কেবল একরাতের স্পর্ধা নয়, রাতদখল প্রতিরাতের গল্প হোক

খালিদা খানুম

 


এই রাতদখল কেবল একরাতের স্পর্ধার গল্প নয়, এই রাতদখল প্রতিরাতের গল্প হয়ে ওঠা দরকার। এটি একটা নিরবচ্ছিন্ন লড়াই। যেভাবে ঘরের ঝুল প্রতি সপ্তাহে পরিষ্কার করা দরকার তেমনি এই দখলের লড়াই শুধু আরজিকর নিয়ে থেমে গেলে চলবে না। আরজিকর একটি মুখ মাত্র, এর পেছনে কলকাঠি যারা নাড়ছে, তাদের নিয়েও নাড়াচাড়া শুরু হোক। আরজিকরের সামনে শুধু নয়, কেবল পুরুষবিদ্বেষী পোস্ট লাগিয়ে নয়, রাজ্যের নিরাপত্তার দায় যাদের উপর তাদের মুখোমুখি কথা হোক। এ লড়াই থেমে গেলে আমাদের আবার একটি মোমবাতি মিছিলের অপেক্ষা করতে হবে

 

যারা আমরা দূর থেকে কলকাতা দেখি, তাদের কাছে কলকাতা শব্দটা অন্যরকম। কলকাতা মানেই স্বাধীনতা। তাই গ্রামে যারা আমরা পড়াশোনা করি, তাদের স্বপ্ন থাকে, কলকাতার কোনও একটা কলেজে নিজের কলেজজীবন কাটানো। আরজিকরের ঘটনা ঘটার পর সম্ভবত এই স্বপ্ন দেখতে ভয় পাব, যদি না রাত দখলের লড়াই-এ আমরা সফল হই।

রাত দখলের লড়াই কেবল একটি ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদ না হয়ে, হয়ে উঠুক অধিকার বুঝে নেওয়ার লড়াই। লড়াইটা হোক ভাল আর মন্দের।

নারীসুরক্ষার ব্যপারটি অনেক কিছুর উপর নির্ভরশীল। কারণ নারীদের অসুরক্ষার ব্যপারটি কেবল একটি ঘটনা বা ‘হিট অফ মোমেন্ট’-এর ঘটনা নয়। ঘরে-বাইরে সবস্থানেই নারীদের অসুরক্ষার ব্যপারটি উঠে আসে। নারীরা কেবল রেপ হলেই অসুরক্ষার ঘটনাটি ঘটে না, ফোনে মেসেঞ্জারে অযাচিত আলাপ, ইচ্ছাবিরুদ্ধভাবে ঘনিষ্ঠ (মানসিকভাবেও) হতে চাওয়া, ভাল করতে চাওয়া, সেক্সুয়াল মিম পাঠানো (যদিও বলা হয়, জাস্ট জোক)— এগুলো অসুরক্ষার প্রথম ধাপ। সুসভ্য পোশাক পরিহিত মানুষ বিকারহীনভাবে বৌ/প্রেমিকাকে নিয়ে নিম্নরুচির মিম শেয়ার করতে পিছপা হয় না, এবং সেগুলো উদার মানসিকতার মাপকাঠি বলে প্রমাণ করা হয়। রেপ-ভিকটিমের ছবি শেয়ার করার প্রতিবাদ করলে ছবি ডাউনলোড না করার পরামর্শ দেওয়া হয়।

ধান ভানতে শীবের গীতের মতো হলেও বাস্তব এই যে মেয়েরে সুরক্ষা দেওয়ার প্রথম ও প্রধান শর্ত হল নারীদের চিন্তাভাবনার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া। একটি মেয়ের ভাল লাগা বা খারাপ লাগাকে মূল্য না দিয়ে মেয়েদের সুরক্ষা দেওয়াটা যে মুখোশধারীদের কাজ, সেটা বুঝতে বেশি বুদ্ধি দরকার হয় না।

