পঞ্চায়েত নির্বাচনে যেমনটা ঘটে থাকে…

রাজদীপ্ত রায়

 


বোমা পিস্তল আর মাস্কেটের বধ্যভূমিতে দাঁড়িয়ে ইদানিং কালের বাংলার সম্ভবত একটিমাত্র ব্যতিক্রমী 'মানবিক' পুলিশকর্মীর চোখ থেকে জল পড়ে যায়। হয়তো অজান্তেই। ভোটার কাঁদে। ভোটকর্মী কাঁদে। পুলিশ কাঁদে। ভোটের লাইনে বিস্ফোরণে ছেলে হারানো মা কাঁদেন দিনহাটায়। কুচবিহারে। শেষ পেরেক কফিনে পুঁতে গণতন্ত্র পরিণত হয় অসফল গণতন্ত্রে। ফেইলড ডেমোক্রেসি। আবার। বারবার।

 

নির্বাচনের দিন অর্থাৎ ২০২৩, জুন মাসের আট তারিখ। পঞ্চায়েত নির্বাচনের বিশাল ভোটদান পর্ব মহাসমারোহে সম্পন্ন হল এই রাজ্যে। বলা ভাল, অবাধ নির্বাচনের নামে গ্রামবাংলার কোণায় কোণায় ভোটের নামে বিপুল বিচিত্র এক প্রহসন সম্পন্ন হল পশ্চিমবঙ্গে।

নির্বাচনের দিন সারাদিন ঘটে যাওয়া সমস্ত প্রক্রিয়াটা কিছুটা অনুসরণ করলে একনজরে যা বোঝা যায়– এক, ভোটের হার মোটের ওপর চুয়ান্ন শতাংশের কাছাকাছি; কোথাও কিছু কম, কোথাও কিছু বেশি। দুই, দিনের শেষে ভোটের উঠোনে লাশের সংখ্যা, শুধু ভোটের দিনের হিসেবেই, সতের। কয়েকটি গণমাধ্যমের মতে, আঠেরো। তিন, লাশ তৈরি করার ইচ্ছে বা পদ্ধতিতে বৈচিত্র‍্য পুরোমাত্রায় বজায় রেখেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। কোথাও গুলি করে খুন তো কোথাও কুপিয়ে; আবার কোথাও স্রেফ পিটিয়ে। প্রায় আখলাককে মারার কায়দায়। সম্পূর্ণ দলীয় ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে মহান ও গণতান্ত্রিক পঞ্চায়েত অথবা রাজ্য অথবা দেশ গড়ার লক্ষ্যে রাজনৈতিক ক্ষমতা দিয়ে গড়ে তোলা নিপুন প্রক্রিয়ায় মব-লিঞ্চ চলেছে। চার, বোমাশিল্পের সার্বিক বাড়বাড়ন্তে আমাদের রাজ্য যে রীতিমতো টইটম্বুর, আজ সারাদিনে টিভির পর্দায় তার দেদার হাতেগরম ধোঁয়া-ওঠা ছবি ও শব্দে পঞ্চায়েতের বাংলা ছিল দারুণ সরগরম। যা দেখা গেল, রকমারি বোমার পশরায় বেশি নাম কিনল সুতলিবোমা, সকেটবোমা, পাইপবোমা, কৌটোবোমা। বোমা চার্জ করার লক্ষ্য হিসেবে মহান গণতান্ত্রিক দলীয় কর্মীদের বেশি পছন্দ ছিল মূলত ভোট-বুথের চারপাশের এলাকাগুলি। তবে নানা সময়ে ভোট দিতে আসা জনতার লাইন, ভোটকর্মী, গণতন্ত্রের তীর্থক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত ভোট-বুথ এবং বিভিন্ন প্রার্থী এজেন্ট বা স্বয়ং ভোটাররূপী নারায়ণটিও এই বোমারূপী দলীয় প্রসাদ বিতরণের অকাতর লক্ষ্য হিসেবে গর্বের সঙ্গে সামিল হতে পেরেছিলেন এমন নির্বাচনের মহাযজ্ঞে। পাঁচ, আদালতের নির্দেশে বেশ কিছু আধাসেনা রাজ্যে এলেও একষট্টি হাজার বুথের বেশিরভাগ জায়গাতেই হয় আধাসেনা ছিল না, অথবা কোথাও থাকলেও সেখানে তাদের সংখ্যা ছিল নিতান্তই কম। বিএসএফ-এর প্রধান জানিয়েছেন যে পঞ্চায়েত ভোটের দিন সকাল পর্যন্তও রাজ্যের নির্বাচন কমিশন জেলাওয়ারি স্পর্শকাতর বুথের তালিকা আধাসেনার হাতে তুলে দেননি। উত্তরে নির্বাচন কমিশনার যেসব কথাবার্তা বলেছেন তাতে করে সমস্যা মেটানোর চাইতে সমস্যা তৈরি করাতেই যে তাঁর আগ্রহ বেশি, যেমনটা তিনি দায়িত্বভার নেওয়ার পরমুহূর্ত থেকে তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপে বুঝিয়ে এসেছেন, সেই বিশ্বাস আরও দৃঢ় হয়েছে। ছয়, এবং সম্ভবত সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ হল নির্বাচন কমিশনারের একটি অসামান্য মন্তব্য যেখানে এতগুলি মানুষের প্রাণ হারানোর প্রসঙ্গে নির্বিকার গলায় তিনি জানাচ্ছেন যে নির্বাচনের দিনে কোথায় কে কাকে গুলি করে মেরে দেবে তার হদিশ রাখা তাঁর কাজ নয়। এমনকি তিনি এও জানিয়েছেন যে, ভোটকর্মীদের নিরাপত্তার দায়িত্বও তাঁর নয়; ওসব নিতান্তই জেলা প্রশাসনের কাজ। ওঁর কাজ শুধু কিছু কাগুজে ব্যবস্থাপনা করে দেওয়া, ব্যস!

