পটভূমি উনিশে মে: আসাম, বরাক উপত্যকা এবং বাংলা ভাষার অবস্থান

সঞ্জীব দেবলস্কর

 


অনেক নিথ্যার মধ্যে অবশ্য একটিই চরম সত্য, তা হল দেশবিভাগের ফলে পূর্ববঙ্গ থেকে বাস্তুচ্যুত ভারতবাসীর আগমন। কিন্তু এরা তো এ-ভূমিতে এসেছে কারও অনুকম্পায় নয়, নিজ অধিকারেই— এটা স্বীকার করতে কুণ্ঠা তাদেরই যারা স্বাধীনতা এবং দেশবিভাজনের ইতিহাসকে অস্বীকার করে। নিজদেশের একটি অঞ্চল ভিন্ন রাষ্ট্রের হাতে তুলে দেওয়া হলে যে-সব ভারতীয়রা এদিকে সরে এসেছে, এরা নিজের দেশেই এসেছে নিজেদের হারিয়ে যাওয়া ভূমি ছেড়ে। দেশবিভাগের পূর্বে আবহমানকাল ধরেই এরা ভারতীয় ছিল। তদানীন্তন কাছাড় তথা আসামে এসেও ওরা ভারতীয়। পাকিস্তানি তো নয়ই, বাংলাদেশিও নয়। এ সোজা সত্য কথাটি সবাই বুঝবেন

 

আজকের ভারতবর্ষের যে প্রদেশটির নাম আসাম, অর্থাৎ যে ভৌগোলিক সীমানা নিয়ে আসাম প্রদেশটির আত্মপ্রকাশ, সেটা একান্তই ব্রিটিশ শাসকদের সৃষ্টি। প্রথম অবস্থায় ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ অধিগ্রহণের সময়ে যে আহোম রাজ্যের অবস্থিতি ছিল তা নিয়েই গঠিত হল ব্রিটিশ-অধিকৃত আসাম যাকে ভাগ করা হয়েছে কামরূপ, দরং, শিবসাগর, লখিমপুর এবং নগাঁও জেলায়। এরপর মুঘল আমলের বাংলা সুবার অংশ, ঔপনিবেশিক আমলে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অংশ গোয়ালপাড়া, গারো পাহাড়, খাসিয়া-জয়ন্তিয়া, উত্তর কাছাড়, মিকির পাহাড়, নাগা পাহাড়কে সংযুক্ত করা হল আসামের সঙ্গে; সে সঙ্গে সংযুক্ত হল সিলেট ও কাছাড় জেলা। এই নিয়ে যে আসাম প্রদেশটি গঠিত হল, ঐতিহাসিক সুজিৎ চৌধুরীর মতে এ নামকরণটি misnomer। এতে একাধিক স্বতন্ত্র ভাষিক অঞ্চল রয়েছে, রয়েছে বিচিত্র নৃ এবং ভাষিক গোষ্ঠী, পার্বত্য অঞ্চল এবং সমতলভূমি। এই আসাম নামক প্রদেশটির বৈধ নাগরিক কে বা কারা, কারা স্থানীয় আদিবাসী, original inhabitant, বা খিলঞ্জিয়া, আর কারা আগন্তুক, অনুপ্রবেশকারী, কাদের ভাষা রাজ্যে সরকারি স্বীকৃতির যোগ্য— দীর্ঘদিন যাবৎ চলে আসা এ-তর্ক এ-মুহূর্তে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে কেবল বিদগ্ধ পণ্ডিত, উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, একেবারে সাধারণ মানুষকেও রাজ্যের সমাজগঠন, জাতিগঠন এবং রাষ্ট্রগঠনের ইতিহাস, জনবিন্যাস, এমন-কি কিছুটা ভাষাতত্ত্ব এবং রাজনৈতিক পালাবদলের ইতিহাস সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা রাখতেই হবে। নইলে কখন কোনদিক থেকে আঘাত আসবে, কার স্থান হবে ডিটেনশন ক্যাম্পে, কার ভোটাধিকার কাটা যাবে, আর সাঁজোয়া গাড়িতে চাপিয়ে রাতের অন্ধকারে কাকে নিয়ে সীমান্তের ওপারে ছুড়ে দেওয়া হবে কেউ বলতে পারে না।

