হয়তো হীরক নিজেও যে কষ্টের মধ্যে কাটিয়েছে এতগুলো বছর তার একটা হদিস পেতে শুরু করেছিল। ধীরে ধীরে উঠে এসেছিল হীরকের কাছে। কাঁধে হাত রেখেছিল আলতো করে। ভেজা গলায় বলল, ঠিক আছে হীরুদা। আমি আগে দিদিকে জিজ্ঞেস করব, ও দেখা করতে রাজি আছে কিনা। হ্যাঁ বললে, আমি তোমাকে ঠিকানা পাঠিয়ে দেব।
পরদিন লেখা যে আবার তার কাছে এসেছিল সেটাই হীরকের মনের বল বাড়িয়েছে। অন্তত একজনকে তো সে বোঝাতে পেরেছে নিজের কষ্টটা। সেই ভরসাতেই রেখার দরজায় এসে দাঁড়াতে পেরেছে আজ।
গুটি গুটি পায়ে বাইরের দরজায় দাঁড়িয়ে বেল বাজাল হীরক। মনে পড়ল বহু বছর আগে এমনি আশানিরাশার দোলায় দুলতে দুলতে ওদের দুর্গাপুরের বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়েছিল। তফাত, সেদিন সামনে ছিল সুদূর সম্ভাবনা আর আজ পিছনে পড়ে থাকা ধংসস্তূপ।
খুট করে দরজা খুলে গেল। মাধুরীকাকিমা।
ছোটবেলা থেকে পরিপাটি সাজে এক রমণীয় উপস্থিতিতে দেখেছে কাকিমাকে। সাজপোশাকে যত্নের ছাপ এখনও। কিন্তু এতগুলো বছরের ঝড়ঝঞ্ঝা মুখের প্রতিটা রেখায়। চুলে পাক। চশমার আড়ালে দুই চোখে ক্লান্তি। গলায় বড় বড় রুদ্রাক্ষের মালায় জীবনের সুরক্ষা।
দরজা খুলে মাধুরী প্রথমে বুঝতে পারেনি কে এসেছে। অসময়ে দরজায় বেল দেওয়া লোক নিয়ে স্বাভাবিক বিরক্তি মুখে। অনাহূত উপস্থিতিতে অবাক হতে হতে হঠাত পরিচয়ের আলোয় ভরে গেল মাধুরীর মুখ। ওমা, হীরু? তুই হীরু না?
কোলাপসিবল গেটের অন্য পার থেকে আশ্বস্ত গলায় বলে উঠল হীরক, কেমন আছ কাকিমা? ঠিক চিনেছ। আমি হীরক, হীরু।
ব্যস্তসমস্ত হয়ে গেটে টেনে খুলে ফেলল মাধুরী। কতদিন পরে বাবা, কত যুগ পরে। বলতে বলতে কেঁদে ফেলল মাধুরী। কিছু মনে করিস না হীরু। বয়স হয়ে যাচ্ছে তো। আগের চেনা কাউকে দেখলেই কেমন পুরনো জীবনটার কথা মনে করে নিজেকে ভাসিয়ে ফেলি। তোকে দেখে যে আমার কী আনন্দ হচ্ছে। অনিশ্চিত হাতে হীরকের চুলে, মাথা থেকে গালে হাত বোলায় মাধুরী। সেই ছোঁয়ার মমতা অনুভব করে কেমন কেঁপে উঠল হীরক। তবু নিজেকে জড়ো করতে করতে নিশ্চিত হতে চাইল হীরক।
—লেখা জানিয়েছিল তো আমার আসার কথা?
