![debashis 3](https://i0.wp.com/www.4numberplatform.com/wp-content/uploads/2024/05/debashis-3.jpg?resize=678%2C381&ssl=1)
দেবাশিস মিথিয়া
অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটিয়ে মানুষের সম্পদ সৃষ্টিতে কেন্দ্র-রাজ্য দুই সরকারই ব্যর্থ— এটা আজ স্পষ্ট। তবে, একটা উন্নয়ন নজর কেড়েছে, তা হল শাসকদলের (কেন্দ্র ও রাজ্য) জনপ্রতিনিধিদের সম্পত্তির বৃদ্ধি। ২০১৯ সালে নির্বাচন কমিশনকে তাঁরা সম্পত্তির যে হিসেব দিয়েছিলেন আর ২০২৪-এ মনোনয়নের সময় তাঁরা যে হিসেব দিলেন সেখানে সম্পত্তির বৃদ্ধি অনেকখানি। এই বৃদ্ধির সঙ্গে সাধারণ জনগণের সম্পদ বৃদ্ধির একটা তুল্যমূল্য বিচার করতে পারলে বোঝা যায় জনপ্রতিনিধিরা শুধুই নিজেদের সম্পত্তি বাড়িয়েছেন, না তাঁরা যাদের প্রতিনিধি সেই মানুষদেরও সম্পদবৃদ্ধিতে সাহায্য করেছেন
এই মুহূর্তে দেশবাসী মেতে আছেন গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় উৎসব নির্বাচনে। তাকে সামনে রেখে প্রচার পাল্টা প্রচারে রীতিমতো সরগরম গোটা দেশ। ইতিমধ্যে এ-রাজ্যে ৪ দফা নির্বাচন শেষ হয়ে গেছে। এখনও বাকি ৩ দফার নির্বাচন। একসময় নির্বাচনী প্রচারের প্রধান হাতিয়ার ছিল ‘নির্বাচনী ইশতেহার’ বা ‘ইলেকশান ম্যানিফেস্টো’। এবারেও রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করে জানিয়েছে আগামী দিনে ক্ষমতায় এলে তারা জনগণের জন্য কী কী করবে। রাজনৈতিক দলগুলি ঘটা করে গণমাধ্যমের সামনে ইশতেহার প্রকাশ করলেও জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে কেউই প্রায় ইশতেহারের ধার মাড়াচ্ছেন না। নির্বাচনী জনসভাগুলিতে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা যা বক্তব্য রাখছেন তাতে না আছে রাজনীতি, না আছে সমাজনীতি। নেই অর্থনৈতিক উন্নয়নের কোনও দিশা কিংবা মানুষের দিনবদলের পরিকল্পনা। এখন প্রচার মানেই পারস্পরিক কুৎসা। ব্যক্তিগত স্তরে আক্রমণ। রাজ্যের শাসকদল কেন্দ্রের শাসককে বলছে চোর। পাল্টা কেন্দ্রের শাসকদল রাজ্যের শাসককে বলছে চোর। দু-দলের কথাতেই যে সত্যতা আছে তা দেশের জনগণ ইতিমধ্যে অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝেছেন। এছাড়াও দুই শাসকদল প্রকাশ্য জনসভায় সাম্প্রদায়িক বিভাজনের কথা বলে ভোট টানার চেষ্টা করছে। ভোট পেতে কেউ স্টিং ভিডিও বানাচ্ছে, কেউ প্রতিপক্ষের ঘর পোড়াচ্ছে। ভিন্নমতের মানুষকে এলাকাছাড়া করেও ক্ষান্ত হচ্ছে না, খুন পর্যন্ত করে বসছে। আমজনতার দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিতেই রাজনৈতিক দলগুলি এইসব সস্তা চমকের আশ্রয় নিচ্ছে।
উন্নয়নের প্রশ্নে কেন্দ্রীয় সরকার কিংবা রাজ্য সরকার কেউই কথা রাখেনি। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির সঙ্গে বাস্তবের বিস্তর ফাঁক। পরিসংখ্যান সেই কথাই বলছে। রামমন্দির তৈরি, কাশ্মিরে আর্টিকেল ৩৭০ বাতিল ছাড়া বিজেপি বাকি কোনও নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির ধার দিয়ে যায়নি। রামমন্দির প্রতিষ্ঠাকে বিজেপি ইশতেহারের প্রতিশ্রুতি পূরণ বলে বিজ্ঞাপন করছে। এটা ভুললে চলবে না মন্দির-মসজিদ কখনও গরিবের পেটে ভাত, বেকারের হাতে কাজ দেয় না, বাসস্থানের ব্যবস্থা করে না। ২০১৯ সালে বিজেপি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল প্রত্যেক পরিবারের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ১৫ লাখ টাকা এবং দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী পরিবারের শতাংশকে এক ডিজিটে নামিয়ে আনার। কারও অ্যাকাউন্টে একটা টাকাও ঢোকেনি। ভারতে এখনও ২৩ কোটি মানুষ দরিদ্র। ২০২৩ সালের শেষে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা ১১.২৮ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ ইশতেহারের দারিদ্র্য দূরীকরণের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হয়নি। কয়েকটি বিশেষ ক্ষেত্রকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করে বলা হয়েছিল কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। বছরে ২ কোটি বেকার চাকরি পাবে। কোথায় চাকরি? ২০১৯ সালে বেকারত্বের হার যেখানে ৫.২৭ শতাংশ ছিল ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে তা বেড়ে হয়েছে ৮.১১ শতাংশ। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে বলা হয়েছিল ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলির প্রসার ঘটিয়ে বাড়তি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হবে। আজ জলের মতো পরিষ্কার কর্মসংস্থান নয় ইলেকটোরাল বন্ডে টাকা আদায়ের জন্যই এদের বাড়তি সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। ২০২২ সালের মধ্যে কৃষকের গড় মাসিক আয় দ্বিগুণ করার প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়নি। ভারতকে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত করার স্বপ্নও অধরা থেকে গেছে।
রাজ্যে, সরকার চালাচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেস। ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ১০০ দিনের কাজকে ২০০ দিনের করা হবে সঙ্গে দৈনিক মজুরি দ্বিগুণ। সেই ভাবনাকে মিথ্যে প্রমাণিত করতে ভুয়ো জবকার্ড বানিয়ে ১০০ দিনের কাজের বরাদ্দ টাকা নয়ছয় করেছে। সঠিক ইউটিলাইজেশন সার্টিফিকেট দিতে না পারায় কেন্দ্র বরাদ্দ বন্ধ করেছে। অর্থের অভাবে রাজ্যে মনরেগার কাজ বন্ধ। মহিলাদের ক্ষমতায়ন প্রতিশ্রুতির তালিকায় জ্বলজ্বল করছে। বাস্তবে দেখা গেল মহিলাদের স্বনির্ভর না করে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের দেয় ৫০০ টাকাকে বাড়িয়ে ১০০০ টাকা করতে। এতে ভোটব্যাঙ্ক নিশ্চিত হলেও নারীর ক্ষমতায়ন হল না। সন্দেশখালির ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে রাজ্যে মহিলাদের আত্মমর্যাদা বৃদ্ধিতে সরকারের সদিচ্ছার অভাব কতটা। যুবক ও শিক্ষার্থীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রতিশ্রুতি, শুধুই কথার কথা। নইলে শিক্ষক নিয়োগে এত বড় দুর্নীতি ঘটত না— যার জেরে গোটা শিক্ষাদপ্তর জেলে। কৃষকদের ফসলের সঠিক দাম নিশ্চিত করার পাশাপাশি তাদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দেওয়ার কথা ছিল। রাজ্যের কৃষকদের পিএম কৃষান-এর ৬০০০ টাকা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শস্যবিমায় রাজ্যের