‘নামে কী আসে যায়?’

মৌমিতা আলম

 



ভারতে একজন মুসলিম হয়ে বেঁচে থাকাটা আজ এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। আমরা আমাদের নামের বোঝা প্রতিনিয়ত বয়ে চলেছি

 

 

 

উইলিয়াম শেক্সপিয়ার একবার বলেছিলেন, “নামে কী আসে যায়? আমরা গোলাপকে যে-নামেই ডাকি না কেন, তার গন্ধ ঠিক একইরকম থাকবে।”

কিন্তু রোমিও জুলিয়েট-এর এই বিখ্যাত উক্তিটি সত্ত্বেও আমি যদি এই প্রশ্নের মুখোমুখি হই, তাহলে আমার উত্তর হবে— নামে সবকিছুই যায় আসে!

আমার নামই ঠিক করে দেবে আমি বাড়ি ফিরে আসতে পারব, না কি আকলাখ বা জুনায়েদের মতো আমার ভাগ্য হবে;[1] আমি বিনামূল্যে রেশন পাব কিনা; কিংবা পাসপোর্ট যাচাই অফিসে আমাকে ‘বাংলাদেশি’ বলে সন্দেহ করা হবে কিনা।

আমার জন্ম ১৯৮৭ সালে। আমাকে নাম দেওয়া হয় মৌমিতা— একটি সাধারণ বাঙালি হিন্দু নাম। আমার সমসাময়িক অনেক কাজিনের নামও ছিল ঠিক এরকম— টনি, জিমি, স্বপন, বাবলু, মিতা ইত্যাদি। সবই সাধারণ বাঙালি নাম।

সে-সময় বাবরি মসজিদ ধ্বংস হয়নি, দেশে উদারীকরণও (লিবরালাইজেশন) আসেনি। পশ্চিমবঙ্গে তখন বাম সরকার ক্ষমতায় ছিল, আমাদের বাবা-মায়েরা ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী। আমি কখনও দেখিনি কোনও মৌলবী এসে আমাদের পরিবারের নবজাতকের নাম ঠিক করছেন।

 

বাবরি-পরবর্তী আতঙ্ক এবং মুসলিম সমাজের গভীর ত্রাস

আমার মা-বাবার সময়েও আমাদের অনেক আত্মীয়ার নাম মীরা, মিনা, রিনা, হিনা ইত্যাদি ছিল। কিন্তু নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে পরিবর্তন আসতে শুরু করে। তখন আমাদের সম্প্রদায়ের অনেককে বলতে শুনতাম, “একজন মুসলিমের উচিত ‘শুদ্ধ মুসলিম নাম’ রাখা, কারণ তা না হলে জান্নাতে জায়গা পাওয়া কঠিন হবে।” আর এ সময় থেকেই পশ্চিমবঙ্গের গ্রামগুলোতে তাবলিগি জামাতের উত্থান ঘটে।

 

৯/১১-এর পর থেকে আমরা প্রথমবারের মতো “তালিবান” শব্দটির সঙ্গে পরিচিত হই।

বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরবর্তী মানসিক আঘাত মুসলিম সমাজকে নিরাপত্তাহীনতার এক গভীর সঙ্কটে ঠেলে দেয়। যদিও সেই ঘটনার সময়ে বা পরে পশ্চিমবঙ্গে বড় ধরনের কোনও দাঙ্গা হয়নি, কিন্তু সেই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় মুসলমানরা নিজেদের জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয় খুঁজতে থাকে। তাবলিগি জামাতের মতো রক্ষণশীল গোষ্ঠীগুলো তখন মুসলিমদের মধ্যে ঐক্যের অনুভূতি এবং নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে থাকে।

বাঙালি মুসলমানরা বরাবরই পীরভক্তি-নির্ভর— যে সংস্কৃতি অনেক বেশি বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং বহুত্ববাদী— সেই তারাই এবার আস্তে আস্তে জামাত-এর মতো আরও রক্ষণশীল মতাদর্শের দিকে ঝুঁকে পড়ে।

