অম্লান চক্রবর্ত্তী
মেয়েদের জন্য ঘুমপাড়ানি ছড়ায় থাকে, “বর আসবে এখুনি/নিয়ে যাবে তখুনি”। অর্থাৎ, তুমি যোনি নিয়ে জন্মেছ। পুরুষের দ্বারা সামাজিকভাবে নীত হওয়াই তোমার ভবিতব্য। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-খেলোয়াড়-কবি-কেরানি যাই হোক না কেন, মেয়েদের নিয়তি যেন ‘নীত’ হয়েই। তাই সানিয়া মির্জা ডাবলসে উইম্বলডন জেতার পরেও এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, “কবে সেটল করছেন?”
ভারতবর্ষে না কি প্রতি ১৬ মিনিটে একটি করে ধর্ষণ/শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটে। তার কত শতাংশ খবরে আসে, তা হিসাব করতে বসলে দশমিকের পর পিঁপড়ের লম্বা সারি দিয়ে শূন্য বসে শেষে ১ বসবে। আর তার মধ্যে যখন একজন নির্ভয়া-অভয়া-আসিফা-হাথরাস ঘটে, আমাদের বিপ্লব-স্পৃহা জেগে ওঠে। আর পারিবারিক বা সামাজিক ধর্ষণ? বা আরও নির্দিষ্ট করে বলা হলে, একটি মেয়েকে ছোট থেকে যে অনুশাসনে বড় করা হয়, তা ধর্ষণের থেকে কোনও অংশে কম নয়।
“কন্যা তোর জীবনভর সর্বনাশী”
পিঠোপিঠি দুই ভাই-বোন বড় হচ্ছে একটি সংসারে। তাদের ‘প্রগ্রেসিভ পেরেন্টস’। নারী-পুরুষ সমানাধিকারের কথা বলেন। সেই পরিবারেও কান পাতলে শোনা যায়, ছেলে স্নান করে এসে চিৎকার করে বলছে, “মা, আমার স্যান্ডো গেঞ্জি কই?” অথচ মেয়েও অনুরূপে চিৎকার করে “মা, আমার টেপজামা কই?” বলতে পারবে না। ব্রা শব্দটি মুখে আনলেও প্রত্যুত্তরে গালে ঠাস্ করে শব্দ হবে। “তুমি মেয়ে, তোমার অন্তর্বাস লজ্জা” এই শেখানো হয়।
অবশ্য, পুরুষতন্ত্রের সূচনা তারও আগে থেকে। মেয়েদের জন্য ঘুমপাড়ানি ছড়ায় থাকে, “বর আসবে এখুনি/নিয়ে যাবে তখুনি”। অর্থাৎ, তুমি যোনি নিয়ে জন্মেছ। পুরুষের দ্বারা সামাজিকভাবে নীত হওয়াই তোমার ভবিতব্য। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-খেলোয়াড়-কবি-কেরানি যাই হোক না কেন, মেয়েদের নিয়তি যেন ‘নীত’ হয়েই। তাই সানিয়া মির্জা ডাবলসে উইম্বলডন জেতার পরেও এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, “কবে সেটল করছেন?”