মাধুরী এবার আলগোছে হীরকের হাত ধরল। হালকা টানে সোফায় নিয়ে বসাল যেন হীরক নিজে থেকে বসতে পারবে না। মাধুরীর এই অন্তরঙ্গতা হীরককে আশ্বস্ত করছিল, কিছু সত্যের মুখোমুখি হওয়া বড় কঠিন। ভিতরে ভিতরে কাঁপছিল হীরক এক অনাগত উত্তেজনায়। মাধুরীর হাতের স্পর্শে কিছুটা শান্তির প্রলেপ পড়ল।
হীরক বসতে মাধুরী আবার কথার খেই ধরল। হ্যাঁ তো। লেখি বলেছিল তোর সঙ্গে দেখা হয়েছে। তুই একবার আসতে চাস। রেখাকে জিজ্ঞেসও করেছিল জানতে— জানিস তো মেয়েটা এতগুলো বছর কারও সঙ্গে দেখাও করতে চায়নি। বলতে বলতে আবার আর্দ্র হয়ে গেল মাধুরীর গলা। হাতের পাতায় চোখের কোল মুছতে মুছতে বলল, কিন্তু আমাকে বলেনি কবে আসবি। আগে থেকে জানলে তোর কাকুকেও আজ বেরোতে দিতাম না।
—কেন কাকু রিটায়ার করেছে না?
—হ্যাঁ, কিন্তু এখানে একটা কোচিংসেন্টারে পড়াতে যায়। দ্যাখ তুই থাকতে থাকতে যদি এসে পড়ে।
—আর রেখা?
এই নামটা ফিসফিস করে নিজের কাছে জীবনে কতবার নিয়েছে তার কোনও লেখাজোখা নেই। কিন্তু দুই ঠোঁটে সেই নাম উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে বুকটা মুচড়ে উঠল হীরকের।
—ও তো সচরাচর কোথাও যায় না। আগে একদমই যেত না। আসলে আমরা কেউই কোথাও তেমন যেতাম না আর। নিজেদের লুকিয়ে ফেলেছিলাম রে জীবনের থেকে। কী ছিল বল আমাদের জীবনে? একটার পর একটা ধাক্কায় টালমাটাল খেতে খেতে বেঁচে থাকার নাম কি জীবন? কেউ ছিল না রে আমাদের পাশে, কিছু ছিল না।
আবার কুঁকড়ে গেল হীরক। সেও তো ছিল না। কাকিমা তাকেও নিশ্চয় দোষারোপ করছে। করলেও বলার কিছু নেই। এই কথা তো এড়ানো যাবে না। মাধুরী নিজেই কথার মোড় ঘোরাল। আমরা কাউকে চাইওনি। লুকিয়ে থাকতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তখন যে আমাদের কী অবস্থা ছিল। তোর কাকু গুলি খেয়ে কতদিন ওইভাবে পড়েছিল সেটা তুইও দেখেছিস। দুর্ভাগ্য আমাদের পিছনে লেগেই রইল। মেয়েটার জীবন যখন চোখের সামনে এইভাবে চুরমার হয়ে গেল আমার আর কোনও কিছুতে ভরসা ছিল না। রাহুর দশা, সব রাহুর দশা। গুরুদেবের সঙ্গে কথা বললাম। বলল বাড়িতে দোষ আছে, জায়গা বদলাও। আমিও সেটাই আঁকড়ে ধরলাম। শুধু জায়গা ছাড়লাম না, ছেড়ে দিলাম যত চেনা-পরিচিতকেও। কী জানি ঠিক করেছিলাম কিনা। রেখাটাও নিজেকে এমন গুটিয়ে নিল। লেখা এখনও খুব রাগ করে। বলে মা, আমরা ইঁদুরের মতো গর্তে লুকালাম। মানুষের মতো রুখে দাঁড়ালাম না কোনওদিন। যে লোকটা আমাদের এত বড় সর্বনাশ করল সে দ্যাখো কেমন পায়ের উপর পা তুলে জীবন কাটাচ্ছে।
নিজের হাতে কিছু না করলেও সব কিছুর পিছনে নাটের গুরু কে সেটা হীরক জানত। বীরু। কিন্তু ওর টিকি ছোঁয়ার মুরোদ নেই কারও। প্রমাণও নেই।
—রেখা কেমন আছে কাকিমা?
