কামরূপের পূর্ণিমা ও এক বিলীয়মান বিহঙ্গ-কথা

সোমনাথ মুখোপাধ্যায়

 

বলতে পারেন কলকাতা কর্পোরেশনের প্রাতিষ্ঠানিক এম্ব্লেমে একদা কোন পাখির ছবি থাকত? মনে পড়ছে না তো? রসুন। খটকা কাটাতে এই প্রসঙ্গে দু-একটা কথা শুরুতেই বলি, ধরতাই হিসেবে।

অরনিথোলজির পরিভাষায় পাখিটিকে ডাকা হয় Leptoptilos dubius। বেশ বড়সড়, হাট্টাকাট্টা চেহারার এই পাখিটি একান্তভাবেই একটি স্ক্যাভেঞ্জার বার্ড বা ঝাড়ুদার পাখি। অর্থাৎ, এরা চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে পড়ে থাকা দ্রুত পচনশীল মৃত প্রাণীর দেহাবশেষ খেয়ে ফেলে পরিবেশকে সাফসুতরো, পরিশুদ্ধ করে।

পাখিটির এমন বিশেষ গুণের কারণেই ১৮৯৬ সালে কলকাতা কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে পাখিটিকে সংস্থার প্রাতিষ্ঠানিক এম্ব্লেম বা প্রতীক হিসেবে মান্যতা দেওয়া হয়। ১৯৬১ সাল পর্যন্ত সগৌরবে এই গুরুভার বইতে হয়েছে এই বিকট দর্শন, এক অর্থে কদাকার, এমন ঝাড়ুদার পাখিটিকে।

অবশ্য, পরবর্তীতে এই পাখিটি ক্রমশই বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার কারণে সম্ভবত পৌরপ্রতিষ্ঠানের গৌরবময় অভিজ্ঞানের মর্যাদা হারায়। পৌরপ্রতিষ্ঠান বাধ্য হয়েই বদলে ফেলে এই ঐতিহ্যবাহী বিহঙ্গ স্মারকটিকে।

একটা বিষয় নিশ্চিত করেই বলা যায়, একসময় কলকাতা অঞ্চলে বেশ বড় সংখ্যায় এই উপকারী পাখিটির দেখা মিলত। তখন অবশ্য কলকাতা আজকের মতো এক বিশিষ্ট মহানগরীতে পরিণত হয়নি। নগর পৌরপ্রশাসনের অধীনে আসার আগে মারাঠা খাত দিয়ে ঘেরা সেকালের কলকাতা ছিল নেহাতই একটি ছোট্ট শহর। শহরের কেন্দ্রস্থল জুড়ে তখন সাদা চামড়ার ইংরেজদের দাপাদাপি। নেটিভরা তখন শহরের প্রান্তিক খোলা এলাকার বাসিন্দা। নাগরিক সংখ্যা খুব বেশি না হলেও, ময়লা-আবর্জনার পরিমাণ বাড়ছিল বেশ দ্রুত গতিতে।

এসব ময়লা-আবর্জনার ঠাঁই হবে কোথায়? এজন্যই মূল শহরের বাইরে স্থাপন করা হল ধাপার মাঠ বা ভাগাড়। মৃত পশু-সহ অন্যান্য আবর্জনা নিয়ে ফেলা হতে লাগল সেই প্রান্তিক ধাপা অঞ্চলে। প্রয়োজন দেখা দিল সুষ্ঠু নাগরিক পরিষেবা সঞ্চালনের। এই তাগিদ সূত্রেই পৌরসভার স্থাপনা।

