ডঃ দাভোলকর হত্যাকাণ্ড— বিচার ও রায়— ফিরে দেখা

প্রবীর মুখোপাধ্যায়

 


ভারতীয় সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যকে অন্ধবিশ্বাস আর কুসংস্কারমুক্ত করে যুক্তি আর প্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার যে আন্দোলন গড়ে তোলা হচ্ছিল, ডঃ দাভোলকর এবং তার পরবর্তী সময়ে গোবিন্দ পানসারে, এমএম কালবুর্গি এবং গৌরী লঙ্কেশের ওপর সংগঠিত এই সব হত্যাকাণ্ডগুলি প্রকৃতপক্ষে সেই সব আন্দোলনের ওপর সংঘটিত সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ। এই সব হত্যাকাণ্ডের পেছনে আছে পাকা মাথার পূর্বপরিকল্পনা। আর সেই সব পাকা মাথা হচ্ছে সেই সমস্ত মৌলবাদী সংগঠন যারা ধর্ম আর রাজনীতিকে একসঙ্গে মিলিয়ে দেশের রাজনৈতিক প্রশাসনিক ক্ষমতা দখল করে রাখতে সচেষ্ট। সেই কারণেই এই সব হত্যাকাণ্ড সংক্রান্ত তদন্তে শ্লথগতি আর দীর্ঘসূত্রিতা, আদালতের সামনে অপরাধ ও অপরাধীদের সঠিকভাবে উপস্থাপিত করার অনীহা

 

দেশজুড়ে সংসদীয় নির্বাচনের ব্যস্ততা ও কোলাহলের মাঝে একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ খবর হয়তো অনেকেরই নজর এড়িয়ে গেছে। খবরটি হল এই যে ১০ মে তারিখে পুনে শহরের এক বিশেষ সিবিআই আদালত ডঃ নরেন্দ্র অচ্যুত দাভোলকরকে হত্যা করার অপরাধে দুই ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করল। ২০১৩ সালের আগস্ট মাসের ২০ তারিখে শচিন প্রকাশরাও আন্দুরে এবং শারদ ভাউসাহেব কালাসকর এই দুজনে মোটর সাইকেলে করে এসে মহারাষ্ট্রের অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার দূরীকরণ আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ডঃ নরেন্দ্র অচ্যুত দাভোলকরকে সামনাসামনি গুলি করে হত্যা করে। ডঃ দাভোলকর তখন ‘মর্নিং ওয়াক’ সেরে বাড়ির পথে ফিরছিলেন। ঘটনাস্থল পুনে শহরের শনিবার পেঠ এলাকার ওঁঙ্কারেশ্বর ব্রিজ-এর কাছাকাছি জনবহুল এলাকা।

অন্ধবিশ্বাস আর কুসংস্কারকে হাতিয়ার করে কবচ-তাবিজ-জলপড়া-বশীকরণ ইত্যাদির মাধ্যমে রোগ-বিপদ নিরাময় নিয়ে একটা বিরাট ব্যবসায় আমাদের গ্রামাঞ্চলে চালু আছে। শহুরে মানুষদেরও অনেকেই আর্থিক অস্বচ্ছলতা ও অজ্ঞতার কারণে এই ব্যবসায়ীদের খপ্পরে পড়ে যায়। এই ধরনের প্রতারণার বিরুদ্ধে এক আইন প্রণয়নের দাবিতে ডঃ দাভোলকর শুধু যে এক শক্তিশালী গণআন্দোলন গড়ে তুলছিলেন তাই নয়, অন্ধশ্রদ্ধা নির্মূলন বিলের এক খসড়া তিনি প্রস্তুত করেছিলেন। যখন দাভোলকরকে হত্যা করা হয় সেই সময়ে ওই খসড়া বিল মহারাষ্ট্র বিধানসভার সামনে অনুমোদনের জন্য ছিল। এই বিলকে ‘হিন্দুবিরোধী’ বলে অভিহিত করে বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল আর সামাজিক ও ধর্মীয় সংগঠন এর বিরোধিতা করছিল। আশ্চর্যের বিষয় এই যে ডঃ দাভোলকরকে ১০ আগস্ট গুলি করা হল আর মহারাষ্ট্র সরকার তার ১৪ দিন পরেই সেই বিলকে অর্ডিন্যান্স বা অধ্যাদেশ হিসাবে পাশ করাল। এবং ওই ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে মহারাষ্ট্র বিধানসভা Maharashtra Prevention and Eradication of Human Sacrifice and other Inhuman, Evil and Aghori Practices and Black Magic Act, 2013 অনুমোদন করে।

