
শুভ প্রতিম
২০২৫ সালে রামনবমীর শোভাযাত্রা নিয়ে একটি সমীক্ষা চালাচ্ছে ‘আমরা এক সচেতন প্রয়াস’। রাজ্যের ১২টি জায়গায় এই সমীক্ষার মাধ্যমে সমাজমনে শোভাযাত্রাটির প্রভাব জানার চেষ্টা করা হচ্ছে। বিশদ রিপোর্ট পরে প্রকাশিত হবে। ২০২৫ সালে ওয়াকফ আইন নিয়ে প্রতিবাদ আন্দোলন এবং কয়েকটি জায়গায় হিংসার ঘটনা আমরা দেখেছি। সে-নিয়েও আমাদের তথ্য অনুসন্ধান চলছে। এই লেখায় আপাতত শুধুমাত্র হুগলির চাঁপদানির প্রসঙ্গ তুলে ধরা হল। গত ১১ এপ্রিল এখানে যে সংঘর্ষ হয়, তার ‘অন দ্য স্পট’ অভিজ্ঞতার কিছু বয়ান এখানে উপস্থাপিত হল। পাশাপাশি ‘আমরা এক সচেতন প্রয়াস’-এর সামগ্রিক প্রেক্ষিতের ওপর একটি পর্যবেক্ষণও রাখা হল।
সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে, শোনো শোনো পিতা
জিটি রোড থেকে পলতাঘাটের দিকে ঢোকার মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। সামান্য ঝুঁকে, লাঠিতে ভর দিয়ে। তাঁর পাশ দিয়েই যাচ্ছিল মুসলিম জনতার কাতার। ঘাটের দিকে চাঁপদানি ফাঁড়ি তাঁদের গন্তব্য।
গত বুধবার রামনবমীর মিছিল থেকে জিটি রোড-সংলগ্ন মসজিদের উদ্দেশ্যে কটূক্তি করা হয়েছিল। তারপর থেকেই এলাকা উত্তপ্ত। ১১ এপ্রিল, শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর এলাকার কয়েকটি মসজিদ থেকে আহ্বান জানানো হয়— পুলিশের কাছে গিয়ে প্রতিবাদ জানাতে হবে। পুলিশের আচরণ আক্রমণাত্মক ছিল, না মিছিলের আচরণ তা আজকের ‘ভিডিও ভাইরাল’-এর যুগে আর তর্কের অবকাশ রাখে না, বরং বিতর্কের জন্ম দেয়। সোশাল মিডিয়ার রমরমার এই সময়ে পুলিশের কাছে আর কিছুই অজ্ঞাত থাকে না।
তাহলে কেন রামনবমীর মিছিল থেকে মসজিদ তথা মুসলিমদের উদ্দেশে গালিগালাজ করার জন্য দায়ী অভিযুক্তদের গ্রেফতার করা গেল না? কেন মসজিদ থেকে আসা মিছিল যে আক্রমণাত্মক হতে পারে, তার খবর রাখল না পুলিশ?
আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা বলে, কোনও একটি গোষ্ঠীর হিংসা বা আক্রমণাত্মক আচরণের পর অন্য গোষ্ঠীকে একই ‘কাজ’ করতে দেওয়ার প্রশাসনিক ‘ব্যবস্থাপনা’-র ইতিহাস আছে এই রাজ্যে। ২০২১-এ তেলেনিপাড়ায় মুসলিমদের উগ্র আচরণের দু-দিন পরে হিন্দুত্ববাদীদের মিছিল করার অনুমতি দেওয়া হয়। সেই মিছিল থেকেই আক্রমণ করা হয় লেবার লাইনের মুসলিম ঘরগুলি, আক্রান্ত হয় জিটি রোডের সত্যপীরের মাজার, ইত্যাদি।[1] এ যেন শোধবোধের খেলা!
চাঁপদানির বিএম রোডে অশান্তি হয়েছে সবচেয়ে বেশি। জিটি রোড থেকে ভিতরে ঢুকতেই মসজিদের সামনে কয়েকজন যুবক। মসজিদের সামনে পুলিশ বসে আছে, পাহারারত। মসজিদের পিছনের রাস্তায় কথা হয় বছর সত্তরের আসলাম আনসারি (নাম পরিবর্তিত)-র সঙ্গে। সদ্য ঘটে যাওয়া হিংসা পরিস্থিতির জন্য প্রথমে সাবলীল হতে পারছিলেন না। পরে কথা হয়।
আমিও গিয়েছিলাম নামাজে। কিন্তু ইমাম সাহেব যখন পুলিশের কাছে যাওয়ার কথা বললেন, আমি দ্বিমত করি। বিভিন্ন জায়গা থেকে আজ এসেছিলেন নামাজিরা। আমার কথা ছিল, যদি পুলিশের কাছে অভিযোগ জানাতে হয়, তাহলে কয়েকজন গেলেই হয়। সবাই মিলে যাওয়ার কী আছে?
তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়— গণ্ডগোল কি বাইরের লোকেরা করে? বৃদ্ধ জানান, শুধু বাইরের লোক বললে ভুল হবে। তবে এঙ্গাস আর তেলেনিপাড়া থেকে লোকজন এসেছিল। কী দাবি ছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, রামনবমীর দিনে যে গালিগালাজ দেওয়া হয়েছে, তার বিহিত করতে হবে। কেন কাউকে গ্রেফতার করা হল না— এইসব।
এরপর এই প্রতিবেদক পলতাঘাটে নৌকো চেপে ওপারে সহযাত্রী হয় এক মুসলিম পরিবারের। কিছু কথা হয়, যা বিস্তারে পরে প্রকাশ করা হবে। মহিলা ছিলেন দুজন— শাশুড়ি ও পুত্রবধূ। ওঁদের সঙ্গে কথা হয় পলতা স্টেশনে। আসলাম আনসারির সঙ্গে কথোপকথনের সময় তাঁরা যাচ্ছিলেন ঘাটের দিকে। যাওয়ার সময় সালাম বিনিময় হয়েছিল।
আসলে তাঁরা পালিয়ে যাচ্ছিলেন। বৃদ্ধার মেয়ের বাড়ি, নৈহাটির হাজিনগর। বৃদ্ধা ও তাঁর পুত্রবধুর চোখেমুখে ছিল উদ্বেগ, অনিশ্চয়তা। দুপুরের জমায়েতে তাঁর ছেলেও গিয়েছিল। যদি পুলিশ ঝামেলা করে! যদি হিন্দুরা বদলা নেয়! হিন্দুদের দোকান কারা ভাঙচুর করেছিল জানতে চাইলে বছর চব্বিশের যুবকটি নির্বাক থাকেন। জিজ্ঞেস করি, বদলা যদি হয়, শুধু আপনার বিরুদ্ধেই কেন হবে— অন্যরাও তো ছিল? উত্তরে জানা গেল, এর মধ্যে কয়েকজন এলাকা ছেড়েছে। তখনই বোঝা গেল উদ্বেগের কারণ।
১১ এপ্রিল অশান্তির ঘণ্টাখানেক পর পলতাঘাট যাওয়ার পথে এক মন্দিরের সামনে কয়েকজন হিন্দু যুবকের সঙ্গে দেখা হয়। তাদের সংলাপে ছিল প্রবল আক্রমণাত্মক সুর। তখন অনেকেই ঘাটের দিকে যাচ্ছিলেন নৌকা ধরতে— ওপারে পলতা, সেখানেই তাঁদের গন্তব্য। যাত্রীদের মধ্যে মুসলিম পরিবারও ছিল। কিন্তু যুবকেরা তাঁদের ভ্রূক্ষেপ করছিল না। তাদের ঔদ্ধত্যপূর্ণ শারীরিক ভাষায় স্পষ্ট হয়ে উঠছিল, এলাকা কার ‘দখলে’। অনতিদূরেই পুলিশের ভ্যান দাঁড়িয়েছিল, পুলিশ সদস্যরাও সেসব কথাবার্তা শুনছিলেন।
তারা বলছিল, দুপুরে একদল মুসলিম আসে পুলিশ ফাঁড়িতে। ফাঁড়িতে কিছু বচসা হয়ে থাকবে, তারপর ওরা আমাদের দোকানে ভাঙচুর করে। আমরাও পাল্টা দিই। “আমরা এখানে কম আছি কি?”— প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে চ্যালেঞ্জ ছিল তাদের কণ্ঠস্বরে। “কিছু করতে আসুক না আমাদের এই পলতাঘাটে, কাউকে ছেড়ে দেব না। পুলিশ তো ওদের দিকে। মমতার পুলিশ যে!”
