‘দিয়েছে পথ, গিয়ে’

প্রগতি বৈরাগী একতারা

 


এ-লেখা যখন লিখছি, এক দলমতচিহ্নবিহীন মানবিক আন্দোলনে তখন ভেসে যাচ্ছে কলকাতা শহর। তার প্রতিরোধের রেশ পৌঁছে যাচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। এবং সেই একই সময়ে পর্নসাইটের সার্চবারে সবচেয়ে বেশিবার টাইপ করা হচ্ছে নিহত, ধর্ষিত ডাক্তার মেয়েটির নাম। যেমন হয়েছিল নির্ভয়া, তেলেঙ্গানার ডাক্তার মেয়েটির সময়ে। বেলঘরিয়ার স্কুলছাত্রী কিশোরীটি প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় তার উপর কাটারি নিয়ে চড়াও হয়েছে প্রত্যাখ্যাত তরুণ

 

না। তাঁরা জানতেন কিছুটা পথ হেঁটে কোনও গন্তব্যেই পৌঁছবেন না। কোথাও নেই কোনও স্থায়ী জলসত্র, শান্তিপাত্র। তবু চোদ্দই আগস্ট, দু-হাজার চব্বিশ রাতে তাঁরা ঘরে থাকতে পারেননি। উজ্জ্বল হলুদ ফুলের মতো মেধাবী এক মেয়ের নৃশংসতম খুন, মৃত্যুর আগে বা পরে ভয়ঙ্করতম অত্যাচার, ধর্ষণ, একমুহূর্তে ছিঁড়ে ফেলেছিল অন্য অন্য নারীদের দৈনন্দিন কোকুন, ভুলিয়ে দিয়েছিল আজীবনের পাঠ, ‘মেয়েজন্ম, শান্ত থাকার জন্য’। চৌকাঠ-অন্দর, বাইরের পৃথিবী সামলে, ল্যাপটপ গুছিয়ে, হাতের হলুদের দাগ শাড়ির কোনায় মুছতে মুছতে গলি, নুক্কড়, রাজপথে এসে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁরা। অফিস-ফেরত তরুণী, যুবতী মা, সঙ্গে একরত্তি, প্রথমবার মিছিলে আসা মধ্যবয়সিনী, ওয়াকিং লাঠি হাতে বৃদ্ধা্‌। মাথায় তাঁদের একতাল আগুন, কদমে কদম, গলায় রাতদখলের চিৎকার… শহর কলকাতা, গ্রাম, মফস্বল এমন মিছিল দেখেনি আগে। মধ্যরাতে, ফাঁকা চৌরাস্তার মাঝখানে, দগদগে পোস্টার হাতে উঠে দাঁড়িয়েছেন ঠায় একা তরুণী। যাঁরা বেরোতে পারেননি, বাতি জ্বালিয়ে রেখেছেন, জেগে থেকেছেন সারারাত। ব্যালকনিতে এসে দাঁড়িয়েছেন অশীতিপর নারী, চলমান মিছিলের দিকে তুলে ধরেছেন টর্চবাতি, আলোর ব্যাটন। কী ভাবছিলেন তাঁরা! রাত্রি চিরে ফেলা পায়ে পায়ে কি ঘষে তুলে ফেলতে চাইছিলেন অপব্যবহার আর অপমানের কালশিটে! শৈশবে ফ্রকের পিঠে ছাপ রেখে যাওয়া নিকটাত্মীয়ের ঘিনঘিনে আঙুল, ঠাসা পাবলিক ট্রান্সপোর্টের নামহীন থাবা ও কনুই, স্বামী বা প্রেমিকের হুকুমবরদারি, মারের দাগ, কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীর চটচটে চোখ, ঊর্ধ্বতনের একবার শোওয়ার সাধ, বদলে পদোন্নতি… হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসা সমঝে দেওয়া এবং দাবিয়ে রাখার দাঁত নখ, ক্রূরতম নীতি।

আধুনিক নারীবাদের জননী সিমোন দ্য বোভোয়ার তাঁর ‘দ্বিতীয় লিঙ্গ’ বইয়ে বলেছেন, ‘কেউ নারী হয়ে জন্ম নেয় না, বরং ক্রমশ নারী হয়ে ওঠে।’ এবং ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের সাম্প্রতিকতম সার্ভে রিপোর্ট-এ লেখা হচ্ছে, সারা পৃথিবীতে অন্তত এক-তৃতীয়াংশ নারী তাঁদের জীবৎকালে যৌন-হিংসার শিকার হন। এ তো কেবল দাখিলকৃত তথ্য। প্রদীপের নিচে নিয়ত জমে উঠছে আরও কত অনথিবদ্ধ অন্ধকার! এই রিপোর্টের একটি অংশে আরও বলা হয়েছে, “Violence can negatively affect women’s physical, mental, sexual, and reproductive health, and may increase the risk of acquiring HIV in some settings.”

