
অনিন্দ্য রায়
চার-চারটে দিন ধরে মাস্কেট্রি রাইফেল কাঁধে পাহাড় ও জঙ্গলের মধ্যে পথ চলতে চলতে শত্রুনিধনের জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিল বছর পনেরোর কিশোর। একদিন সঙ্গীদের কাছে দৃপ্ত কণ্ঠে সে ঘোষণা করেছিল— “এখন আমাদের কাজ অসম সাহসের সঙ্গে দ্বিধাহীন চিত্তে যুদ্ধ করা। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে মরণপণ যুদ্ধে শত্রু-নিধন যজ্ঞ চালিয়ে যাব। শপথ নিচ্ছি মৃত্যু।” মাটিতে আঁচড় কেটে লিখেছিল— ‘DEATH’।

যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ‘লাইং পজিশন’ থেকে বারবার লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে অকুতোভয়ে গুলি চালাচ্ছিল সে। শত্রুপক্ষের লুইসগান থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে আসা গুলিতে লুটিয়ে পড়ার পর পাশেই যুদ্ধরত নিজের বড়দাদাকে ক্ষীণকণ্ঠে শেষ বিদায়টুকু জানাতে পেরেছিল— “সোনাভাই চললাম…।” প্রত্যুত্তরে নিজের ‘পজিশন’ থেকে এতটুকু না নড়ে, অবিচলিত কণ্ঠে দাদা জানিয়েছিলেন— “যুদ্ধক্ষেত্রে সোনাভাই কেউ নেই। আমরা সৈনিক, আমাদের কর্তব্য ‘ডু অ্যান্ড ডাই’! বীরের মতো প্রাণ দাও!” ছোটভাই হরিগোপাল বল, টেগরা নামেই যে সহযোদ্ধাদের কাছে পরিচিত ছিল। বড়দাদা লোকনাথ বল। জালালাবাদ পাহাড়ের যুদ্ধে যিনি ছিলেন ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির সেনাপতি।


১৯২৯ সালে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস যখন চট্টগ্রাম রাজনৈতিক জেলা কনফারেন্সে সভাপতিত্ব করতে এসেছিলেন, তখন সতেরো বছরের স্বাস্থ্যবান, সুপুরুষ এক কিশোর তাঁর নজর কেড়েছিল। দুর্জয় সাহস এবং বিচক্ষণতার জন্য তাঁকে নিয়োগ করা হয়েছিল ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির ব্রিগেডিয়ার পদে। যুদ্ধ চলাকালীন শত্রুপক্ষের গুলিতে বিদ্ধ হয়ে তাঁকে লুটিয়ে পড়তে দেখে নিজেকে আর স্থির রাখতে পারেননি তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু এবং সহযোদ্ধা আরেক কিশোর। ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসা গুলি অগ্রাহ্য করে বন্ধুর দিকে দৌড়ে এসেছিলেন তিনি। বন্ধুর ইউনিফর্মের বোতাম খুলে বুকের ক্ষতস্থানের দিকে কয়েক মুহূর্ত নির্নিমেষ তাকিয়ে থেকে, বাষ্পাচ্ছন্ন চোখে আবার লাগিয়ে দিয়েছিলেন বোতাম। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে ‘অ্যাটেনশন’ পজিশনে সামরিক অভিবাদন জানিয়েছিলেন শহিদ ব্রিগেডিয়ার ত্রিপুরা সেনকে। আবার নিজের পজিশনে ফিরে গিয়ে দ্বিগুণ উদ্যমে চালিয়েছিলেন তাঁর হাতের মাস্কেট্রি। চোখের বদলে চোখ, রক্তের বদলে রক্ত চাই। বন্দেমাতরম। লং লিভ রেভল্যুউশন। গ্রুপ-ক্যাপ্টেন দেবপ্রসাদ গুপ্ত প্রতিজ্ঞা করেছিলেন শত্রুর শেষ দেখে ছাড়বেন। আরেক সহযোদ্ধা, বছর পনেরোর নির্মল লালা গুলিবিদ্ধ হয়ে যখন লুটিয়ে পড়েছিলেন মাটিতে, তখন এই দেবপ্রসাদই ফের দৌড়ে এসেছিলেন নির্মলের কাছে। পরম স্নেহে কোলে তুলে নিয়েছিলেন মৃত্যুপথযাত্রী নির্মলের মাথা, হাত বুলিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর মাথায়, বুকে।
বিধু ভট্টাচার্য এবং নরেশ রায় ছিলেন দুই অভিন্নহৃদয় বন্ধু। দুজনেই ডাক্তারি পাশ করেছিলেন এবং দুজনেই ছিলেন ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির নিবেদিতপ্রাণ সৈনিক। যাঁদের কথা বলার ভঙ্গিমা বা স্রেফ শরীরী ভাষা উল্টোদিকের মানুষটির অট্টহাস্যের কারণ হতে পারে, বিধু ছিলেন সেই বিরল গোত্রের রসবোধের মানুষ। যুদ্ধক্ষেত্রে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর সহাস্যে সেনাপতিকে জানিয়েছিলেন— “লোকাদা, এতক্ষণে গুলি লেগেছে!” একের পর এক গুলি এসে বিঁধেছিল তাঁর দেহে, আর বিধু তাদের সোল্লাসে আহ্বান জানিয়েছিলেন, “আর কত ঢুকবি? ঢুকেছিসই যখন, তখন আর আশেপাশে কেন? বুকে ঢুকছিস না কেন?” শেষপর্যন্ত তাঁর বুকে গুলি লাগলে, প্রিয় বন্ধুকে উদ্দেশ্য করে তাঁর শেষ কথা ছিল— “চললাম নরেশ। তুমিও এসো। তোমায় রিসিভ করব!” বন্ধুর এই আহ্বান নরেশ বেশিক্ষণ উপেক্ষা করতে পারেনি। স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর আরও এক শহীদের রক্তের অক্ষরে যেন লেখা হয়েছিল— “উদয়ের পথে শুনি কার বাণী, ভয় নাই, ওরে ভয় নাই।”