নাম অনেক সময় বইয়ের মলাটের মতো— যা দেখে অনেকে বিষয়বস্তু সম্পর্কে ধারণা করে নেয়। ফলে আমার ক্ষেত্রেও এটি সুবিধা-অসুবিধা দুইই ডেকে এনেছে। কলেজে পড়ার সময় আমার নাম আমাকে থাকার জায়গা পেতে সাহায্য করেছিল। ভারতের অন্যান্য শহরের মতো, পশ্চিমবঙ্গের জেলাশহরগুলোতে বা প্রতিবেশী আসামেও মুসলমানদের জন্য বাড়ি ভাড়া পাওয়া কঠিন। আসামেই আমি আমার ব্যাচেলর অব এডুকেশন (B.Ed) সম্পূর্ণ করতে গিয়েছিলাম।

আমার নামের জোরেই আমি তখন থকার জায়গা পেয়ে গেছিলাম! মালিক আমার নাম দেখে সন্তুষ্ট হয়ে ঘর ভাড়া দিয়েছিলেন। ভাগ্যক্রমে, তিনি আমার পদবি জানতে চাননি! যখন জানতে পারলেন, তখন আমার কোর্স প্রায় শেষ হয়ে এসেছে।

কিন্তু আমার নামই আবার আমার শ্বশুরবাড়ির কৌতূহল এবং সন্দেহের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাঁরা প্রশ্ন করতে শুরু করলেন—আমার নাম কেন আরবি, ফারসি বা উর্দু নয়? তাঁদের মনে হল আমার পরিবারের সদস্যরা নিশ্চয়ই “যথেষ্ট মুসলমান” নয়!

 

শেক্সপিয়ার ভাগ্যবান, মোদির যুগে জন্মাননি

২০১৪ সালে মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিষয়টি বদলে গেল। এখন আমার প্রথম নাম নয়, আমার পদবি— “আলম”— আমাকে সংজ্ঞায়িত করে। এখন আমি শুধুই একজন মুসলিম, যাকে যে-কোনও অজুহাতে পিটিয়ে মারা যেতে পারে।

ভাগ্য ভালো, শেক্সপিয়ার মোদির যুগে জন্মাননি। নাহলে তিনি “নামে কী আসে যায়?” কখনওই লিখতে পারতেন না!

এ-যুগে আধার কার্ড থার্ড রাইখের সময়কার ইহুদি পরিচয়পত্রের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদি আপনার আধার না থাকে, কিংবা তাতে কিছু ভুল থেকে যায়, তবে যাবতীয় হয়রানি আপনার জন্য অপেক্ষা করে আছে। এমনকি আপনি ডিজিটালি অস্তিত্বহীনও হয়ে পড়তে পারেন।

আমি একটি সরকারি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করি, যেখানে আমার ছাত্র-ছাত্রীরা প্রান্তিক সমাজ থেকে উঠে আসা প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থী। এদের নামের বানানে ভুল থাকা অতি সাধারণ ঘটনা।

নামের ভুলের সঙ্গে কি একজন মানুষের শ্রেণি, জাত এবং লিঙ্গ-পরিচয়ের কোনও সম্পর্ক আছে? হ্যাঁ, অবশ্যই আছে।

আমার অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রী তাদের দাদা-দাদির সঙ্গে থাকে। তাদের মা-বাবা শহরে গিয়ে শ্রমিকের কাজ করেন, কেউ কেউ সন্তানদের কিছুদিনের জন্য সঙ্গে নিয়ে যান, তারপর আবার দাদা-দাদির কাছে রেখে যান। এই আসা-যাওয়ার মধ্যে কাগজপত্র হারিয়ে ফেলার ঘটনা হরহামেশাই ঘটে।

