
অপর্ণা ঘোষ
আজ এই শতাব্দীতে পুনরায় সেই সব ভাস্বর আগুন
কাজ করে যায় যদি মানুষ ও মনীষী ও বৈহাসিক নিয়ে—
সময়ের ইশারায় অগণন ছায়াসৈনিকেরা
আগুনের দেয়ালকে প্রতিষ্ঠিত করে যদি উনুনের অতলে দাঁড়িয়ে—পরিচায়ক, জীবনানন্দ দাশ
উনুনের অতলে দাঁড়িয়ে ছায়া-সৈনিকের মতো বাপ্পাদিত্য আগুনের দেয়াল গড়ার আর্তনাদে ফেটে পড়ে— “কিন্তু আপনি আমায় একটি পোস্টকার্ডে নির্বাসন দিতে পারেন না, হুজুর! পোস্টকার্ড কোনও দেশ নয়!” আর শুরু হয় এক অনন্ত মায়াকাহন— যাতে জেগে ওঠে, নিভে যায়, গলে পড়ে ছায়াবিদ্ধ মস্তিষ্ক দখল করা মানুষ, মনীষী আর বৈহাসিক।
শুরুর বাক্যটিতে অনেকটা সময় দাঁড়িয়ে থাকি। ছোটবেলায় জমানো পিকচার পোস্টকার্ডগুলোর কথা কেন মনে পড়ে গেল, কে জানে!
পূর্বপ্রজন্মের বাসভূমিও আসলে পোস্টকার্ডেরই দেশ। তার নদী ও নৌকা, তার পুকুর, পুকুরের মাছ, তার গাছ, গাছের ফল, তার আকাশ, আকাশের পাখি— আমার দেশ নয়। তবে কি আমি যেখানে জন্মেছি, তার নদী, তার জল, তার পাখি… না, তাও নয়। দেশ আসলে একফালি কাগজ। তার বাইরে ধোঁয়ার মতো দাঁড়িয়ে থাকে তার ইতিহাস— যা আসলে কুহক, যৌথ অবচেতনার অন্ধকারে জমিয়ে রাখা খুচরো পয়সার মতো মায়া, যা ব্যাপক স্বাধীন।
সেই মুক্ত, স্বাধীন, বহুমাত্রিক, বহুস্তরীয় কুহকের হাত ধরে সুবিপুল পদব্রজে দীর্ঘ স্মৃতিযাত্রায় বাংলার ইতিহাসের এক বিকল্প মায়াবয়ান, সাড়ে ছশো পাতা জুড়ে বুনে চলে সাতগাঁর হাওয়াতাঁতিরা।
যদিও বাপ্পাদিত্য জানে— “এই পোস্টকার্ড যে দেশ থেকে এসেছিল, সেই দেশটাই আর নেই, ইয়োর অনার।”
বাপ্পাদিত্য দেশহীন। নাগরিক রেজিস্টারে নাম তোলার জন্য সে তার মাতৃকুলের নটি প্রজন্মের ইতিহাসের স্মৃতিপথে ঘুরে মরে। যার মূল ধাক্কাটি হল ভালোবাসা— যার কোনও দায় নেই কাগজের, যার পাঠ তৈরি হয় স্তরীভূত সমাজের অজস্র মানুষের দিনযাপনের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার দ্বন্দ্ব ও সংশ্লেষে।
অনেকেরই মনে পড়বে মার্কেজের ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ারস অব সলিচুড-এর কথা— মাকোন্দো কেমন করে লাতিন আমেরিকার রক্তমোক্ষণ হয়ে উঠেছিল।
