দেশ এবং বাংলা বাঁচানোর নির্বাচন

শুভোদয় দাশগুপ্ত

 


এই নির্বাচন শুধুমাত্র গণতন্ত্র বাঁচানোর লড়াই নয়। এই নির্বাচন আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক ব‍্যবস্থার শুদ্ধিকরণের শপথ নেওয়ার নির্বাচন। এই নির্বাচন দেশের সংবিধানকে বাঁচানোর নির্বাচন। লড়াইটা কঠিন এবং অসম সন্দেহ নেই। কারণ গণতন্ত্র এবং এ-দেশের নির্বাচন দুই-ই এখন নিয়ন্ত্রিত হয় বে-আইনি টাকায় এবং বাহুবলীদের দ্বারা। এই দেশ বাঁচানোর লড়াইতে প্রতিপক্ষ দুটি রাজনৈতিক দল বিজেপি এবং তৃণমুল ইলেকটোরাল বন্ডের সর্ববৃহৎ দুই বেনিফিশিয়ারি। বিরোধীদের গণতন্ত্র ও দেশ বাঁচানোর লড়াইটা এই দুই দলের বিপুল টাকা, পেশিশক্তি এবং ব‍্যয়বহুল ও বর্ণাঢ‍্য প্রচারের বিপ্রতীপে দাড়িয়ে। তবে ইতিহাসে যখন সঙ্কটের চরমে পৌঁছে দেশ ও জাতি বিপন্ন হয়, জনগণ তখন ঠিকই প্রত‍্যয় ও বিপুল সাহসের সঙ্গে রুখে দাঁড়ায়

 

শুধুমাত্র আর একটা সাধারণ নির্বাচন নয়; এ হল বিপন্ন দেশের অস্তিত্বরক্ষার নির্বাচন। এই নির্বাচনের ফলাফলের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই সুবৃহৎ গণতন্ত্রের ভবিষ‍্যৎ। স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পেরিয়েও যে গণতন্ত্র বিদ‍্যমান, তার স্থায়িত্ব কিন্তু নিদারুণ সঙ্কটে। আমাদের রাজ‍্যে ও সারা দেশে আজ রাজনীতি দুর্নীতির সমার্থক। আর এই দুর্নীতিকে এমন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়েছে বর্তমান গণতান্ত্রিক ব‍্যবস্থাকেই ব‍্যবহার করে যে সেই ‘গণতন্ত্র’ এক বিভীষিকা আজ। দীর্ঘ চৌঁত্রিশ বছরের বাম শাসনের অবসান ঘটবার পর গণতান্ত্রিক কাঠামোতেই যে চরম স্বৈরতান্ত্রিক শাষন এ-রাজ‍্যে এক দশকের বেশি সময় ধরে চালানো হয়েছে তা এককথায় দুঃস্বপ্ন!

আমাদের দেশে গণতান্ত্রিক কাঠামোতে কিছু সীমাবদ্ধতা তো বরাবরই ছিল। বৈধ ভোটারদের কমবেশি তিরিশ শতাংশ মতদাতা ভোটদানে বিরত থাকেন। অর্থাৎ এই বৃহদংশের প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের মতের ব‍্যতিরেকেই দেশের শাসনক্ষমতা চলে যায় নির্বাচিত রাজনৈতিক দলের হাতে। অবাধ ও শান্তিপূর্ণ ভোটের কোনও নির্ভরযোগ‍্য ব‍্যবস্থা আজও নিশ্চিত করতে পারে না আমাদের দেশের নির্বাচন কমিশন। নির্বাচনে চলে বাহুবলীদের রমরমা, অর্থের দাপট। দরিদ্র ভোটারদের ভোট সামান‍্য কিছু টাকা অথবা একটা ভাল নৈশভোজ, কখনও কখনও সঙ্গে এক বোতল মদের বিনিময়ে কেনা, আবার কখনও বা বৈধ ভোটারদের ভয় দেখিয়ে তাঁদের ভোটার কার্ড নির্বাচনের আগের রাতে কেড়ে নিয়ে ভোটের দিন অবাধে ছাপ্পা ভোট দেওয়া। অর্থ এবং বাহুবলে বলীয়ান রাজনৈতিক দল ভোটগ্রহণের আগের দিন ভোটগ্রহণ কেন্দ্রেও পৌঁছে যায় সরকারি ভোটকর্মীদের কাছে। মদের বোতল এগিয়ে না দিলেও, এলাহি খাবারের প‍্যাকেট উপহার দেওয়ার চেষ্টা করে, তাঁদের দেখভাল করবার আশ্বাস দিয়ে, পরদিন ‘লক্ষ্মী হয়ে’ ভোট পরিচালনা করবার প্রচ্ছন্ন নির্দেশ দেওয়া হয় তাঁদের। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশগুলোর অন‍্যতম ভারতবর্ষে তাই নাগরিকরা কোনওকালেই আদর্শ গণতান্ত্রিক অধিকার অর্জন করেছে এ-কথা বলা যাবে না।