চাষিদের যুক্ত হওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি। পরিবর্তে নিজেরা বাংলা শস্যবিমা চালু করে কৃষকদের ঠকিয়েছে। সরকারি মান্ডিতে রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে একশ্রেণির মান্ডি অফিসারদের অশুভ আঁতাতের ফলে চাষি ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে ধান বিক্রি করে লাভ ঘরে নিয়ে যেতে পারেননি। রাজ্যের অসংগঠিত ক্ষেত্রে নির্ভরশীল মানুষের জীবনযন্ত্রণা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তা বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি খাতায়কলমে। বিগত নির্বাচনী ইশতেহারে তৃণমূল কংগ্রেস যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে আরও শক্তিশালী করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু কেন্দ্র-রাজ্যের আর্থিক সম্পর্কের কোনও তোয়াক্কা না করে নিজেরাই ১০০ দিনের টাকা দেবে বলে ঘোষণা করছে। আবাস যোজনায় ঘর দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকারের সমস্ত কর্মসূচির বিকল্প কর্মসূচি রাজ্য সরকার আলাদা নামে চালু করেছে। এই প্রবণতা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে ভেঙে দেয়। এতে গরিব মানুষ কেন্দ্রীয় প্রকল্পের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। নতুন বিনিয়োগ এনে অর্থনৈতিক উন্নয়নের যে স্বপ্ন গত নিবার্চনের আগে শুনিয়েছিল তা পূরণ হয়নি কারণ শিল্পে বিনিয়োগ টানতে বছরের পর বছর রাজ্যে শিল্প সম্মেলন হয়েছে কিন্তু প্রকৃত বিনিয়োগ শূন্য। ফলে নতুন শিল্পের হাত ধরে উন্নয়ন বিশ বাঁও জলে।
অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটিয়ে মানুষের সম্পদ সৃষ্টিতে দুই সরকারই ব্যর্থ— এটা আজ স্পষ্ট। তবে, একটা উন্নয়ন নজর কেড়েছে, তা হল শাসকদলের (কেন্দ্র ও রাজ্য) জনপ্রতিনিধিদের সম্পত্তির বৃদ্ধি। ২০১৯ সালে নির্বাচন কমিশনকে তাঁরা সম্পত্তির যে হিসেব দিয়েছিলেন আর ২০২৪-এ মনোনয়নের সময় তাঁরা যে হিসেব দিলেন সেখানে সম্পত্তির বৃদ্ধি অনেকখানি। এই বৃদ্ধির সঙ্গে সাধারণ জনগণের সম্পদ বৃদ্ধির একটা তুল্যমূল্য বিচার করতে পারলে বোঝা যাবে জনপ্রতিনিধিরা শুধুই নিজেদের সম্পত্তি বাড়িয়েছেন, না তাঁরা যাদের প্রতিনিধি সেই মানুষদেরও সম্পদবৃদ্ধিতে সাহায্য করেছেন। আগে দেখে নেওয়া যাক এই ৫ বছরে সাধারণ মানুষের সম্পত্তি কতটা বেড়েছে। তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে বেছে নেওয়া হয়েছে অর্থনীতির প্রাথমিক বা কৃষিক্ষেত্রের প্রতিনিধিকে, নেওয়া হয়েছে মাধ্যমিক ক্ষেত্রের ২ জনকে। একজন শিল্পশ্রমিক অপরজন ছোট কারখানার মালিক। বেসরকারি হোটেল মালিক ও সরকারপোষিত স্কুলের শিক্ষিকাকে সেবাক্ষেত্রের উদাহরণে ব্যবহার করা হয়েছে।
অবস্থা-১: প্রভাকর মণ্ডল, বীরভূমের মুরারই-এর প্রান্তিক চাষি। বর্তমান রেকর্ড বলছে প্রভাকরের নামে ৬ বিঘে চাষের জমি। ২০১৯ সালেও এটাই ছিল। অভাবের তাড়নায় তিনি ১০ কাঠা জমি অপরের কাছে বন্ধক রেখেছেন। সেটা কোভিড-পরবর্তী সময়ের ঘটনা। ২০১৯ সালে স্ত্রীধন ছিল ৩ ভরি সোনা। এখনও তাই আছে তবে মেয়ের পড়াশোনার জন্য তা মহাজনের কাছে বন্ধক। বাস্তুভিটের কোনও রদবদল হয়নি। এটা বলার অর্থ দুই লোকসভা নির্বাচনের মধ্যবর্তী সময়ে প্রভাকরের স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি খাতায়কলমে না বদলালেও, বাস্তবে কমে গেছে।