ব্রিটিশদের পক্ষে ছিল ‘সুরমা ভ্যালি লাইট হর্স রেজিমেন্ট’ একটি কোম্পানি এবং ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেলসের একটি কোম্পানি। তার সঙ্গে ছিল ভিকার্স মেশিনগানের একটি এবং লুইসগানের চারটি সেকশন। ব্রিটিশ সামরিক ম্যানুয়াল অনুযায়ী, এক একটি কোম্পানি গঠিত হত ১৫৬ জন সৈনিক নিয়ে। ভিকার্স মেশিনগান থেকে মিনিটে প্রায় সাড়ে তিনশো গুলিবৃষ্টি হচ্ছিল। ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির পঞ্চান্নজন অকুতোভয় কিশোর-যুবকের সম্বল ছিল মাস্কেট্রি রাইফেল, কিছু রিভলভার, পিস্তল এবং তুলনায় সীমিত সংখ্যক কার্তুজ। মাস্কেট্রির পাল্লা ছিল মাত্র ২০০ গজ এবং অন্যতম সমস্যা ছিল ব্যারেল ও চেম্বারে ধোঁয়াবিহীন কালো বারুদ জমে যাওয়া। তাই নিরবচ্ছিন্ন গুলিবর্ষণ করতে ক্রমাগত পরিষ্কার করে চালু রাখতে হচ্ছিল রাইফেলগুলি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই কাজটি করে সহযোদ্ধাদের মনোবল জুগিয়েছিলেন বাহিনীর সর্বাধিনায়ক মাস্টারদা সূর্য সেন। শত্রুপক্ষের মারাত্মক গুলিবর্ষণের মাঝে যখন ‘লাইং পজিশন’ থেকে মাথা তোলা একপ্রকার অসম্ভব, তখন রুক্ষ পাথুরে জমিতে এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে বুকে হেঁটে মাস্কেট্রি পরিবহনে নিজে উদ্যোগ করেছিলেন। বিপ্লবীদের গুলি যখন প্রায় ফুরিয়ে আসছে, তখন ক্রমাগত ‘কন্ট্রোলড ফায়ার’ করতে নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন, যাতে গুলির অপ্রতুলতার ব্যাপারে শত্রুপক্ষ বিন্দুমাত্র আঁচ না করতে পারে।


বিপ্লবীদের পক্ষে এছাড়াও শহীদ হয়েছিলেন পুলিনবিকাশ ঘোষ, শশাঙ্ক দত্ত, মধুসূদন দত্ত, প্রভাস বল, যতীন্দ্র লালা এবং মতি কানুনগো। গুরুতর আহত হয়েছিলেন অর্ধেন্দু দস্তিদার। পুলিশ ও মিলিটারি তাঁকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করলে সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়েছিল।
এছাড়াও গুরুতর আহত হয়েছিলেন অম্বিকা চক্রবর্তী, বিনোদ দত্ত এবং বিনোদ চৌধুরী।


যুদ্ধের আগে চারদিন এই মৃত্যুহীন বিপ্লবীরা জালালাবাদ পাহাড়ে প্রায় অনাহারে বা অর্ধভুক্ত অবস্থায় দিন কাটিয়েছিলেন। অসহ্য তৃষ্ণায় জলের অভাবে কখনও তাঁরা গাছের পাতার রস নিংড়ে পান করেছিলেন, আবার কখনও হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে বন্দুক পরিষ্কার করার মোবিল গলায় ঢেলে দিয়েছিলেন। বিপ্লবের দুর্গম, বন্ধুর পথ তাঁরা সুগম করে নিয়েছিলেন তাঁদের অদম্য সাহস, সুদৃঢ় আত্মপ্রত্যয় এবং দেশের প্রতি নিখাদ ভালোবাসায়। ‘নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান, ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।’ তাঁদের দুর্জয় বৈপ্লবিক প্রেরণার কাছে শেষপর্যন্ত হার মেনে রণে ভঙ্গ দিতে বাধ্য হয়েছিল ক্যাপ্টেন টেট, কর্নেল ডালাস স্মিথ, ডিআইজি ফারমার প্রমুখের নেতৃত্বাধীন ব্রিটিশ বাহিনী।

চলতি বছরের ২২ এপ্রিল, ৯৫তম বর্ষপূর্তি হল ভারতের সশস্ত্র আন্দোলনের ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়ের, যার নাম ‘জালালাবাদ যুদ্ধ’…