হুগলি আর মরে যাওয়া সরস্বতী নদীর মাঝে গড়ে ওঠা প্রাচীন বন্দরনগরী সাতগাঁ ক্রমে বাণিজ্য ও উপনিবেশের ইতিহাসের এক দ্বন্দ্বসংকুল সন্ধিক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। কথনে, চলনে, মোচড়ে, স্বপ্নে ও জাগরণে মাকোন্দোর সঙ্গে তার মিল নেই। বাস্তবে, গ্রন্থের শুরুতে বংশলতিকা দেওয়ার আঙ্গিক মিলটুকু ছাড়া সবকিছুই বাংলার ইতিহাস-মাতৃকার নিরন্তর প্রসববেদনা।
সাতগাঁর এই মৎস্যভূমিতে দেশভাগে ছিন্নমূল সিলেটি এক প্রত্নতত্ত্ববিদ যুবার সঙ্গে প্রেম ও বিবাহ এখানকার কনৌজি বৈদিক পরিবারের এক মেয়ের। কথিত, এই পরিবার রামের মূর্তি সঙ্গে নিয়ে এই ত্যাজ্যভূমিতে এসেছিল বহুযুগ আগে; গড়েছিল আদিরামবাটি। বাপ্পাদিত্য এই পূর্ব-পশ্চিম বিবাহের ফসল। সিলেটকে সে দেখেছে তার পিতা ও পিতৃকুলের আত্মীয়জনের একধরনের স্মৃতিমেদুর যাপনজনিত বিহ্বলতার মধ্যে দিয়ে।
…এরপর চিনিকাকা বলতে শুরু করত ওদের ছেড়ে আসা দেশটার কথা, যে দেশটা হিমালয় পাহাড় থেকে নামা নদীনালায় কাটাকুটি সবুজ আর অনন্ত বিলে ছাওয়া, যেখানে উত্তরের দেশ থেকে কমলালেবু রঙের হাঁসেরা উড়ে আসে, আর চেরি-ব্লসম জুতোর কালির রঙের পানকৌড়ির দল সারাদিন মাছ ধরে খায়। রাতে বাড়ির লাগোয়া বাগানে ঘুমোতে আসে ওরা, ওদের বিষ্ঠার চুনে গাছের পাতাগুলো রুপোলি রাংতার মতো হয়ে যায়। তারপরে যখন বর্ষা আসে— চিনিকাকা বলে যেত— ঠিক যেন একটা অনন্ত জলের মশারি বঙ্গোপসাগর থেকে উড়ে এসে পুরো উপত্যকাটা ঢেকে দেয় তিন-তিনটে মাস। তখন চারদিক সবুজ ভেলভেটের মতো, এমনকি বাতাসেও সবজেটে গন্ধ। আর তখনই সবকটা জলাশয় ভরে ওঠে রাশি রাশি মাছে।
‘এত্ত মাছ, বুঝলি বাপ্পা, এত্ত মাছ! তোর মা যদি তখন একবার ওখানকার নদীতে নেমে ডুব দেয়, তোর মায়ের ওই ঘন কোঁকড়ানো চুলের গোছে এত কুচোমাছ জড়িয়ে যাবে যে একটা আস্ত পরিবারের একবেলার ভাত উঠে যাবে!’
…
ওই পুবের দিগরে, যেখানে বাপ্পার বাবা-কাকাদের দেশ, মাটি তখনও ভিজে। বাতাসে তখনও জোলো ভাপ। ওখানে তাই লোকেরা রাশি রাশি কুচো চ্যাপামাছ মেটে হাঁড়িতে ভরে কলাপাতায় মুখ বেঁধে মাটির নীচে পুঁতে দেয়। মাসের পর মাস কাঁঠালগাছের ছায়ায় ঘেরা ঠান্ডা অন্ধকারে সঞ্চিত থাকে সেগুলো। ওদিকে আকাশ ফের নীল হয়, পাখিরা ফিরে আসে বাগানে, আর মাটির ভাঁড়ারে মজে-ওঠা গুপ্তধন শুষে নিতে থাকে এই সবকিছু— পাতার ফাঁক দিয়ে আসা চাঁদের আলো, শিউলিফুলের গন্ধ, শীতপাখির ডাক।…
