দেবসত্য কুমার

নো ম্যাচ ফাউন্ড

 

.

ইদানীং দীর্ঘশ্বাস জড়ো হয়ে
মেঘ হয়ে
উড়তেই থাকে।
উড়তেই থাকে।
শুধু উড়ে যাওয়া ছাড়া।
এই কিছুদিন হল,
সার্চ বোতামে টাইপ করে নিজেকে দেখি
নো ম্যাচ ফাউন্ড।

 

২.

অ্যাডমিট কার্ড

নামের ঠিক উল্টো দিকের
এগারো সেন্টিমিটার দূরে
কোনও একদিনের
আবছা আলোয় তোলা
চিবুক বসা তোমার ভেঙেচুরে যাওয়া মুখ, মাইনাস পাওয়ারের
চশমা,
গত আট বছর ধরে পড়ে আছে একাকী।
জন্মতারিখের বয়স বেড়েছে
ঠিক তার নিচে বাবার নাম
আজ স্বর্গীয় হয়ে গেছে
প্রতি বছর ঋতুর মতো হাতে আসা অ্যাডমিট কার্ড তা জানতেই পারল না।
শুধু সাত ডিজিটের রোলনম্বরগুলো
আট বছর ধরে নো ম্যাচ ফাউন্ড দেখিয়ে গেল।

 

৩.

প্রেমের সিলেবাস

আমি কেবল চিহ্নিত করেছি
চন্দ্রগুপ্তের সাফল্য।
শঙ্কিত হয়েছি
সায়রাবানুর মামলায়।
আর্টিকেল টুয়েন্টি ওয়ানে চোখ আটকে যাওয়াতে
বার বার হলুদ মার্কারে ঘষেছি।
এভাবেই বছর কেটে গেছে।
সেই পিঁড়ি আর নেই, মানুষটাও।
উইপোকা খেয়ে গেছে কয়েকটা আর্টিকেল।
দেয়ালে সাটা বৃদ্ধ দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ
ও আর্টিকেল থ্রি-সিক্সটি পাশাপাশি থেকে গেছে এখনও।

 

৪.

ইচ্ছে

চলে গিয়েও আবার ফিরে আসত
কতবার অন্ধকারে মুখোমুখি হয়েছি
‘লড়াই লড়াই লড়াই চাই’ বলে
সূচের মাথাটা
ফুটতে থাকত সারা গায়ে।
আজ ভোঁতা হয়ে আছে।
রানি রাসমণি রোড থেকে কলেজ স্ট্রিট হয়ে
যে ঘামের গন্ধ আজও
পুরনো শার্টে লেগে আছে।
তাকে কোনও সাবানেই ধোয়া গেল না।
শুধু সাদা ডানাকাটা পায়রার
কয়েকটি পাখা
থেকে গেল মনে।

 

৫.

মানিব্যাগ

প্যান, আধার, ভোটার কার্ডের ফাঁকে
তার উপস্থিতি জিতে যাওয়া জনপ্রতিনিধির মতো হলেও
কখনও কখনও
সামান্য খুচরো হয়ে আসে।
কয়েকদিন মনিব্যাগ আলো করে থাকে।
সেই কদিন
মুদির দোকানের সামনে মাথা নিচু করে এগিয়ে যাও
আরও সামনের দিকে।
বড় বড় শপিংমলের পাশ দিয়ে
ঘাড়ভাঙা পিঁপড়ের মতো হেঁটে চলে যাও বড় বাসস্ট্যান্ডের দৈনিক পেপার স্টলের দিকে।
অজস্র সুস্বাদু গন্ধ পাশ কেটে
‘দ্য হিন্দু’ নিয়ে ফেরো
দশ বাই দশের
পলেস্তারা চটে যাওয়া
অতিপরিচিত গুমোট ঘরে।
বাইরে তখন শহর দখল করে
বিয়াল্লিশ ডিগ্রি তাপমাত্রা।

 

৬.

পোস্টপন্ডস

সেই কবে,
লাঙল থেকে
সরে গেছে হাত।
উঠোনের মাঝে মায়ের যত্ন করে আলপনায় আঁকা লক্ষ্মীর পায়ে কোনও সবুজ ধান
এসে বসে না আর।
নবান্নের কাকও ব্যাজার মুখে
উড়ে যায় অন্য বাড়িতে
ঘরের শোকেসে যত্নে রাখা কবিতার বইগুলোর
আজ পর্যন্ত কোনও শুনানি হল না।

 

৭.

এমসিকিউ

নিমের মতো তেতো
অজস্র প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েও বরাবর এগিয়ে গেছি সামনে।
চাষিবাবা, অক্ষরহীন পুঁইশাকের মতো
লতপতে মা আর রাজমিস্ত্রি দাদার
কোনো প্রশ্ন আজ অবধি অ্যাটেন্ড করিনি।
কোচিংয়ের দাদা ব্লাইন্ড গেস করতে মানা  করেছি
তবু বাবা, মা, দাদার এমসিকিউ কোশ্চেনে এসে
কলম থেমেছে বহুবার।
আজও থামে।
শুধু নেগেটিভের ভয়ে,
পরের প্রশ্নে এগিয়ে গেছি

 

৮.

কাট অফ

কয়েকটা অ্যাটেম্পট পার হয়ে
এখন মোটামুটি
সিক্সটি পার্সেন্ট বাইরের মিথ্যা,
ফর্টি পার্সেন্ট ভিতরের ক্রোধ আর রাগের সিলেবাসকে রিভাইজ করা হয়ে গেছে বহুবার।
তবু কারেন্ট অ্যাফেয়ার্সে আসা
সিরিয়া, ইউক্রেনের যুদ্ধ, প্যালেস্তাইনে শিশুর মৃত্যু একবার দেখে যাওয়া ভালো।
গতবারের প্রশ্নপত্রে দুটা রাগ, একটা ভালোবাসাকে স্কিপ করেছিলাম বলে
জীবনের কাট অফ থেকে সামান্য দূরে এসে দাঁড়িয়ে।

 

৯.