এবারে প্রশ্ন ওঠে, এই যে সারাদিন ধরে একটি আপাদমস্তক পূর্বপরিকল্পিত তাণ্ডবের রক্তাক্ত লাইভ টেলিকাস্ট রাজ্যবাসী দেখলেন, যা কিনা ক্লান্তিকরভাবে প্রত্যাশিত এবং জঘন্য অসভ্যতার পুনরাবৃত্তি ছাড়া আর কিছুই নয় — যার একদিকে শাসন ক্ষমতায় টিকে থাকা বা টিকে যাওয়া ‘মানি অ্যান্ড মাসল’ মাত্র সম্বল একটি আপাত-পরাক্রমী শক্তি, তার গায়ে জোঁকের মতো লেগে থেকে ক্ষমতার ক্ষীর চুষে খাওয়া বিরাট প্রশাসনিক অংশ, শাসকের ব্যক্তিগত শ্বাপদবাহিনীতে পরিণত হওয়া নির্লজ্জ রক্ষকের দল আর শাসক দলের আঙুলে বাঁধা সুতোয় নেচে অভ্যস্ত এবং শাসকের আত্মীয়স্বজনের লেহ্যপেয় উচ্ছিষ্টের মোচ্ছবে চাতক সেজে বসে থাকা একটি পুতুলসম নির্বাচন কমিশনার ও তাঁর পাহাড়প্রমাণ দায়িত্বজ্ঞানহীনতা আর অন্যদিকে সাধারণ মানুষের সামান্য বুনিয়াদি স্তরের সাংবিধানিক অধিকার প্রয়োগের বিষয়– এর শেষ কোথায় বা কখন?

ভারতের স্বাধীনতার বয়স পঁচাত্তর পেরল। এখন এই ২০২৩-এ এসে বলাই যায় যে, ভারতে ‘মহান গণতন্ত্র’ বলে যে সোনার পাথরবাটিটি প্রতিদিন প্রায় জলের দরে পাঠ্যবইয়ে, সংবাদপত্রে, প্রচার মাধ্যমে বা রাজনৈতিক বক্তব্যের নামে ভারতের অধিকাংশ নেতানেত্রীদের নিত্যনৈমিত্তিক অসাড় বমনক্রিয়ার মাধ্যমে ছেলে-বুড়ো সমস্ত ভারতবাসীকে গেলানো হয়, সেরকম কোনও জিনিসের অস্তিত্ব আমাদের দেশে বা রাজ্যে আদৌ নেই; বরং যা আছে তাকে যদি একটি সম্পূর্ণ অসফল গণতন্ত্র বা ‘ফেইলড ডেমোক্রেসি’ বলে চিহ্নিত করা যায়, তাহলে হয়তো অনেকেই প্রলাপ বলে গাল পাড়বেন। কিন্তু, ভাবলে দেখা যায়, পঞ্চায়েত ভোটের নামে যে চিত্র আজ সারাদিন ধরে গোটা পশ্চিমবঙ্গে আঁকা হয়েছে, সেই একই ছবি দেখা যাবে আবার সামনের লোকসভা বা বিধানসভা ভোটে। বাস্তবতার প্রয়োজন এবং নিজস্ব চরিত্র মেনে সন্ত্রাসের তুলির টানে সরু বা মোটার কিছু বৈচিত্র‍্য থাকলেও মোটের ওপর ব্যাপারটা একইরকম হবে, বলাই বাহুল্য। আজকের পঞ্চায়েত ভোটের কোনও বুথজ্যাম, খুন, রক্তগঙ্গা বা বোমের ধোঁয়া না দেখিয়ে যদি আজ সারাদিন বাংলার সমস্ত চ্যানেল ২০১৮ বা তারও আগের কোনও একটি পঞ্চায়েত ভোটের দিনের পুরনো ফুটেজ চালিয়ে দেখানো হত, তাহলেও আসলে আমরা আজ যা দেখেছি বা আশু ভবিষ্যতে যা দেখব বলে আশঙ্কা করছি, তাইই দেখতাম।

