দেওচা: বাতাসে বিষের গন্ধ

শুভ প্রতিম

 



সংঘর্ষ ও সহাবস্থান সম্পর্কিত ক্ষেত্রসমীক্ষা ও গবেষণা গোষ্ঠী ‘আমরা, এক সচেতন প্রয়াস’-এর সদস্য

 

 

 

 

চব্বিশ ঘণ্টাও কাটেনি, মুখ্যমন্ত্রীর ‘আম্বানি-আদানি চাই, কৃষিও চাই’— এই উক্তির, ও মা নবান্নে হাজির তিনি! তারপর মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে গৌতম আদানির ছবি জনসমক্ষেও হাজির। দুইজনে করজোড়ে একে অন্যের প্রতি। সৌজন্যই হবে! যদিও আদানির অসৌজন্যের ইতিহাস কারও অজানা নয়। তবে তা কখনও রাষ্ট্রের মাথাদের সঙ্গে নয়। প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে তাঁর নিত্য ওঠবোস, ক্ষমতা ও বাণিজ্যের আঁতাত বলে কথা। যত অসৌজন্য সাধারণ মানুষ, আদিবাসীদের প্রতি। অসৌজন্য কম বলা হল, বলা উচিত ডাকাতি।

জমিডাকাত আদানি ঝাড়খণ্ডের গোড্ডায় আদিবাসীদের জমি কেড়ে নিয়েছে। কীভাবে আদানির গুণ্ডারা আর পুলিশ আশেপাশের গ্রামবাসীদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে, মিথ্যা মামালায় ফাঁসিয়েছে আদিবাসী-অনাদিবাসী মানুষকে যাঁরা প্রতিরোধে সামিল ছিলেন, সে ইতিহাস কি আমাদের জানা? আমরা কি জানি ঝাড়খণ্ডের সেইসময়ের বিজেপি সরকার তার সমগ্র প্রশাসনকে লাগিয়েছিল যাতে আদানির পথে কোনও বাধা না থাকে? প্রধানমন্ত্রীর সাধের প্রকল্প, প্যারের আদানি বলে কথা!

ঝাড়খণ্ডের পরেয়াহাট আর গোড্ডা ব্লকে তাদের তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র হচ্ছে। প্রলোভন দেখিয়ে, ভয় দেখিয়ে, অনুমতির তোয়াক্কা না করে জবরদস্তি জমি নিয়ে এখানে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র অদূরেই চালু হতে চলেছে। ‘আমরা, এক সচেতন প্রয়াস’ (সংঘর্ষ ও সহাবস্থান সম্পর্কিত ক্ষেত্র গবেষণা গোষ্ঠী) ২০১৯ সালে সেখানে কয়েকবার যায়, একটি রিপোর্টও প্রকাশ করে। খুব সম্প্রতি সেখানে আবার যাওয়া হয়, উদ্দেশ্য লকডাউনের বিস্তৃতকাল শেষে কেমন আছেন সেখানের মানুষ, তা জানা, বোঝা। সেই রিপোর্ট প্রকাশিতব্য। তবে এটুকু বলা যায়, কর্পোরেট ডাকাতের ভয়ঙ্কর নিদর্শন এই আদানি, তারা দেওচা-পাচামির কয়লা ব্লক পেতে উৎসুক হতে পারে। কেননা ঝাড়খণ্ডের গোড্ডা জেলারই সুন্দরপাহাড়ি ব্লকে কয়লার খনি তারা নিতে চেয়েছিল। কয়লামন্ত্রক কেন্দ্রের অধীন। নিলামে সেই কোল ব্লক পেতে কোনও অসুবিধা হয়নি। কিন্তু আটকে দিয়েছিলেন সেখানের আদিবাসীরা। ২০১৮ সালের কথা। ‘মাওবাদী’ তকমা দিয়ে, একাধিক মামলা দিয়ে, গ্রেফতার করে আন্দোলন আটকাতে নেমে পড়েছিল আদানি-বন্ধু বিজেপির রাজ্য সরকার। কিন্তু প্রতিবাদে, প্রতিরোধে, প্রতিশোধে পথে নেমেছিল সাঁওতাল। হেরেছিল আদানি। কয়লা পায়নি, ওদের কয়লা দরকার।