প্রকৃতির নিয়ম মেনেই এই সব ভাগাড়ের আশপাশে ভিড় জমাতে শুরু করল ঝাড়ুদার পাখির দল। শহরের আকাশপটে তখন এই বিশাল চেহারার পক্ষিকুলের ওড়াউড়ি। সদ্য প্রতিষ্ঠিত পৌরকর্তৃপক্ষ আর বিলম্ব না করে এই পরিবেশবান্ধব পাখিটিকেই বেছে নিলেন কলকাতা কর্পোরেশনের প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক অভিজ্ঞান বা এম্ব্লেম হিসেবে। এই পাখিটির চলতি নাম হল জায়ান্ট অ্যাডজুট্যান্ট স্টর্ক, বাংলায় একে ডাকা হয় হাড়গিলা নামে।

 

এমন বিদঘুটে নাম কেন? আসলে ভাগাড়ে কোনও মৃত পশুর দেহ এসে পড়লেই তার প্রথম ভাগীদার হয় শকুনেরা। কলকাতার আশপাশে তখন এমন প্রাকৃতিক স্ক্যাভেঞ্জারদের কোনও অভাব ছিল না, যারা মৃত পশুদের ভক্ষণ করে পরিবেশ সাফসুতরো রাখে। তাই শকুনরাই ছিল আহার্যের প্রথম, একরকম ন্যায়সিদ্ধ অংশীদার। তাদের খাওয়াদাওয়া শেষ হলেই হাড়গিলারা গুটিগুটি পায়ে এসে হাজির হত সেই খাবারের টেবিলে। তারপর শক্তিশালী ঠোঁট দিয়ে মটমটিয়ে ভেঙে সেই হাড়গোড় গিলে ফেলত এই পাখির দল। হাড় ভেঙে গিলে খাওয়ার এই বিশেষ দক্ষতার জন্যই স্টর্ক প্রজাতির এই পাখিদের নাম হয়েছে Bone Swallowers, বাংলায় যাদের ডাকা হয় হাড়গিলা।

আমাদের পরিবেশের পক্ষে অত্যন্ত উপকারী এই পাখিটি আজ ক্রমশই বিলুপ্তির পথে। অথচ এক সময় দক্ষিণ এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এই ঝাড়ুদার পাখিটির দেখা মিলত। কিন্তু বর্তমানে হাড়গিলারা রীতিমতো কোণঠাসা। আজকের দিনে ভারতের মাত্র দুটি অঞ্চলে এদের টিকে থাকার খবর আছে— এক, উত্তর-পূর্বের আসামে; দুই, বিহারের ভাগলপুরে অবস্থিত হাড়গিলা সংরক্ষণ কেন্দ্রে।

গলার সামনে ঝুলন্ত থলির মতো মাংসল অংশের জন্য সহজেই চেনা যায় এই পাখিটিকে। আর এই টিকে থাকাটাই এখন ভীষণ জরুরি— পরিবেশের জন্য, আমাদের সবার জন্য।

এই গুরুত্বের কথা হয়তো অধিকাংশ মানুষ বোঝেন না, কিন্তু একজন সংবেদনশীল সহনাগরিক হিসেবে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন আসাম রাজ্যের এক লড়াকু নারী— শ্রীমতী পূর্ণিমা দেবী বর্মন।

জীববিদ্যার পিএইচডি পূর্ণিমা ছোটবেলা থেকেই যে পাখিটিকে দেখে বড় হয়েছেন, তা এই হাড়গিলা। তাঁর চেনা সেই পাখিটির সংখ্যা আচমকা কমে যেতে দেখে খানিকটা অবাকই হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বিজ্ঞানের ছাত্রী হিসেবে চোখ বুজে বসে না থেকে, এই কমে যাওয়ার কারণ খুঁজে বের করার এবং তার প্রতিকার করার সিদ্ধান্ত নেন।

পূর্ণিমা বুঝে গিয়েছিলেন, সমস্যার শিকড়টা অনেক গভীরে। আর সেটা কাটিয়ে ওঠার উপায় একটাই— গণসচেতনতা। বিশেষ করে, তৃণমূল স্তরের মানুষের মধ্যে সচেতনতা ছড়ানো। কারণ, সাধারণ মানুষ যদি সজাগ হন, তাহলেই হাড়গিলাদের সুরক্ষিত রাখা সম্ভব হবে।