১৮৭৪ সালে চিফ কমিশনার-শাসিত আসাম প্রদেশ গঠন এবং তৎপরবর্তী পালাবদলের ইতিহাসের সূত্র ধরে, বরাক উপত্যকা প্রসঙ্গে সুজিৎ চৌধুরী আশির দশকেই লক্ষ করেছেন, “স্বাধীনতার পরবর্তীকালে স্বার্থান্বেষী মহল থেকে বরাক উপত্যকার ভাষিক চরিত্র সম্পর্কে বিভ্রান্তি জন্মানোর জন্য রচিত একটা পরিকল্পনা ধারাবাহিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। অবিভক্ত আসামে অপরাপর ভাষিকগোষ্ঠীর ওপরেও পরবর্তীতে এ-আঘাত এসেছে এবং এর প্রতিক্রিয়া আমরা দেখেছি বড়ো-অধ্যুষিত অঞ্চলে। খাসি জনগোষ্ঠীরা নিজেদের ভাষিক অঞ্চল নিয়ে সরে গেছে, গোয়ালপাড়াতে এক নীরব প্রক্রিয়ায় সমস্ত স্কুলগুলোকে বাংলা মাধ্যম থেকে অসমিয়া মাধ্যমে রূপান্তরও প্রায় শেষ, যদিও নৃ-তাত্ত্বিক রূপান্তর এবং মাতৃভাষার অবলুপ্তি, এ-বিষয়টি এক দুই দশক বা এক শতাব্দীর ব্যাপারও নয়। অসংখ্য জনজাতি তাদের নিজস্ব ভাষা এবং উপভাষা নিয়েই যে আসামের বৈধ নাগরিক এবং নিজ মাতৃভাষার অধিকারের ন্যায্য দাবিদার এ-বাস্তবতার প্রতিবন্ধক হিসেবে দাঁড়িয়েছে ‘আসাম’ শব্দটি। সাম্প্রতিককালে চর্চিত অসমিয়ার সংজ্ঞাকরণ বিষয়টিও। এ-কথাগুলো মনে রাখলে ১৯৬০ সালে ‘ভাষা আইন’ পাশ করিয়ে নেওয়ার এত তৎপরতার অন্তর্নিহিত তাৎপর্যটি অনুধাবন করাও সহজ হয়।” রাজ্যটি ভাষিক, নৃতাত্ত্বিক এবং সাংস্কৃতিক চরিত্রলক্ষণে যে স্পষ্টতই একটি সমন্বিত (composite) সমাজবিশিষ্ট রাজ্য, এটা উগ্র জাতীয়তাবাদী বা ভাষিক সম্প্রসারণবাদীদের এক অজানা আশঙ্কার কারণ। অপর ভাষার সংস্থান রেখেও অসমিয়া ভাষার বিকাশ এবং প্রসারে অসুবিধা কোথায়? বিহার কিংবা বাংলা বা পাঞ্জাবে তো হিন্দি, বাংলা বা পাঞ্জাবি ভাষা আইন প্রণয়ন করে ভাষার বিকাশের কোনও প্রকল্প নেই। প্রাক্-স্বাধীনতাকালীন সময়ে আসামে একসঙ্গে অনেকজন বিদ্বান, চিন্তাশীল মনীষী এবং সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীর আত্মপ্রকাশ অসমিয়া ভাষা-সংস্কৃতিকে যে-অগ্রগতির দিকে নিয়ে গিয়েছিল এতে স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতেই এ-ভাষা এগিয়ে যেত, গেছেও। বিভেদের রাজনীতি, সাম্প্রদায়িকতা এক্ষেত্রে যে ক্ষতিসাধন করেছে এটা অবশ্যই অপূরণীয়। তবে এ-প্রসঙ্গটা থাক এখানেই, আমরা যাই বরাক উপত্যকা প্রসঙ্গে।

 

দুই.

