কিন্তু, রাতটা পার হবে সাবধানে…

দীপ ঘোষ

 


শাসক বোঝাতে চাইছে, আরজিকরে যা ঘটেছে তা আদ্যোপান্ত একটা দুর্ঘটনা। যেমন দুর্ঘটনা ঘটে সাবধানে রাস্তা না পেরোলে৷ আর শাসকের সবচেয়ে অস্বস্তি, তাদের দেখানো কুমিরের কান্না না-কেউ বিশ্বাস করছে, না-কেউ খাচ্ছে তাদের বানানো গল্প। বাংলা এর আগে ধর্ষণ দেখেছে। আলবাত দেখেছে। এ-বাংলার বুকে রাস্তায় শুয়ে থাকা পাগলির ময়লাটে চাদর ভেসে যায় রক্তে। গৃহবধূ ঠোঁটে আর পিঠে কালসিটে নিয়ে সুখী দাম্পত্যের গল্প করে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে। পরিবারের মামা কিংবা কাকার দেওয়া যন্ত্রণাকাতর স্বর হারিয়ে যায় চার দেওয়ালের মধ্যেই। কিন্তু হ্যাট্রিক করে আসা তৃণমূল সরকার এমন প্রকাশ্যে ধর্ষকের পক্ষ নেবে; এ-বাংলা ভাবতে পারেনি

 

না, মানছি যা হয়েছে অন্যায় হয়েছে কিন্তু একদিন রাত দখল করে কি আদৌ কিছু বদলাবে? না, মানছি এমনটা হওয়া উচিত নয়, কিন্তু মেয়েটারই বা কী দরকার ছিল অত রাতে একা একা সেমিনার হলে যাওয়ার? না, এও মেনে নিচ্ছি এমনটা কাঙ্ক্ষিত নয়, কিন্তু এ নিয়ে এত আন্দোলনের কী আছে? কলকাতার বুকে তো এই প্রথম রেপ হল না? কংগ্রেসের আমলে ধর্ষণ হয়েছে। সিপিএমের চৌত্রিশ বছরের রাজত্বকালেও ধর্ষণের সংখ্যা কম নয়। বিজেপির রাজ্যগুলোতেও ধর্ষণ এবং ধর্ষকের পক্ষে মিছিল একখানা রোজকার ঘটনা। তাহলে বঙ্গতৃণমূল নিয়ে এত কান্নাকাটির কী আছে?

রাস্তাঘাটে, লোকাল ট্রেনে, মেট্রোর কামরায়, অফিস ক্যান্টিনে এই কথাগুলোই উঠে আসছে। এবং আশ্চর্যজনকভাবে, সমুদ্রমন্থনে যে এ ধরনের বিষ উঠে আসবে, সব্বাই জানত। বরং অমৃত নিয়েই সবাই একটু অবাক। তবে, শুরুতেই সমস্ত কিন্তু-কিন্তু ভাব সেরে ফেলি। সরাসরি জন স্নোর কথায় সহমত পোষণ করে বলে দিই, “Everything before the word ‘but’ is horseshit.”

অর্থাৎ ন্যাকান্যাকাভাবে কিংবা বিজ্ঞের মতো, ধর্ষককে সামান্য বকাঝকা করে যাঁরা কিন্তু লাগিয়ে আলটপকা প্রশ্ন করছেন, তাঁদের আসল বক্তব্যের সঙ্গে ধর্ষকদের বক্তব্যের বিশেষ ফারাক নেই। চিরকাল তারা চায়, নারীদের পর্দায় যতখানি পারা যায় ঢেকে রাখা হোক। না-হলেই, মাছি ভনভন করবে। বসবে। এবং দফারফা করবে। লোকের কথাবার্তা মোটামুটি উদাহরণ বদলে একই পথে গড়িয়ে এসেছে চিরকাল। সিন্দুকে তালা দিই যখন, খাবারে ঢাকা দিই যখন, নারীকে খোলামেলা ঘুরতে দেওয়া তো বোকামি। নারীমাত্রই তা কারও-না-কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি। হয় বাবার, নয় দাদার, নয় স্বামীর, না-হলে সন্তানের। আর বাসে-ট্রেনে চড়া মানুষমাত্রই জানেন, “মালের দায়িত্ব আরোহীর” কিংবা “পকেটমার হইতে সাবধান”।

এখানেই এল সাবধানের প্রসঙ্গ। একজন মেয়েকে বসার সময়ে সাবধানে থাকতে হবে। খেয়াল না করলেই পাশের সহযাত্রীর কনুই যে বাসের ঝাঁকুনিতে কতবার হৃদয় ছুঁয়ে যাবে, ইয়াত্তা থাকবে না। একজন মেয়েকে দাঁড়াতে হবে সাবধানে। লোকজন হাঁটবে চলবে চোখে ঠুলি পরে৷ ভিড় যদি থাকে, তাহলে তো পোয়াবারো। হাত কথা বলবে। অজুহাত কথা বলবে। আর শেষে মিষ্টি হেসে দাদা বলবে, “এত অসুবিধে থাকলে ট্যাক্সি করে যাতায়াত করুন।” মেয়েদের ঝুঁকতেও হবে সাবধানে। উপস্থিত বীরপুঙ্গবদের চোখ খুবই সুযোগসন্ধানী। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নির্লজ্জের মতো চেষ্টা করে যাবে, যতখানি গভীরে যাওয়া যায়। কিন্তু এসবে দোষখানা মেয়েটার। মানে, এগুলোই শেখানো হয়েছে। তাদের জীবনখানা পার হতে হবে সাবধানে। দিনের আলোয় তুর্কিরা অতর্কিতে আক্রমণ শানিয়েই যাবে। বাঁচতে হবে তাদের।