অর্থাৎ কিনা মারো, কাটো, ক্রমশ নারী হয়ে ওঠার পথটি পুরুষের জন্য করে তোলো সুগম। ছুরি-কাঁচি, ছেনি-বাটালি দিয়ে প্রয়োজন ও পছন্দমাফিক ছেঁটে ফেলো নারীকে, ভরে ফেলো সমাজনির্ধারিত বাক্সে। সমাজ তো নারীকে যুগে যুগে, কালে কালে পণ্যই ভেবে এসেছে বরাবর। প্রাচীন যুগে নারীকে ‘পণ্য’-হিসেবে বিনিময় করা যেত, উপঢৌকন হিসেবে উপহার দেওয়া যেত এবং দান করাও। গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব এবং জনপদ গড়ে ওঠার কালে যুদ্ধবন্দি নারী হয়ে ওঠে সবচেয়ে লোভনীয় লুঠ, ব্যক্তিগত সম্পত্তি। ‘শতপথ ব্রাহ্মণ’-এ বলা হয়েছে, নারীকে যে-কোনও মূল্যে বশে রাখতে হবে। সে-নিয়ম এখনও চলছে। আর যে-নারীকে বশে রাখা গেল না, ঢোকানো গেল না মাপমাফিক বাক্সে, সে বড় বিপজ্জনক। তাকে বেমালুম নিকেশ করে দেওয়াই রীতি। বিধানও আছে যথাবিহিত। উত্তর-বৈদিক যুগের ‘আগস্ত্য ধর্মসূত্র’-র বিধানে, যে-সমস্ত প্রাণীকে হত্যা করলে একদিনের প্রায়শ্চিত্তই যথেষ্ট, তার তালিকাটি হল— কালো পাখি, শকুন, বেজি, ছুঁচো, কুকুর, শূদ্র ও নারী। এই প্রেক্ষিতে অবশ্য অন্যান্য ধর্মেও নারীর অবস্থা খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয়। বরং করুণ। সেবাব্রতের বাইরে ম্লান হয়ে থেকে যান খ্রিস্ট সন্ন্যাসিনীরা। হিজাব না পরার কারণে খুন হয়ে যান ইরানি তরুণী।

কর্মক্ষেত্রে মেধাবিনী চিকিৎসকের নির্মম হত্যা ও ধর্ষণ, বর্তমানে যে ঘটনার প্রেক্ষিতে মেয়েরা সামাজিক বাউন্ডারি এবং দিনরাত্রির ফারাক ভেঙে রাজপথে নেমে এসেছেন, সেখানে যৌনহিংসার পাশাপাশি উঠে এসেছে পাহাড়প্রমাণ আর্থিক দুর্নীতি এবং লেনদেনের তত্ত্ব, যদিও তা তদন্তসাপেক্ষ। বলা হচ্ছে, অনেককিছু জেনে ফেলা চিকিৎসক এক্ষেত্রে পুরুষ হলেও একই পরিণতি হত, খুন। এবং এই জেনেরালাইজড মন্তব্য থেকেই উঠে আসে দ্বিমত, উঠে আসছে সেই সমঝে দেওয়ার বিধান। নারী যতই পাহাড় ভাঙুক, ছুঁয়ে ফেলুক সাফল্যের চূড়া, পৌঁছে যাক যে বয়সেই, পুরুষতন্ত্রের কাছে শেষ পর্যন্ত সে শুধু দুটি স্তন ও একটি যোনি। তাই মরার আগে সে ভোগ্যবস্তু। ধর্ষিত হয়ে, নির্মম অত্যাচার সয়ে মরাই তাঁর জন্য পুরুষতন্ত্রের নিদান। পুরুষ নয়, পুরুষতন্ত্র। তার ধারক, বাহক, যে কেউ-ই হতে পারেন।

সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয়, নারীকে যৌনবস্তু ভেবে নেওয়ার স্বভাব কেবল প্রতিপক্ষের নয়, প্রিয়পক্ষেরও। তাই ধর্ষণকে আদিকাল থেকেই যুদ্ধজয় বা কোনও গোষ্ঠীর মনোবল ভেঙে দেওয়ার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। তা সে ফ্রান্সের শাসকের জিপসি বিতাড়নের পন্থা হোক, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জাপানিজ বা রুশ সৈন্যবাহিনির প্রতিপক্ষ দেশের নারীদের গনধর্ষণ অথবা ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময়ে, বাংলাদেশে নারীদের প্রতি যুদ্ধাপরাধ। আজও বহু জায়গায় পরিবারের পুরুষ সদস্য কোনও অপরাধ করলে শাস্তি হিসেবে সেই পরিবারের নারীকে গণধর্ষণের বিধান দেওয়া হয়।

