নহি যন্ত্র — দুই

সৈকত ভট্টাচার্য

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

—ধ্যাত, টাইম ট্রাভেল সত্যি নাকি? আমার মুখের কথাটা কেড়ে নিয়ে শুভই বলে ফেলল।
—হুঁ হুঁ বাওয়া, সব সত্যি। মহিষাসুর সত্যি, ক্যাপ্টেন স্পার্ক সত্যি… টাইম ট্রাভেলও সত্যি। রোজ করছি আমরা। অন্তত আমি তো করি, তোরা করিস কি না জানি না।

বলে আমাদের হাঁ করা মুখগুলোর ওপর একবার চোখ বুলিয়ে জয়দা আবার বলল, রাতের আকাশের দিকে তাকালেই হয়। আকাশের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র, সিরিয়াস, বা যাকে আমরা লুব্ধক বলে চিনি, পৃথিবী থেকে তার দূরত্ব কত বল তো?

আমাদের আবার মাথা চুলকনোর পালা। অতএব উত্তরটা জয়দাকেই দিতে হল, তা ধর প্রায় সাড়ে আট আলোকবর্ষ। আলোকবর্ষ কথাটা নিশ্চয়ই জানিস।

এবার একটা কমন প্রশ্ন পেয়ে দুজনেই মাথা নেড়ে বললাম, হ্যাঁ হ্যাঁ, আলো এক বছরে যতদূর যায়।

—গুড, জয়দা আবার বলে চলল, অর্থাৎ লুব্ধক থেকে আমাদের পৃথিবীতে আলো আসতে সময় লাগে সাড়ে আট বছর। তার মানে, তুই আজ রাতের আকাশে যে লুব্ধককে দেখছিস, তা আসলে সাড়ে আট বছর আগের লুব্ধক। এখন সে আদৌ আছে কি না কে জানে। এ একরকমের অতীতদর্শন হল না?

তা হল বটে। আমরা দুজনেই মাথা নেড়ে সায় দিলাম।

—বিজ্ঞানীরাও এইভাবেই টাইম ট্রাভেল করলেন। অনেক দূরের থেকে আসা তরঙ্গের মধ্যে থেকে খুঁজে পেলেন ব্রহ্মাণ্ডের ইতিহাস।
—কীভাবে? স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্নটা মনে আসে।
—অধিকাংশ আবিষ্কার যেভাবে হয়— অ্যাক্সিডেন্টালি। আমেরিকার নিউ জার্সির ক্রফোর্ড হিলে বিখ্যাত বেল ল্যাবের একটা রেডিও অ্যান্টেনা ছিল। এই অ্যান্টেনার কাজ ছিল স্যাটেলাইটের মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করার। কাজ নেহাত মামুলি হলেও আদতে বেশ জোরদার অত্যাধুনিক অ্যান্টেনা ছিল এটা। ফলে রেডিও অ্যাস্ট্রনমাররা, অর্থাৎ যাঁরা মহাবিশ্বের বিভিন্ন কোণ থেকে আসা রেডিও তরঙ্গ বিশ্লেষণ করে নানাবিধ অনুসন্ধান জানান…
—রেডিও তরঙ্গ মানে?

জানতাম শুভ এই প্রশ্নটা করবে। তাই উত্তরটা আমিই দিলাম— আরে ইশকুলে পড়েছিলিস তো, সব ভুলে মেরে দিয়েছিস? মানে যে সমস্ত তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গের তরঙ্গদৈর্ঘ্য একটু বড়, মানে আমাদের দৃশ্যমান আলোর মধ্যে লাল আলোর সবচেয়ে বেশি হয়, এ হল তার চেয়ে বড়। তাই না, জয়দা?