আজ যেভাবে দৃঢ়তার সঙ্গে হাড়গিলাদের সম্পর্কে কথা বলতে পারেন পূর্ণিমা দেবী বর্মন, শুরুটা কিন্তু মোটেও এত সহজ ছিল না।

 

২০০৭ সালের এক ঘটনার কথা এখনও স্পষ্ট মনে আছে তাঁর।

সেই সময় দুনিয়াজুড়ে এই পাখির সংখ্যা নেমে এসেছে মাত্র ৪৫০-তে। খবরটা শোনার পর থেকেই যেন নতুন উদ্যমে ময়দানে নেমে পড়েন তিনি। কিন্তু খুব দ্রুতই বুঝতে পারেন, সাধারণ মানুষের মনে একটা নতুন ভাবনার বীজ বুনে দেওয়া এতটাও সহজ নয়।

তবু হাল ছেড়ে ময়দান ফাঁকা করে দেওয়ার পাত্রী তিনি নন— আসামের মাটির সন্তান পূর্ণিমা। তখন সবে সংগঠনের কাজ একটু একটু করে শুরু হয়েছে। এমন সময় খবর আসে, হাড়গিলাদের একটি পরিচিত বসতি এলাকায় একটি গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে।

সব্বোনাশ!

ওই গাছেই তো বাসা বেঁধেছে এক হাড়গিলা পরিবার। আর সেই বাসায় আছে সদ্যোজাত শাবকদের ছোট্ট ভিড়!

চিন্তায় পড়ে অকুস্থলে পৌঁছন তিনি। গিয়ে দেখেন, যা আশঙ্কা করেছিলেন তাই হয়েছে— কুঠারের আঘাতে গাছের উপর থেকে বাসা ভেঙে পড়েছে মাটিতে। শাবক-সহ বাকিরা আতঙ্কিত, দিশেহারা। আর যিনি এই কাজটি করছেন, তাঁর সাফ কথা— “এই পাখি রোগ ছড়ায়, এরা শয়তানের অভিশাপ। তাড়াতে হবে।”

পূর্ণিমা বুঝে যান, মানুষটিকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। এ এক গভীর সংস্কার—চিরন্তন অজ্ঞতার ছায়া। এই অন্ধকারকে সরিয়ে ফেলতে হলে তাঁকেই এগিয়ে আসতে হবে। আনতে হবে নতুন চেতনার আলো।

লোহা একবার বেঁকে গেলে যেমন সহজে সোজা করা যায় না, ঠিক তেমনই অবস্থা হয় যখন মানুষ অপবিশ্বাস আর অপসংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়।

যাই হোক, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সেদিন মানুষটিকে থামানো গেলেও, এরকম ঘটনার পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা পুরোপুরি মুছে ফেলা যায়নি। এর সঙ্গে যোগ হয় আরেক জটিলতা— একজন শিক্ষিত ঘরের মেয়ে সারাদিন কদাকার চেহারার কিছু পাখির পেছনে পেছনে এ-ভাগাড়, সে-ভাগাড় ঘুরে বেড়াচ্ছে— এই দৃশ্যটা এলাকার মানুষজন একেবারেই ভালো চোখে নেয়নি।

তার উপর হাড়গিলা নামটার মধ্যেই যেন একটা অলুক্ষণে ভাব লেগে আছে— এই পাখি নিয়ে এত আদিখ্যেতা কীসের? প্রেমট্রেমই বা কেন?