প্রথমত প্রশ্ন করা দরকার, নারী, আক্ষরিকভাবে বলতে গেলে নারীদেহের সুরক্ষা কেন দরকার? পুরুষদেহের সুরক্ষা কেন দরকার হয় না? (যদিও অনেক ক্ষেত্রে ছোট ছেলে বাচ্চাদের জোর করে সেক্সের ঘটনা উঠে আসে। কিন্তু পারসেন্টেজ করলে সেটা অনেক কম।)

নারীদেহকে লোভনীয় করে তোলার পেছনে, নারীদেহের পণ্যায়ন অনেকটা দায়ী। খেটেখাওয়া নারীদেহ এবং বিউটি প্রোডাক্টের ফসল যে নারীদেহ, তার মধ্যে পার্থক্য আছে। নারীদেহের স্বাভাবিক যৌন আকর্ষণকে পুঁজি করে যে বিশাল ব্যবসা চালু হয়েছে সারা দুনিয়াজুড়ে তা কিছুটা হলেও নারীদেহকে অসুরিক্ষত করেছে। পর্নসাইটগুলো না বলেও বলতে চেয়েছে পুরুষত্ব কেবল নির্দিষ্ট অঙ্গে। যার ফলে ছোট বয়স থেকেই নারীদেহ ও সেক্সের প্রতি অসত্য ধারণা তৈরি হয়েছে।

প্রশ্ন আসবে অতীতে, যখন বিশ্বায়ন হয়নি, বা তারও সূদুর অতীতে, যখন ব্রেস্ট ট্যাক্স দিতে হত বা জমিদারের ভোগলালসার শিকার হতে হত নারীকে, তখন তো বিশ্বায়ন বা পর্নসাইট আসেনি, তাহলে সে ঘটনা কেন ঘটত? তখনও এই মানসিকতাই ছিল, যে নারীদেহ ভোগ্য। ভোগ্য তাই হয় যা পণ্য। পণ্যকে ভোগ করার জন্য কেউ অনুমতির প্রয়োজন বোধ করে না। এখানেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে সামাজিক সুরক্ষার প্রশ্নটি। সামাজিকভাবে যদি নারীদেহের প্রতি দৃষ্টিভিঙ্গি না পরিবর্তন হয়, তাহলে নির্ভয়া, আসিফা, তিলোত্তমার পরিসংখ্যান কেবল বাড়তে থাকবে। এগুলো আমাদের নজরে আসছে, কিন্তু গ্রামেগঞ্জে, ঘরের ভেতরে প্রতিদিন কত ঘটনা ঘটে যাচ্ছে তার কোনও হিসেব নেই।

হিসেব রাখার দায়িত্ব সরকারের। গ্রামে বিভিন্ন হসপিটালে একা একজন ডাক্তার/নার্স কাজ করে। এখানে ‘কাজ করা’ মানে কেবল পেশেন্টের বিপি দেখা, ইনজেকশন দেওয়া নয়, রেজিস্ট্রার মেইনটেইন করা থেকে পাবলিক ডিলিং। এমন সব ব্লক ও পঞ্চায়েত অফিসে মেয়েরা কাজ করে, যেখানে পাঁচটার পর পাবলিক ট্রান্সপোর্ট পাওয়া যায় না। সরকার এখানে কী সুবিধা দিতে পারে? পুলিশি নিরাপত্তা/সুরক্ষা-সংক্রান্ত টোল ফ্রি নাম্বার, আরও কিছু হাবিজাবি…

কিন্তু রাস্তা থেকে পার্টি অফিস চত্বর সামলানো ‘সিভিক পুলিশ’ সত্যিই কি নির্ভরযোগ্য? বা পুলিশি নিরাপত্তাই কি শেষ কথা?