আর এই অবস্থার অন‍্যতম কারণ স্বাধীনতার ৭৫ বছর পেরিয়েও দেশের শিক্ষা, অর্থনীতি ও বেকারত্বের এই শোচনীয় হাল, যার প্রতি কোনওকালে কোনও সরকার কোনও দায়বদ্ধতা পালন করেনি।

গণতন্ত্রের প্রহসন শুধু ভোটগ্রহণের প্রক্রিয়ায় নয় ভোটগণনাতেও। শাসকদল বা বাহুবলী দল গণতন্ত্রের সর্বনাশ করেছে ভোটগণনায় কারচুপি করেও। একটা চালু রসিকতা ছিল— বিরোধী রাজনৈতিক দল অভিযোগ করছে আমরা অনেক ভোটে এগিয়েছিলাম কিন্তু তারপর “বাতি নিভায়ে দিল”। মানে গণনাকেন্দ্রের লোডশেডিং হল। আর আলো ফিরে এল যখন বিরোধীরা বিপুল ভোটে পিছিয়ে পড়ল, যে ব‍্যবধান আর ঘোচা সম্ভব নয়। এটা অবশ‍্য প্রাক-ইভিএম যুগের ভোট ও ভোটগণনার কাহিনি। তখন ব‍্যালটপেপারে পছন্দের প্রার্থীকে রাবার স্ট‍্যাম্পে ছাপ দেওয়ার যুগ ছিল। আর সেই হাজার হাজার ব‍্যালটবাক্স স্ট্রংরুম হয়ে গণনাকেন্দ্রে পৌঁছত। আর গণনার আগে বড় ড্রামে বিভিন্ন বুথের ব‍্যালটপেপার মিশিয়ে দিয়ে গণনা শুরু হত যাতে কোনও বিশেষ এলাকায় ভোটারদের ভোটের ট্রেন্ড চিহ্নিত না হয়ে যায়।

এদেশে রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলগুলির অবক্ষয় আজ গণতন্ত্রকে এক প্রহসনে পরিণত করেছে। একরাতের ভরপেট খাবার, মদ এবং টাকা দিয়ে কিনে নেওয়া যায় গরিব মানুষের মূল‍্যবান একটি ভোট যা পাঁচ বছরের জন‍্য এক জনপ্রতিনিধি তৈরি করার ক্ষেত্রে এবং শাসনক্ষমতা দখল করায় নির্নায়ক হয়ে উঠতে পারে। প্রশাসনকে ব‍্যবহার করে, বাহুবলীদের অবাধ সন্ত্রাস করতে দিয়ে বুথ দখল করে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করা হয় যা সরকার গঠনে নির্ণায়ক হয়ে ওঠে।

আমাদের দেশে গণতন্ত্রের সীমাবদ্ধতা এখানেই শেষ নয়। মতদাতারা পাঁচ বছর অপেক্ষা করে তাঁদের মতাদর্শকে পবিত্রতার সঙ্গে প্রয়োগ করে যে জনপ্রতিনিধি-কে নির্বাচিত করে পাঠালেন সেই জনপ্রতিনিধি এক লহমায় বিবিধ চাপের মুখে, তা সে মিথ‍্যে মামলায় ফাঁসানোর হুমকিতে হোক অথবা বিরাট অঙ্কের টাকার প্রলোভনে অন‍্য দলের ঝান্ডা ধরে নিলেন। পাঁচ বছর অপেক্ষা করে নিজেদের রাজনৈতিক আদর্শতে অবিচল থেকে যে প্রতিনিধিকে মতদাতারা সংসদে অথবা বিধানসভায় পাঠালেন তাঁদের সেই আদর্শের প্রতি অটল আস্থাকে ভুলুণ্ঠিত করে জনপ্রতিনিধি অন‍্য দলের ঝান্ডা ধরলেন!! এদেশের গণতন্ত্রের এই নড়বড়ে রাস্তাতেই মোদি এবং মমতা বিগত একদশক যথাক্রমে বিরোধীশূন‍্য সংসদ ও বিরোধীশূন‍্য বিধানসভা গঠনের উদ্দাম নেশায় মেতেছেন।