‘বরাক উপত্যকা’ অভিধাটি সাম্প্রতিক। কাছাড় জেলাটি ত্রিধাবিভক্ত হলেও একই ঐতিহ্যের পরম্পরা বহনকারী জনগোষ্ঠী, একই রাজনৈতিক পাশাখেলার শিকার, অর্থনৈতিক অনগ্রসরতার সমান ভাগীদার। কাছাড়-করিমগঞ্জ-হাইলাকান্দি এ তিন জেলার একটি একক পরিচিতির প্রয়োজন ছিল। সময়ের প্রয়োজনেই শব্দগুচ্ছটির আত্মপ্রকাশ। পুরো অঞ্চলটি বাংলা প্রেসিডেন্সি থেকে বের করে সিলেটের সঙ্গে একযোগে ১৮৭৪ সালে নবগঠিত আসাম প্রদেশের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। এ-সংযুক্তির কারণ হল প্রস্তাবিত চিফ কমিশনার শাসিত এ-রাজ্য গঠনের প্রতিবন্ধকতা ছিল রাজস্ব ঘাটতি এবং জনসংখ্যার অপ্রতুলতা। সিলেট-কাছাড় এবং সে-সঙ্গে গোয়ালপাড়াকে আসাম রাজ্যের প্রয়োজনেই ওই সময় বাংলা থেকে এনে সংযুক্ত করা হয়। সিলেট এবং কাছাড় মিলে তৈরি হয়েছিল একটি প্রশাসনিক ইউনিট, নাম সুরমাভ্যালি ডিভিশন। এই সুরমাভ্যালি ডিভিশনের করিমগঞ্জ সাব-ডিভিশনের একটা অংশ বাদ দিয়ে বাকি আংশ নিয়েই আজকের বরাক উপত্যকা। এ-উপত্যকায় বাংলা ভাষা কোনও হঠাৎ করে চাপিয়ে দেওয়া কিছু নয়। বাংলার, বিশেষ করে দক্ষিণবঙ্গের ইতিহাসের সঙ্গে ভূগোলকে মিলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে বরাক উপত্যকা ভৌগোলিক দিকে বঙ্গ-সমভূমির স্বাভাবিক সম্প্রসারণ। সুতরাং নৃতাত্ত্বিক, সামাজিক, ভাষিক এবং সাংস্কৃতিক দিকে উপত্যকাটি আবহমানকাল ধরেই বাংলার সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত।

অবশ্য এ-অঞ্চলের ভাষিক চরিত্র নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির পরিকল্পনা দীর্ঘদিনের। অথচ এ-অঞ্চলে বাঙালিদের আত্মপ্রকাশ যে খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ-যোড়শ শতকেই, বঙ্গদেশে বাঙালি জাতিসত্তার আত্মপ্রকাশের সময় থেকে একেবারে সমান্তরালভাবেই— এর ঐতিহাসিক প্রমাণও বিদ্যমান। কাছাড়ে শ্রীহট্ট রাজ্যের সম্প্রসারণের বস্তুগত প্রমাণ রয়েছে রাজকীয় সনদ, ধাতুনির্মিত মুদ্রায়, নৃতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব এবং লোকসাহিত্যেও।

বরাক উপত্যকায় বাঙালিদের অস্তিত্ব যে যোড়শ শতকে কোচ রাজত্বকালে কিংবা এর পূর্ব থেকেই বিদ্যামান এ তো প্রতিষ্ঠিত সত্য। আর অষ্টাদশ শতকে ডিমাসা আমলে রাজকীয় ভূমিদান, সনদ, মুদ্রা, প্রস্তরলিপি ইত্যাদিতে বাংলা ভাষার প্রয়োগ, রাজসভাশ্রিত সাহিত্যকৃতিতে বাংলাভাষার প্রচলন তো স্পষ্টতই কাছাড় রাজ্যে বাঙালি জনগোষ্ঠীর অবস্থিতির সাক্ষ্য বহন করে। পূর্বের ধারাবাহিকতা রক্ষা করেই ডিমাসা আমলে রাজকীয় উদ্যোগে বাঙালিদের আরও প্রব্রজন ঘটে কাছাড়ে ১৮ শতকে। সেই জনগোষ্ঠীর উত্তরসূরিরা আজ তিনটি শতাব্দী পরও যদি আগন্তুক, mere settlers, infiltrators অভিধায় ভূষিত হয় তবে original inhabitant শব্দবন্ধের কোনও মানেই থাকে না।

এত ঐতিহাসিক প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও বাঙালিদের বৈধতা আজ প্রশ্নচিহ্নের সম্মুখীন। এদের ভারতীয়ত্ব প্রমাণসাপেক্ষ। অথচ এ-বাঙালিরা স্পষ্টতই হিমালয়ের ওপার থেকে আসেনি, নাগা পাহাড়ের ওপার থেকেও নয়, বঙ্গোপসাগর, ভারত মহাসাগর পেরিয়েও নয়— হাজার বছরের প্রব্রজন প্রক্রিয়ায় যে-ভূমি থেকে এরা পূর্ব অভিমুখে এসেছে এ-ভূমিটি আদি অনাদি ভারতবর্ষেরই mainland.