—ঠিক বলেছিস। জয়দা বেশ তারিফের চোখে তাকাল আমার দিকে। দৃশ্যমান আলোর মধ্যে সবচাইতে লম্বা তরঙ্গদৈর্ঘ্য হল লাল আলোর, অর্থাৎ লাল আলো সবচেয়ে লম্বা লম্বা লাফ দিয়ে উৎস থেকে আমাদের চোখে পৌঁছতে পারে— আর যত লম্বা লাফ দিতে পারবে, তার বাকিদের তুলনায় রাস্তা হারিয়ে এদিক ওদিক চলে যাওয়ার প্রবণতা সবচেয়ে কম— যাকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় ডিসপার্শন বলে। তাই জরুরি কিছুতে নজর টানার জন্য লাল আলো বা লাল রঙের ব্যবহার তো তোরা জানিসই। লাল রঙের থেকে যে সমস্ত আলোকতরঙ্গের তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেশি, তাদের আমরা মনুষ্যচক্ষে দেখতে পাই না। লালের ঠিক ওপরের যে তাকে বলে অবলোহিত বা ইনফ্রা-রেড। তার ওপরের দাদার নাম মাইক্রোওয়েভ, যেটা দিয়ে প্রতিদিন রাতে আমরা আমাদের রবি ঠাকুরের বানানো ঘ্যাঁট গরম করে খাই। আর আলোদের মধ্যে তরঙ্গদৈর্ঘ্যে সবার বড় যে তার নাম হল রেডিও তরঙ্গ। আর এর তরঙ্গদৈর্ঘ্য সবচাইতে বড় হওয়ার কারণে, বিনা রাস্তা ভুলে মহাবিশ্বের এক কোণা থেকে অন্য কোণায় আরামসে পাড়ি দিয়ে ফেলে। আর বড় বড় ডিস্ক অ্যান্টেনার মতো রেডিও টেলিস্কোপের সাহায্যে তাদের ধরে রেডিও অ্যাস্ট্রোনোমাররা গবেষণা করেন। বোঝা গেল?

শুভ এবার ঢক করে ভালো ছেলের মতো মাথা নেড়ে দিল।

জয়দা শুভর মাথা নাড়া দেখে খুশি হয়ে আবার খেই ধরল— যেটা বলছিলাম। বেল ল্যাবের সেই অ্যান্টেনার কথা। এমন শক্তিশালী অ্যান্টেনা হওয়ায় অনেক রেডিও অ্যাস্ট্রোনোমাররাই ওটা ব্যবহার করতে আসত। এমন দুই রেডিও-জ্যোতির্বিজ্ঞানী ছিলেন আর্নো পেনজিয়াস এবং রবার্ট উইলসন। দুজনেই পরবর্তীকালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। যাই হোক, ওঁরা ওখানে যেতেন আমাদের এই আকাশগঙ্গা ছায়াপথ বা মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির থেকে নিঃসৃত রেডিও তরঙ্গের খোঁজে। এই অ্যান্টেনাতে বাকি সব অ্যান্টেনার মতোই আসল ‘সিগন্যালে’র পাশাপাশি ধরা পড়ত বিভিন্ন অযাচিত সব তরঙ্গ— যাকে আমরা ‘নয়েজ’ বলে থাকি। এই সব অনাকাঙ্ক্ষিত তরঙ্গদলের উৎস হয় সাধারণত অ্যান্টেনার মধ্যেকার ইলেক্ট্রিক্যাল সার্কিট অথবা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল। কিন্তু পেনজিয়াস আর উইলসন নানাবিধ পরীক্ষানিরীক্ষা করে দেখলেন যে এই তরঙ্গস্রোত, যা আসলে মাইক্রোওয়েভ তরঙ্গের পর্যায়ে পড়ছে, তারা এই দুই উৎসের কোনওটা থেকেই উদ্ভূত নয়। শুধু তাই নয়, বছরের যে কোনও সময়, আকাশের যে কোনও দিকেই অ্যান্টেনা তাক করা হোক না কেন, এই মাইক্রোওয়েভের তরঙ্গমালা একইভাবে আছড়ে পড়ছে অ্যান্টেনার উপর। কিন্তু এমনটা তো হওয়ার কথা নয়। পেনজিয়াসরা একটু অবাক হলেন বটে, তবে সেরকম আমল দিলেন না। একদিন পেনজিয়াস তাঁর বন্ধু জ্যোতির্বিজ্ঞানী বার্নার্ড বার্কেকে ফোন করে এটা সেটা গল্পগাছার ফাঁকে এমনিই বলেছেন যে বেল ল্যাবের অ্যান্টেনাতে এমন এক ভুতুড়ে নয়েজের কথা। বার্কে সঙ্গে সঙ্গে বলেন, দাঁড়াও হে, সেদিনকেই আমার বন্ধু কেন টার্নার জন হপকিন্সে পিবলস নামে প্রিন্সটনের এক ছোকরার লেকচার শুনে এসে এরকমই কী একটা বলছিল। সে ছোঁড়া নাকি এক রেডিয়েশনের কথা তত্ত্বগতভাবে দেখিয়েছে যা নাকি আমাদের ব্রহ্মাণ্ডের জন্মরহস্য ভেদ করতে সাহায্য করবে। তুমি তারই সন্ধান পাওনি তো? প্রিন্সটনে একবার খোঁজ নিয়ে দেখো তো! ব্যস, যে কথা সেই কাজ। প্রিন্সটনের তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীদের সঙ্গে কথা বলে পেনজিয়াস আর উইলসন বুঝলেন যে হঠাৎ করে তাঁরা কী এক অদ্ভুত জিনিস আবিষ্কার করে ফেলেছেন— যার নাম কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন বা সংক্ষেপে সিএমবিআর।