ভারতীয় সংবিধানের অন‍্যতম শ্লাঘা হল বহুত্ববাদের ঐতিহ‍্য। সেই ঐতিহ‍্য ধ্বংস করে ধর্মীয় বিভাজন ও ধর্মীয় উন্মাদনার মাধ‍্যমে মেরুকরণ করে ক্ষমতা দখলের লড়াই চলে আসছে। আর এই কদর্য রাজনীতিকেও পরোক্ষে পুষ্ট করে চলেছে বহুজাতিক সংস্থাগুলি তথা কর্পোরেট বাণিজ্যের জগৎ কোটি কোটি টাকা দিয়ে।

এই দুর্নীতি, যা ইলেকটোরাল বন্ডের ছদ্মবেশে গণতন্ত্রের সর্বনাশ করে এই দেশকে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে তার সঙ্গে যুঝবার ক্ষমতা আজ আর থাকছে না আদর্শবান রাজনৈতিক দলগুলোর। বিজেপির শাসনকালেই ২০১৭ সালে ইলেকটোরাল বন্ডের সূত্রপাত। এই পদ্ধতিতে কোনও ধনকুবের বা কর্পোরেট সংস্থা নিজেদের পরিচয় গোপন রেখে স্টেট ব‍্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার মাধ‍্যমে যে-কোনও রাজনৈতিক দলকে কোটি-কোটি টাকার বন্ড উপহার দিতে পারে। বলা বাহুল‍্য রাজনৈতিক দলগুলো এই ডোনারদের চিহ্নিত করে ক্ষমতায় এসে ডোনারদের কায়েমি স্বার্থের অঙ্গুলিহেলনে সরকার চালাতে বাধ‍্য হবে। শাসকদলের প্রতিটা নীতি নির্ধারিত হবে কর্পোরেট বন্ডের স্বার্থের নিরিখে। যে তথ‍্য সামনে আসছে তাতে কোভিডের সময় আমাদের দেশে বিজেপি সরকার নাকি আদার পুনাওয়ালার থেকেও বড় অঙ্কের ইলেকটোরাল বন্ডের বিনিময়ে একটা ভ‍্যাকসিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পরীক্ষার ন‍্যূনতম সময়ের অপেক্ষা ব‍্যতিরেকে তাকে ছাড়পত্র দেওয়ার মতো ঘৃণ‍্য অপরাধ করেছে। এখন শোনা যাচ্ছে যে এই কোভিড ভ‍্যাকসিন দেশ জুড়ে যাঁদের নিতে হয়েছে তাঁদের অনেকেরই জীবনসংশয় হওয়ার মতো রোগের আশঙ্কা থাকছে এবং এমন ঘটনা ঘটছেও। এই খবরের সত‍্যতা যাচাইয়ের ক্ষমতা নেই এই দেশের গরিব-নিরক্ষর মানুষদের। বিশেষত এই নয়া ডিজিটাল দুনিয়ায় যেখানে কোনটা ট্রুথ কোনটা ফেক, কোনটা রিয়েল কোনটা এআই, বোঝার উপায় নেই সাধারণ নিরক্ষর মানুষের। কিন্তু অভিযোগ যদি সত‍্যি হয় তাহলে সর্বোচ্চ দণ্ডের দাবি রাখে এই নৃশংস অপরাধ।

ইলেকটোরাল বন্ডের অর্থে বলীয়ান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অন‍্যান‍্য রাজনৈতিক দলগুলো আজ এক অসম লড়াই লড়ছে ভারতবর্ষের তথাকথিত গণতান্ত্রিক ব‍্যবস্থায়। তাদের একটা নির্বাচনে অবতীর্ণ হয়ে ইলেকটোরাল বন্ডের মদতপুষ্ট কোটি কোটি টাকার বর্ণাঢ‍্য প্রচারের পাশাপাশি ভোটারদের কাছে নিজেদের দলের প্রার্থীপরিচিতি বা দলীয় নির্বাচনী ইস্তেহার পৌঁছে দেওয়ার ন‍্যূনতম আর্থিক সঙ্গতিটুকুও নেই।