কিন্তু বাপ্পার চেতনা অধিকার করে আছে খেলনার মতো তিন-কামরার ট্রেনে চেপে, তার মন্থর চাকার ‘কেরেস্তান-গোরস্তান’ শব্দের উপর ভর করে, মায়ের আঁচলে সেঁধিয়ে পৌঁছে যাওয়ার দেশ সাতগাঁ। যেখানে তার জন্ম হয়েছিল আদিরামবাটির সুতিকাগৃহে, ধাইয়ের হাতে; তার জন্ম রেজিস্টার্ড হয়নি।
এ-দেশের নাড়িস্পন্দনে জড়ানো পরিচয় খুঁজতে চেয়ে সে আঁকড়ে ধরেছে মাতৃবংশ ব্যাখ্যান। এই বই খুঁচিয়ে তোলে আদিম মাতৃকাতন্ত্রের স্মৃতি।
…কলকাতা থেকে মাত্র তিপান্ন কিলোমিটার দূরে একটি জনগোষ্ঠী বহু শতাব্দী ধরে এক নদীবেষ্টিত স্থানে বাস করে আসছে। এক অনড়, মন্থর জীবনছন্দ, যেখানে দৈনন্দিন যাপনের জমে ওঠা জঞ্জালের নীচে চাপা পড়ে যেতে থাকে অতীত। সরস্বতী নদীটিও চারশো বছর আগের এক ফিকে স্বপ্ন বই কিছু নয়। মধ্যযুগের খিলান, গম্বুজ ও অন্যান্য পোড়ামাটির স্থাপত্য চিহ্ন উপর্যুপরি বন্যা আর খাতবদলের পলির নীচে হারিয়ে গিয়েছে। চওড়া দেয়াল ও ভিতের উল্লম্ব অংশ কিছু কিছু মাধ্যাকর্ষণ উপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে থেকেছে, যতদিন না নরম মাটি তাদের ভূগর্ভে টেনে নেয়, কিংবা ঝোপে ঝাড়ে ঢেকে যায়। সাতগাঁর আশেপাশে এখনো পুকুর কিংবা নতুন বাড়ি নির্মাণের ভিত খুঁড়তে গিয়ে কষ্টিপাথরের বিগ্রহ থেকে শুরু করে চীনা হরফ আঁকা পোর্সেলিনের টুকরো, আদি বাংলার লিপি খোদাই করা পাথরের ট্যাবলেট, প্রবাল, পুঁতি ও কড়ি উঠে আসে।…
সাতগাঁর মাটির তলায় উপনিবেশ ও উপনিবেশপূর্ব সময় পাশাপাশি ঘুমিয়ে থাকে। লেখকের হাওয়াতাঁতে একসঙ্গে ঝুলে থাকে ওলন্দাজ, দিনেমার, পর্তুগিজ, ফরাসি বণিকদের বাণিজ্যজাহাজের পাল, সুদূর বালখ থেকে আসা দরপ খানের বাংলার গাজি হয়ে ওঠার কাহিনি। গাজির গঙ্গাস্তোত্র বুকের ভিতরে নিয়ে যেন এক অন্য সভ্যতার বিষণ্ণ হাওয়ায় জেগে ওঠে কোঁয়াসভিল, পোর্তোপেক্যনো, ম্যাওবিড়ালের গির্জা আর বর্গিব্যাটারি। প্রত্নতত্ত্ববিদ রথীনের সাতগাঁ দর্শনের ব্যাখ্যান থেকে সারা উপন্যাস জুড়ে সময়ের অসরলরৈখিক গতিপথে সাতগাঁকে জাগতে, ঘুমাতে, গৌরবে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে, আনন্দে উদ্বেল হতে, চকিত সন্ত্রাসে উদ্বিগ্ন চোখ মেলে তাকাতে দেখি। শেষ অবধি, লুণ্ঠিত হৃতসর্বস্ব বাংলার করুণ, উদাসীন উপনিবেশ-পীড়িত প্রতিমার এক প্রতীক হয়ে ওঠে সাতগাঁ। সাতগাঁকে ঘিরে অজস্র মুখ্য ও অনতিমুখ্য চরিত্রের বিস্তার সেই বিষণ্ণতাকে পরিণতি দিয়েছে যেন।