ডঃ দাভোলকরকে গুলি করে হত্যা করার ঘটনা কোনও একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ২০১৩ সালের ১০ আগস্ট তারিখে ঘটে যাওয়া এই ঘটনাটির ধারাবাহিকতা দেখতে পাওয়া গিয়েছিল যখন একের পর এক গুলি করে হত্যা করা হল গোবিন্দ পানসারে, এমএম কালবুর্গি এবং গৌরী লঙ্কেশ-কে। মহারাষ্ট্রের কোলাপুরে কমিউনিস্ট নেতা গোবিন্দ পানসারে ও তাঁর স্ত্রী উমা আততায়ীর হাতে গুলিবিদ্ধ হন ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫। গোবিন্দ পানসারে মারা যান এর চারদিন পরে ২০ ফেব্রুয়ারি তারিখে। ৩০ আগস্ট ২০১৫ তারিখে কর্নাটকের ধারওয়াদ জেলায় নিজের বাড়িতে দুজন অজ্ঞাত আততায়ীর গুলিতে নিহত হন কন্নড় সংস্কৃতির সুপণ্ডিত এমএম কালবুর্গি। তিনজন অজ্ঞাত আততায়ী ব্যাঙ্গালোরের রাজরাজেশ্বরী নগরে সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশের বাড়িতে ঢুকে গুলি চালিয়ে তাঁকে হত্যা করে ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭ তারিখে। ডঃ দাভোলকর-সহ এদের সকলেরই এক অপরাধ, এঁরা সমাজ থেকে অন্ধবিশ্বাস, গোঁড়ামি আর কুসংস্কার দূর করার সামাজিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন।

 

ঘটনা ঘটে যাওয়ার দশ বছরেরও বেশি সময় পার হয়ে যাওয়ার পরে অপরাধের শাস্তি বিধান হল। বিশেষভাবে উল্লেখ করার বিষয় এই যে এই অপরাধের তদন্ত আর আদালতে বিচারের সময়ে পুলিশ ও সরকারি আধিকারিকদের ভূমিকা নিয়ে স্বয়ং বিচারকই যে অসন্তুষ্ট সে-কথা তাঁর রায়ে প্রকাশ করতে বিচারক প্রভাকর পি যাদব দ্বিধা করেননি।

 

কে এই নরেন্দ্র অচ্যুত দাভোলকর?

ভারতীয় সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যকে অন্ধবিশ্বাস আর কুসংস্কারমুক্ত করে প্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার যে আন্দোলন প্রধানত মহারাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছিল তার নেতৃত্বে ছিলেন ডঃ নরেন্দ্র অচ্যুত দাভোলকর।