দেশের প্রচারমাধ‍্যম তথা গণতন্ত্রের অন‍্যতম স্তম্ভ সংবাদমাধ‍্যমের একটি বড় অংশ ইলেকটোরাল বন্ডের মুখাপেক্ষী অস্তিত্বে আজ আর “গণতন্ত্রের প্রহরী” নয়। সংবাদমাধ‍্যমের এই অংশ আজ লোকদেখানো গণতন্ত্র করে বিরোধী রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদেরও নিয়ম করে প্রতিদিন প‍্যানেল আলোচনায় ডাকছে, কিন্তু বর্তমান রাজনৈতিক সমীকরণে অপেক্ষাকৃতভাবে দুর্বল রাজনৈতিক দলের নেতাদের আলোচনার বেশিরভাগ সময়ে নিছক শ্রোতার মতো বসিয়ে রাখছে বা দয়া করে দু-চার মিনিট বলতে দিচ্ছে।

নাগরিকদের আর এক নির্ভরতার স্থল, যে কোনো শিক্ষিত দেশে পুলিশি ব‍্যবস্থা, যেখানে ন‍্যূনতম স্বচ্ছতা থাকা একটা শিক্ষিত দেশের জন‍্য অপরিহার্য। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের দেশের স্বরাষ্ট্র দফতর কোনওদিন আমজনতাকে নির্ভরতার জায়গা দিতে পারেনি। ঔপনিবেশিক পুলিশিব‍্যবস্থার ঘেরাটোপ থেকে স্বরাষ্ট্র দফতর আজও বেরোতে পারেনি আমাদের দেশে; না কেন্দ্রে না রাজ‍্যে। এই দফতর সর্বদাই সরকারের নয়, শাসকদলের বাহুবলী শক্তি আমাদের দেশে। একজন অতি সাধারণ নাগরিক যে-কোনও বিপদে যে-কোনও সঙ্কটে যে-কোনও দেশে যে-কোনও পরিস্থিতিতে যে জায়গায় সর্বাগ্রে নির্দ্বিধায় যাওয়ার অধিকার রাখে, সেই পুলিশের কাছে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ আজও কোনও সঙ্কটের মুহূর্তে যেতে ভয় পায়। এটাই বাস্তব। আর এই অবস্থাটা স্বাধীনতার পর থেকে ক্ষমতার অলিন্দে থাকা রাজনৈতিক দলগুলো বজায় রেখে চলেছে। পুলিশ-কে তারা শাসকদলের  প্রধানতম হাতিয়ার বানিয়েছে জাতিকে শিক্ষিত হতে না দিয়ে জাতিকে গরিব করে রেখে। ন‍্যায‍্য বিধান চেয়ে একজন নাগরিক পুলিশের কাছে এদেশে যেতে পারে শুধুমাত্র এক প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায়। শাসকদলেরা এদেশে পুলিশ-কে ক্ষমতাসীন দলের ঊর্দিধারী ঠ‍্যাঙাড়ে বাহিনি বানিয়ে রাখে। তাই এদেশের গণতন্ত্রে মুখ‍্যমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীরা কোনওদিনই যেমন আমনাগরিকের প্রধানমন্ত্রী/মুখ‍্যমন্ত্রী হন না, এই রাষ্ট্রপ্রধানদের স্বরাষ্ট্র দফতরও কোনওদিন আমজনতার পরিত্রাতা হয়ে উঠতে পারে না। পুলিশকর্মীদের সরকারি চাকুরে হিসেবে চাকরির নিরাপত্তা, পদোন্নতি ও বদলি সবই নির্ভর করে তাদের শাসকদলকে সেবা দেওয়ার উপর।

 

পড়ুন, দশের কথা, দেশের স্বর

 

এমনই এক দিশাহীন গণতান্ত্রিক ব‍্যবস্থায় দুর্নীতি এদেশে অবাধে রাজত্ব করবার পরিসর পেয়েছে। এই দুর্নীতি মন্ত্রিসভা থেকে আমলাদের সর্বস্তরে, বিশেষত পুলিশি ব‍্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে। দুশো বছরের ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার মহাকব‍্যিক স্বাধীনতা সংগ্রাম, শত-সহস্র শহিদের রক্তের বিনিময়ে, দেশভাগের যন্ত্রণার দুঃস্বপ্ন বহন করে যে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে, স্বাধীন ভারতের শাসককুল সেই ইতিহাসের প্রতি কোনও সুবিচার করেনি দেশ পরিচালনায়। ১৫ আগস্ট, ২৬ জানুয়ারি অথবা ৩০ জানুয়ারি জাতীয় পতাকা উড়িয়ে, চরকা কেটে, মাইকে দেশাত্মবোধক গান বাজিয়ে বছরের বাকি দিনগুলো দেশকে তলিয়ে যেতে দিয়েছে। এইভাবেই দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে গণতন্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপর্ণ স্তম্ভগুলোতে।