পিতাপুত্রের অঙ্ক

পিতা-পুত্র অঙ্কের জটিলতা
না কাটতেই
বাজারের খালি ব্যাগ হাতে
সামনে দাঁড়িয়ে থাকে বাবা।
আমি কিছু সময় চেয়েছিলাম একা লড়ার, আকাশে ওড়ার।
কতবার বলেছি বাবাকে,
ঠিক একদিন সরল সুদে,
সব ঋণ শোধ করে দেব
কিন্তু,
সময় দূরত্ব একই বেঞ্চের দুজন মেধাবী ছাত্র।
এটা জানতেই অনেকটা সময় লেগে গেল আমার।

 

১০.

জব কার্ড

জব কার্ডের আইডেন্টিটিতে
আমার মুখ অস্পষ্ট হয়নি বলে,
এখনও কিছু সুযোগ
ঘরের দেয়ালে দেয়ালে
বিভিন্ন রঙের প্রতীকে
কেন্নোর মতো উঠে আসে।
এযাবৎ কোনও রঙে
হাত লাগাইনি বলে
কিছুতেই কিছু হল না আমাদের।
শুধু প্যাডে প্যাডে বাবার টিপছাপ
আমার সই পড়ে থাকল
ব্লক অফিসের
অন্ধকার ঘরের
কোনও এক ডাস্টবিনে।

 

১১.

মশারি

পৃথিবীর কোনও দেশ
দেখা হয়নি এখনও,
ছোটবেলা থেকে
একটি মশারির দেশ দেখেছি শুধু।
বাবা-মার খুব পছন্দের
সে দেশে কোনও সীমানা নেই।
সীমানাহীন সে দেশে
আমাদের ছোট ছোট দ্বন্দ্বগুলোকে
মা সাদা কালো ছোট ছোট
ভালোবাসার সুতোয়
প্রতিরাতে সেলাই করে রাখে।
চারটি পেরেকের মাঝে
আজও সেই দেশ অটুট হয়ে আছে।

 

১২.

অর্ধেক

একটা অর্ধেক জানালা
কতটা হাহুতাশ,
কতটা বিপজ্জনক।
তুমি গোটা জানালা
না খুললে
কোনওদিন বুঝতেই পারতে না।

 

১৩.

জেদ

কতশত কথা থেকে গেল
দু-মলাটের বাইরে।
সন্ধ্যাপ্রদীপের মধ্যে পড়ে থাকা
যে আধপোড়া সলতে
তার কথাও বলেনি কেউ কোনওদিন,
কুড়ি টাকায় কেনা
মায়ের হোমোপ্যাথির শিশিতে
সেরে না ওঠা
যে ক্রনিক অসুখ
তার কথাও বলা নেই কোথাও।
বারবার মাংসের আবদারকে সয়াবিনের ঝোলে মিটিয়ে দেওয়া বাবার কথাগুলোও থেকে গেল।
আর থেকে গেল রান্নাঘরের জং ধরা সেই নিরামিষ বটিটার কথাও।
এভাবেই কত কথা থেকে গেল
পৃষ্ঠার বাইরে

 

১৪.

কুয়াশা

নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেব বলেই
যৌথ থেকে একাকী হয়েছি।
দেখেছি,
একাকী সাপের মতো ছোবল দেয় অহরহ।
সমস্ত আলো জ্বালিয়েও
খুব অন্ধকার লাগে নিজেকে।
ফের,
নিজের সিদ্ধান্তটি নিতে না পারার জন্য
অন্ধকার থেকে আলোর দিকে
এগিয়ে এলাম,
যৌথ হলাম।
দেখি সেখানেও আলো নেই, অন্ধকার নেই।
শুধুই কুয়াশা

 

১৫.

অপারগ

ঈশ্বর আছেন,
এবং তিনিই সব পারেন
অনেককেই বলতে শুনেছি।
তাই ছোট্টবেলা থেকেই
স্কেল, কম্পাস দিয়ে
ষাট, নব্বই কখনও বা পুরো একশো আশি ডিগ্রি কোণে
মেপে মেপে কাছে যাওয়ার চেষ্টা
কখনও বৃত্তে কিংবা আয়তক্ষেত্রে
মাঝে মাঝে ত্রিভুজের মধ্যমার মতো নিজেকে
দু-খণ্ড করেছি অনেকবার
তবু পাইনি।
ঈশ্বর আছেন,
এই অসত্য মেনেই
এখনও বেঁচে আছি।
একটা বিশ্বাস জন্মে গেছে
আমার মতোই
ঈশ্বরও সব পারেন না।

 

১৬.

নিরুদ্দেশ

মাটির উঠোনে বসেছিল
দুটো পাখি।
ঠিক যেন মা-বাবার মতো
নাকি দাদু-ঠাম্মির?
নাকি পূর্বপুরুষের কেউ
জানা নেই।
সারা উঠোন জুড়ে
ঠোঁটের আগায়
ভালোবাসা খুঁজে খুঁজে
চোখে জল নিয়ে
কাউকে কিছু না বলে
হঠাৎ আবার উড়ে চলে গেল।

এভাবেই একদিন
সব শূন্য রেখে
আমার পূর্বপুরুষেরা
নিরুদ্দেশ হয়েছিল।

 

১৭.

শান্তি

মা বলেছিল,
নিকোনো গোবরে
বাড়িতে শান্তি থাকে
মাকে, জিজ্ঞেস করা হয়নি
কবরেও কি একই শান্তি থাকে?

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5044 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...