কেন দেওচা-পাচামিতে কয়লা উত্তোলনের বিরোধিতা করা দরকার? কেন এই প্রকল্প একই সঙ্গে মানবাধিকার এবং পরিবেশ রক্ষার বিরুদ্ধে এক বৃহত্তর ষড়যন্ত্র তা নিয়ে আলোচনার সময় এসেছে। বস্তুত ‘আমরা, এক সচেতন প্রয়াস’-এর পক্ষ থেকে ২০১৯ সাল থেকে দেওচা-পাচামি নিয়ে সমীক্ষা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর অংশ হিসাবে কয়েকটি খোলামুখ কয়লা খনি এলাকায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। উদ্দেশ্য সেখানের সামাজিক, অর্থনৈতিক, স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত ও পরিবেশগত ক্ষতির স্বরূপ নিরূপণ। যাতে ইতিমধ্যে পাথর খাদান ও ক্রেশার মেশিনের ফলে দূষিত দেওচা-পাচামির কতটা ক্ষতি হতে চলেছে তা বোঝা যায়। আমাদের সমীক্ষা এখনও চলছে। এই লেখায় আমরা সামসাময়িক কয়েকটি গবেষণা ও সমীক্ষার সাহায্য নিয়েছি। এই রিপোর্টটিতে স্থানীয় মানুষের জীবন ও জীবিকার ক্ষেত্রে এবং পরিবেশের নিরিখে খোলামুখ কয়লাখনি কত বড় বিপদ তা তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।

 

যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু’

একটু ইতিহাসে ফেরা যাক। আমরা যে তথ্য পাচ্ছি তা হল, ১৭৭৮ সালে প্রথম খনন শুরু হয় রানিগঞ্জ-ঝরিয়া অঞ্চলে। প্রায় আড়াইশো বছর আগের সেইসময়ে না ছিল পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার জন্য কোনও আইন, না ছিল শ্রমিকদের নিরাপত্তা সম্পর্কিত কোনও আইন। ইংরেজ শাসনের সেই সময়ে বেশিরভাগ ভূগর্ভস্থ খনিতেই অগভীর খননকার্য হওয়ার পর সেই খনিগুলি এখন মিথেন গ্যাসে পরিপূর্ণ, পরিত্যক্ত ও জলমগ্ন হয়ে ছোট ছোট পিলারের ওপরে দাঁড়ানো। পিলারগুলি বয়সের ভারে দুর্বল ও ভঙ্গুর, ফলত প্রতিনিয়ত ধসের সম্মুখীন। মিথেন গ্যাস থেকে খনিতে আগুন লেগে, বিপদ বেড়েছে কয়েক গুণ। ৪৭-এ ইংরেজ শাসনের অবসানের পর মালিকানার বদল হয়, কয়লা খনিগুলি ব্রিটিশ কোম্পানিদের হাত থেকে বিভিন্ন দেশীয় পুঁজিপতিদের মালিকানায় বদল হয়। শুধুমাত্র মুনাফা অর্জন— এই লক্ষ্য ব্রিটিশ বা ভারতীয় সকল কোম্পানিই বজায় রাখে।