বিচারব‍্যবস্থাতেও এর ব‍্যতিক্রম হয়নি। কালে কালে বিচারব‍্যবস্থাকেও গ্রাস করতে উদ‍্যত হয়েছে রাজনীতি ও দুর্নীতি। একটা দেশের পক্ষে এর চেয়ে দুর্ভাগ‍্যজনক আর কিছুই হতে পারে না। এই পরিস্থিতি অভূতপূর্ব। এই ভ্রান্ত গণতান্ত্রিক ব‍্যবস্থায় গণতন্ত্রের সুযোগ নিয়ে জুডিশিয়ারিকে কালিমালিপ্ত করছে রাজনৈতিক দলগুলো। কালিমালিপ্ত করছে রাজনৈতিক দলগুলোর আশ্রয়ে থাকা বাহুবলীরা। সংবিধানের এই অবমাননা শুধু আদালত অবমাননা নয়; দেশদ্রোহিতার নামান্তর। বিচারব‍্যবস্থায় দুর্নীতিগ্রস্ত আইনজীবীদের অবাধ বিচরণ দেশের আজ অন‍্যতম বিপদ। এক কঠিন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আজকের ভারতবর্ষ।

একে একে গণতন্ত্রের সব কটি স্তম্ভের প্রতি আস্থা হারিয়েছে স্বাধীন ভারতের সাধারণ ও দরিদ্র নাগরিক। আজ এখন এই সাধারণ  নির্বাচনের আবহে এই রাজ‍্যে শিক্ষক নিয়োগের দুর্নীতি, কর্পোরেশনের নিয়োগ দুর্নীতি, নারদা-সারদা-রোজ ভ‍্যালি, গরুপাচার, রেশন দুর্নীতি,…. এক দশকের বেশি সময় ধরে এই প্রভূত দুর্নীতির পরও এই সরকার-কে কোনও নির্বাচনে এযাবৎ কোনও শিক্ষা দিতে চাননি (যদি-না ইভিএমেও দুর্নীতি হয়ে থাকে) মতদাতারা। নির্বাচনী ব‍্যবস্থায় যদি কোনও দুর্নীতি না থেকে থাকে কিসের জোরে মমতা বন্দ‍্যোপাধ‍্যায় এবং নরেন্দ্র মোদি এই সব সীমাহীন দুর্নীতি ও কেচ্ছা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হতে থাকবার পরও অত‍্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে দিব‍্যি ক্ষমতায় আসীন থেকে যাচ্ছেন? রহস‍্যটা কোথায়? কন‍্যাশ্রী, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, দু-টাকা কেজি চাল অথবা একশো দিনের কাজ? মা-বোনেদের কাছে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এক আত্মমর্যাদার সাক্ষ‍্য বহন করে সন্দেহ নাই। কিন্তু এই মর্যাদা শুধু পশ্চিমবঙ্গের নারীরা নয়, অন‍্যান‍্য রাজ‍্যেও নারীরা পান সরকারি প্রকল্পের আওতাভুক্ত হয়েই। তাই এই স্বীকৃতির প্রতিদান শাসকদলকে ভোট দেওয়া নয়, এটা তাদের অধিকার। যে-কোনও সরকারই মা-বোনেদের এই অনুদান দিতে কার্যত বাধ‍্য থাকবে ভবিষ‍্যতে। তাই এই রাজ‍্যে এই অনুদানের কৃতজ্ঞতাস্বরূপ শাসকদলকে ভোট দেওয়ার কোনও দায় নেই মা-বোনেদের। বরং তাঁদের ভাবতে হবে এই দ্রব‍্যমূল‍্যবৃদ্ধি, অশিক্ষা ও বেকারত্বের অসহায়তায় কর্পোরেট তরুণ প্রজন্মের সামনে কোনও সুন্দর জীবনযাপনের দিশা নেই। এ-রাজ‍্যের শিক্ষাব‍্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। দুর্বৃত্তরা দখল নিয়েছে স্কুল ও কলেজগুলিতে। শিল্প নেই, চাকরি নেই। আছে শুধু সন্ত্রাস, চুরি আর দুর্নীতি। এ-রাজ‍্য ছেড়ে ভিন্ন রাজ‍্যে চলে যেতে হচ্ছে আমার আপনার ঘরের ছেলেমেয়েদের জীবিকা অথবা উচ্চশিক্ষার সন্ধানে। ওইসব যৎসামান‍্য সরকারি অনুদান যা থেকে কোনও সরকারই বঞ্চিত করবেন না ভবিষ‍্যতে, তার বিনিময়ে মমতার সরকারকে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দেওয়ার অর্থ আপনার পরিবারে কোনও যোগ‍্য প্রার্থীর একটা সরকারি চাকরি পাওয়ার রাস্তা চিরতরে বন্ধ হয়ে যাওয়া। এ-রাজ‍্যে অসংখ‍্য নেতা-মন্ত্রী-আমলা বিগত দু-বছর ধরে জেল খাটছে। এই নির্বাচনের পর হয়তো এই রাজ‍্য সরকারের আরও ‘রাঘব-বোয়াল’ নেতামন্ত্রীরা জেলে চলে যেতে পারেন। আজ দু-বছরের বেশি সময় হাজার হাজার ছেলেমেয়ে ঘরবাড়ি ভুলে রাস্তায় আন্দোলন করছেন। তাঁদের পরীক্ষায় পাশ করে, ইন্টারভিউ দিয়ে পাওয়া চাকরি এই সরকারের আমলে বিক্রি হয়ে গেছে অযোগ‍্য ফেল করা চাকরিপ্রার্থীদের কাছে।