কবাডি খেলায় বিশেষ দক্ষ দাভোলকর শিবাজি ইউনিভার্সিটির কবাডি টিমের ক্যাপ্টেন ছিলেন আর মহারাষ্ট্র সরকারের শিব ছত্রপতি যুব পুরস্কার লাভ করেছিলেন। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এক কবাডি প্রতিযোগিতায় ভারতের পক্ষে অংশগ্রহণও করেছিলেন। গভর্নমেন্ট মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি নিয়ে বারো বছর ডাক্তার হিসেবে প্র্যাকটিস করার পর ১৯৮০ সাল থেকে সামাজিক আন্দোলনের কর্মী হিসেবে নিজেকে পুরোপুরি নিয়োজিত করেন দাভোলকর। দলিত অচ্ছ্যুৎ নির্বিশেষে গ্রামের প্রত্যেক অধিবাসী যেন একই কুয়ো থেকে জল নিতে পারার অধিকার পায় সেই লক্ষ্যে বাবা আধভ শুরু করেছিলেন এক গাঁও এক পানোথা (এক গাঁও-এক কুয়ো) অভিযান। দাভোলকর যুক্ত হন সেই অভিযানে। ক্রমে ক্রমে সমাজের অন্ধবিশ্বাস দূরীকরণের প্রতি দাভোলকরের দৃষ্টি কেন্দ্রীভূত হয়। যোগদান করেন অখিল ভারতীয় অন্ধশ্রদ্ধা নির্মূলন সমিতিতে (Akhil Bharatiya Andhashraddha Nirmoolan Samity ABANS)। মহারাষ্ট্রে ১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠা করেন মহারাষ্ট্র অন্ধশ্রদ্ধা নির্মূলন সমিতি (MANS)। গ্রামে গ্রামে গিয়ে অন্ধবিশ্বাস আর নানা ধরনের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রচার করতে থাকেন। সেইসব তান্ত্রিক আর ‘বাবা’ যারা তুকতাক করে মাদুলি কবচ তেলপড়া জলপড়া আর দৈবশক্তিতে অসুখ সারিয়ে দেওয়ার কথা বলে তাদের স্বরূপ উন্মোচিত করতে থাকেন গ্রামের সরল মানুষদের কাছে। সমাজের প্রান্তিক মানুষেরা যেন নিরাপত্তা, আত্মসম্মান আর উন্নতির সঙ্গে বাস করতে পারে সেই পথে তাদের ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে মহারাষ্ট্রের সাতারা শহরে এক সামাজিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র পরিবর্তন-এর তিনি ছিলেন অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাসদস্য। ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন যুক্তিবাদী নেতা সানাল এডামারুকুর সঙ্গে। সানে গুরুজি নামে প্রখ্যাত পান্ডুরং সদাশিব সানে প্রতিষ্ঠিত বিখ্যাত মারাঠা সাপ্তাহিক সাধনা পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন দাভোলকর। ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান র‍্যাশনালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনস-এর সহসভাপতি হিসাবেও আগে কাজ করেছেন। ১৯৯০ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে দলিত অচ্ছ্যুৎ মানুষদের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের সমর্থনে, ভারতের জাতিবর্ণাশ্রম ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আর জাতিবর্ণ সংক্রান্ত হিংসাত্মক সব ঘটনার প্রতিবাদে গণআন্দোলন গড়ে তুলতে দাভোলকর নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করছিলেন। এই সব বিষয়ে প্রচুর প্রচারপুস্তিকা ও বই তিনি লিখেছেন। এই সময়ে তিন হাজারেরও বেশি জনসভায় বক্তৃতা দিয়েছেন।

মারাঠাওয়াড়া ইউনিভার্সিটির নাম পরিবর্তন করে বাবাসাহেব আম্বেদকরের নামে করার অন্যতম প্রস্তাবকও তিনি ছিলেন। ২০১৩ সালের মার্চ মাসে যখন সারা মহারাষ্ট্র জুড়ে ভয়ঙ্কর খরা চলছে, লোকে পানীয় জলের অভাবে ভুগছে, সেই সময়ে আসারাম বাপু তার চেলাচামুন্ডাদের নিয়ে হোলি উৎসবে মত্ত। আর তার জন্য ট্যাঙ্কারে ভরে ভরে জল আসছে নাগপুর মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনায়। এর প্রতিবাদে আন্দোলনে পথে নেমে পড়েছিলেন দাভোলকর।