১৯৭৩ সালের ১ মে Coal Mines (Nationalization Act), 1973, এই আইন বলে বেসরকারি বাণিজ্যিক খননের একচেটিয়া রাজত্ব খতম করে কয়লা খনিগুলির জাতীয়করণ করা হয়। ১ নভেম্বর, ১৯৭৫-এ সরকারি কোম্পানি কোল ইন্ডিয়া (Coal India) স্থাপিত হয়। এর অধীনে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে পূর্বতন কয়লা কোম্পানিগুলিকে নিবন্ধিত করা হয়। কোল ইন্ডিয়ার অধীনে থাকে ভারত কোকিং কোল লিমিটেড, ইস্টার্ন কোল ফিল্ড লিমিটেড, ওয়েস্টার্ন কোল ফিল্ড লিমিটেড ইত্যাদি সংস্থাগুলি। কিন্তু নয়ের দশকে ভারতে নয়া-উদারবাদী নীতি গ্রহণ করা হয়, বলা যেতে পারে নতুন করে ‘কোম্পানি রাজ’-এর শুরু হয় সেই সময়। খনিগুলি থেকে আরও মুনাফার লক্ষ্যে বেসরকারি খোলামুখ কয়লা খনির অনুমতি দেয় কয়লা মন্ত্রক। সুড়ঙ্গ কেটে নয়, ডিনামাইট ফাটিয়ে খোলামুখ খনি থেকে কয়লা তোলার ফলে তাদের খরচ কমে, কিন্তু ব্যাপক ক্ষতি হতে থাকে পরিবেশের। ধস, গ্যাস, আগুন সঙ্গী হয় কয়লাঞ্চলের কয়েক কোটি মানুষের।

খোলামুখ খনন এবং অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বেআইনি খননের ফলে পরিত্যক্ত পুরনো খনিতে, যেখানে আগে থেকে মিথেন গ্যাস রয়েছে, সেখানে আগুন লেগে ধসের ঘটনা ঘটছে। ICML, Bengal Emta ইত্যাদি বেসরকারি, এমনকি সরকারি ECL-এর খনিগুলিতে যে কেউ গেলেই দেখতে পাবেন, খনিতে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। ঝাড়খণ্ডের ঝরিয়া এলাকায় বিস্তীর্ণ এলাকা এভাবেই জ্বলছে। অত্যধিক তাপমাত্রার ফলে আশেপাশের গাছপালা গেছে শুকিয়ে। ঝরিয়া শহর তো বহুদিন থেকেই সম্ভাব্য ধস নামার জন্য খালি করে দেওয়ার কথা, পুরো শহরটাই যেকোনও দিন খাদে তলিয়ে যেতে পারে। এসবের প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ছে আশেপাশের মানুষ, গাছপালা, জীবজন্তুদের ওপর। প্রতিদিন হাওয়ায় মিশছে বিষাক্ত গ্যাস, যা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে বহু বর্গকিলোমিটার পর্যন্ত। এছাড়াও অতিগভীর খোলামুখ কয়লাখনির কারণে জলস্তর নেমে যাচ্ছে উদ্বেগজনকভাবে। মানুষ জলকষ্টে ভুগছেন।

কোল ইন্ডিয়া হোক বা রাজ্য সরকার, এসব জানা নেই, তা নয়। পরিত্যক্ত কয়লা খনি থেকে কয়লা চুরি এই অঞ্চলের ‘অর্থনীতি’-র বড় ‘শরিক’। তার ‘মধু’ পানে সক্রিয় রাজনৈতিক মদতপুষ্ট কয়লা-মাফিয়ারা। কয়লা-মাফিয়ারা এখন রাজনৈতিক ক্ষমতারও শরিক। রাজ্যের শাসক দলের নেতাদের পকেটে হোক বা দলীয় ফান্ডে, কয়লা চুরির টাকা এই আমলের দুর্নীতির অন্যতম বড় দিক। বিগত ১০ বছরে কয়লা চুরি পশ্চিমবঙ্গের এই প্রান্তে প্রায় ‘বৃহৎ শিল্প’-এ পরিণত। তবে মাফিয়া-নেতার আঁতাতের ক্ষেত্রে আজকের দিনে বলা যায়, এখন কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসক দলদুটির আশ্রয় ও প্রশ্রয় দিনের আলোর মত পরিষ্কার। এসবের প্রতিকার চেয়ে আন্দোলন হয়েছে বহুবার, আসানসোল-রানিগঞ্জ এলাকায়, বহু স্থানে। আন্দোলন দমন করতে পুলিশ ও মাফিয়াদের গুন্ডাবাহিনির অত্যাচার, মিথ্যা মামলা দায়ের, নিরবচ্ছিন্ন সন্ত্রাস চালাচ্ছে প্রান্তিক মানুষদের ওপর। পশ্চাৎপট এই। এখন দেখা যাক একটি সমীক্ষার নির্যাস।