অবস্থা-২(ক): হুগলির চুঁচুড়ার বাসিন্দা সুশান্ত গায়েন। ওই অঞ্চলের তারপোলিন ফ্যাক্টরির শ্রমিক। পিএফ, গ্র্যাচুইটি সব আছে। কোভিডকালে মালিক একদিনের জন্য মজুরি বন্ধ করেননি। তা সত্ত্বেও অবস্থার উন্নতি নেই। ওঁর কথায় ২০১৯-এর তুলনায় মাইনে অনেকটাই বেড়েছে। কিন্তূ জিনিসপত্রের দাম, ছেলেমেয়ের লেখাপড়া চালিয়ে সঞ্চয় করার কথা ভাবতেই পারি না। ছোট একটা পৈতৃক বাড়ি আছে এটুকুই বাঁচোয়া। স্ত্রীধন বলতে ভরি ২ গহনা। এগুলো আগেও ছিল এখনও তাই আছে। সম্পত্তির নিরিখে, গত ৫ বছর তিনি একই জায়গায় দাঁড়িয়ে।
অবস্থা-২(খ): বিক্রম দত্ত, পশ্চিমবঙ্গের শেফিল্ড হাওড়ায় লেদকারখানার মালিক। ওঁর স্ত্রী গৃহবধূ। বাড়ি ও স্ত্রীধন ২০১৯ সালে যা ছিল আজ ২০২৪ সালেও একই আছে। ২০১৯-এ ওঁর লেদমেশিন ছিল ৩টি, বর্তমানে তা ১টায় ঠেকেছে। ২টি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। ওঁর কথায় ২০২০ সালে কোভিডের পর কাজের বাজার এতটাই খারাপ হয়ে গেছে ১টা মেশিনের কাজ জোগাড় করতেই হিমসিম খাচ্ছি। কাজের মজুরি ২০১৯ সালে যা ছিল এখনও প্রায় তাই আছে। এই অবস্থা বিক্রমের একার নয়। বেশিরভাগেরই অভিজ্ঞতা এক। ফলে অস্থাবর সম্পত্তি ২০১৯ সালের তুলনায় অনেকটাই কমেছে।
অবস্থা-৩(ক): ইনি মৃত্যুঞ্জয় ঘোষ, কৃষ্ণনগর শহরে পাইস হোটেল চালান। ২০১৯ সালে ওঁর স্থাবর সম্পত্তি যা ছিল আজও তাই আছে। অস্থাবর সম্পত্তির মধ্যে স্ত্রীধনের পরিমাণ একই থাকলেও সঞ্চিত অর্থ অনেকটাই কমে গেছে। ওই সময়ে ব্যাঙ্কে স্থায়ী আমানত ছিল প্রায় ১০ লাখ টাকা। পাঁচ বছর পরে সেই টাকা সামান্য কমে ৯ লাখে এসে দাঁড়িয়েছে। কোভিডকালে লম্বা সময় কোনও রোজগার না থাকাকেই উনি দায়ী করেছেন। সেইসময় দীর্ঘদিন ধরে ৮ জন কর্মচারীর পারিশ্রমিক ও দৈনন্দিন সংসার খরচে সঞ্চিত অর্থের অনেকটাই ব্যয় হয়ে যায়। সেই ক্ষতি পূরণ করে সঞ্চয় বৃদ্ধি সম্ভব হয়নি।
অবস্থা-৩(খ): দক্ষিণ ২৪ পরগনার ডায়মন্ড হারবারের স্কুলশিক্ষিকা মন্দিরা দে। সরকারপোষিত বিদ্যালয়ে চাকরি করার ফলে সরকারি নিয়ম অনুযায়ী প্রতি বছর তাঁর ৩ শতাংশ করে মাইনে বেড়েছে। তিনি ডিএ পেয়েছেন রাজ্য সরকারের নিয়মানুযায়ী। নিয়মিত বেতন পাওয়ায় কোভিডের প্রভাব আয়ের ওপর খুব একটা পড়েনি। নিজস্ব ফ্ল্যাট ২০১৯-এর আগেই কেনা। ২০১৯-এর পর মেয়ের জন্য ৩ ভরি সোনা কিনেছেন। সঞ্চিত অর্থ বলতে প্রভিডেন্ট ফান্ডের ৬ লাখ টাকা। তবে অর্থের প্রয়োজনে প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে ঋণ করেছেন ২ লাখ টাকা।
এরকম অজস্র উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। উদাহরণের ভারে ভারি করা উদ্দেশ্য নয়। দেখার ছিল অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রের জনগণ বিগত ৫ বছরে তাঁদের স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির কতটা বদল ঘটাতে পেরেছেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই বদল আদৌ কী ঊর্ধ্বমুখী না নিম্নগামী?