এরপর আসে পারিবারিক শ্লীলতাহানির ঘটনা। কাকা বা মামা বা বাবার বন্ধুর হাতে ‘ও মা, কত বড় হয়ে গেছিস’ অছিলায় অবাঞ্ছিত স্পর্শ বা নিগৃহীত হওয়ার ঘটনা বোধহয় প্রতি পরিবারেই আছে। সেখান থেকে বাঁচলেও স্কুলে যাওয়ার পুলকারের গাড়িকাকু আছে। নির্জ্ঞানের যে যৌনতা দর্শন হয়, তা সারা জীবনের প্রভাব ফেলে মেয়েটির সারা জীবনে। অধিকাংশ সময়ই মেয়েটি তার অসম্মানের কথা জানাতে পারে না। আর জানালেও? “এ মা, ছিঃ ছিঃ, এসব বাইরে বলতে নেই।” বা “মেয়েমানুষ হয়ে জন্মেছ, এটুকু সইতে হবে।” ও হ্যাঁ, এই শাসানি আসে বাবা-মায়ের থেকেই।
এই সবে শুরু। এরপর বাসে-ট্রামে সর্বত্রই ব্যক্তিগত অঙ্গে পুরুষের লালসা-স্পর্শ হলেও মেয়েটিকে চুপ করতে শেখানো হয়। আর বিয়ের পর? সেই নিয়ে বলতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে। কী আশ্চর্য? মহাভারতেই তো পারিবারিক যৌন অত্যাচার বর্ণিত আছে।
“এলাটিং বেলাটিং সই লো/একটি বালিকা চাইল”
রাজার মনোরঞ্জন করতে হবে। নারী প্রয়োজন। পূর্ণবয়স্কা তন্বী নারী? উঁহু, রাজার চাই কচি, নরম শরীর। কুঁড়ি চাই। অনাঘ্রাতা নবমুকুলের মধু পান করে রাজা হবেন তৃপ্ত। রাজতন্ত্র চলে গেছে। কিন্তু ‘লং লিভ কিং’— রাজ-লালসা নয়, বরং ফিরে এসেছে অন্য রূপে— নেতাতন্ত্রে।
মন্দিরে পুরোহিতের যৌনকামনা মেটানোর আমাদের দেশেই শুরু হয়েছিল ‘দেবদাসী’ প্রথা। প্রধানত, বালিকাদেরই আনা হত। দেবতার, থুড়ি, পুরোহিতের সেবায় প্রয়োজন অক্ষত যোনি। এমনকি, রজোদর্শনের পূর্বেই সেই যোনিপথে পুরোহিতকে ধারণ করতে হবে। তবেই মোক্ষ! কার? বালিকার? হাসালেন মশাই।
দেবদাসী প্রথা আইন করে বন্ধ করা হয়েছে। কিন্তু ২০২৩ সালে ‘ডেকান হেরাল্ড’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি খবরে জানা যায়, দেবদাসী প্রথা আজও রমরমিয়ে চলছে দক্ষিণভারতের কিছু মন্দিরে। শোষকের রং বদলেছে। ভারতে ‘মহান’ হয়েছেন বখাটে গডম্যানরা। আশারাম বাপু বা রাম-রহিমের আশ্রমে কী ঘটেছিল, তা আজ সকলেরই জ্ঞাত।
“কালচারে তোর রক্ত লেগে/রক্ত দেশের বাল্যস্মৃতি” (কবীর সুমন)
বৈদিক ভারতে নারীর অবস্থানের কথা উঠলেই দুটি নাম ঘুরেফিরে আসে— গার্গী ও মৈত্রেয়ী। কিন্তু তাঁদের পথেও ছিল কাঁটা। বহু ক্ষেত্রেই যুক্তি-প্রতিযুক্তির সময় তাঁদের দিকে ভেসে আসত তির্যক বক্তব্য, যার অধিকাংশই ছিল নারীবিদ্বেষী এবং লিঙ্গনির্দেশক। প্রতি পদক্ষেপে তাঁদের বুঝিয়ে দেওয়া হত, যে নারী দ্বিতীয় শ্রেণির বাসিন্দা।
সত্যযুগে পরশুরাম মাতৃঘাতী হয়েছিলেন। তাঁর বাবা জমদগ্নির অকারণ সন্দেহে পরশুরাম মা রেণুকার মাথা কেটে হত্যা করেন। ত্রেতাযুগে বিনাদোষে সীতাকে অগ্নিপরীক্ষা দিতে হয়। দ্বাপর যুগে রজঃস্বলা দ্রৌপদীকে একবস্ত্রে কৌরবসভায় টেনে হিঁচড়ে আনা হয়। তাঁর স্বামী যে তাঁকেই বাজি রেখে পাশা খেলায় অংশ নিয়েছিলেন!