‘পিপলস কালেকটিভ ইন্ডিয়া’ একটি সমীক্ষা চালায় ঝাড়খণ্ডের একটি খোলামুখ কয়লাখনি এলাকায়। ফেব্রুয়ারি, ২০২১-এ সমীক্ষার রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা চিকিৎসক ও গবেষকদের দল সমীক্ষা করেন কয়লা এবং সংশ্লিষ্ট শিল্পের ৩ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে চারহি, দুরুকাস্মার, তাপিন, দুধমাটিয়া— রামগড় জেলার এই প্রত্যন্ত চারটি গ্রামে। এই রামগড়েই আছে সেন্ট্রাল কোলফিল্ড এবং টাটা স্টিলের কোলিয়ারি। সবই খোলামুখ।

তাদের সর্বমোট ২৩৫৩টি সমীক্ষিত স্বাস্থ্য তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে এখানের মানুষের প্রধান দশটি রোগের কথা। সেগুলি হল, ব্রঙ্কাইটিস (হাঁপানি সহ); সিওপিডি/কার্ডিওভাসকুলার (নিশ্বাসের সমস্যা); যক্ষা; ত্বক (কালো/সাদা দাগ, চুলকানি, আলসার); চুল (পতন/হ্রাস, বিবর্ণ); চোখ (জল পড়া ও লাল); পা/পায়ের পাতা (ফাটা, আলসার); কোমরে ব্যাথা, বাত এবং পেটের অসুখ। এই এলাকার বায়ু, জল, মাটি আর পলি পরীক্ষা করে পাওয়া গেছে মারাত্মক দূষণ, বিভিন্ন বিষাক্ত ভারী ধাতু। বায়ুদূষণ (পিএম ২.৫) যা ভারতীয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও মার্কিন নিয়ন্ত্রক নির্দেশিকার সীমা অতিক্রম করেছে। বাতাসে যে পরিমাণ ম্যাঙ্গানিজ, নিকেল ও সিলিকন পাওয়া গেছে তা স্বাস্থ্য নির্দেশিকার নির্দিষ্ট মাত্রার অতিরিক্ত। মাটিতে ক্রোমিয়াম, ভ্যানাডিয়াম, আর্সেনিক, ক্যাডিয়াম পাওয়া গেছে, যা পরিবেশ রক্ষায় নির্দেশিত কানাডীয় মৃত্তিকা নির্দেশিকার মাত্রা অতিক্রম করেছে। বিষাক্ত ক্রোমিয়াম ও নিকেল পাওয়া গেছে পলিতে, ফলে জলজ প্রাণীর অস্তিত্ব সঙ্কটে। অ্যালুমিনিয়াম, লোহা, ম্যাঙ্গানিজ পাওয়া গেছে জলে, যা ব্যুরো অফ ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ড নির্দেশিত মাত্রার বাইরে।

 