পঞ্চায়েত হোক বা অন্য নির্বাচন, ইদানিং মৃত বা সন্ত্রস্ত নাগরিকের পিনকোডের পরিবর্তন ছাড়া সামগ্রিক অভিজ্ঞতার চেহারায় অন্তত ইতরবিশেষ কিছু হয় না। যদিও এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য আগাগোড়াই বজায় ছিল যা কিনা, অন্যভাবে দেখলে, আমাদের গণতান্ত্রিক কাঠামোর নির্বাচনী ব্যবস্থাটাকে আরও বেশি করে কালিমালিপ্ত করে আবারও সেই ‘ফেইলড ডেমোক্রেসি’র প্রসঙ্গটাকেই বড্ড জ্বলজ্বলে করে চোখের সামনে এনে ফেলেছে।

যেকোনও নির্বাচনের ক্ষেত্রেই নির্বাচন কমিশন নামক ব্যবস্থাটি যতটা হাঁকডাক করে প্রক্রিয়াটা আরম্ভ করে, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় দেখা যায় তার সিকিভাগ শেষ পর্যন্ত পেরে ওঠে কিনা সন্দেহ। মোটামুটি, সরকারি বা আধা সরকারি কর্মচারী, যাঁরা ভোটকর্মী হন, প্রশাসনের এক-দুটি অংশ আর পুলিশ বা আধাসেনা, এদের ওপর আস্ফালনেই নির্বাচন কমিশনের বিপুল শক্তিশালী কাজকর্ম সীমাবদ্ধ থাকে। এই অভিজ্ঞতা ভারতের বেশিরভাগ নির্বাচনের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ব্যতিক্রম থাকে। হঠাৎ কোনওদিন একজন টি এন শেষন বা একজন মীরা পান্ডে কেন্দ্রে বা রাজ্যে নির্বাচন কমিশনার হয়ে এলে সেসব হয়তো কখনও ঘটেছে বা ঘটতে পারে। কিন্তু, ব্যতিক্রমের বিজ্ঞাপনেই চিরাভ্যাসের মারণব্যাধি যে আরও প্রকট হয়ে উঠেছে বা ওঠে সে তো সকলেই জানেন। মোদ্দা কথা হল, এবারে রাজ্যের নির্বাচন কমিশনারের পদে বসেই কোনওরকম সর্বদলীয় বৈঠক ছাড়া নির্বাচনের দিন ঘোষণা করে শ্রীযুক্ত রাজীব সিনহা মশাই যে কর্তাভজা কলের পুতুলের মতো ছুটতে (পড়ুন, নাচতে) আরম্ভ করলেন, আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মাননীয় রাজ্যপাল মশাইয়ের বাগাড়ম্বর বিস্তারে যে বান ডাকল, তাতে করে গণতন্ত্রের উৎসবের অন্তর্জলি যাত্রার সুরটা প্রথম থেকেই স্পষ্ট ধরা যাচ্ছিল।