যাদের কাছে পরের দিনের খাবারের কোনও নিশ্চয়তা নেই, তাদের পক্ষে কাগজপত্র সংরক্ষণ করা সত্যিই দুরূহ।

দাদা-দাদিরা স্কুলে নাতি-নাতনিদের আধার কার্ড করাতে নিয়ে যান এবং স্থানীয় উচ্চারণে নাম উচ্চারণ করেন, যা অফিসারেরা বুঝতে পারেন না। ফলে নামের বানানে ভুল থেকে যায়। আমি একজনেরই তিনটে আলাদা ডকুমেন্টে তিনটে আলাদা নাম দেখেছি। ফলে অফিসিয়ালদের শ্রুত শব্দ এবং তাঁদের মনোযোগের ওপর নির্ভর করে সুমাইয়া কখনও “ছুমাইয়া” হয়ে যায়, কখনও বা হয়ে যায় “চুমাইয়া”।

আমার প্রথম চাকরি মুর্শিদাবাদ জেলায়। এখানে মুসলিমরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। আমার বেশিরভাগ সহকর্মীই মনে করত বিয়ের পর আমি মুসলিম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছি। একজন মুসলিম মেয়ের নাম যে মৌমিতা হতে পারে সে তারা ভাবতেই পারত না।

২০১৯-২০ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA) এবং জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (NRC) বিরোধী আন্দোলনের সময় আমি আমার ঠিকানা সংশোধন করাতে চেয়েছিলাম, কারণ আমি তখন ডিভোর্সের পরে একা থাকছিলাম। আধার সংশোধন কেন্দ্রে গিয়ে আমি আতঙ্কিত হয়ে পড়লাম— এক তো সেখানে দীর্ঘ লাইন, এবং দেখলাম লাইনে দাঁড়ানো অধিকাংশই বিবাহিত নারী। তাঁদের সবার নাম সংশোধন করাতে হবে, কারণ, বিয়ের আগে তাঁদের যা-ই পদবি থাকুক বিয়ের পর হয় তাঁদের পরিবার, নয়তো সরকারি অফিসার, সেই পদবিটি বদলে “বিবি” করে দিয়েছে।

এটাই তো এক ধরনের সহিংসতা— একজন নারীর নাম মুছে ফেলে সে যে কেবল তার স্বামীর সম্পত্তি সেই স্ট্যাম্প লাগিয়ে দেওয়া!

 

ফেব্রুয়ারি ২০২১। আমি ট্রেনে করে মুর্শিদাবাদ যাচ্ছিলাম। আশপাশের সহযাত্রীরা এখন খুব সাধারণ হয়ে ওঠা মুসলিম-বিরোধী গালগল্পে ব্যস্ত। আমি দম চেপে বসে আছি— তারা যেন আমার পরিচয় না জানতে পারে! আমি বেশ সন্ত্রস্ত তখন।

ঠিক তখনই টিকেট চেকার এলেন। আমার শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল। আমিও কি আকলাখ বা জুনায়েদ বা তাদের মতো অন্য আরও লিঞ্চিং-এর শিকারদের ভাগ্য বরণ করতে যাচ্ছি?

আমি তাড়াতাড়ি শুধু আমার প্রথম নাম বললাম এবং মোবাইলে টিকেট দেখালাম— যেন তিনি আমার পুরো নাম না উচ্চারণ করেন। বেঁচে গেলাম।

ভারতে একজন মুসলিম হয়ে বেঁচে থাকাটা আজ এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। আমরা আমাদের নামের বোঝা প্রতিনিয়ত বয়ে চলেছি।

শুনতে পাচ্ছেন, শেক্সপিয়ার?

 


[1] Apoorvanand. Junaid’s Lynching and the Making of a ‘New India’ Beyond Recognition. The Wire. Jun 22, 2018.


*মৌমিতা আলম কবি। তাঁর এই নিবন্ধটি দ্য ওয়ার-এ গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5044 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

আপনার মতামত...