 

আসলে বিপন্ন মা-পাখিদের অসহায় চাহনি, শাবকদের রক্ষা করার করুণ আর্তি— এই দৃশ্য যেন ঝড় তোলে দুই যমজ কন্যার মা পূর্ণিমার মনে। নিজের সন্তানদের চোখে-মুখে যে আকুলতা দেখেন, হাড়গিলা শাবকদের দৃষ্টিতে তিনি ঠিক সেই একই অসহায়তা খুঁজে পান। একটুও ফারাক মনে হয় না।

সেদিনই পূর্ণিমা নিজের ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা স্থির করে ফেলেন। প্রকৃতির এই নীরব আহ্বান উপেক্ষা করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। তাঁর কাছে পরিবেশবান্ধব এই পাখিটির হারিয়ে যাওয়ার মানে, মানুষেরই অস্তিত্ব সংকটে পড়া। আর তাই আর দেরি না করে, তিনি একেবারে হোলটাইমার হিসেবে নেমে পড়েন মাঠে— সব দ্বিধা, সংকোচ আর প্রতিকূলতাকে একপাশে সরিয়ে রেখে।

বিশ্বজুড়ে ক্রমশ কমে আসা হাড়গিলা পাখির সংখ্যা একজন জীববিদ্যার ছাত্রী পূর্ণিমা দেবী বর্মনকে গভীরভাবে বিচলিত করেছিল। এই বিপন্ন প্রজাতিকে রক্ষা করার দায় যেন ব্যক্তিগতভাবে এসে ঠেকেছিল তাঁর কাঁধে। তাই শুধু গবেষণার গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ না থেকে, তাঁদের সংরক্ষণের পথ খুঁজতে তিনি নিজের কর্মকাণ্ডকে আরও প্রসারিত করার উদ্যোগ নিলেন।

এই কাজে তাঁর সবচেয়ে ইতিবাচক ও সাড়াজাগানো পদক্ষেপ হল হাড়গিলা পাখিদের রক্ষা করার জন্য এক প্রমীলা স্বেচ্ছাসেবিকা বাহিনী— “হাড়গিলা আর্মি” গড়ে তোলা। যাঁদের একমাত্র কাজ‌ই হবে গ্রামীণ তৃণমূল স্তরের সাধারণ মানুষদের মধ্যে হাড়গিলা পাখিদের সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে নিরন্তর প্রচার চালানো।

 

এই কাজে মহিলাদের যুক্ত করার বিষয়টি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ এর ফলে গ্রামসমাজের তথাকথিত রক্ষণশীল মানসিকতায় বদল আনা সম্ভব হয়েছে। কামরূপ জেলার যেসব এলাকায় হাড়গিলাদের বসতি রয়েছে, সেসব এলাকায় ঘুরে ঘুরে মহিলাদের এই সেনাদলে সামিল করার কাজ শুরু করলেন পূর্ণিমা। গ্রামীণ মহিলারা যেন এই সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিলেন। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত এইসব নারীদের কথা শোনার অবকাশ এতদিন কারও ছিল না। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের এ এক দীর্ঘদিনের বিষম জ্বালা।

তবে নিজেদের জন্য নয়, বরং প্রকৃতি ও পরিবেশের জন্য তাঁদের এই দাবি, তাঁদের এই অংশগ্রহণ অচিরেই জীবনের নতুন এক আস্বাদ এনে দিল। একটু একটু করে বাড়তে থাকে হাড়গিলা আর্মির সদস্যসংখ্যা। আজ প্রায় ১০,০০০ মহিলা এই সেনাদলের সদস্যা এবং প্রায় ৪০০ জন অসমিয়া স্বেচ্ছাসেবক এই কাজে সক্রিয়ভাবে যুক্ত।

পূর্ণিমার সংগঠন শুধু হাড়গিলা পাখিদের সংরক্ষণের কথা বলে না, আহত পাখিদের শুশ্রূষা ও চিকিৎসার কাজ‌ও করে থাকে। বরদইছিলা বা কালবৈশাখীর দাপটে গাছপালা ভেঙে গেলে দুর্ঘটনায় বহু শাবক বিপন্ন হয়ে পড়ে। তখন স্বেচ্ছাসেবীদের কাজ বেড়ে যায় অনেকটাই। পূর্ণিমা নিজে এইসব কাজে নেত্রী হিসেবে ময়দানে নেমে পড়েন, অন্য সব কাজ পিছনে ফেলে।