কথায় বলে বহ্বারম্ভে লঘুক্রিয়া। একজন শাসক দলের প্রতি একনিষ্ঠ সমর্পিত প্রাণ হয়ে উঠে কমিশনার পদের জন্য অবমাননাকর ও অবাঞ্ছিত অতি-নিস্ক্রিয়তায়, আর অন্যজন তাঁর উপরতলার কাছে নম্বর তোলার তাগিদে অতি-সক্রিয়তায় আসলে যে সহজ সত্যিটাকে বে-আব্রু করে দিলেন সেটা এই যে, আমাদের রাজ্যে মসনদে থাকা দলীয় শাসকের ক্ষমতা, অর্থ আর পেশিশক্তির কাছে, তা সে যে বা যারাই ক্ষমতায় থাকুন না কেন, এইসব সাংবিধানিক পদাধিকারীরা শুধুমাত্র নামেই বাঘ। আদপে এঁদের কোনও ক্ষমতাই নেই। এঁরা না পারেন কোনও গণতান্ত্রিক পরিবেশ সুনিশ্চিত করতে, না পারেন জনগণ বা ভোটকর্মী, কারুর সুরক্ষার কোনও ব্যবস্থা করতে। নির্বাচনের সময়ে নাকি, সাংবিধানিক রীতি অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশনারের অধিকার ও ক্ষমতা সর্বোচ্চ। বাস্তবে দেখা গেল, যদি শাসকদলে সমর্পিতপ্রাণ একটি স্বার্থান্বেষীকে নির্বাচন কমিশনার করে ফেলা যায়, যার প্রতিটি পদক্ষেপে শাসককে তুষ্ট করার অভিসন্ধি আর আদালতের রায়কে বাস্তবায়িত করায় অনীহা স্পষ্ট থাকে, তাহলে বিরোধী দল বা সাধারণ নাগরিক মায় আদালত পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করলেও নির্বাচন নামক রক্তাক্ত প্রক্রিয়াটিকে ‘মহান গণতান্ত্রিক’ রূপ দেওয়া যায় না। কাগুজে কথা আর বিশ্রম্ভালাপে আটকে থাকে গণতান্ত্রিক দাবির সমস্ত স্বর। নির্বাচন পরিণত হয় প্রহসনে। ভোটার মরে। নাগরিক মরে। মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে সকাল আটটার মধ্যে ভোটবাক্স লুঠ হয়ে যায়। পরে তা উদ্ধার করতে হয় নর্দমা থেকে। বুথে বোমা পড়ে। মহার্ঘ ভাতা না পাওয়া নিরাপত্তাহীন ভোটকর্মী তাঁর সন্তানের মুখ আদৌ আর দেখতে পাবে কিনা এই আশঙ্কায় আরেকটি মৃত রাজকুমার রায় হয়ে যাওয়ার আগে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। হয়তো প্রখ্যাত লেখকের উপন্যাসে বর্ণিত আসাহী পেনট্যাক্সের লেন্সের দিকে। বিখ্যাত ঔপন্যাসিক বা কবিরা অবশ্য এসব দেখেও দেখেন না। তাঁরা হয়তো তখন বাংলা আকাদেমির জন্য কোনও প্রশাসক কবির অতি উন্নত কবিতা সঙ্কলনকে পুরস্কারে মনোনীত করতে ভীষণ ব্যস্ত। হয়তো। বোমা পিস্তল আর মাস্কেটের বধ্যভূমিতে দাঁড়িয়ে ইদানিং কালের বাংলার সম্ভবত একটিমাত্র ব্যতিক্রমী ‘মানবিক’ পুলিশকর্মীর চোখ থেকে জল পড়ে যায়। হয়তো অজান্তেই। ভোটার কাঁদে। ভোটকর্মী কাঁদে। পুলিশ কাঁদে। ভোটের লাইনে বিস্ফোরণে ছেলে হারানো মা কাঁদেন দিনহাটায়। কুচবিহারে। শেষ পেরেক কফিনে পুঁতে গণতন্ত্র পরিণত হয় অসফল গণতন্ত্রে। ফেইলড ডেমোক্রেসি। আবার। বারবার।

এত সবের পর, খবরে প্রকাশ,

১) ভোট পরবর্তী সন্ত্রাস এখনও অব্যাহত;

২) সন্ত্রাসের দায় নিয়ে শাসক আর বিরোধীর তরজার স্বর পাড়ার কুকুরদের চুপ করিয়ে দিয়েছে। দায় ফুরোনোর খেলার ফলাফল, এক-এক।  এ ব্যাপারে স্থিতাবস্থা জারি থাকছে।

৩) প্রাকনির্বাচনী সন্ত্রাস ধরে এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনের উৎসবে মোট প্রাণহানির সংখ্যা ৩৬।

৪) নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, ওঁর তথ্য অনুযায়ী মাত্র তিনটি প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হয়েছে।

“কত মানুষ মরলে তুমি কাঁদবে বলো শেষে” জাতীয় কোনও গান লেখা হয়নি। পঞ্চায়েত নির্বাচন আপাতত শেষ। গণতন্ত্র চলছে।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4664 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...