—জীবনটা শেষ হয়ে গেলে যেমন থাকে। ফ্যাকাশে হাসল মাধুরী। ঘরের বাইরেই আসতে চাইত না। ডাক্তারের কাছে ছাড়া বাড়ির থেকে বেরোয়ওনি। শুধু গান নিয়ে কাটিয়ে দিয়েছে এতগুলো বছর। তারপর লেখা সিনেমায় নামার পরে, জোর করে ওকে বের করেছে গান গাইতে। তাও প্লেব্যাক, স্টেজে যেতে চায় না এখনও। কিন্তু লেখা বলেছে দিদিকে বের করবই। কী জেদ জানিস তো লেখির। বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। একসময় রাগ করেছি কত। কিন্তু আমাদের জীবনে আবার যদি কোনও আশার আলো জ্বেলেছে, সে ওই। বলতে বলতে মাধুরীর মুখে গোধূলির ঔজ্জ্বল্য।
—রেখা আসবে এখানে কাকিমা? বলতে বলতেই হীরক বুঝতে পারছিল নিজের গলা নিয়ন্ত্রণে থাকছে না।
—তুই ওর ঘরে যা না। সিঁড়ি দিয়ে উঠে প্রথম ঘরটা। তুই তো আমার ঘরের ছেলে, তোর যেতে কী লজ্জা। আমি তোর জন্য চা নিয়ে আসছি।
কিছু কিছু দূরত্ব পার করতে অনেক বছর লেগে যায়। কোনও কোনও সিঁড়ি ভাঙায় অনেক দ্বিধা। ভেজানো দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে একটু ইতস্তত গলায় ডাকল হীরক, রেখা! রেখা! আমি হীরক, হীরু।
কয়েক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা। হীরক এই মুহূর্তে নিজের নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছিল। যেন অনন্তকাল। তারপর ঘরের মধ্যে একটু নড়াচাড়ার আওয়াজ।
—আসব ভিতরে? আমি হীরু।
—আয়।
ভিতরে ঢুকে চোখ সইয়ে নিতে সময় লাগল। কারণ ঘরের আলো কমানো। চেয়ারে বসে দরজার দিকে মুখ করেই বসেছিল রেখা। দীর্ঘ বারো বছর পর মুখোমুখি।
ইচ্ছা থাকলেও ফেরা অত সহজ নয়। বহু বছরের দূরত্ব সময়ের পলিমাটিতে প্রতিমা নির্মাণ করে। চোখের আলো তাতে রং চড়ায়। যা কিছু অনভিপ্রেত মন তাকে সযত্নে লুকিয়ে ফেলে। ক্ষত আড়ালে যায়। সেই নাট্যমঞ্চে আলো ততটাই পড়ে যতটা দেখান হয়। অথচ যখন সত্যিকারের ফেরা হয়, সামনাসামনি হতে হয় চরম সত্যের, সে বাস্তব থেকে পালিয়ে যাওয়ার জন্য দু-পা ছটফট করে ওঠে।
—বড় আলো নেই?
—দরকার না হলে আমি টিউবলাইটটা জ্বালি না। তাছাড়া তুই অত শক্ত নোস, নিতে পারবি না।
যদি কোনওদিন রেখার সঙ্গে দেখা হয় কী কথা হবে, কীভাবে শুরু করবে, এসব অনেকরকম ছকে রেখেছিল হীরক। কিন্তু জীবনটা রেললাইন নয়, বেঁধে দেওয়া পথে তো যায় না। রেখার কথায় নিশ্চিত তাচ্ছিল্য। তবু নদীর পাড়ভাঙার জোর গলায় ঢেলে হীরক বলল, আমি তোকে আমার কাছ থেকে লুকিয়ে থাকতে দেব না আর রেখা।
রেখা কি হাসল? হাসলেও সেটা এই ঘরের আলোর মতো। আছে আর নেইয়ের মাঝখানে ত্রিশঙ্কুর মতো ঝুলছে।
—কেন? এত বছর তো লুকিয়ে ছিলাম, খোঁজ করেছিস নাকি?
—এরকম তুই বলতে পারিস। যে কোনও কিছু শোনার জন্যই তৈরি হীরক।
—না, না তোকে আমি দোষ দিচ্ছি না রে। অসুন্দরের কাছ থেকে সবাই পালাতে চায়। সাফল্য আর অপূর্ণতার একদম বনিবনা নেই। তবু দ্যাখ লেখার সঙ্গে দেখা হতে না হতেই আমার সন্ধানে ছুটে এলি, কম ভাগ্যের কথা?