মহারাষ্ট্রে অন্ধবিশ্বাস দূর করার লক্ষ্য নিয়ে দাভোলকরের তত্ত্বাবধানে মহারাষ্ট্র অন্ধশ্রদ্ধা নির্মূলন সমিতি (MANS) ২০১০ সালে এক জাদুটোনা বিরোধী বিল (Anti-Superstition & Black Magic Ordinance)এর খসড়া তৈরি করে। এবং দাবি করে যে এর ভিত্তিতে বিধানসভায় আইন পাশ করা হোক। কিন্তু বিলের খসড়া প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই বিলকে ধর্মবিরোধী বলে চিহ্নিত করে এর সমালোচকেরা। ভারতীয় জনতা পার্টি আর শিবসেনা এই বিলের বিরোধিতা করে এই বলে যে এই বিল এর ফলে হিন্দু সংস্কৃতি, রীতিনীতি আর ঐতিহ্য আহত হবে। এই সব সমালোচনার যথাযোগ্য জবাব দিয়ে দাভোলকর সংবাদমাধ্যম এএফপিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, “এই বিলের সম্পূর্ণ অংশের কোনও স্থানেই ভগবান বা ধর্ম প্রসঙ্গে একটি শব্দও নেই। এরকম কিছুই নেই। ভারতীয় সংবিধান ধর্মাচরণের স্বাধীন অধিকার দিয়েছে আর কোনও কিছুই সেই অধিকার কেড়ে নিতে পারে না। এই বিল লোকঠকানো আর শোষণমূলক কাজ কারবারের বিরুদ্ধে।”

 

দাভোলকর হত্যা তদন্তকাণ্ড

তারিখ ছিল ২০১৩ সালের ২০ আগস্ট। নিয়মিত প্রাতঃভ্রমণ করছিলেন দাভোলকর। এমন সময়ে দুজন মোটরসাইকেল আরোহী আততায়ী তাঁকে সরাসরি গুলি করে। ঘটনাস্থল পুনে শহরের ওঙ্কারেশ্বর ব্রিজের শনিবার পেঠ এলাকা। স্থানীয় পুলিশ মণীশ রামদাস নোগরি এবং বিকাশ রামঅবতার খান্ডেলওয়াল নামে দুই ব্যক্তিকে এই হত্যাকাণ্ডে যুক্ত অভিযোগে গ্রেফতার করে। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিতে পুলিশ ব্যর্থ হয়। প্রথম থেকেই এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার তদন্তে পুলিশের গাছাড়া মনোভাব ও দায়সারা কাজের অভিযোগ তুলে দাভোলকর পরিবারের পক্ষ থেকে উচ্চতর আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হতে থাকে। ২০১৭ সালে গৌরী লঙ্কেশ হত্যাকাণ্ডের তদন্তে কর্নাটক পুলিশের সক্রিয় হস্থক্ষেপের পরেই দাভোলকর হত্যা মামলার তদন্তে কিছু গতি আসে।

গত দশ বছর ধরে এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত চলেছে। শুরু হয়েছিল পুনে পুলিশের হাতে— তারপর মহারাষ্ট্রের অ্যান্টিটেররিজম স্কোয়াড (ATS) দায়িত্ব নেয়। ২০১৪ সালে বম্বে হাইকোর্টের নির্দেশে তদন্তভার আসে সিবিআই-এর কাছে। ২০১৫ সালে হাইকোর্টে দাভোলকরের পরিবার অভিযোগ করে যে এই মামলার তদন্তে কোনও অগ্রগতি হচ্ছে না। তখন থেকে হাইকোর্ট এই তদন্তের গতিপ্রকৃতির ওপর নজর রাখতে শুরু করে। তদন্তের অগ্রগতিতে সন্তুষ্ট হয়ে হাইকোর্ট এই নজরদারি তুলে নেয় ২০২৩ সাল থেকে।