নয়, বদল চাই সিস্টেমের। চেয়ারের পেছনের যে বিশাল একটা জাল রয়েছে যেখানে কেবল মেয়েরা নয়, বলি হচ্ছে সাধারণ মানুষ।

আরজিকর হাসপাতালের ঘটনা বিচ্ছিন্ন কোনও ঘটনা নয়। বিশাল জালে জড়িয়ে পড়া একটা মাছির গল্প কেবল। মেয়েরা যে রাতদখলের লড়াই করেছে সে রাতে, তা ওই জাল ছিঁড়ে ফেলার প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে বিবেচিত হবে।

কিন্তু দুঃখের ঘটনা এই যে, নাগরিক সমাজ এখানেও দ্বিধাবিভক্ত। রাজনৈতিক হওয়া যাবে কি না, শাঁখ বাজানো যাবে কি না, মেয়েদের মিছিলে ছেলেরা যাবে কি না— এই সব নিয়ে ব্যস্ত। তার উপর রয়েছে ভুল তথ্য/ভুল বার্তা ছড়ানো, রাতদখলের লড়াইয়ে মেয়েদের হেনস্থার ভিডিও। এতে রাতদখলের লড়াই অন্য রং পেয়ে যাচ্ছে। সমাজের চিন্তা অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা সফল হচ্ছে। হয়তো কিছুদিনের মধ্যে আরও এমন একটি ঘটনা ঘটবে, যেখানে ধামাচাপা পড়ে যাবে তিলোত্তমা ও আরজিকরের নোংরামি। আবার চোখের আড়ালে বাড়তে থাকবে মাকড়সার জাল অন্য কোনও শিকারের অপেক্ষায়।

কিন্তু সত্যিই কি সবাই এই লড়াইয়ে একাত্ম হতে পারছে? ভয় হচ্ছে না কি, পাছে সরকারি সুবিধা থেকে বঞ্চিত না হয়ে যায়। হচ্ছে বা ভয় দেখানো হচ্ছে। কিন্তু সরকারি সুবিধা পাওয়ার জন্য কোনও রঙের জার্সি পরতে হয় না, সরকারি সুবিধা (অনুদান নয়) মানুষের ন্যায্য অধিকার। সেটা বুঝে নিতে হবে। এটা যতদিন মানুষ না বুঝবে ততদিন রাজনৈতিকভাবে অসুরক্ষিত থাকবে সবাই। রাজনৈতিক মদতপুষ্ট বাহিনি রেপের মতো ক্রাইমকেও ধামাচাপা দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। সম্ভবত এই ঘটনা নিয়ে টানাটানি করলে কানের সঙ্গে মাথা নয়, পুরো শরীর সমেত উপড়ে পড়বে, তাই হয়তো এত সতর্কতা।

যেভাবে আমরা ভুলে গেছি মণিপুরের ঘটনা, উলঙ্গ করে মহিলাকে রাস্তায় হাঁটানো ঘটনাটি দিব্যি হজম করিয়ে দিয়েছে পালের গোদাটি, তেমনি হয়তো কিছুদিনের মধ্যে চাপা পড়ে যাবে তিলোত্তমা।

সেইদিক থেকে বিচার করলে নারীদের অর্থনৈতিক সুরক্ষা, সামাজিক সুরক্ষা আর রাজনৈতিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা দরকার।

আসলে এই রাতদখল কেবল একরাতের স্পর্ধার গল্প নয়, এই রাতদখল প্রতিরাতের গল্প হয়ে উঠা দরকার। এটি একটা নিরবচ্ছিন্ন লড়াই। যেভাবে ঘরের ঝুল প্রতি সপ্তাহে পরিষ্কার করা দরকার তেমনি এই দখলের লড়াই শুধু আরজিকর নিয়ে থেমে গেলে চলবে না। আরজিকর একটি মুখ মাত্র, এর পেছনে কলকাঠি যারা নাড়ছে, তাদের নিয়েও নাড়াচাড়া শুরু হোক। আরজিকরের সামনে শুধু নয়, কেবল পুরুষবিদ্বেষী পোস্ট লাগিয়ে নয়, রাজ্যের নিরাপত্তার দায় যাদের উপর তাদের মুখোমুখি কথা হোক। এ লড়াই থেমে গেলে আমাদের আবার একটি মোমবাতি মিছিলের অপেক্ষা করতে হবে।


*মতামত ব্যক্তিগত

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4887 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...