রেখার কথা শুনতে শুনতে হীরক বুঝতে পারছিল না ও কি বিদ্রূপ করছে, না সত্যিই হীরকের আসায় খুশি হয়েছে।
—শুনে একটু অবাক হয়েছিলাম জানিস। হোক না এত বছর বাদে, তবুও আমার যে খারাপ লাগেনি সে-কথাও সত্যি। কিন্তু জানি না তোর আসার কারণ। এবার বল, কেন এসেছিস?
রেখার কথাগুলোর ওজন নিচ্ছিল হীরক। কী বলতে চায় মেয়েটা? যাই বলতে চাক, ওর অভিযোগ করার পূর্ণ অধিকার। এখুনি হীরককে দূর দূর করে বের করে দিলে কিছু বলার ছিল না। কোনওভাবে দোষ দিতে পারল না। তাই যা বলতে এসেছিল সেটাই বলে ফেলল, যদি বলি ভালোবাসাকে ভুলে যাইনি বলে।
আধো অন্ধকারে রেখা হাসল কিনা বোঝা গেল না। খুব হালকা একটা হাসির আওয়াজ এল বটে, কিন্তু এত মিহি যে সহজেই বাতাসে মিশে কথাকে জায়গা ছেড়ে দেয়।
—কেউ ভালোবাসার কথা বললে কি কখনও খারাপ লাগতে পারে। একটা সময় ছিল তুই এরকম কথা বললে আমার মনে একটা বিশাল ঢেউ উঠত। আমি সেই ভালোবাসার পরিণামের কথা ভেবে উদ্বেল হয়ে উঠতাম। কিন্তু এখন আর হব না।
—পরিণাম ছাড়া বুঝি কোনও কিছুর মূল্য থাকতে নেই? নিজের গলাটাই অচেনা ঠেকছিল হীরকের কানে।
—আমি জানি ভালোবাসা মনের থেকে আসে। কিন্তু বিবেচনাবোধ, কোনটা ভালো কি খারাপ, কোন পথে এগোব আর কোন পথ থেকে সরে আসব— সে-সব আমাদের মাথা ঠিক করে। মানুষের মাথায় অনেক হিসাবনিকাশ চলে। সেখানে অন্ধ আবেগের অত দাম নেই। তুই সেটা ভালো করেই জানিস।
রেখার এমন নিশ্চয়তার সঙ্গে তার কথাকে ব্যবচ্ছেদ করাটা হীরককে দিশাহারা করছিল। কী বলবে বুঝতে না পেরে ঘরটার চারদিকে চোখ বোলানোর চেষ্টা করল। ওরা কিছুদিন মোটে এই বাড়িতে এসেছে। জীবনযাপনের ছাপ সেভাবে এখনও পড়েনি। কিন্তু ঘরটার আড়ম্বরহীনতা খুব সহজেই চোখে পড়ে। সেটা তার চেনা রেখার সঙ্গে একদমই যেন মেলে না। রেখা সাজগোজ করতে ভালোবাসত, তেমনি নিজের চারপাশটাকেও খুব সাজাতে ভালোবাসত। বেশ মনে আছে হীরকের। ঘর সাজানোর জন্য এটা-সেটা কেনার কী ঝোঁক ছিল রেখার। কিন্তু সে যেন এক অন্য জীবন। সে বোধহয় এক অন্য রেখা।
—বললি না কিন্তু কেন এসেছিস। মানে সত্যি কথাটা। এই যেমন দ্যাখ এখানে এসেও আমার দিকে তাকাতে তোর অস্বস্তি হচ্ছে। কিংবা ভয়। ভয়ের সঙ্গে লড়াই করে ভালোবাসা থাকে না এটা আমার চেয়ে বেশি কেউ জানে না।
ধীরে ধীরে দরজার কাছে রাখা মোড়াটায় বসে পড়ল হীরক। নিজের বলা প্রতিটা শব্দ চিনতে পারার বিশ্বাস নিয়ে বলল, আশ্চর্য হলেও সত্যি যে ভালোবাসাটা নাক বাড়িয়েছিল এত বছর ধরে। মনের মধ্যে ভালোবাসার একটা মূর্তি গড়েছিলাম, সেটা তোর।
—যুক্তির কাছে বন্ধক রাখা ভালোবাসা কোন কাজে লেগেছে কারও কখনও?