অবস্থা ১ থেকে অবস্থা ৩(খ) দেখে একটা বিষয় স্পষ্ট। গত ৫ বছরে অর্থনীতির যে ক্ষেত্রেকেই আলোচনায় আনুন না কেন, সেখানকার মানুষ খুব একটা নিজের অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে পারেননি। উল্টে কোভিড মহামারিতে অনেকেই স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি খুইয়ে নিজের খাদ্যের সংস্থান করেছেন বা দৈনন্দিন অন্যান্য চাহিদা পূরণ করেছেন।
পড়ুন, ইলেকশন এক্সপ্রেস ২০২৪
জনপ্রতিনিধিদের সম্পত্তির পরিবর্তন বিচারের ক্ষেত্রে তাঁদের তথ্যই ব্যবহার করা হয়েছে যাঁরা গতবারের লোকসভা নির্বাচনে লড়াই করে জিতেছিলেন এবং কোনও না কোনও স্তরে শাসকের ভূমিকা পালন করেছেন। শুধু তাই নয় এবারও তাঁরা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ইতিমধ্যে মনোনয়ন জমা দিয়েছেন এবং নির্বাচন কমিশনের কাছে তাঁদের বর্তমান সম্পত্তির হিসেব পেশ করেছেন। আর একটি বিষয় মাথায় রাখা হয়েছে, এদের প্রত্যেকের-ই মূল পেশা রাজনীতি।
উন্নতি-১: ইনি হুগলির সাংসদ লকেট চ্যাটার্জি। কেন্দ্রে যে দল সরকার চালাচ্ছে সেই বিজেপির প্রতিনিধি। ২০১৯ সালে নির্বাচনের আগে তাঁর স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির মোট পরিমাণ ছিল ২ কোটি ৫৯ লাখ ৬৫ হাজার ৬৫৯ টাকা। ২০২৪ সালের নির্বাচনী হলফনামায় দেখা যাচ্ছে ওঁর স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি বেড়ে ৪ কোটি ১৪ লাখ ৮৭ হাজার ৪৬৩ টাকা হয়েছে। বৃদ্ধির পরিমাণ টাকার অঙ্কে ১ কোটি ৫৫ লাখ ২১ হাজার ৮০৪ টাকা।
উন্নতি-২: বীরভূমের তৃণমুল সাংসদ শতাব্দী রায়। তিনবারের সাংসদ। এবারেও নির্বাচনে লড়াই করছেন। ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে এঁকে জনরোষের মধ্যে পড়তে দেখা গেছে। এক বয়স্ক মহিলা গত ৫ বছরে কিছুই পাননি বলে সাংসদকে অস্বস্তিতে ফেলেছেন। তাতে কী গেল এল। নিজের পাওনার ঝুলি উনি অনেকটাই ভরিয়ে নিয়েছেন। ২০১৯ সালে বীরভূমের সাংসদের স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি মোট পরিমাণ ছিল ১ কোটি ৬৯ লাখ ৬৮ হাজার ৭০৫ টাকা। আর ২০২৪ সালে সেটাই বেড়ে হয়েছে ৮ কোটি ২ লাখ ৫৩ হাজার ৬৪০ টাকা। অর্থাৎ ৫ বছরে সাংসদের সম্পত্তি বৃদ্ধির হার ৩৬.৪৪ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে।