এই আবহেই গণতন্ত্রের স্তম্ভগুলো আক্রান্ত হয়ে চ’লেছে। সংবাদমাধ‍্যমের একটা বড় অংশ নতুন করে বিশ্বাসযোগ‍্যতা হারাতে বসেছে বিশেষত ইলেকটোরাল বন্ডের স্ক‍্যাম সামনে আসবার পর। এই রাজ‍্যে নিয়োগ-দুর্নীতি নিয়ে যখন রাজ‍্য তোলপাড়, ইলেকটোরাল বন্ডের স্ক‍্যাম ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। আর এই পরিস্থিতিতেই প্রশ্ন জাগছে এত এত নিউজ চ‍্যানেল, এত এত সংবাদপত্রের বিশ্লেষণ— তার স্বচ্ছতা কতটুকু? প্রশ্ন জাগছে এইসব চ‍্যানেলের নির্বাচনী বিশ্লেষণ, প্রাক ও পোস্ট-পোল সমীক্ষা কতটা স্বচ্ছ!!

সাধারণ মানুষ তাহলে কোথায় দাঁড়াবে! একশো একচল্লিশ কোটির এই সুবৃহৎ গণতন্ত্র যার শতকরা আশিভাগ মানুষ স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পেরিয়েও শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও স্বাস্থ্যের রাষ্ট্রীয় পরিষেবা থেকে বঞ্চিত অথচ যাদেরকে ব‍্যবহার করে, যাদের ভোটকে প্রভাবিত করেই এদেশের তথাকথিত গণতন্ত্র আজও বিরাজ করছে, তারা কি কোনওদিন মাথা উঁচু করে জীবনযাপন করতে পারবে? এই প্রশ্নটাই আজ আরও গুরুতর হয়ে উঠেছে এই লোকসভা নির্বাচনে যা সাত-টি পর্বে সংঘটিত হচ্ছে তার পরিপ্রেক্ষিতে। বিগত এক দশকের বেশি সময় ধরে আমাদের রাজ‍্যে ও দেশে শাসককুল ও শাসনব‍্যবস্থা যেভাবে এই তথাকথিত গণতন্ত্রেরই নড়বড়ে কাঠামোকে তিলে তিলে অপব‍্যবহার করে এক চূড়ান্ত স্বৈরাচারকে প্রতিষ্ঠা করে চলেছে তা ভয়ঙ্কর এবং নৃশংস। দেশ ও এ-রাজ‍্যের সচেতন নাগরিকদের পরিস্থিতির সবটাই জানা। এক দশকেরও বেশি সময় এই রাজ‍্যে আদ‍্যন্ত দুর্নীতিতে ভরা একটা সরকার চলছে। নারদা-সারদা, শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি, কলকাতা কর্পোরেশনে নিয়োগ দুর্নীতি, গরু-পাচার, রেশন দুর্নীতি, স্কুলশিক্ষায় মিড-ডে মিল দুর্নীতি… শাসকদলের গুরুত্বপূর্ণ অসংখ‍্য নেতা-মন্ত্রী, এবং সরকারি আমলারা বহুকাল জেলে বন্দি… তবু এই সরকার ক্ষমতাসীন এই বাংলায়, যে বাংলাকে নিয়ে একদা বলা হয়েছে “আজ বাংলা যা ভাবছে আগামীকাল তাই ভাববে গোটা দেশ”। এই অবাধ এবং লাগামহীন দুর্নীতিকে এক প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে দুর্নীতিকে এক শিল্পে পরিণত করতে মমতা বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের সরকার সূচনাপর্ব থেকেই গণতন্ত্রের কন্ঠরোধ করেছে, বিরোধীশূন‍্য বিধানসভা গঠনের লক্ষে বিরোধী জনপ্রতিনিধিদের ভয় দেখিয়ে, ক্ষমতা ও টাকার প্রলোভন দেখিয়ে প্রকাশ‍্যে তাদের হাতে শাসকদলের পতাকা