…কয়েক দিন বাত-ক্ষ্যাপা বাতুলেরা আসে। যে বাত ভিনদেশি নাবিক বণিকের চোখে আবুলির আঠা পরিয়েছে, এই মৎস্যভূমিতে বেঁধেছে, সেই একই বাত এদের ঘরছাড়া করে। তারা পাগল হয়ে বেরিয়ে পড়ে মনের মানুষের সন্ধানে। কেউ গলায় সোলেমানি পাথরের মালা ঝোলায়, একতারা হাতে নিয়ে পায়ে ঘুঙুর বেঁধে ঘুরে ঘুরে নেচে গান গায়, পাগলের মতো মাথা ঝাঁকায়। অন্য এক দল মধ্যরাতে বটের গভীর ছায়ায় এসে জড়ো হয় অম্বুবাচি তিথিতে, যখন ধরিত্রী রজস্বলা হয়, গোপন অকথ্য ক্রিয়ায় মেতে ওঠে। দেশে কোম্পানির শাসন শুরু হবার পর, মড়ক মন্বন্তর বাড়তে থাকার পর ধর্মতলার মাহাত্ম্য দূরদূরান্তে ছড়িয়েছে। ভীরু আতুর অন্তেবাসী মানুষ রোগ শোক ও বিবিধ বিপর্যয় থেকে উদ্ধারের বাসনায় ধর্মঠাকুরের থানে হত্যে দিতে আসে। নদীতে ডুব দিয়ে দন্ডি কেটে আসে। গাছের ঝুরিতে পোড়ামাটির ঘোড়া বেঁধে মানত করে, এলাচদানা ও মন্ডা পুজো দেয়।…
সময়ের সুতো আশ্চর্য এক কল্পনোত্তর গ্রন্থিতে বেঁধেছেন লেখক। তাঁর চরিত্রগুলি সরাসরি ইতিহাস থেকে উঠে আসে এমন সব অবয়ব নিয়ে, যার ভিতর থেকে সময়কে খুঁজে নিতে হবে পাঠককে। ক্রমাগত এক টানটান খুঁজে বেড়ানোর খেলায়, একই সঙ্গে খুঁজে নিতে হবে সময়ের ছায়া ও কায়াকে। কোথাও তিনি চরিত্রকে নিয়ে গেছেন অন্য সময়ের পারে, কখনও অন্য সময়ের চারিত্র্য ভরে দিয়েছেন অপর কোনও সময়ের চরিত্রের খোলে। চেনা চেনা স্বরে পাঠককে স্পর্শ করে যায় ব্যাটারিং রাম, অ্যাক্রয়েড ঘোষ, বাঁটুল দি গ্রেট, শার্ল লেবো, ক্যালকাটা শাস্ত্রী, কাঁঠালপাড়ার রাজমোহন চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। তথাকথিত বঙ্গীয় নবজাগরণের উল্টোপিঠের অন্ধকার থেকে উঠে আসতে থাকে বাংলার আবহমান কৃষক, ভিষগ, তাঁতি, কর্মকার, মিঠাইকর, নির্মাণশিল্পীর বিস্মৃত মুখ, ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র থেকে জল-অনাচরীয় অবধি স্তরান্বিত সমাজের প্রতিরোধ ও আত্তীকরণের গাথা, তাতে ফিসফিসিয়ে ধুয়ো দেয় লোককথা, পুরাণ আর প্রজন্মবাহিত যৌথস্মৃতিচর্যার সন্ধ্যাভাষা। পাদরিবাবা আর আলিসাহেবের ছায়া সেই একই মায়ামুকুরে স্থির হয়ে থাকে। যে আয়না গল্প বলে—