অর্থাৎ সেই এক অভিযোগ বা চাপানউতোর— বসিরহাট থেকে আসানসোল, ভাটপাড়া থেকে বেথুয়া— যা আমরা প্রত্যক্ষ করে চলেছি বিভিন্ন দাঙ্গা-উপদ্রুত এলাকায়। ‘তৃণমূল’ মানে মুসলিম আর ‘বিজেপি’ মানে হিন্দু— এই ন্যারেটিভ। দুই সম্প্রদায়ের যুবক, বলা উচিত সদ্য-যুবক, শ্রেণির হিংসায় নামা। ২০২০-উত্তর সময়ের নতুন বাস্তবতা, বলা যায় নতুন ন্যারেটিভের অপেক্ষা।
বিগত কয়েক বছর ধরে বাংলার মুসলিম জনতার উগ্রতা নজরে এসেছে। সুদূর উত্তরপ্রদেশে নবিকে গালিগালাজ করার আক্রোশ দেখা যায় মালদহের কালিয়াচকে।[2] প্রায় একই কারণে নদিয়ার বেথুয়াডহরিতে লোকাল ট্রেন আক্রমণ, জাতীয় সড়কে হিন্দুদের দোকান আক্রমণ করা হয় ২০২২ সালের জুন মাসে। এরপর আরএসএস মাঠে নামে, আক্রান্ত হয় মুসলিম বাড়ি, গ্রাম। এই একই সময়ে হাওড়ার পাঁচলায় মুসলিমদের মিছিল থেকে আক্রমণ করা হয় বহু দোকান।
মুসলিম সমাজের বহু স্বরকে এক স্বরে নিয়ে আসার জোরজবরদস্তি বেড়েছে এই সময়ে। মুর্শিদাবাদের হুলাসপুর, রেজিনগরের ঘটনা আমরা দেখেছি। এগুলি ছিল শরিয়তি ইসলামের নামে মাজার, দরবার, খানকা শরীফ আক্রমণের একাধিক নজির।[3]
যুযুধান সাম্প্রদায়িকতার এই বাংলার সাম্প্রতিক সংযোজন ওয়াকফ নিয়ে হিংসা। কেন্দ্র সরকারের সংবিধান-বিরোধী ওয়াকফ আইনের বিরুদ্ধে যৌক্তিক আন্দোলনকে সাবোতাজ বা নাশকতা করে দাঙ্গা করা।
ফিরে আসি সামান্য ঝুঁকে লাঠিতে ভর করে দাঁড়িয়ে থাকা বৃদ্ধের কাছে। প্রতি বছর ২ অক্টোবর প্রচুর মালা চাপানো হয় তাঁর মূর্তিতে। তৃণমূল, বিজেপি কেউ বাদ যায় না। দাঙ্গাবাজ, দাঙ্গাপীড়িত কেউ না। বৃদ্ধ সম্ভবত আরও একটু ঝুঁকে যান। তাঁর শেষ উচ্চারণ আর দাঙ্গাবাজের উল্লাসে রাম আছে, কিন্তু দুই রামে ফারাক যে বিস্তর!
রামনবমীর মিছিলের সামনে ছিলেন শ্রীরামপুরের সাংসদ কল্যাণ ব্যানার্জি। এমনই বিভিন্ন মিছিলে থাকেন কখনও বিধায়ক, কখনও পুরসভার চেয়ারম্যান। সম্ভবত ‘হিন্দুত্ব’ কারও একচেটিয়া নয়— এই প্রতীতি থেকে বা কৌশল থেকে। কিন্তু পাগলা ঘোড়ায় চাপলে ঘোড়াকে বাগে আনা যায় না, বরং ঘোড়া এক ঝটকায় ফেলে দেয় ঘোড়সওয়ারকে।
২০২৫-এর চাঁপদানি হোক বা ২০১৮-র আসানসোল, কল্যাণ ব্যানার্জির হোক বা মলয় ঘটকের, পাগলা ঘোড়ার লণ্ডভণ্ড চলছেই।
সমাজে রাজনৈতিক ধর্মের বাড়ন্ত প্রভাব
হুগলি জেলার চটকল এলাকায় হোক বা সারা রাজ্যে— রাজনৈতিক ধর্মের প্রভাব অতি দ্রুততার সঙ্গে ক্রমশ বেড়েই চলেছে।
হুগলি জেলার শ্রীরামপুর এবং হুগলি লোকসভা এলাকা মূলত শহর এলাকা। একই সঙ্গে, এটি শতাব্দীপ্রাচীন শিল্পাঞ্চলও। একদা চটকল, কেমিক্যাল কারখানা, মোটরগাড়ি শিল্প-সহ একাধিক বৃহৎ ও মাঝারি শিল্পের খাসতালুক ছিল এই জেলা।
স্বাধীনতার আগে থেকেই উত্তরপ্রদেশ, অবিভক্ত বিহার, ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে শ্রমিকরা এখানে এসেছেন। তাঁদের বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নিজ নিজ ধর্মীয় ও ভাষিক সংস্কৃতি এলাকাগুলিকে সমৃদ্ধ করেছিল বহু রঙে। কিন্তু ৯২-উত্তর পর্বে এখানেও মানুষের মধ্যে একমুখী ধর্মীয় সংস্কৃতির প্রাবল্য লক্ষ্য করা গেছে। রামকে ঘিরে যে রাজনীতি হিন্দি বলয়ে বিজেপির সিংহাসন লাভ নিশ্চিত করেছে, সেই কৌশলেই পূর্বভারতে নজর দিয়েছে তারা।