যে বিভ্রান্তি-সৃষ্টিকারী পরিকল্পনার কথা মধ্যে বলা হয়েছে তার একটি নমুনা:

‘বাঙালি হিন্দু ও মুসলমান, বিশেষ করে বাঙালি হিন্দুরা ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার সময়ে পলাতক (ভগনীয়া) হিসেবে কাছাড়ে এসে ঢোকে। এই পালিয়ে আসা মানুষগুলি শিলচর করিমগঞ্জ ইত্যাদি শহরে ও তার আসেপাশে বাস করতে থাকে। স্বাধীনতার পরে বিশেষ করে ১৯৭০-৭১ সালে বাংলাদেশ যুদ্ধের সময়ে কিছুসংখ্যক বাঙালি হিন্দু ও মুসলমান অনুপ্রবেশকারী হিসাবে কাছাড়ে ঢোকে। … এই ভাষিক সংখ্যালঘু মানুষ শিক্ষার ক্ষেত্রে কাছাড়ের স্থানীয় লোকদের তুলনায় উন্নত বা বেশি আগ্রহী এবং চতুর। তাই বর্তমান বরাক উপত্যকায় আর তার বাসিন্দাদের উপর এরা নিজেদের প্রাধান্য বজায় রাখতে পারছে।’ (আক্ষরিকভাবেই অনূদিত)।

১৯৮৭ সালে শিলচর থেক প্রকাশিত একটি স্মারকগ্রন্থে রচনাটি লিখেছেন মথুরামোহন শর্মা। সমস্ত ইতিহাস এবং ঐতিহাসিক তথ্যকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া এসব রচনার যথেষ্ট সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব থাকে, তা যতই হাস্যকর হোক না কেন এ-ধরনের গবেষণাকৃতি। উগ্র জাতীয়তাবাদী এবং সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদীদের সেই পুরনো কথা— স্বাধীনতা এবং দেশবিভাগ-পরবর্তী দিনগুলোতেই বাঙালিরা এসেছে কাছাড়ে, ওদের ভাষায় ‘ভগনীয়া’ হয়ে।

তাহলে হরিকেল-কামরূপ-সমতট রাজত্বের অধ্যায়, নিধনপুর তাম্রশাসন সম্পৃক্ত পর্ব, ত্রিপুরি শাসনপর্ব, শ্রীহট্ট রাজ্যের উত্থান এবং শাহজালাল-শ্রীচৈতন্যের সমকালীন সামাজিক ইতিহাস, প্রাগ্-ডিমাসা যুগ থেকে ব্রিটিশ অধিগ্রহণ (১৮৩২) পর্ব— এ-সমস্ত ইতিহাসই কি মিথ্যা? মাইবং এবং সমতল কাছাড়ের প্রস্তরলিপির বাংলাভাষা কি মিথ্যা, মিথ্যা কি ‘হেড়স্ব রাজ্যের দশুবিবি’র বাংলা অক্ষরমালা, মিথ্যা ভুবনেশ্বর বাচস্পতির ‘নারদী রসমৃত’ কাব্য, মিথ্যা ডিমাসা রাজাদের বাংলা কীর্তন গীতিকা, মালসী গান, রাসোৎসব গীতামৃত? সিপাহি বিদ্রোহের দ্রোহগাঁথা, জঙ্গীয়ার গীত, স্বদেশি আন্দোলন, অসহযোগ-খিলাফৎ আন্দোলনে আমাদের পূর্বজদের অংশগ্রহণ, কারাবরণ সবই কি তাহলে মিথ্যা?

 

তিন.