রেখার কথাগুলো স্তব্ধতার গহ্বরে তলিয়ে যেতে দিল হীরক। নাহলে পরের কথাগুলো যেন বলা যাবে না। জোরে শ্বাস নিল, তারপর কথার সুতো পাকড়ে ধরল আবার।
—লেখার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর সেই যুক্তির বেড়াজাল ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল রে। আমি তো জানতাম অ্যাসিডে জ্বলে গেছে তোর মুখের একটা অংশ। তবু লেখার কাছে সেই ছবি দেখার আগে অবধি তুই আমার কাছে ছিলি সেই রেখা যাকে আমি বারো বছর আগে রেখে গেছি। আমি নিজের একটা ভিতরমহল বানিয়েছিলাম যেখানে আমি তোর সঙ্গে কথা বলতাম, তোকে চাইলেই আমার কাছে পেতাম। কিন্তু তোর ছবি দেখার পরে আর পাই না রেখা। আমি আর তোর সঙ্গে কথা বলতে পারি না।
এবারের হাসিটা স্পষ্ট। তীক্ষ্ণ। এবার আর না শুনতে পাওয়ার কোনও কারণ নেই। হাসিটা ওদের দুজনের মধ্যের জায়গাটায় ঝুলে রইল এক অস্বস্তিকর অনমনীয়তায়।
—জানতাম। আমার এই বীভৎস চেহারা দেখার পর তুই আমার কাছ থেকে আবার দূরে পালাবি। সহ্যই করতে পারবি না। দ্যাখ, কেমন চালাক আমি। নিজেই দূরে সরে গেছি।
—না। নিজের আর্তচিৎকারে নিজেই কেঁপে ওঠে হীরক। সে-জন্য না রেখা। আমি ছবি দেখে দূরে পালাতে চাইনি। ওই ছবির চোখ আমার দিকে একরাশ বেদনা নিয়ে তাকায় রেখা, আমায় থমকে দাঁড় করিয়ে দেয়।
—একটা চোখই নেই যার, সেই চোখে আবার বেদনা! নিজের প্রতি এক মর্মান্তিক কৌতুকে বেজে ওঠে রেখা। মণিহারা চোখের সকেটে পড়ে আছে একরাশ শূন্যতা। হাসতে হাসতে থমকে যায়। দ্যাখ, এখন কেমন নিজের কানাচোখ নিয়ে হাসতে পারছি। অনেক বছর হয়ে গেছে তো, নিজের ভাগ্যের উপর হাসতে শিখে গেছে আমার মন। তবে লেখা বম্বে নিয়ে গিয়ে প্লাস্টিক সার্জারি করানোর আগে মুখ খুলে হাসতেও পারতাম না।
—আলোটা জ্বালাব।
এক ঝটকায় উঠে পড়ে সুইচবোর্ডের প্রতিটা সুইচ টিপতে থাকে হীরক। টিউবলাইটের ঝকঝকে আলোয় রেখার চেহারার প্রতিটা বিকৃতি সম্পূর্ণ অভিঘাতের সঙ্গে হীরকের দিকে ছুটে আসে এক মুহূর্তে। রেখা কোনওভাবেই নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করল না। রেখার বাঁ-চোখের পাতা ঝুলে পড়ে ঢেকে রেখেছে শূন্য কোটর। বাঁ-গাল জুড়ে চামড়ায় মোম ঢেলে টেনে ধরে রাখার মতো চকচকে ভাব। ঠোঁটের আকারটাও বদলে গেছে অনেক, বাঁদিকটা বেশি চাপা। রেখা যা মনে করেই হাসুক, বাঁকা হয়েই বেরোবে। দেখতে দেখতে হীরক আর ভয় পেল না। সত্যের মুখোমুখি হতে পারার একটা শক্তি আছে। সেই শক্তি হীরককে সমস্ত চাক্ষুষ বাধা অতিক্রম করে রেখাকে ছুঁতে চাওয়ার শক্তি দিচ্ছিল। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, রেখা, আমি একবার ছুঁয়ে দেখতে পারি তোকে? একবার?
—কেন?