ধরিয়ে গিয়েছে। এই মডেল  প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মডেলের রেপ্লিকা। কারণ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিই এই বিরোধীশূন‍্য লোকসভার মডেলের প্রবক্তা। যার প্রতিধ্বনী বিজেপির এই লোকসভা নির্বাচনের প্রচারেও.. আবকি বার চারশও পার। এই বিরোধীশূন‍্য গণতন্ত্রের স্লোগান ভারতীয় গণতন্ত্রে অভুতপূর্ব। এই বিরোধীশূন‍্য বিধানসভা/সংসদ গঠনের আহ্বানও কিন্তু জানানো হচ্ছে ভারতবর্ষের বর্তমান গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোকে ব‍্যবহার করেই। এটাই প্রহেলিকা! আর নরেন্দ্র মোদির এই বিরোধীশূন‍্যতার লক্ষে দেশবাসীকে প্ররোচিত করার প্রলুব্ধ করবার অন‍্যতম উদ্দেশ‍্যই হল স্বাধীন ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ বহুত্ববাদের ঐতিহ‍্যে সমৃদ্ধ সংবিধানকে সরাসরি আক্রমণ করে ধর্মীয় মৌলবাদকে মান‍্যতা দিয়ে এক হিন্দুরাষ্ট্র গঠন করা। এই লক্ষ‍্যেই বিজেপি একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবেদিত। এরই লক্ষ‍্যে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা, গোধরায় গণহত‍্যা সংঘটিত করা, দেশের বহুত্ববাদের পবিত্র ইতিহাসকে বদলে দেওয়ার দুরভিসন্ধি। এই লক্ষ‍্যেই কোভিড অতিমারির পৃথিবীব‍্যাপী দুঃস্বপ্নের সময়ে অযোধ‍্যায় ভূমি-পূজা, রেল, পোস্টাল সার্ভিস তথা কয়লা শিল্পের বেসরকারিকরণের প্রক্রিয়া শুরু করা। এই লক্ষ‍্যেই ভরা অতিমারি, ভরা লকডাউনে জাতীয় শিক্ষানীতি সংসদে আলোচনার পরিসর ব‍্যতিরেকে পাশ করিয়ে নিয়ে এদেশে পাবলিক ফান্ডেড এডুকেশন থেকে যাবতীয় দায়বদ্ধতা প্রত‍্যাহার করে নেওয়ার রাস্তা সুগম করা। অনলাইন শিক্ষাব‍্যবস্থার বিশ্বব‍্যাপী বাণিজ‍্যে এই দেশকে সঁপে দেওয়া। এই সুগভীর দেশ বেচার চক্রান্তের মধ‍্যে যখনই কোনও নির্বাচন এসেছে দেশবাসীর সামনে আনা হয়েছে কারগিল, পুলওয়ামার মতো স্পর্শকাতর দেশাত্ববোধের সেন্টিমেন্ট। আর এমন একটা মৌলবাদী দল, যাদের কোনও কালে কোনও ঠাঁই ছিল না পশ্চিমবঙ্গে বাম আমলে, নিজের প্রাসঙ্গিকতা তৈরি করবার তাগিদে তাদের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছিলেন মমতা বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়, যার ফসল তিনি আজও ঘরে তুলছেন এ-রাজ‍্যের শাসনক্ষমতা কুক্ষিগত রাখতে। এই উদ্দেশ‍্য চরিতার্থ করতে গিয়ে তিনি এই রাজ‍্যের সাংস্কৃতিক তথা রাজনৈতিক কৃষ্টিটাই ধ্বংস করে  দিয়েছেন সমাজবিরোধীদের হাতে সন্ত্রাস ও দুর্নীতির অগাধ ক্ষমতা তুলে দিয়ে।