এত কিছু নিথ্যার মধ্যে অবশ্য একটিই চরম সত্য, তা হল দেশবিভাগের ফলে পূর্ববঙ্গ থেকে বাস্তুচ্যুত ভারতবাসীর আগমন। কিন্তু এরা তো এ-ভূমিতে এসেছে কারও অনুকম্পায় নয়, নিজ অধিকারেই— এটা স্বীকার করতে কুণ্ঠা তাদেরই যারা স্বাধীনতা এবং দেশবিভাজনের ইতিহাসকে অস্বীকার করে। নিজদেশের একটি অঞ্চল ভিন্ন রাষ্ট্রের হাতে তুলে দেওয়া হলে যে-সব ভারতীয়রা এদিকে সরে এসেছে, এরা নিজের দেশেই এসেছে নিজেদের হারিয়ে যাওয়া ভূমি ছেড়ে। দেশবিভাগের পূর্বে আবহমানকাল ধরেই এরা ভারতীয় ছিল। তদানীন্তন কাছাড় তথা আসামে এসেও ওরা ভারতীয়। পাকিস্তানি তো নয়ই, বাংলাদেশিও নয়। এ সোজা সত্য কথাটি সবাই বুঝবেন, বুঝবেন না আমাদের নীতি-নির্ধারকেরা, প্রশাসকরা, জনপ্রতিনিধিরা, এমনকি আমাদের পরম আস্থার স্থল সর্বোচ্চ নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানসমূহও।

তবু বরাক উপত্যকা তথা আসামের বাঙালিদের এ সত্য কথাগুলো বারবার উচ্চারণ করে যেতেই হবে। ইউরোপে নাজি জমানায় মিথ্যাকে বারবার উচ্চারণ করে সত্যে রূপান্তরিত করার কথা আমরা জানি, কিন্তু সত্যকে বারবার উচ্চারণ করলে মিথ্যায় রূপান্তরিত হয় এ-কথা তো ভূ-ভারতে কেউ কোনওদিন শোনেনি।

স্বাধীনতার অব্যবহিত পর (নভেম্বর ৫, ১৯৪৭) আসাম বিধানসভার প্রথম অধিবেশনের উদ্বোধনী ভাষণে রাজ্যপাল আকবর হায়দরির মুখ দিয়ে উচ্চারণ করিয়ে নেওয়া হয়েছিল ‘বাঙালিরা এখন হীনবীর্য’ (The Bengalees has no longer the power)। পরে্র বাক্যগুলো এ রকম, ‘এরা এখন ইচ্ছে থাকলেও আর পাহাড় এবং উপত্যকার মানুষের উপর আধিপত্য করতে পারবে না।’ সদ্য স্বাধীনতা লাভ করা এবং একই সঙ্গে প্রিয় মাতৃভূমির একটি অঞ্চলকে হারিয়ে স্বদেশের অবশিষ্ট অংশকে (যে অংশ হস্তান্তরের চক্রান্ত ছিল প্রবল) আঁকড়ে ধরা এ-জনগোষ্ঠীর প্রতি এত আক্রোশ! কিন্তু বাঙালি তো কোনও কালেই আগ্রাসী বা আধিপত্যবাদী ছিল না। বাংলা তো ভালবাসার ভাষা, আগ্রাসনের ভাষা তো নয় কদাপিও।

 

চার.

আজ যখন প্রতিদিন সারা বিশ্বে একটি করে ভাষা অবলুপ্তির দিকে যাচ্ছে তখন বিশ্ববাসীর প্রতি নিজ নিজ মাতৃভাষা রক্ষার মানবিক আবেদন এসেছে ওই বাংলাভাষীদের থেকেই।

ভাষাশহিদ দিবসেই স্বাধীন সার্বভৌম ধর্মনিরপেক্ষ গণপ্রজাতন্ত্রী এ-রাষ্ট্রে সমবেত ঐকতানে প্রতিটি ভাষারই সমান অধিকারের দাবি উচ্চারিত হোক—

আমি চাই সাঁওতাল তার ভাষায় বলবে রাষ্ট্রপুঞ্জে
আমি চাই মহুল ফুটবে সৌখিনতার গোলাপকুঞ্জে
আমি চাই নেপালি ছেলেটা গিটার হাতে
আমি চাই তার ভাষাতে

গাইতে আসবে রাষ্ট্রপুঞ্জে।*


*গানটির রচয়িতা কবীর সুমন। তাঁর প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4760 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...