২০১৯ সাল থেকে কৃত্রিমভাবে ডিম ফুটিয়ে ছানা জন্ম দেওয়ার ব্যবস্থাও চালু হয়েছে। হাড়গিলা আর্মির এই সাংগঠনিক সাফল্যের পেছনে রয়েছে এক সচেতন, সংবেদনশীল প্রকৃতিকন্যার হার না-মানা, অবিচল লড়াইয়ের ইতিহাস এবং এক বিপুলসংখ্যক সাধারণ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষের যৌথ ক্ষমতায়নের এক চমকপ্রদ ইতিবৃত্ত।

পাখিদের সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া শুরু হতেই তরতরিয়ে বাড়তে থাকে হাড়গিলা পাখিদের বসতি। ২০০৭ সালে যেখানে মাত্র ২৮টি বাসা ছিল, ২০১৯ সালে সেই সংখ্যাই বেড়ে দাঁড়ায় ২০০টিতে। ২০২৪-এ বাসার সংখ্যায় আরও শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে। এই মুহূর্তে ২২৫টি নিরাপদ বাসা নিয়ে কামরূপের এই স্টর্ক কলোনি এখন পৃথিবীর বৃহত্তম হাড়গিলা পাখিদের আবাস।

পূর্ণিমা— আজ এক তৃপ্ত মানুষের নাম।

পূর্ণিমা ও তাঁর হাড়গিলা আর্মির সদস্যদের নিরলস কর্মপ্রয়াসের ফলে এক সময়ের উপেক্ষিত, আক্রান্ত, কদাকার চেহারার এই পাখিরা আজ আসামের কামরূপ জেলার আপামর মানুষের কাছে শুধু গ্রহণযোগ্য নয়, পরম আদরণীয় হয়ে উঠেছে। কামরূপের লোকজীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে এই পরিবেশবান্ধব পাখিটি। একসময় যাদের নিয়ে বিস্তর কুসংস্কার আর জল্পনার ঝড় উঠত, আজ তারাই সাদরে ঠাঁই পেয়েছে বিবাহ বা নবাগতদের আগমনের মতো মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে। মানুষের মনোভঙ্গির এই আশ্চর্য রূপান্তর সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র পূর্ণিমা দেবী ও তাঁর সহযোগী হাড়গিলা আর্মির সদস্যদের অক্লান্ত প্রচেষ্টার জন্যেই।

পূর্ণিমার দূরদর্শী কর্মপ্রয়াসের ফলে হাড়গিলা পাখিদের ঘিরে কামরূপের মানুষের, বিশেষ করে ওই অঞ্চলের মহিলাদের, আর্থসামাজিক অবস্থার যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। প্রতিবছর ২ ফেব্রুয়ারি দিনটি হাড়গিলা উৎসব হিসেবে পালন করা হয়। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে ওই অঞ্চলে বিপুলসংখ্যক মানুষের সমাগম ঘটে। হাড়গিলা পাখিদের সংরক্ষণের তাৎপর্য তুলে ধরার পাশাপাশি চলে গান, নাটক, লোকনৃত্যের আসর। সেই সঙ্গে হাড়গিলা আর্মির মহিলাদের তৈরি নানা ধরনের স্মারকপণ্যের বিক্রিবাটাও চলে সমানতালে— পাখি দেখার অভিজ্ঞতার সঙ্গে জুড়ে যায় স্মৃতিবিজড়িত পণ্যের ক্রয়বিক্রয়। সংসারে আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য এলে মানুষ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ভোগ্যপণ্য— সব কিছুতেই বেশি ব্যয় করতে পারে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই উন্নতি ঘটে জীবনের মানে। হাড়গিলা পাখিদের কল্যাণে ঠিক এমনটাই ঘটেছে এই অঞ্চলে।