‘ছোট-ছোট’ এইসব মলেস্টেশনের ক্ষেত্রগুলোতে মেয়েটার পরিবারও মেয়েটার দোষ দেখবে। মলেস্টার নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাবে না। একরকমভাবে তাদের আড়ালই করবে৷ আর ‘বড়সড়’ ক্ষেত্রে, মানে যখন ধর্ষণ হয়ে যাবে কিংবা ধর্ষণের সঙ্গে মেয়েটি বিনামূল্যে পেয়ে যাবে মৃত্যু। ফ্রি। ফ্রি। ফ্রি। তখন ধর্ষককে আড়াল করতে নামবে রাজ্য। এবং আশ্চর্যজনকভাবে দেখা যায়, অধিকাংশ ধর্ষকই কী এক মন্ত্রবলে শাসকের কাছের লোক। ক্ষমতার প্রিয় পাত্র। এবারেও ব্যাপারটা মোটামুটি তাই।

আসল সমস্যা হল, শাসক ভীষণভাবে বোঝাতে চাইছে, আরজিকরে যা ঘটেছে তা আদ্যোপান্ত একটা দুর্ঘটনা। যেমন দুর্ঘটনা ঘটে সাবধানে রাস্তা না পেরোলে৷ আর এখানেই শাসকের সবচেয়ে অস্বস্তি, তাদের দেখানো কুমিরের কান্না না-কেউ বিশ্বাস করছে, না-কেউ খাচ্ছে তাদের বানানো গল্প। বাংলা এর আগে ধর্ষণ দেখেছে। আলবাত দেখেছে। এ-বাংলার বুকে রাস্তায় শুয়ে থাকা পাগলির ময়লাটে চাদর ভেসে যায় রক্তে। গৃহবধূ ঠোঁটে আর পিঠে কালসিটে নিয়ে সুখী দাম্পত্যের গল্প করে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে। পরিবারের মামা কিংবা কাকার দেওয়া যন্ত্রণাকাতর স্বর হারিয়ে যায় চার দেওয়ালের মধ্যেই। কিন্তু হ্যাট্রিক করে আসা তৃণমূল সরকার, এমন প্রকাশ্যে ধর্ষকের পক্ষ নেবে; এ-বাংলা ভাবতে পারেনি। চোখের সামনে প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা, ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার নিষ্ঠা আমজনতার বিবেককে ধরে নাড়িয়ে দিয়েছে৷ হাজার কিন্তুর ভিড়ে তাই লক্ষ্যকণ্ঠ সরাসরি কলার ধরেছে শাসকের৷ জানতে চেয়েছে, কেন? কীসের জন্য?

শাসক শাকের বন্দোবস্তে ত্রুটি রাখেননি। কিন্তু কিছুতেই এবারের মাছখানা ঢাকা যাচ্ছে না। হাজার টাকার লক্ষ্মীভাণ্ডার কিংবা পঁচাশি হাজারের পুজোর চাঁদা দিয়েও, বাংলার মেয়ে দেখতে পাচ্ছেন, কেউই ওঁকে চাইছে না৷ বরং বিচার চাইছে। প্রতিদিন কোনও-না-কোনও জায়গায় জমায়েত হচ্ছে। মিছিলের সঙ্গে মিছিল জুড়ে মানববন্ধন হচ্ছে। পুলিশ কমিশনারকে উপহার দেওয়া হচ্ছে ‘শিরদাঁড়া’। মাঝেমধ্যেই বিক্ষিপ্তভাবে মিছিলে ভিজিটে আসছে তৃণমূলের দাদাভাইরা। মারধর করছে। ভয় দেখাচ্ছে। সরকারের চেহারাখানা আরও নগ্ন হয়ে যাচ্ছে৷ ১৪ আগস্ট যে রাতদখলের স্রোত দেখে কেউ একজন বলেছিলেন এসব কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে বানানো, ক্রমাগত এ ছবি তাঁকে হয়রান করছে নিশ্চিত।

তবে এখন ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে। এ আন্দোলন ক্ষণজন্মা যে নয়, সব্বাই টের পেয়ে গেছেন। সংশয় যা ছিল, ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গেছে। বাংলার আকাশে এখনও অন্ধকার। নিবিড় রাত। লক্ষ্য যুবতী, তরুণী, কিশোরী, প্রৌঢ়া দখল করে রেখেছে এ-রাত। বিচার তো আসবেই। চিন্তায় বরং সরকার। জানি, এ-সরকারকে মানুষই ভোটে জিতিয়ে এনেছেন। বোধহয় ধর্ষকের সঙ্গে গোপন আঁতাত জানা ছিল না। তাই সরকারকেই বলি। সময় সুবিধের নয় কিন্তু। রাতটা পার হবেন সাবধানে।


*মতামত ব্যক্তিগত

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4858 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...