—অনুভব করতে চাই তোকে। ছুঁতে চাই তোর জীবন।
—সেটা একবার ছুঁয়েই হয়ে যাবে? আনন্দ আর দুঃখ অনুভব করতে গেলে জাপটে ধরে থাকতে হয়। পারবি? একটা ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি জেগে উঠছিল। ভালোবাসা কি ট্যুরিস্ট অ্যাট্রাকশন? হোটেলের জানালা থেকে দেখার মতো? ভালোবাসার একটা ঘর লাগে। পাকাপাকি ঘর। ভালোবাসা দু-হাত ভরে অনেক কষ্ট নিয়ে আসে, সেগুলো রাখার জায়গা চাই না?
বলতে বলতেই হেসে উঠল রেখা। হাসিটা ওর সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছিল, গরম লাভার উষ্ণতা নিয়ে।
—ভাবছিস এত কী গম্ভীর গম্ভীর কথা বলছে মেয়েটা, জ্ঞানী পণ্ডিতের গলায়। অনেক তপস্যা করেছি না? জ্ঞানলাভ তো হবেই।
আস্তে আস্তে হাসিটা মিলিয়ে গেল রেখার। অমাবস্যার পথে যাত্রা করা চাঁদের মতো। এরপর যেন নিজেকেই বলছিল।
—কিছু কথা ঠোঁটের বাইরে আসছিল, কিছু ঘুরপাক খাচ্ছিল বুকের মধ্যেই। কতদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা, ঘুম থেকে জেগে ওঠার পর আবার ঘুমোনোর আগে অবধি, ভেবেছিই শুধু। নিজেকে দুষতে দুষতে, সারা পৃথিবীর উপর রাগে জ্বলতে জ্বলতে নিজেকেই দগ্ধেছি। এতদিন বাদে নিজের রাশ ধরেছি একটু। তখন কিনা তুই এলি ভালোবাসার গল্প নিয়ে।
নৈঃশব্দ্য হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে পড়েছিল ঘরে। হীরক জানে না কী বলবে। অনেকক্ষণ চুপ থেকে রেখাই আবার কথা বলল।
—তুই যে রেখাকে ভালোবেসেছিলি, আমি কি আর সেই রেখা? হয়তো রেখার মতো। তাই বা কী করে বলি? দেখতেও তো আলাদা হয়ে গেছি। ভাবনাতেও। সেই রেখাকে ভালোবেসেছিলি বলেই এই রেখাকে তোর ভালো লাগবে সেটা কেন ভাবছিস? তুই তো বদলে গেছিস, আমিই কি আর তোকে ভালোবাসতে পারব? পারতেও পারি, কিন্তু গ্যারান্টি নেই কোনও।
রেখার গলায় যে অত রাগ ছিল তা নয়। লোহা পুড়ে পুড়ে মজবুত হয়েছে, কিন্তু গরম নেই। যে কোনও দমকা হাওয়ায় হেলে যাবে না আর, তার জন্য ঝড় চাই। রেখার বলার মধ্যে সেই স্থির নিশ্চয়তা জেগে রইল; যখন বলল, সেসব কিছুই হল না, আর তুই আমাকে বুড়িছোঁয়া করে চলে গেলি, কী লাভ? ওমনি ওমনি নিজের বিবেক দংশন থেকে উদ্ধার পেয়ে যাবি সেটাও তো হয় না। হয় বল? আমি অনেক আগুন পেরিয়ে এখানে পৌঁছেছি। এই রেখাতে পোঁছাতে গেলে তোকেও কিছু পাঁচিল টপকাতে হবে। তাই না? তাই না, বল?
হীরক কী বলবে বুঝতে পারল না। কতদিনের ঝুলকালি জমা হয়ে ঝুলছে। প্রতি পদক্ষেপে সারা শরীরে জড়িয়ে যাচ্ছে সব। কাকিমা এখুনি হয়তো চা নিয়ে চলে আসবে। কী বলবে খুব তাড়াতাড়ি ভাবতে হবে হীরককে। কিংবা হয়তো কোনও তাড়া নেই। বরং অনেক সময় দিতে হবে এই রেখাপথ পেরোতে। তবেই ছায়াপাখি তার আকাশ খুঁজে পাবে।
[আবার আগামী সংখ্যায়]