 

পূর্ণিমা এক নতুন পথে হেঁটেছেন। আর তাই তাঁর এই কর্মপ্রয়াসের স্বীকৃতি মিলেছে ঘরে ও বাইরে— দু-জায়গা থেকেই। ২০১৭ সালে তিনি ভারতীয় মহিলাদের জন্য নির্ধারিত সর্বোচ্চ জাতীয় সম্মান ‘নারী শক্তি পুরস্কার’ লাভ করেন। সেই বছরই তিনি পান ‘গ্রিন অস্কার’ নামে পরিচিত Whitley Award। ২০২২ সালে পান UNEP প্রদত্ত, সেরা উদ্যোগের জন্য নির্ধারিত বিভাগে Champions of the Earth পুরস্কার। আর এ-বছর, ২০২৫-এ, বিখ্যাত Time Magazine-এর পক্ষ থেকে মনোনীত হয়েছেন বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী মহিলা হিসেবে। এই স্বীকৃতি শুধু পূর্ণিমার একার পুরস্কার নয়— ভারতের মাঠ-প্রান্তরে নীরবে স্বপ্নের বীজ বপন করে চলা অসংখ্য মহিলাই এই গৌরবের সমান অংশীদার।

পূর্ণিমা জানেন, কাজ কখনওই শেষ হয়ে যায় না— বরং কেজো মানুষের কাজের পরিধি ক্রমশই বেড়ে চলে। নিজের ঘরের চৌহদ্দিতে জন্ম নেওয়া স্বপ্ন আজ অনেক অনেক মানুষের স্বপ্ন হয়ে উঠেছে। একদল বিহঙ্গ খুঁজে পেয়েছে নতুন জীবন। তারাই ডানায় ভর করে পূর্ণিমার কৃতিত্বের কাহিনি পৌঁছে দেবে দূর-দূরান্তে। তারাই বয়ে আনবে নতুন পৃথিবীর শুভেচ্ছাবার্তা।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5044 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

4 Comments

  1. অনুপুঙ্খ বিবরণী। পূর্ণিমার কথা সত্যিই সেভাবে জানা ছিলনা। আর হাড়গিলা পাখির সঙ্গে এই প্রথম পরিচয়। সবটাই সম্ভব হলো এই লেখাটির সূত্রে। শকুনেরা হারিয়ে গেছে আমাদের চেনা পরিসর থেকে। এবার কি তবে হাড়গিলাদের পালা?

  2. স্নেহময়ী পূর্ণিমার আছেন বলেই পৃথিবী এখনও বাসযোগ্য আছে।প্রণাম জানাই।

    লেখককে অনেক ধন্যবাদ।খবরগুলো তিনি জনসমক্ষে নিয়ে আসেন।

  3. যে মেয়ে টাইম ম্যাগাজিন দ্বারা দুনিয়ার অন্যতম প্রভাবশালী বলে বিবেচিত হন তিনি যে খুব সাধারণ নন তা আন্দাজ করেছিলাম, এবার এই লেখার সূত্রে সবটা জানতে পারলাম। পাশাপাশি আরও গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন লেখক। ধন্যবাদ জানাই লেখককে।

  4. পূর্ণিমা সত্যিই অনন্যা। তাঁর সহযোদ্ধারাও প্রশংসার যোগ্য। একটা পাখি আমাদের মধ্য থেকে হারিয়ে যাচ্ছে তার জন্য আমাদের খুব উদ্বেগ নেই। আমরা এই বিষয়ে মোটেও ভাবিনা। এদের অস্তিত্ত্বের সঙ্গে আমাদের ভালো থাকা নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে। এই সমীকরণ নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে সকলকেই।

আপনার মতামত...