দাভোলকরের ওপর গুলি চালিয়েছিল যে দুজন আততায়ী সেই শচিন প্রকাশরাও আন্দুরে এবং শারদ ভাউসাহেব কালাসকরকে আইপিসির ৩০২ এবং ৩৪ ধারা অনুসারে অপরাধী ঘোষণা করে গত ১০ মে তারিখে পুনের বিশেষ সিবিআই আদালতের বিচারপতি প্রভাকর পি যাদব যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন। উপযুক্ত উদ্দেশ্য বা মোটিভ প্রমাণে ব্যর্থ হওয়ায় অপর তিন অভিযুক্ত ডঃ বীরেন্দ্রসিন্হ শারদচন্দ্র তাওয়াড়ে, আইনজীবী সঞ্জীব পুনালেকর এবং তার সহকারী বিক্রম ভাবে ছাড়া পেয়ে যায়। ১১ মে তারিখে প্রকাশিত ১৭১ পৃষ্ঠার বিস্তৃত রায়ে বিচারক যাদব এই হত্যাকাণ্ড মামলার তদন্তে পুলিশ ও সিবিআইএর ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করেন। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের UAPA আইনের আওতায় এনে বিচারের জন্য যে ধরনের সরকারি অনুমোদন প্রয়োজন হয় নিয়ম অনুসারে সেইসব অনুমোদন মহারাষ্ট্র সরকারের আইন বিভাগে থেকে না আসায় সরকারপক্ষ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে যে দাভোলকরের হত্যাকাণ্ড একটি সন্ত্রাসবাদী কাজ— সাধারণ কোনও হত্যা নয়। এই তিনজন অভিযুক্ত যে খালাস পেয়ে যাচ্ছে তার মূল কারণ এই নয় যে এরা এই অপরাধে যুক্ত ছিল না। প্রথমে মহারাষ্ট্র পুলিশ ও তারপরে সিবিআই নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে বলেই এরা ছাড়া পেয়ে গেল এ-কথা পরিষ্কারভাবে বিচারক তাঁর রায়ে উল্লেখ করেছেন।  

দাভোলকর গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন ২০১৩ সালে। গৌরী লঙ্কেশ হত্যাকাণ্ডে এই দুজন জড়িত এ-কথা প্রকাশ পাওয়ার পরেই আততায়ী আন্দুরে আর কালাসকর গ্রেফতার হয় ২০১৮ সালে। লঙ্কেশের হত্যা নিয়ে তদন্ত করছিল কর্নাটক পুলিশের স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম (SIT)। তাদের সাহায্যে মহারাষ্ট্রের অ্যান্টিটেররিজম স্কোয়াড (ATS) এদের গ্রেফতার করে। আন্দুরে আর কালাসকর কিন্তু ভাড়াটে খুনি মাত্র। আদালতের রায় থেকে বোঝা যাচ্ছে যে আন্দুরে আর কালাসকর দাভোলকরকে যে গুলি করে হত্যা করল সেটি খুব সুচারুভাবে প্রস্তুত এক পরিকল্পনা অনুসারে ঘটানো হয়েছিল। এই দুই অভিযুক্তের আর্থিক ও সামাজিক যে অবস্থান তার থেকে এটা স্পষ্ট যে এরা এই অপরাধের প্রধান হোতা হতে পারে না। বিচারক লিখছেন “এই অপরাধের পিছনে প্রধান হোতা, ইংরেজিতে যাকে বলে মাস্টারমাইন্ড, তিনি অন্য কোনও ব্যক্তি। পুনে পুলিশ আর সিবিআই উভয়েই এই ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের সামনে নিয়ে আসতে ব্যর্থ। তাদের ভেবে দেখতে হবে যে এটা তাদের নিজেদের দিক থেকে ব্যর্থতা না কি তারা ক্ষমতাসীন কোনও ব্যক্তির অঙ্গুলিহেলনে ইচ্ছাকৃতভাবে উদাসীন থেকেছে।”

পুনে পুলিশ আর সিবিআই উভয়েই আদালতের সামনে যে চার্জশিট বা অভিযোগপত্র পেশ করেছিল সেখানে ডঃ বীরেন্দ্রসিংহ শারদচন্দ্র তাওয়াড়ে-কে এই হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড বলা হয়েছে। ২০০০ সাল অবধি ডঃ তাওয়াড়ে পেশাদার চিকিৎসক হিসাবে কাজ করেছেন। ওই বছরে তিনি নিজের পেশা ত্যাগ করে সনাতন সংস্থা এবং এর সহযোগী হিন্দু জনজাগ্রুতি সমিতিতে পুরোপুরি যুক্ত হয়ে পড়েন। সিবিআইএর চার্জশিটে দাবি করা হয় যে দাভোলকরের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত শত্রুতা ছিল। বারংবার এই প্রসঙ্গ সামনে এনে চার্জশিটে দাবি করা হয় যে দাভোলকরকে হত্যার পিছলে মূল কারণ এই ব্যক্তিগত শত্রুতা। কিন্তু এই দাবির সমর্থনে কোনও প্রমাণ সিবিআই আদালতের সামনে হাজির করতে ব্যর্থ হয়।