…রাজপ্রাসাদের বিলাসব্যসনে হাঁপিয়ে উঠে একদিন সাত ভাই গৃহদেবতা রামের বিগ্রহ নিয়ে সাত ময়ূরপঙ্খীতে ভেসে পড়ল গঙ্গায়। তারপর অনেক কুঞ্ঝটিকাময় অরণ্য, অনেক রৌদ্রচুম্বিত উপত্যকা, বণিক ও তীর্থযাত্রীতে মুখরিত বহু জনপদ পেরিয়ে ভাসতে ভাসতে এসে পড়ল পুবের এই বঙ্গদেশে। এ ছিল ত্যাজ্যভূমি। যযাতি তাঁর তৃতীয় পুত্র দ্রুহুকে এখানে নির্বাসন দেন। আর্যাবর্তের কেউ বঙ্গের মাটিতে পা রাখলে স্বদেশে ফিরে প্রায়শ্চিত্তকর্মের প্রথা ছিল। কিন্তু সাত রাজপুত্র ভেসে এসেছিল পবিত্র গঙ্গাবক্ষে। রাজমহল পাহাড় পেছনে ফেলে ক্রমশ দক্ষিণে ভেসে আসতে আসতে দুপাড়ে মাইল মাইল সবুজ পলিমাতৃক ভূমি আর মিঠে দখিনা বাতাসে তাদের চিত্ত চঞ্চল হল। ময়ূরপঙ্খীর রেশমি পালগুলো ব্যাগপাইপের মতো ফুলে উঠে তাদের হৃদয়ে বেজে উঠল অশ্রুত সঙ্গীত। মখমল তৃণভূমিতে শরত মেঘের মতো সাদা গাভীর দুধ আর জুঁইয়ের পাপড়ির মতো ভাত আস্বাদন করে জিভে সুপ্ত স্বাদকোরকগুলি ফের জেগে উঠল। এক অপরাহ্ণে তারা এসে পড়ল সেখানে, যেখানে গঙ্গা মুক্তবেণী হয়েছে ত্রিধারায়। গঙ্গার দুই শাখা ভাগীরথী ও সরস্বতীর মাঝে পলি জমে জমে সৃষ্টি হয়েছে এক আশ্চর্য মৎস্যাকৃতি ভূখণ্ড— মহীরুহে ছাওয়া, পাখির কলকাকলিতে মুখরিত, পত্রপল্লবের ফাঁক দিয়ে আসা সূর্যের রশ্মিতে ছাপানো চিত্রল হরিণ দলে উষ্ণ সজীব এক বনাঞ্চল।…
লেখক ব্যবহার করেন তাঁর নিজস্ব বাংলাভাষা এবং তার মানানসই আঙ্গিক, যার পরিচয় তাঁর পাঠকমাত্রই জানেন। এখানে সেই ভাষা সময়ের অতীত-ভবিষ্যৎ-বর্তমানের গলি-রাজপথে বক্রগতিতে ধাবমান হতে হতে জৈবছন্দে বারবার পরিবর্তিত অভিব্যক্তিতে জমাট বেঁধেছে, গলে গেছে আর কখনও ধোঁয়ার মতো, কুয়াশার মতো অন্ধকার হয়ে হিম হয়ে গেছে। বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা একে পড়া। জাদুকরী বাংলাভাষা যেমন করে ‘স্যান্টা অ্যানাকে’ ‘সনাতন’ করে তোলে তেমন করেই জলের গভীরে নেমে মেয়েরা বার্তা দেয় দূরের জলের মেয়েদের, নদীমাতৃক এ-সভ্যতায় জলই বার্তাবহ কে না জানে। ফিরিঙ্গি অ্যান্টনির আত্মা নিয়ে ফিরে আসা কাকাতুয়া গর্ভবতী করে মান্দাসীকে, বাংলার উপকূল থেকে চুরি হয়ে পর্তুগিজ দাসজাহাজের খোলে ভর্তি পোকার মতো অগুনতি মানুষের আর্তনাদ যার উরুতে ত্রিভুজচিহ্ন হয়ে জন্মেছিল।