নারীর বেঁচে থাকা, সম্ভ্রমের সঙ্গে জুড়ে গেছে শরীর। সেই নোংরা, ভুল ও ভয়ের বীজ ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে বালিকামনে। বুক ঢাকো কয়েক প্রস্থ লেয়ারে। পিঠ কুঁজো করে লুকিয়ে রাখো শরীরের স্বাভাবিক উঁচুভাব। শরীর নিয়ে বিব্রত হও, জবুথবু। তারপরেও কারও চিত্তচাঞ্চল্যের কারণ হলে, ধর্ষণের মতো কোনও ঘটনা ঘটে গেলে, তার দোষ, অপরাধ, সবটুকু মেয়েটির।

এ-লেখা যখন লিখছি, এক দলমতচিহ্নবিহীন মানবিক আন্দোলনে তখন ভেসে যাচ্ছে কলকাতা শহর। তার প্রতিরোধের রেশ পৌঁছে যাচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। এবং সেই একই সময়ে পর্নসাইটের সার্চবারে সবচেয়ে বেশিবার টাইপ করা হচ্ছে নিহত, ধর্ষিত ডাক্তার মেয়েটির নাম। যেমন হয়েছিল নির্ভয়া, তেলেঙ্গানার ডাক্তার মেয়েটির সময়ে। বেলঘরিয়ার স্কুলছাত্রী কিশোরীটি প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় তার উপর কাটারি নিয়ে চড়াও হয়েছে প্রত্যাখ্যাত তরুণ। জেলাশহরে ভিন্ন ভিন্ন ঘটনায় খুন হয়েছেন দুই বা ততোধিক তরুণী। অন্তত একটি ক্ষেত্রে প্রাক্তন প্রেমিক খুন করেছে মেয়েটিকে। ঠোঁটে ঠোঁটে রটে গেছে মেয়েটির কুৎসা। কেন সে কাউকে ভালবাসার মতো অপরাধ করেছিল? এবং সে প্রেম ভেঙে গেলেও কেন চুপচাপ সব মেনে নেয়নি, বেরিয়ে আসার ধক দেখিয়েছে? ভিকটিম ব্লেমিং। ঠিক যেভাবে ছত্রিশ ঘণ্টা টানা ডিউটির পরে ডাক্তার মেয়েটি কর্মক্ষেত্রেরই একটি ঘরে বিশ্রাম নিতে গিয়ে নিহত, ধর্ষিত হলে প্রাথমিক পর্যায়ে বলা হয়েছিল, কেন সে এত রাতে একা একা বিশ্রাম নিতে গিয়েছিল?

পুরুষতন্ত্র, ভিকটিম ব্লেমিং, রাজনীতি, দুর্নীতি, মানা ও মেনে নেওয়ার চাপ এবং সমঝে দেওয়া। নারীরা, মানুষেরা জানেন, কিছুটা পথ হাঁটা এর কোনওটিকেই একেবারে মুছে ফেলতে পারবে না। তবু তাঁরা হাঁটবেন, চিৎকার করবেন, যতদূর আওয়াজ যায়। আর মনে মনে প্রতিদিন মেধাবী, পরিশ্রমী, আলোর মতো মেয়েটির কানের পাশে গুঁজে দেবেন রক্তজবার ফুল, যে মেয়ে, ‘গেছে এ পথ দিয়ে/দিয়েছে পথ, গিয়ে’।


*শিরোনাম ঋণ: শ্রদ্ধেয় শঙ্খ ঘোষ। মতামত ব্যক্তিগত

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4858 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. হ্যাঁ, দিয়েছে পথ গিয়ে। খুব ভালো লেখা, ধন্যবাদ। এই পথ চলা আর যাই হোক, পথ চলার স্মৃতিটুকু রাখবে। বেশি আশা তো করি না, এ শুধু নারীবাদের কথাই নয়, সব আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধেই বলা কথা। পাল্টাবে না হয়তো কিছুই, কিন্তু মুখোশের আড়ালে থাকা মুখগুলি চিহ্নিত হলো, হবে, যারা আধিপত্যের ভালোবাসাধন্য।

আপনার মতামত...