সত্য-ত্রেতা-দ্বাপর যুগের রেশ চলে কলিকালেও। কুলীন সমাজে পুরুষ একাধিক বিয়ে করে এবং নাবালিকাদের প্রতি পৌরুষ জাহির করতেও দ্বিতীয়বার ভাবেনি। আইন করে বহুবিবাহ বন্ধ করা হয়েছে। কিন্তু মনোভাব তেমন বদলেছে বলে মনে হয় না।
এই প্রেক্ষিতে অবশ্য অন্যান্য ধর্মেও নারীর অবস্থান খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয়। বরং করুণ। খ্রিস্টধর্মে সেবা বা ‘নার্সিং’য়ের বাইরে অন্য কোনও কাজে নারীর দেখা মেলে না। বৌদ্ধধর্মে স্বয়ং তথাগতই বলেছিলেন, থেরীদের আগমনে সঙ্ঘের বয়স কমে গেল। ইসলামে নারীর অধিকারের কোনও প্রামাণ্য তথ্য নেই। বরং খবরের কাগজে নাবালিকা-বিবাহ বা ‘শেখ ম্যারেজ’ নামক জঘন্য ব্যবস্থার খবর পাওয়া যায়। যে-ব্যবস্থায় বয়স্ক শেখরা ভারতে আসেন, নাবালিকা মেয়েদের বিয়ে করেন এবং কিছুদিন পর তালাক দিয়ে ফিরে যান। নাবালিকার পরিবার এবং আড়কাঠিদের পকেট ভরে ওঠে। পাকিস্তান-আফগানিস্তানে নাবালিকা-বিবাহের খবর আজও পাওয়া যায়।
সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয়, ধর্ষণকে আদিকাল থেকেই যুদ্ধজয় বা রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। ফ্রান্সে যখন জিপসিদের খেদানো শুরু হয়, তখন শাসকের প্রধান পন্থা ছিল ধর্ষণ। গোটা উপজাতির মনোবল ভেঙে দেওয়া হয়েছিল ধর্ষণের মাধ্যমে।
“বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে” (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
আজন্ম পরিবার, সমাজের দ্বারা প্রতিনিয়ত ধর্ষিতা হওয়ার পর এবং ইতিহাসের পাতাতেও রক্তের দাগ দেখার পর একসময় মেয়েরা নিজেকে সত্যিই মাংসপিণ্ড ভাবতে থাকে। তবু কোনও মেয়ে গর্জে ওঠে। তখন অপর একটি মহিলার থেকেই শুনতে হয়, “মেয়েদের অত কথা শোভা পায় না”, “রাত জেগে কাজ করার কী দরকার?”, “ওসব একটু সইতেই হয়”। বিচার? সত্যিই তামাশা। এবং পুরুষ ও সমাজের অধিকাংশ নারীই তারিয়ে-তারিয়ে তা উপভোগ করে।
পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রও এটাই চায়।
তথ্যসূত্র:
- ভট্টাচার্য, সুকুমারী। প্রাচীন ভারতে নারী ও সমাজ।
- শ্রীপান্থ। হারেম।
- শ্রীপান্থ। দেবদাসী।
- বসু, রাজশেখর। মহাভারত সারানুবাদ।
- Mallick, Aditi. ‘Sheikh Marriage’ Trafficking Ring Busted In Hyderabad, 20 Held’. TOI. Sep 20, 2017.
- Gourney, Cytheia & Sinclair, Stephany. Too Young to Wed. National Geographic.
- Pailoor, Anitha. 40 years after ban, Devadasis still shackled to system. Deccan Herald. Nov 9, 2023.
*মতামত ব্যক্তিগত
একেবারে সত্যি কথা লিখেছেন। ভারতের আধা-সামন্ত তান্ত্রিক, ধর্মীয় সমাজে মেয়েদের ভুমিকা প্রায় পণ্যের পর্যায়ে। আবার মেয়েরাই বেশি ধার্মিক – সেই শিকলে বাঁধা। ক’দিন বাদেই ‘শিবরাত্রি’ তখন ‘লিঙ্গপূজা’ হবে। সতিদাহে তে মেয়েরাই মেয়েদের আগুনে ঠেলে দিত। সেই ব্যবস্থার কি খুব বেশি পরিবর্তন হয়েছে? মনে পড়ছে মমতা প্রথম সরকারে আসার পর বা একটু আগে একটা ধর্ষণ হয়েছিল পার্ক স্ট্রীট অঞ্চলে। মমতা বলেছিল -মেয়েরা অত রাতে, ওই জায়গায় থাকে কেন? ( paraphrasing). ইহাই বাস্তব। আর-জি-কর আবার আসবে, আবার যাবে – পুরুষরা মজা লুটবে, আর মেয়েরা শিবরাত্রি করবে। ‘কী বিচিত্র এই দেশ, সেলুকাস।’