উন্নতি-৩: কৃষ্ণনগরের বিতর্কিত সাংসদ মহুয়া মৈত্র। এই সাংসদের কোনও স্থাবর সম্পত্তি নেই। সবটাই অস্থাবর সম্পত্তি। ২০১৯ সালে সেই সম্পত্তির মূল্য ২ কোটি ৬৪ লাখ ৯৫ হাজার ২৫০ টাকা। ২০২৪-এ তা বেড়ে হয়েছে ৩ কোটি ৫০ লাখ ৬৭ হাজার ১৬৬ টাকা। সম্পত্তি বৃদ্ধির আর্থিক মূল্য অনেকখানি।
উন্নতি-৪: অভিষেক ব্যানার্জি, ডায়মন্ড হারবারের তৃণমূল সাংসদ। লোকশ্রুতি রাজ্যের সরকার চলে এঁর অঙ্গুলিহেলনে। সভাসমিতিতে এঁর দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাজ্য সরকার অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। তাই ইনি বলতে পারেন ১০০ দিনের টাকা আমরা দেব, আবাস যোজনার ঘর আমরা বানিয়ে দেব, ইত্যাদি। তবে তথ্য বলছে এঁর কোনও স্থাবর সম্পত্তি নেই। এমনকী পরিবারের কোনও সদস্যেরই স্থাবর সম্পত্তি নেই। শান্তিনিকেতন নামের এস্ক্যালেটর বসানো যে বাড়িতে সাংসদ থাকেন তা নিয়ে সংবাদপত্র, সোশ্যাল মিডিয়াতে এত কথা— এগুলো সব তাহলে মিথ্যে! এটা পরিষ্কার, বিতর্কিত বাড়িটি পরিবারের কারও নয়। সাংসদের কাছে যা আছে সবই অস্থাবর সম্পত্তি। নির্বাচন কমিশনের তথ্য বলছে ৫ বছরে ওঁর সম্পত্তির বৃদ্ধি বাকিদের তুলনায় অনেকটাই কম। ২০১৯ সালে ডায়মন্ড হারবারের সাংসদের অস্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ৭১ লাখ ৪০ হাজার ৭৩৯ টাকা। ২০২৪ সালে সেটাই ১ কোটি ২৬ লাখ ২০ হাজার ২০৪ টাকা হয়েছে। তবে ওঁর ঋণ আছে ৩৬ লাখ টাকা।
এতক্ষণ যাঁদের কথা হল তাঁরা সবাই আইনসভার সদস্য। প্রত্যেকেই কোভিডের মতো কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েও নিজেদের স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির অনেকটাই বৃদ্ধি ঘটিয়েছেন। এঁরা প্রত্যেকেই কোটিপতি। আলোচনা থেকে সহজেই অনুমান করা যায়, সম্পত্তি বাড়ানোর উপায় এঁদের কাছে জানা আছে। আমজনতার সম্পত্তির বৃদ্ধি ঘটিয়ে তাঁদের জীবনযাত্রার মানকে উন্নত করার দায়িত্বও তো এঁদেরই হাতে ন্যস্ত ছিল। জনগণের সম্পদ বৃদ্ধি তো ঘটল না! তাঁরা যে তিমিরে ছিলেন সেই তিমিরেই রয়ে গেলেন। এখন প্রশ্ন হল, এই কোটিপতি জনপ্রতিনিধিরা কি জনগণের আয় বাড়াতে চাননি? না চেয়েছিলেন, পারেননি? এই প্রশ্নের উত্তর চাপা পড়ে যাচ্ছে কেন্দ্র-রাজ্য পারস্পরিক অরাজনৈতিক টানাপোড়েনে।
*মতামত ব্যক্তিগত। সমীক্ষায় ব্যবহৃত জনগণের নামগুলি পরিবর্তিত