দেবজিৎ ভট্টাচার্য
এ উৎসব আসলে আন্দোলনৎসব। এতে প্রায় প্রত্যেক অংশের মানুষেরাই সামিল হয়েছেন, নিজেদের সাধ্যমতন করে। জুনিয়র ডাক্তারদের ডাকা কর্মসূচিগুলি সাড়া ফেলেছে শহর থেকে গ্রাম ও মফস্বলে। রাত নটায় টালির বাড়ি, পাড়ার মুদিখানার দোকানদারও আলো নিভিয়ে নতুন ভোরের সন্ধানে মুখর। অপরিণত অক্ষরের পোস্টারে বিচারের স্বর। রিকশাচালকেরা নতুন কায়দায় প্রতিবাদী মিছিল সাজিয়েছেন। মুটে-মজুরেরা জীবনে প্রথমবার মাইক হাতে নিজেদের গলার স্বর উঠিয়েছেন। শ্রমজীবী 'মা' সন্তানদের উদ্দেশ্যে নিজের লেখা প্রতিবাদী কবিতা পাঠ করে শোনাচ্ছেন। এ অধিকার তাঁদের কে দিতে পেরেছে, এই আন্দোলনৎসব ছাড়া। হিজাব পরা মেয়ে হিন্দু ছেলের পাশে দাঁড়িয়ে স্লোগান উঠিয়ে নারী-পুরুষের সমতা চাইছে। পোস্টারে লিখছে, 'ধর্ষণ অপরাধ নয়, নারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা'। এর চেয়ে বড় উপহার আমাদের সমাজকে আর কোন উৎসব দিতে পেরেছে?
বিপ্লবের থেকে বেশি ভয়ঙ্কর বিপ্লবের ভূত, শাসকের কাছে। এ ভূত শক্তিশালী। শুধু যে রাতে বেরোয় তা নয়; শাসককে দিনেও তাড়া করে বেড়ায়। বারংবার মনে করিয়ে দেয়, তার দোষ, অপরাধ, নির্মমতা। শাসকের কানে ক্ষণে ক্ষণে বলে যায়, এ আমাদের শাসক নয়। রাজ্যের মূখ্যমন্ত্রী মমতা এখন এই বিপ্লবের ভূতের তাড়া খেয়েছেন। পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, সমস্যার মূল জায়গা থেকে।
সম্প্রতি বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া চিত্রগুলি এখন মমতার চোখের সামনে ভাসছে। তাই তিনি প্রায় প্রতি ভাষণেই বাংলাদেশের স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের গণঅভ্যুত্থানের দ্বারা পতনের প্রসঙ্গ টানছেন। মমতার গরম আবার নরম দুইভাবে, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ‘উৎসবে ফিরে আসুন’ বলা আসলে বিপ্লবী-ভূতের তাড়া থেকে পালানোর চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশ্রয়প্রাপ্ত নেতারা তাঁর দেখানো পথে পালাতে গিয়ে সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ-মিছিলে আক্রমণ নামিয়ে আরও বেকায়দায়। তবে বাংলাদেশে কোনও প্রকারের বিপ্লব হয়নি। তারপরেও মমতা কেন সে-দেশের প্রসঙ্গ টানছেন? কারণ একটাই, জনরোষের চাপে পড়ে ক্ষমতা হারানোর ভয়। তেরো বছর ক্ষমতার চূড়ায় বসে এখন তাঁর কাছে উৎসবের মানে হয়ে দাঁড়িয়েছে, স্বৈরাচারীর কর্তৃত্ববাদী ‘রাজনৈতিক ক্ষমতা’। একে মমতার নিকৃষ্টমানের ক্ষমতোৎসব বলতে হয়। এ বিষয় বিলক্ষণ বুঝেছেন আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তারেরা। লাল কালিতে পোস্টার লিখেছেন, ‘কাঁদছে আমার বোনের শব, চাই না এমন নোংরা উৎসব’।