সরকারপক্ষ থেকে এই মামলায় কুড়িজন সাক্ষীকে জেরা করা হয়। এর মধ্যে দুজন এই গুলিচালনার ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, আর দুজন ছিলেন সনাতন সংস্থার ঘনিষ্ঠ সহযোগী। ডঃ তাওয়াড়ের ঘনিষ্ঠ ও এক সময়ে সনাতন সংস্থার সঙ্গে জড়িত সঞ্জয় অরুণ সাদভিলকর এই মামলার অন্যতম এক সাক্ষী। সাক্ষী হিসাবে তিনি আদালতে জানান যে ডঃ তাওয়াড়ের সঙ্গে দাভোলকর এক বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন ২০০৪ সালে কোলাপুরের এক প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে। হিন্দু মৌলবাদীদের এক প্রধান সমালোচক ছিলেন দাভোলকর। এই সব কট্টরপন্থীরা জনগণের মধ্যে নানা কুসংস্কার ছড়াচ্ছে বলে অভিযোগ করতেন তিনি। এক রুপোর দোকান চালাতেন সাদভিলকর। নিজের সাক্ষ্যে তিনি জানান দাভোলকর হত্যাকাণ্ড ঘটার কয়েকদিন আগে তাওয়াড়ে তার কাছে এসে তাকে একটা পিস্তল তৈরি করে দিতে বলে। সাদভিলকর দাবি করে যে সে পিস্তল তৈরি করে দিতে রাজি হয়, কিন্তু একই সঙ্গে এটাও বলে যে গুরুত্বপূর্ণ কোনও ব্যক্তির কাছ থেকে এই বিষয়ে অনুরোধ এলে তবেই সে এটা তৈরি করে দেবে। তাওয়াড়ের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে সন্দিহান হয়ে সাদভিলকর এ বিষয়ে আর কিছু করে না বলেই মনে হয়। সাদভিলকরের আচরণে যে তাওয়াড়ে অখুসী একথা আরও দুবার তার কোলাপুরের দোকানে এসে সে জানিয়েছিল এমনটা সাদভিলকর তার সাক্ষ্যে দাবী করেছে। তাওয়াড়ে কী উদ্দেশ্যে তাকে পিস্তল বানাতে বলেছিল সেটা দাভোলকর নিহত হওয়ার পরেই সে বুঝতে পারে এমন কথা সাদভিলকর বলছে।

সাদভিলকর এই মামলায় প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী নয়, এমনকি তার সাক্ষ্য অনুসারে তাওয়াড়ে যে সরাসরি দাভোলকর হত্যাকাণ্ডে জড়িত এমন কথা বলা যায় না। ফলে আদালতের কাছে তার সাক্ষ্য খুব কাজে এল না।

 

প্রমাণ লোপাট করা

দাভোলকর মামলায় সাক্ষ্যপ্রমাণ বিনষ্ট করার অভিযোগ আনা হয়েছে আইনজীবী সঞ্জয় পুনালেকর আর তার সহযোগী বিনয় ভাবের বিরুদ্ধে। ৪ জুন ২০০৮ সালে থানে আর ভাশি-তে এবং ২০ ফেব্রুয়ারি পানওয়েল-এর থিয়েটার হলের বাইরে বোমা বিস্ফোরণ হয়। সেইসব ঘটনায় হিন্দু জনজাগ্রুতি সমিতি পরিচালিত ধর্মীয় গোষ্ঠী সনাতন সংস্থার কয়েকজন সেবককে পুলিশের সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধী শাখা গ্রেফতার করে। এই অভিযুক্তদের পক্ষে উকিল ছিলেন মুম্বাই-এর এই আইনজীবী পুনালেকর।