—সেটা ব্রহ্মাণ্ডের জন্মরহস্য ভেদ করল কীভাবে? আমার আগেই শুভ প্রশ্ন করে বসল।
—ওই যে বললাম, টাইম ট্রাভেল। জয়দা আবার রহস্য করে। এই মাইক্রোওয়েভ রেডিয়েশনের জন্ম হয়েছিল সেই আদি বিস্ফোরণের মাত্র কয়েক সহস্র বছর পর। অতীতের থেকে ধেয়ে আসা এই বিকিরণ তাই এমন সমসত্ত্বভাবে ছড়িয়ে আছে মহাবিশ্ব জুড়ে। শুধু মাঝে মাঝে অল্পবিস্তর ওঠা-নামা। বৈজ্ঞানিকরা অঙ্ক কষে বিগ ব্যাং-এর যা ধারণা দিয়েছিলেন, তার সঙ্গে মিলে যায় এই সমস্ত কিছু। শুরুর সেই ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণের ফলেই যে আজকের মহাবিশ্বের জন্ম, সেই তত্ত্বকেই স্বীকৃতি দিয়ে দিল এই অতীত-দর্শন।
—বিগ-ব্যাং তো হল, কিন্তু তার সঙ্গে এআই-এর কী সম্পর্ক? ধান ভানতে শিবের গীত… শুভ কথাটা শেষ করার আগেই জয়দার চোখপাকানি দেখে চুপ করে গেল।
—কিছুই তো জানিস না। খালি বাকতাল্লা! ব্রহ্মাণ্ডের জন্ম না হলে এআই-এর আই, মানে ইন্টেলিজেন্সটা কোথা থেকে আসে শুনি? না শুনতে হয় শুনিস না। আমি বইটা শেষ করি।

বলেই জয়দা ঢাউস বইটা খুলে আবার সোফাতে গা এলিয়ে দিতে যাচ্ছিল, আমি প্রায় ব্যাঘ্রঝম্পনে ‘হাঁ হাঁ’ করে বাঁচালাম। বললাম, আরে, এই পোলাপানকে অত পাত্তা দাও কেন? তুমি বলো দেখি তারপর।

জয়দা বইটা নামিয়ে শুভর দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে আবার বলতে শুরু করল, হ্যাঁ যা বলছিলাম। বিগ ব্যাং। সেই প্রায় সাড়ে তেরো বিলিয়ন বছর আগে জন্ম হল এই গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের। এই নিয়ে বিখ্যাত কসমোলজিস্ট স্টিফেন ওয়াইনবার্গের খুব সুন্দর একটা বই আছে— দ্য ফার্স্ট থ্রি মিনিটস।