আরজিকরের নয় তারিখের মধ্যরাতে নারকীয় ঘটনা ও তার পরবর্তী সময়ে শাসকের রাজনৈতিক হিসেবনিকেশ বহুদিনের নিদ্রাচ্ছন্ন সমাজের চোখে বালতি ভরা জল ঢালবার স্বরূপ। এসবের বিরুদ্ধে এখন মধ্যরাতেই ন্যায় অধিকার আদায়ের লড়াই। এ যে শুধুই শাসক মমতার ক্ষমতার বিরুদ্ধে তাও নয়। বরং লড়াই শুরু হয়েছে, সমাজের পুরনো মতবাদের সঙ্গে নতুন মতবাদের, কালো রাতের পরে উদিত হওয়া নতুন আলোকিত ভোরের। কেমন হবে সে ভোর? এ প্রশ্নের উত্তরের খোঁজে নারী ও পুরুষের মধ্যেকার সামাজিক দ্বন্দ্বগুলি ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে। আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তারেরা খোলা আকাশের নিচে, গলার জোরে শাসককে জানিয়েছিলেন, এর পরের চিঠিতে স্যারে-র সঙ্গে ম্যাডাম-ও উল্লেখ করতে হবে। তাঁদের গলার জোর শাসকের কানে বারবার বিঁধছে, বৈষম্যকারী রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছেও ভয়ের বাতাবরণ সৃষ্টি করছে।
তাই জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনে নানা রাজনৈতিক ক্ষমতাধারীও ভয়ের মুখোমুখি। এই ভয়ের উল্টো পিঠে চড়ে বসেছে জনগণের জয়। এ লক্ষ্যে পৌঁছানোর আঁকাবাঁকা পথে গোটা বাংলা জুড়ে অকাল উৎসবের সূচনা।
গ্রামে-মফস্বলে যে মেয়েদের রাতে বেড়ানো অলিখিতভাবে নিষিদ্ধ ছিল, সেই মেয়েরাই গত ১৪ আগস্ট রাত থেকে মধ্যরাতে ন্যায্য অধিকারের আদায়ে রাস্তার দখল নিয়েছে। সাদা কাপড়ে মোটা দাগের লাল কালিতে লিখেছে, ‘নজরদারি নয় মুক্তি চাই, রক্ষা নয় অধিকার চাই’, ‘গুঁড়িয়ে দেব পিতৃতন্ত্র, ভেঙে যাবে রাষ্ট্রযন্ত্র’। এমনই সব বিচিত্রময় শব্দ বাক্যভরা স্লোগান। রাতের আলোয় রাস্তা দেখা, বন্ধুর সঙ্গে হাঁটতে পারা, নিজের মনের কথা চিৎকার করে বলতে পারা— এসব গ্রামবাংলার মেয়ের কাছে উৎসবের থেকে কম নয়। তাই বিগত তিরিশ দিন ধরে এক বাঁধ ভাঙা উচ্ছ্বাসে মেয়েরা রাতের বেলায় রাস্তায় নেমে প্রতিবাদী স্বর প্রসারিত করেছে। আট থেকে আশি প্রত্যেকেই চিৎকার করে বলছেন, ‘ইয়ে হক হামারি আজাদি’। রাতের রাস্তায় দুইপাশ জুড়ে মেয়েরা বিশাল-বিশাল মানববন্ধন গড়ে তুলছে, যা দেখে দুর্গাপুজোর অষ্টমীর মাঝরাতে প্যান্ডেলের লাইনের কথা মনে পড়ে যায়। জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন ও মেয়েদের লড়াইয়ের এই বিপুল জেদের বশেই শাসক ১৪ আগস্ট মধ্যরাত অবধি মেট্রো চালু রাখতে বাধ্য হয়েছে। এমনটা উৎসব ছাড়া আর কবে দেখা গেছে? এমনকি যাঁরা ভোটের সময় মেয়েদের ‘হাজার টাকার খোদ্দের’ বলে মশকরা করেছিলেন, তাঁরাও আজ লক্ষ্মীর আসনে জায়গা দিয়েছে বাংলার প্রতিবাদী মেয়েদের। পিছিয়ে পড়া প্রতিবাদী মেয়েরাই আজ চমৎকার সব স্লোগানে বাকিদের রাস্তায় ডাকছে। বলছে, ‘দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলে হবে, সঙ্গে এসো লড়তে হবে’। উৎসব তো এমনই হয়। সমাজকে নতুনের সন্ধান দেয়, সীমাবদ্ধতার গণ্ডি ভাঙে, রাজনৈতিক বোধবুদ্ধি বাড়ায়, ভবিষ্যতে শুভ পথের দিশা দেখায়।
এ উৎসব আসলে আন্দোলনৎসব। এতে প্রায় প্রত্যেক অংশের মানুষেরাই সামিল হয়েছেন, নিজেদের সাধ্যমতন করে। জুনিয়র ডাক্তারদের ডাকা কর্মসূচিগুলি সাড়া ফেলেছে, শহর থেকে গ্রাম ও মফস্বলে। রাত নটায় টালির বাড়ি, পাড়ার মুদিখানার দোকানদারও আলো নিভিয়ে নতুন ভোরের সন্ধানে মুখর। অপরিণত অক্ষরের পোস্টারে বিচারের স্বর। কাজে ফাঁকি দিয়ে রাস্তার পথসভায় মিশেছেন পাশের আবাসনে পাহারা দেওয়া বৃদ্ধ পাহারাদার। চটশিল্পে ‘গেট বাহির’ হওয়া আন্দোলনরত শ্রমিকেরা জানান, ‘আমাদের থেকে অনেক বেশি অসহায় সেই মা, যার কোল নিষ্ঠুরতার ফলে খালি হয়েছে।’ রিকশাচালকেরা নতুন কায়দায় প্রতিবাদী মিছিল সাজিয়েছেন। মুটে-মজুরেরা জীবনে প্রথমবার মাইক হাতে নিজেদের গলার স্বর উঠিয়েছেন। বেলঘরিয়ার অত্যাচারিত তরুণীর বাবা এয়ারপোর্ট এক নম্বরে মেয়েদের রাতদখলে অংশ নিয়ে জানান, ‘আজ যদি এই আন্দোলন না চলত তাহলে হয়তো আমার মেয়ের চিকিৎসাই হত না। চিকিৎসার এত টাকা কোথায় ছিল আমার কাছে?’ মেয়ের চিকিৎসার জন্যে প্রয়োজন ছয় লক্ষ টাকা। বাবা এই আন্দোলনের মধ্যে গিয়ে জোগাড় করছেন। সেই সময় শ্রমজীবী ‘মা’ সন্তানদের উদ্দেশ্যে নিজের লেখা প্রতিবাদী কবিতা পাঠ করে শোনাচ্ছেন। এ অধিকার তাঁদের কে দিতে পেরেছে, এই আন্দোলনৎসব ছাড়া। রাতের রাস্তা মেয়েদের দখলের ফলে ঘণ্টা খানেক দাঁড়িয়ে থাকা বাসচালকেরা জানান, ‘আমাদের ঘরেও বউ, মেয়ে রয়েছে, আমাদের সবার জন্যেই এই আন্দোলন প্রয়োজনীয়।’ সেই বাসের অফিসফেরত প্যাসেঞ্জারেরা বাস থেকে নেমে, অচেনা মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে মন খুলে বলছেন, ‘তোমার-আমার এক স্বর, জাস্টিস ফর আরজিকর’। ট্রেনের কামরার ভেতরে স্লোগান উঠেছে, নানা ধরনের প্রতিবাদী পোস্টারও পড়ছে। রাস্তা সেজেছে নতুন রঙে, ল্যাম্পপোস্ট আর দেওয়ালের গ্রাফিতি জুড়ে। তাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে, ধর্ষণ-সংস্কৃতি বিরোধী স্লোগান, ক্ষমতার দিকে তাক করে। হিজাব পরা মেয়ে হিন্দু ছেলের পাশে দাঁড়িয়ে স্লোগান উঠিয়ে নারী-পুরুষের সমতা চাইছে। পোস্টারে লিখছে, ‘ধর্ষণ অপরাধ নয়, নারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা’। এর চেয়ে বড় উপহার আমাদের সমাজকে আর কোন উৎসব দিতে পেরেছে?
আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তারেরা লালবাজার অভিযানে সারা রাত বসেছিলেন, তখন তাঁদের বিনা পয়সায় চা, বিস্কুট, কেক খাইয়েছেন পাশের মুসলমান দোকানদারেরা। সে ছবি সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এখন আন্দোলন স্বাস্থ্যভবনের কানের গোড়ায়। আন্দোলনকারীদের খাবার, জল আসছে বিভিন্ন জাত, ধর্মের মানুষের ঘর থেকে। আন্দোলনকারীরা সেই খাবার রাস্তার অসহায় ভুখা মানুষগুলির সঙ্গে ভাগ করে নেন। আন্দোলনৎসব ছাড়া মানুষের মধ্যে এমন স্বতঃস্ফূর্ত উপলব্ধি বোধ, ভালবাসা, লিঙ্গ-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের মিশে যাওয়া চিত্র ইতিহাসে বিরল। এর চেয়ে বড় উৎসব আর কীই বা হতে পারে?
দীর্ঘদিন বাদে কিংবা জীবনে প্রথম দেখা এমন জীবন্ত দৃশ্যগুলি সকলের আবেগ ছুঁয়ে যায়। মনে করিয়ে দেয় নানা রোমহর্ষক ঐতিহাসিক ঘটনা। ১৯৬৮ সালে মে মাসে প্যারিসের রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভাষণ দেওয়া মার্কসবাদী দার্শনিক আর্নেস্ট ম্যান্ডেলার কতগুলি কথা। “কী অপূর্ব, কী সুন্দর, বিপ্লব তাহলে এসেই গেছে।” তবে জুনিয়র ডাক্তারদের চলমান আন্দোলনের বস্তুনিষ্ঠতা সকলের আবেগের সামনেই লম্বা ব্যারিকেডও গড়ে তুলছে। শাসকশ্রেণির অতিরিক্ত আবেগনিষ্ঠ রাজনীতিতেও প্রত্যাঘাত করছে।
*মতামত ব্যক্তিগত