আবার জীবাশ্ম জ্বালানি 

আবার একটু তথ্য ও ইতিহাসে চোখ রাখা যাক। আমরা জানি, জলবায়ুর বর্তমান আপৎকালীন অবস্থার প্রধান কারণ জীবাশ্ম জ্বালানি। সেই শিল্পবিপ্লবের কাল থেকে কার্বন নিঃসরণের ৮০ শতাংশ উৎস হল কয়লা, পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাস। কয়লা উত্তোলন সম্পর্কিত যাবতীয় কাজ খনন, ওয়াশিং থেকে পরিবহণ, শিল্পে ব্যবহার অর্থাৎ কয়লার দহন ক্রিয়া বায়ুমণ্ডলে বিষাক্ত গ্যাস নির্গমন করে। বিশেষত খোলামুখ কয়লা খনি হল এক বিপজ্জনক ও ঝুঁকিপূর্ণ পদ্ধতি। খোলা মুখ খনি মানেই মাটির ভিতরের বর্জ্যর পাহাড়। শুধু ধস নয়, এর ফলে স্থলজ ও জলজ বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি হয় ব্যাপক। এর ফলে শুধু ওই এলাকার নয়, এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলের কৃষিজ-বনজ উৎপাদন ও পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হয়। আসানসোল থেকে কলকাতা ২১৩ কিমি আর মুহম্মদবাজার থেকে ২০৯। অদূরেই শান্তিনিকেতন, দূষণের শিকার কিন্তু সকলেই।

ভারত সহ কয়লা উৎপাদক দেশগুলির ওপর সমীক্ষা থেকে জানা গেছে, বিষাক্ত দূষক যা কয়লা থেকে নির্গত হয় তা হল, ভারী ধাতুর মধ্যে কঠিন বর্জ্য হিসাবে আর্সেনিক, ক্রোমিয়াম, সীসা, পারদ এবং বায়ুমণ্ডলীয় কণার মধ্যে সালফার ডাইওক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড এবং গ্যাসীয় নির্গমনের মধ্যে ওজোন।

সত্যি আজ বড় বিপদ। দুনিয়া জুড়ে ৪৩২টি নতুন কয়লা প্রকল্প (২,২৭৭ মিলিয়ন টন প্রতি বর্ষে) অনুমোদিত হয়েছে। এর বেশিরভাগ অংশ এই চারটি দেশে— চিন (৬০৯), আস্ট্রেলিয়া (৪৬৬), ভারত (৩৭৬) ও রাশিয়ায় (২৯৯)। আবার ভারতের প্রকল্পগুলির বেশিরভাগ ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা, পশ্চিমবঙ্গ ও ছত্রিশগড়ে, যা পুরো দক্ষিণ এশিয়ার কয়লার ৭৭ শতাংশ।

দেশের আদিবাসী জনসংখ্যার এক চতুর্থাংশের বসবাস এই চারটি রাজ্যে। আমাদের দেশে বিগত দশকগুলিতে ৬ কোটি আদিবাসীর মধ্যে ৪০ শতাংশ মানুষ উৎখাত হয়েছেন বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে। কোল ইন্ডিয়া জানাচ্ছে আগামী পাঁচ বছরে তারা ৫৫টি নতুন খনি খুলতে চলেছে যা তাদের উত্তোলন ক্ষমতা ১৯৩ শতাংশ বৃদ্ধি করবে। ‘ল্যান্ড কনফ্লিক্ট ওয়াচ’ জানাচ্ছে সারা দেশে ৭০৩টি জমি নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে যা ৬৫ লক্ষ মানুষের জীবন ও জীবিকা বিপর্যস্ত করেছে। উন্নয়ন মানে শুধু আদিবাসী উচ্ছেদ এবং জীবাশ্ম জ্বালানির প্রকল্প।

 

দেওচা-পাচামি: আবার বিষ, আবার উচ্ছেদ

এই প্রেক্ষিতে আসা যাক, দেওচা-পচামি প্রসঙ্গে। আমরা জানি, বীরভূমের মুহম্মদবাজার ব্লকের ১১,২২২ একর এলাকা জুড়ে এই কয়লা ব্লক। যার পরিমাণ বলা হচ্ছে ২.২ বিলিয়ন টন। প্রথমে ইস্টার্ন কোলফিল্ডকে কয়লা উত্তোলনের দায়িত্ব দেওয়া হয়, কিন্তু তারা কোনও উদ্যোগ নেয় না। ২০১৪ সালে কেন্দ্র সরকার পশ্চিমবঙ্গ সহ ছয়টি রাজ্যে এটি নেওয়ার প্রস্তাব দেয়, কিন্তু কেউ এগিয়ে আসে না। ২০১৮-তে কেন্দ্র পশ্চিমবঙ্গকে এই খনি দেয়।