—তিন মিনিট? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি।
—ইয়েস স্যার। তার মধ্যেই তৈরি হয়েছিল এই মহাজগতের বুনিয়াদ। বিগ ব্যাং-এর ঠিক পরেই এই মহাবিশ্ব বলতে ছিল একটা অভাবনীয় রকমের গরম স্যুপ। তার মধ্যে ছিল কেবল কোয়ার্ক আর গ্লুয়ন নামের দুই বুনিয়াদি কণা। এক মাইক্রোসেকেন্ডের জন্য অবশ্য। তারপর তারা গঠন করতে শুরু করল প্রোটন, নিউট্রন ইত্যাদিদের। তিন মিনিটের মধ্যে এই প্রচণ্ড উত্তপ্ত ঘন স্যুপ একটু ঠান্ডা হতেই এই সব কণার দল মিলেমিশে তৈরি করতে শুরু করল বিভিন্ন মৌলের নিউক্লিয়াস। গঠন হল হাইড্রোজেন, হিলিয়াম নিউক্লিয়াসের। তারপর হাজার-হাজার বছর ধরে তৈরি হয়েছে আরও জটিল সব পদার্থ। আরও লক্ষ বছর পর তৈরি হয়েছে ছায়াপথ, জন্ম হয়েছে নক্ষত্রদলের। কিন্তু আমার সবচাইতে অবাক লাগে এটা ভেবে যে, এমন হতে হতে একদিন এই সমস্ত বুনিয়াদি কণা, পরমাণুর দল মিলেমিশে এমন এক যৌগের সৃষ্টি করল যা কিনা নিজেই নিজের মতো দেখতে আর এক জটিল যৌগের জন্ম দিতে পারে। একটা থেকে দুটো, দুটো থেকে চারটে— জন্ম হল প্রাণের।
—কী অদ্ভুত না! আপনা থেকেই মুখ থেকে বের হয়ে গেল।
—সত্যিই, প্রকৃতির এই অদ্ভুত, রহস্যময় খেলা থেকেই বোধহয় জন্ম হয় অধ্যাত্মবাদের। যদিও তুই যদি পদার্থবিদ্যার চোখে দেখিস, সমস্ত কিছুর কারণ আছে। এই ‘প্রাণ’ নামক জটিল যৌগের নির্মাণ হয়েছে কারণ ঠিক ঠিক পরিবেশ পেয়ে তার প্রাথমিক মৌলগুলো এমন এক প্যাটার্নে দানা বেঁধেছে যে তাদের নির্দিষ্ট কিছু রাসায়নিক ধর্ম তৈরি হয়েছে। আর সেই রাসায়নিক ধর্মই তাদের মধ্যে এই কোষ বিভাজন করার ক্ষমতার জন্ম দিয়েছে। তার পর লক্ষ বছরের বিবর্তন জন্ম দিয়েছে আমাদের মতো বুদ্ধিমান প্রাণীর।
—আর এখন সেই বুদ্ধিমান প্রাণী জন্ম দিচ্ছে বুদ্ধিমান যন্ত্রের! শুভ ফুট কাটল আবার।

জয়দা এবার হাসিমুখে বলল, কারেক্ট। অর্থাৎ এই যে ইন্টেলিজেন্স বা বুদ্ধিমত্তা তা আদতে সেই বিগ ব্যাং থেকে জন্ম হওয়া এই মহাবিশ্বের একটা বাই-প্রোডাক্ট। কিন্তু বুদ্ধি থাকলেই তো হবে না। একজন প্রচণ্ড বুদ্ধিমান মানুষকে যদি একটা ঘরে আজীবন বন্ধ করে রাখা যায়, বাইরের কোনও সংস্পর্শে আসতে না দিয়ে, তবে কি তার বুদ্ধি কোনও কাজে লাগবে?

—নাহ।
—বুদ্ধিকে কাজে লাগানোর জন্য চাই ট্রেনিং— আর ট্রেনিং-এর জন্য চাই তথ্য বা ইনফরমেশন। এই তথ্য আর বুদ্ধি মিলেমিশে জন্ম দেবে জ্ঞান বা প্রজ্ঞার। কিন্তু সে গল্প আর একদিন।

জয়দার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের নাকেও ততক্ষণে গরম পরোটা আর আলুরদমের সুবাস এসে পৌঁছেছে। অতএব আলোচনায় ইতি টানতেই হল। ভুখা পেট কা সওয়াল বলে কথা!

 

[আবার আগামী সংখ্যায়]

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5088 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...