মাননীয়া আমাদের রাজ‍্যের কৃষ্টি-সম্পন্ন, রাজনীতিসচেতন মানুষকে নিগ্রহ শুধু করেননি, তাঁদের অসম্মানিত করে, সন্ত্রস্ত করে তাদের এক সীমাহীন অবসাদে নিমজ্জিত রেখেছেন এক দশকেরও বেশি সময় ধরে। এই পাপের ক্ষমা নেই। এই সন্ত্রাস, নিগ্রহ, অসম্মান আর সর্বস্তরে লাগামহীন দুর্নীতি আর চুরি “আমার পশ্চিমবঙ্গ নয়”। এই আবহেই রাজ‍্য সরকার বদলের এই নির্বাচন না হয়েও এই লোকসভা নির্বিচন সারা দেশের সঙ্গে এই রাজ‍্যেও এক চরম গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন।

 

পড়ুন, ইলেকশন এক্সপ্রেস ২০২৪

 

এই নির্বাচন শুধুমাত্র গণতন্ত্র বাঁচানোর লড়াই নয়। এই নির্বাচন আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক ব‍্যবস্থা যার দুর্বল জায়গাগুলোকে পূর্ণমাত্রায় ব‍্যবহার করে গণতন্ত্রের মোড়কে চরম স্বৈরতান্ত্রিক শাসন কায়েম করেছে এ-রাজ‍্য ও কেন্দ্রের শাসকদল সেই ছদ্ম-গণতন্ত্রের শুদ্ধিকরণের শপথ নেওয়ার নির্বাচন। এই নির্বাচন দেশের সংবিধানকে বাঁচানোর নির্বাচন। লড়াইটা কঠিন এবং অসম সন্দেহ নেই। কারণ গণতন্ত্র এবং এ-দেশের নির্বাচন দুই-ই এখন নিয়ন্ত্রিত হয় বে-আইনি টাকায় এবং বাহুবলীদের দ্বারা। আর এই দেশ বাঁচানোর লড়াইতে প্রতিপক্ষ দুটি রাজনৈতিক দল বিজেপি এবং তৃণমুল ইলেকটোরাল বন্ডের সর্ববৃহৎ দুই বেনিফিশিয়ারি। বিরোধীদের গণতন্ত্র ও দেশ বাঁচানোর লড়াইটা এই দুই রাজনৈতিক দলের বিপুল টাকা এবং পেশিশক্তি এবং ভোটারদের সম্মোহিত করা ব‍্যয়বহুল ও বর্ণাঢ‍্য প্রচারের বিপ্রতীপে দাড়িয়ে। তবে ইতিহাসে যখন সঙ্কটের চরমে পৌঁছে দেশ ও জাতি বিপন্ন হয়, জনগণ তখন ঠিকই প্রত‍্যয় ও বিপুল সাহসের সঙ্গে রুখে দাঁড়ায়। কোনও রাজনৈতিক দল নয়, জনতাই তখন বুথ পাহারা দিতে নামে, ভোটকেন্দ্রের দখল ন‍েয় নৈতিক তাগিদে। সেই সময়টা বোধহয় এসেই পড়েছে।

ইতালীয় নাট‍্যকার ঔপন‍্যাসিক পিরানদেলোর নাটক “সিক্স ক‍্যারেকটারস ইন সার্চ অফ অ্যান অথর” (প্রকাশকাল ১৯২১), গত শতাব্দীর মধ‍্যভাগ পেরিয়ে অজিতেশ বন্দ‍্যোপাধ‍্যায় যার সার্থক বাংলা প্রযোজনা করেছিলেন “নাট‍্যকারের সন্ধানে ছ’টি চরিত্র” নামের সেই রূপকধর্মী নাটকে; তার একটা অন‍্যতম বার্তা ছিল এই যে,  সিচুয়েশন হলে ক‍্যারেকটার আসবেই। দেশের এই সাধারণ নির্বাচন আভাস দিচ্ছে যে সিচুয়েশন আসতে চলেছে, ক্ষেত্র প্রস্তুত হচ্ছে প্রতিনিয়ত, দেশে এবং এই রাজ‍্যেও। আর ক‍্যারেকটার আসাটাও তাই অবশ‍্যম্ভাবী, কার্যত সময়ের অপেক্ষা।


*মতামত ব্যক্তিগত

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4887 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...