ইতিমধ্যেই এই এলাকা পাথর খাদানের দূষণে দূষিত। পাথর খাদান তাঁদের জীবনে কোনও আর্থিক উন্নতি ঘটায়নি। উপরন্তু ক্ষতি করেছে তাঁদের চাষবাস, তাঁদের সংস্কৃতি। প্রশাসন মানেনি আইন। যেমন, খনিজ ছাড় সুবিধা আইন, ১৯৬০ এবং খনিজ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন আইন ১৯৮৮-এর ২০০৩ সালের সংশোধনী অনুসারে খাদান বুজিয়ে ফেলা সংক্রান্ত বিধি এখনও অবধি দেওচা-পাচামিতে মানা হয়নি। খনন-উত্তর জমি, জলের মান উন্নয়ন, বায়ুর মান উন্নয়ন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, মৃত্তিকার উপরিভাগ বিষয়ক ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি সংক্রান্ত নির্দেশিকা পালন করা হয়নি। এখানে অতি গভীর খাদান ও অন্যদিকে বর্জ্য ও ধুলোর পাহাড়গুলো পড়ে আছে বহুদিন। সেখানকার রাস্তা মানেই চার পাঁচ ইঞ্চির ধুলো যা মানুষের শরীর ও প্রকৃতির ক্ষতি করে আসছে কয়েক দশক। চারিদিকে সবুজহীন ধূসর প্রান্তর। এই সবুজহীনতা আর ধুলোও কিন্তু আদিবাসী সংস্কৃতি পরিচ্ছন্নতার পরিপন্থী, যা এঁদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এরসঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে ‘এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম কয়লা ব্লক’ থেকে কয়লা উত্তোলনের আস্ফালন।

এলাকাটি আদিবাসী অধিকাররক্ষাকারী সংবিধানের পঞ্চম ও ষষ্ঠ তফসিলের অধীনে নেই। অথচ বীরভূমের এই এলাকায় আদিবাসীদের গ্রাম আছে। ঝাড়খণ্ডে সাঁওতাল পরগণা এবং ছোটনাগপুর এলাকায় আদিবাসীদের জমির রক্ষাকবচ হিসাবে যথাক্রমে সাঁওতাল পরগণা টিনেন্সি অ্যাক্ট, ১৯৪৯ এবং ছোটনাগপুর টিনেন্সি অ্যাক্ট, ১৯০৮ আছে। এই আইন বলে আদিবাসীদের জমি অনাদিবাসীদের বিক্রি করা যায় না। প্রতিবাদী মিটিঙে বহুবার এই দাবি উঠেছে, এলাকাটি যাতে সংবিধানের পঞ্চম ও ষষ্ঠ তফসিলভুক্ত হয় বা উক্ত দুটি আইনের ন্যায় নির্দিষ্ট কোনও আইন প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু কোনও আমলেই তা করা হয়নি। জমিডাকাতরা এর সুযোগ নেবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

দেওচা-পাচামিতে যেন এক অঘোষিত কার্ফু জারি করা হয়েছে। বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে কমিটি করা হয়ে গেছে আদিবাসীদের বোঝাতে। তাঁরা শুরুও করেছেন ‘কাজ’। নবান্ন থেকে ঘোষিত হয়েছে প্যাকেজ। শুরু হয়েছে ঢক্কানিনাদ, ভূভারতে এমন প্যাকেজ আর নেই।