আদিরামবাটিতে স্বপ্নে জানান দিয়ে বারবার জাতকেরা ফিরে আসে। রসগোল্লার জন্ম হয় বাংলার মাটিতে আশ্রয় নেওয়া এক উড়িষ্যাজাতক মিঠাইকরের হাতে। বণিকের প্রয়োজনে নদী মরে যায়, বন্দর জেগে ওঠে কোথাও অন্যত্র। মরে আসে পুরনো প্রজ্ঞার আলো। ইতিহাস এখানে তুলে আনে বহুস্বরের ফিসফিসানি। ইতিহাসের তলা থেকে, উপরে থেকে, মাঝ থেকে তারা কথা বলতে থাকে, বলতেই থাকে… ভূমি, দেশ, সভ্যতা, রাষ্ট্র— ঘিরে ঘিরে…
…এতদিন খোলা আকাশের নীচে থেকে শহরে ঋতুর সূক্ষ্ম পরিবর্তনগুলো টের পেতে শুরু করবে। বদলে যেতে থাকা দিনের আলোর রং, হাওয়ার মেজাজ, ভোরের হিম, চামড়ার ওপর জল পড়ে স্মৃতিউদ্রেককারী অনুভূতিগুলো। মাঝরাতে মেহগনির নীচে সিমেন্টের বেঞ্চি থেকে হিঁচড়ে ভ্যানে তুলবে পুলিশ। আবছায়ার ভেতরে দেখবে ভিখিরি, ভবঘুরে, পাগল, হিজড়ে, পাতাখোর, বেশ্যা ও রূপান্তরকামীর দল। কোনোরকম পূর্বপরিকল্পনা ছাড়াই এলোমেলোভাবে তুলেছে। কিংবা পরিকল্পনা অনুযায়ীই তুলেছে। ভ্যানের ভেতর কথাবার্তা থেকে জানতে পারবে স্মার্ট সিটি সৌন্দর্যায়নের ড্রাইভ চলেছে, মানবজঞ্জাল ঝেঁটিয়ে তোলা হচ্ছে। চারদিকে দেয়াল উঠছে, কুৎসিত যা কিছু ঢেকে দেওয়া হচ্ছে। মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাবে একটাই প্রশ্ন: ভেগ্রান্সি অ্যাক্টে ছন্নছাড়া ভবঘুরে হিসেবে যদি কাউকে চিহ্নিত করা হয়, তাহলেও কি তাকে বেআইনি অভিবাসী বলা যায়? যদি কোনো হোমে পাঠানো হয়, যদি ফ্রিডম সেন্টারে যেতে না হয়, তাহলে কি ধরে নেওয়া যায় রাষ্ট্র কোনো একভাবে গ্রহণ করেছে? তা সে জঞ্জাল রূপেই হোক। তাহলেও কি কাগজ দেখতে চায়? তাহলেও কি ফাটকে ভরার আগে জ্যাকেটের পকেট উপুড় করে সিজার লিস্ট বানানোর সময় বলে— ‘শো, ডোন্ট টেল?’
এ বইয়ের ঘোর কাটিয়ে ওঠা যাবে না কখনও। বাংলাভাষার ধ্রুবপদে ‘সাতগাঁর হাওয়াতাঁতিরা’ জীবনগান বেঁধে নিয়েছে। শিরোনামবিহীন অধ্যায়গুলো অবিরাম চৈতন্যপ্রবাহে ছোট-বড় বিস্ফোরণ ঘটাতে ঘটাতে চলে, কখনও বিরতি নিতে দেয় না। প্রাচীন ক্ষয়াটে এক জনপদ অভিজ্ঞান হারানো উন্মাদিনীর মতো পথরোধ করে, ডাকে একটি অনন্ত পাঠক্রিয়ার দিকে। বইটিকে নিয়ে, বইটিকে অতিক্রম করে, আরও আরও কাহিনির দিকে।
আমার শুধু মনে হল, কাহিনির শেষদিকে এসে যেন গতি অনেক দ্রুত হয়ে গেল। ভালোবাসা শব্দটির কাছে পৌঁছতে বাপ্পাদিত্য আর একটু সময় কি নিতে পারত না?
অনবদ্য প্রচ্ছদটির সঙ্গে সঙ্গে বইটির মুদ্রণপ্রমাদমুক্ত হওয়া প্রয়োজন ছিল।