আমার অভিজ্ঞতায় আমি দেখেছি, অবিভক্ত বিহারে ‘রামমন্দির আন্দোলন’ হিন্দুত্বের সামাজিক নির্মাণ দৃঢ় করছে, মণ্ডল রাজনীতির বিরোধিতা সত্ত্বেও। ঝাড়খণ্ড আন্দোলন এবং পরবর্তীতে বিহার বিভাজন পর্বে সঙ্ঘ পরিবার নিজেদের আদিবাসী আবেগের সঙ্গে সংঘাতে যায়নি, উল্টে বনাঞ্চল সম্পর্কিত দাবি-সহ বিভিন্নভাবে প্রাসঙ্গিক থেকেছে ঝাড়খণ্ডে। নতুন রাজ্যের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী তাদেরই। যদিও আদ্যোপান্ত মনুবাদী চিন্তাধারায় শিক্ষিত ও প্রভাবিত এই সঙ্ঘ-রাজনীতি নীতিগতভাবেই আদিবাসী বা দলিত অধিকার ও অস্মিতার বিরোধী।
পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম সীমান্ত জুড়ে বিহার এবং ঝাড়খণ্ড অবস্থিত। স্বাভাবিক কারণে জনবিন্যাস এবং জনসংস্কৃতিতে বিহারের বিভিন্ন জনগোষ্ঠী, ঝাড়খণ্ডের আদিবাসী গোষ্ঠীর উপস্থিতি স্পষ্টভাবে দেখা যায় এই বঙ্গে। হুগলি জেলায় হিন্দি ও উর্দু ভাষাভাষী মানুষের আগমন মূলত শিল্পাঞ্চলে সস্তা শ্রমের চাহিদা এবং সরবরাহ নীতির কারণে। হিন্দি বলয়ে হিন্দুত্বের সামাজিকীকরণের একটি প্রতিফলন হিসেবে এই অঞ্চলেও হিন্দুত্বের হালখাতার প্রেক্ষিত হিসেবে দেখা যেতে পারে।
হিন্দুত্ব প্রকল্প
তবে ২০১৬ সাল থেকে সঙ্ঘের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার বাস্তব রূপ কিছু নজরে এসেছে। রামনবমীর মিছিলে বাঙালির আইকনদের রাখা, কিছু স্থানে শঙ্খধ্বনি ও নকুলদানা-বাতাসা বিতরণ করে ‘এ তোমাদেরও উৎসব’ এই প্রকল্প রূপায়িত হতে থাকে। এখন রামনবমীকে অস্বীকার করার ক্ষমতা কোনও দলের নেই। কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসক দল দুটির প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে বাৎসরিক এই উৎসব গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছে। কে কত বড় হিন্দু, তার প্রতিযোগিতা চলছে।
২০২৪ সালে প্রকাশিত রিপোর্টে ২০১৬ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত রামনবম-হিংসার যে পর্যবেক্ষণ উঠে এসেছে, তাতে চাঁপদানি কেন ঘটছে তার কয়েকটি কার্যকারণ দেখা যাচ্ছে।
ক। পশ্চিমবঙ্গে রামনবমী কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে মূলত হিন্দিভাষী অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। মূলত ঘরোয়া রূপেই রামচন্দ্রের আরাধনা হত। খুব অল্প কিছু জায়গায় শোভাযাত্রা সহকারে রামনবমী উদযাপিত হত। সেই সব শোভাযাত্রা ধর্মনির্বিশেষে সবারই আকর্ষণের বিষয় ছিল। সেই শোভাযাত্রায় সব ধর্মের সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ থাকত স্বতঃস্ফূর্ত। হাওড়ার রামরাজাতলা, খাগড়ায় রাম রঘুনাথের বাড়ি-সহ বাংলায় রামের কিছু পুরনো নিদর্শন আছে, যা স্থানীয় মানুষের কাছে সমাদৃত। তবে, এলাকার বাইরে এগুলি খুব বেশি পরিচিত নয়।