জীবন আর কতটা দুর্বিষহ করলে থামবে রাষ্ট্র? জানতে চাইছেন তাঁরা। ভয় দেখিয়ে, প্রলোভন দেখিয়ে তাঁদের বশে আনতে পারেনি সরকার। শাসক দলের গুণ্ডারা পথে নেমেছে বহুদিন। তা সত্ত্বেও বশ্যতা মানেনি সাধারণ গ্রামবাসী। তাঁদের জীবন-জীবিকা-সংস্কৃতির ওপর আঘাত তাঁরা চান না, জানাল ছোট্ট জমায়েত। পাথর খাদানের ধুলো আমরা খেয়েছি, আর ধুলো খাব না, বললেন অনিল সোরেন (নাম পরিবর্তিত)। প্রতিরোধে সাঁওতাল।

নাগরিক সমাজের একাংশ চুপ। রাজ্য সরকারের কাছে বিশ্বস্ত থাকতে গেলে যে সাধারণ মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ থাকা যায় না সেই বোধ নেই। সর্বাধিক প্রচারিত সংবাদপত্রে হুমকি, “দরকার হইলে রাষ্ট্রক্ষমতা ব্যবহার করিতে হইবে।” শুরু হয়েছে শাসক দলের বাইক মিছিল। এলাকার মাথাদের ভয়ে, প্রলোভনে বশ্যতা মানানো হচ্ছে। হাতে শাসক দলের পতাকা, ‘আদিবাসীদের ভালোর জন্যই দলে যোগদান’— এই বুলি। প্রথমে কেন্দ্রের শাসক দলে, এখন রাজ্যের শাসক দলে।

এত কিছু সত্ত্বেও শুরু হয়েছে আন্দোলন। মহিলারা নেমেছেন পথে। আন্দোলনকে ভেঙে দিতে মাঠে নেমেছে শাসক দল ও রাজ্য সরকার। বহিরাগত উস্কানির তত্ত্ব খাড়া করা হয়েছে। হইচই শুরু হয়েছে, ‘দেউচা পাচামিতে মাওবাদী পোস্টার পাওয়া গেছে’ বলে। প্রতিবাদীদের ডিএম আইনে ফাঁসানোর হচ্ছে। সাঁওতালদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ এখন হাতেগোনা কয়েকদিন মাত্র। ইউএপিএ, ‘রাষ্ট্রদ্রোহ আইন’ চাপানো সময়ের অপেক্ষা। ‘সংঘর্ষ মৃত্যু’ও ওঁত পেতে বসে আছে।

১৮৯৫ সালে ইংরেজদের বিরুদ্ধে শুরু হয়েছিল ‘উলগুলান’, আদিবাসীদের সর্বাত্মক বিদ্রোহ। পাতাজোড়া বিজ্ঞাপনে হুল, উলগুলান নিয়ে বিশেষ বিশেষ দিনে বাণী দেন মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী। দিতেই পারেন। দেওচায় এই সব শব্দাবলি অবশ্য উচ্চারণ করা যাবে না, করলে ‘মাওবাদী’, ‘নকশাল’ ইত্যাদি প্রভৃতি। উদ্ধত বুদ্ধের পতন দেখেছে পশ্চিমবঙ্গ। ফ্যাসিস্ট মোদির এই সেদিন করজোড়ে ‘কৃষি আইন প্রত্যাহার’ দেখল দেশ, বিশ্ব। ভারতের সংবিধান, বনাধিকার আইন, ২০০৬ আদিবাসীদের জমি রক্ষার গ্যারান্টি দিয়েছে। দেওচাকে সবুজ থাকতে দিন। আদিবাসী উচ্ছেদ বন্ধ হোক। সুন্দরপাহাড়ির মানুষ আদানিকে ঢুকতে দেয়নি, দেওচাতেও তাই হবে। আদানি হোক বা অন্য কেউ, পরিবেশ ও মানুষ মারার এই প্রকল্প করতে দেওয়া হবে না। করতে দেবেন না আদিবাসী-অনাদিবাসী সাধারণ মানুষ।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4662 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...