এই মামলায় পুনালেকরের ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। আসামি দুজন আদালতকে জানায় যে ২০১৭ সালে গৌরী লঙ্কেশ-কে গুলি করার পরে তারা দুজনে পুনালেকরের কাছে যায়। আসামিদের বক্তব্য অনুসারে “কোনও এক খাঁড়িতে পিস্তল ছুঁড়ে ফেলে দাও” নির্দেশ দেয় পুনালেকর। কিন্তু আসামিদের এই বক্তব্যের সমর্থনে কোনও স্বতন্ত্র সাক্ষী না থাকায় পুনালেকর অব্যাহতি পেয়ে যায়।

দাভোলকর মামলায় পুনালেকরের সহকারী বিক্রম ভাবের ভূমিকা অনেক গুরুতর। ২০০৮ সালের মামলায় প্রথমে জেলে গেলেও পরে আপিলে ছাড়া পেয়ে যায় বিক্রম ভাবে। অভিযোগ ছিল যে যেখানে দাভোলকরকে গুলি করা হয়েছিল সেই জায়গা আগেভাগে বিক্রম ভাবে আন্দুরে আর কালাসকরের সঙ্গে ‘রেইকি’ করতে গিয়েছিল। আন্দুরে আর কালাসকরের সঙ্গে বিক্রম ভাবে-কে একসঙ্গে দেখা যেত খুব সহজেই যদি ওই এলাকার সিসিটিভি ক্যামেরার ছবি প্রমাণ হিসাবে হাজির করা হত। পুলিশ সেই চেষ্টা আদৌ করেনি।

এই মামলার তদন্ত যে কত নিম্নমানের সেটা বিচারক যাদবের এই পর্যবেক্ষণ থেকে স্পষ্ট: “প্রথম অভিযুক্ত ডঃ বীরেন্দ্রসিংহ তাওয়াড়ের বিরুদ্ধে ডঃ নরেন্দ্র দাভোলকরকে হত্যা করার অভিসন্ধির প্রমাণ আছে। এই অপরাধকর্মে চতুর্থ অভিযুক্ত সঞ্জীব পুনালেকর আর পঞ্চম অভিযুক্ত বিক্রম ভাবে-র যোগসাজস আছে এটা থেকে দেখা যাচ্ছে এদের বিরুদ্ধে যুক্তিযুক্ত সন্দেহ করা যায়। কিন্তু প্রথম, চতুর্থ ও পঞ্চম অভিযুক্তের বিরুদ্ধে এই অপরাধে যুক্ত থাকার যেসব অভিসন্ধি ও সন্দেহ ছিল সেগুলিকে নির্ভরযোগ্য সাক্ষ্যের মাধ্যমে মুখ্য প্রমাণ হিসাবে উপস্থাপিত করতে অভিযোক্তা সরকারপক্ষ (প্রসিকিউশন) ব্যর্থ হয়েছে।” প্রসিকিউশন ব্যর্থ হয়েছে না তাকে ঠুঁটো জগন্নাথ বানিয়ে রাখা হয়েছিল সেই প্রশ্ন সামনে এসে যায়। অভিযুক্তদের কারও বিরুদ্ধেই ইউএপিএ আইনের ১৬ নম্বর ধারা অনুযায়ী অপরাধ প্রমাণের চেষ্টা করা হয়নি। একইভাবে ষড়যন্ত্রের অভিযোগও আদৌ প্রমাণ করা যায়নি।

এই মামলার মুল নায়কদের সাজা দিতে না পারলেও বিচারক যাদব তাঁর রায়ে এই মামলার গুরুত্ব ও জাতীয় তাৎপর্যের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছেন যে ডঃ নরেন্দ্র দাভোলকরকে হত্যার মধ্যে দিয়ে তাঁর ভাবাদর্শকে শেষ করে দেওয়ার চেষ্টা চালানো হয়েছে।