খ। বিগত ২০১৪ থেকে রামনবমীকে একটি প্রকল্প হিসেবে এই রাজ্যে প্রবেশ করানো হয়। ২০১৬ সাল থেকে একসঙ্গে অনেক জায়গায় রামনবমী উদযাপন শুরু হয়। এই রামনবমীর রাম মহাত্মা গান্ধির ‘রঘুপতি রাঘব রাজা রাম’ নন, কিংবা হিন্দি বলয়ের চিরাচরিত ভক্তবৎসল রামচন্দ্র নন। ইনি সিক্সপ্যাক দেহসৌষ্ঠব নিয়ে পৌরুষ ও ক্ষমতার প্রতীক হয়ে রাম। জয় সিয়ারামের সীতাপতি রামচন্দ্রও ইনি নন, ইনি ক্ষমতার প্রতাপ দেখানো রণধ্বনির ‘জয় শ্রীরাম’। ইনি আক্রমক ধনুর্ধারী। এই প্রতিবেদনে বর্ণিত রামনবমীর শোভাযাত্রাকে বিষয় করে আমাদের সমীক্ষা থেকেও এই তথ্য উঠে এসেছে।
গ। কেন্দ্রে বিজেপি সরকার প্রতিষ্ঠার পর রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই রামনবমীর এই উদ্যোগগুলো শুরু হয় মূলত হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর উদ্যোগে। রাজনৈতিক ক্ষমতার আধিপত্য বিস্তার এই সংগঠিত ‘রামনবমী’ উদযাপনের অন্যতম লক্ষ্য। ঘরের রামচন্দ্র আর শুধুমাত্র হিন্দিভাষী জনসাধারণের ঘরোয়া আরাধ্য দেবতা থাকলেন না। তাঁর আরাধনা সর্বজনীন রূপ পেল পাড়ার মণ্ডপে। এই রামনবমীর অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠল ‘জয় শ্রীরাম’ রণধ্বনিতে মুখরিত শোভাযাত্রা।
ঘ। প্রথম দিকে আক্রমণাত্মক ততটা ছিল না রামনবমীর এইসব শোভাযাত্রা, যা ক্রমশ ‘মিছিল’-এ রূপান্তরিত হয়। পরবর্তীকালে, মুহরমের মতোই, অস্ত্রশস্ত্র-সহ মিছিল শুরু হয়। প্রথমদিকে তীর, ধনুক ও গদা ছিল। পরবর্তীতে তলোয়ার এবং নানা ধরনের ধারালো অস্ত্র নিয়ে হাঁটা শুরু হয়। সাম্প্রতিককালে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়েও মিছিলে হাঁটার দৃশ্য দেখা গেছে।
ঙ। ২০১৮ থেকে দেখা যাচ্ছে, রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস হিন্দুত্বের রাজনীতিতে কেন্দ্রের শাসকদল বিজেপির কোথাও প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে, কোথাও বা পরিপূরক। তা সে রামনবমী হোক, হনুমানপুজো হোক কিংবা গঙ্গা-আরতি। রাজ্যের শাসকদলের বদান্যতায় হিন্দুত্বের রাজনীতি সর্বব্যাপী চেহারা নেয়। তার ব্যাপ্তি এতটাই যে তৃণমূলের সংখ্যালঘু কাউন্সিলরকেও রামনবমীর মিছিল সংঘটিত করতে প্রধান ভূমিকা নিতে হয়! তৃণমূল দলের নেতৃবৃন্দ পরিচালিত কোনও কোনও মিছিল দেখে বোঝার উপায় ছিল না কার মিছিল! উত্তেজনাপূর্ণ সাম্প্রদায়িক গান এবং স্লোগানে মুখরিত রামনবমীর মিছিলকে হিন্দুত্ববাদী আরএসএস-ভিএইচপি পরিচালিত মিছিল থেকে আলাদা করা দুষ্কর ছিল। আসানসোলে সেই অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে। বেশ কিছু জায়গায় শাসকদলের নেতাকর্মীদের সম্পর্কে শোনা গেছে, ‘দিনে তৃণমূল, রাতে আরএসএস’।[4]
[1] তেলেনিপাড়া তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদন। আমরা এক সচেতন প্রয়াস। ২০২০।
[2] Kaliachak Fact-finding Report. Aamra Ek Sachetan Prayas & Centre for Study of Society and Secularism, 2016.
[3] Rejinagar Shariyati Violence. Aamra Ek Sachetan Prayas. 2017; Ul Islam, Faruque., Nath, Suman., Sen Gupta, Amitava., Roy Chowdhury, Subha Protim. West Bengal Shariyati Violence against Sufi Centers. Frontier Weekly. 2020.
[4] পশ্চিমবঙ্গ: রামনবমী-উত্তর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, সিরিজ-৩। আমরা এক সচেতন প্রয়াস। ২০২৪।