আদালতে অভিযুক্তদের আইনজীবীদের আচরণ প্রসঙ্গেও বিচারক কড়া মন্তব্য করেছেন। অভিযুক্তদের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী প্রকাশ সালসিঙ্গিকর। দাভোলকরের ওপর গুলিচালনাকে যুক্তিযুক্ত দেখানোর উদ্দেশ্যে তিনি এমএফ হোসেন হিন্দু দেবদেবীদের নিয়ে যে সব ছবি এঁকেছিলেন সেই প্রসঙ্গ সামনে নিয়ে আসেন চূড়ান্ত সওয়ালের সময়ে। প্রশ্ন করার সময়ে সালসিঙ্গিকর এক সাক্ষীকে জিজ্ঞাসা করেন: “তসলিমা নাসরিন কেন ভারতে বাস করেন আপনি জানেন কী? কী কারণে সলমন রাশদি হুমকি পাচ্ছেন আপনি জানেন কী?” দাভোলকর মামলার সঙ্গে এসব প্রশ্নের কোনও সঙ্গতিই নেই। আসলে এই সব অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নের মাধ্যমে সালসিঙ্গিকর দেখাতে চাইছিলেন যে ‘হিন্দু দেবদেবীকে অপমান’ করার জন্য দাভোলকরকে “ঘৃণা” করা হয়েছে।

এই প্রসঙ্গে বিচারক যাদব বলছেন: “সরকারি সাক্ষীসংখ্যা ৪ আর সাক্ষীসংখ্যা ৮, এদের সাক্ষ্য থেকে শুধু নয়, প্রশ্নোত্তরের সময়ে যেসব প্রস্তাবনা এদের সামনে দেওয়া হয়েছিল আর অভিযুক্তদের পক্ষ অবলম্বন করছিলেন যে আইনজীবীরা তাঁদের যুক্তিজাল থেকে এটা স্ফটিকের মতো পরিষ্কার যে সনাতন সংস্থা, হিন্দু জনজাগ্রুতি সমিতি আর এদের সঙ্গে যুক্ত হিন্দু সব সংগঠন নিহত ডঃ নরেন্দ্র দাভোলকরের প্রতি তীব্র শত্রুতাপূর্ণ মনোভাব পোষণ করত। প্রশ্নোত্তরের সময়েই এটাও স্বীকার করে নেওয়া হয়েছিল যে অভিযুক্তরা সনাতন সংস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল।”

বিচারক আরও বলেছেন: “চার্জশিটে যাদের অভিযুক্ত করা হয়েছে তারা এবং তাদের আইনজীবীরা শুধু যে আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা করেছেন এমন নয়। সরকারপক্ষের সাক্ষীদের সঙ্গে অপ্রয়োজনীয় ও দীর্ঘ সওয়াল-জবাব চালিয়ে, এমন কী চূড়ান্ত সওয়ালের সময়েও নিহত ব্যক্তির ভাবমূর্তিকে কলঙ্কিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। নিহত ডঃ নরেন্দ্র দাভোলকরের ওপর হিন্দু-বিরোধী ছাপ লাগিয়ে তার হত্যাকাণ্ডকে যুক্তিযুক্ত প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়েছে অভিযুক্তদের পক্ষ থেকে।”

বিচারকের মতে এই ধরনের প্রচেষ্টা খুবই বিস্ময়কর এবং নিন্দনীয়। তিনি বলছেন যে আগেই বোঝা গেছে যে অভিযুক্ত নম্বর দুই এবং অভিযুক্ত নম্বর তিন কেবল এই দুজনে মিলেই যে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে এমনটা নয়, নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে পাকা মাথার পূর্বপরিকল্পনা কাজ করেছে।

ভারতীয় সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যকে অন্ধবিশ্বাস আর কুসংস্কারমুক্ত করে যুক্তি আর প্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার যে আন্দোলন গড়ে তোলা হচ্ছিল ডঃ দাভোলকর এবং তার পরবর্তী সময়ে গোবিন্দ পানসারে, এমএম কালবুর্গি এবং গৌরী লঙ্কেশের ওপর সংগঠিত এই সব হত্যাকাণ্ডগুলি প্রকৃতপক্ষে সেই সব আন্দোলনের ওপর সংঘটিত সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ। এই সব হত্যাকাণ্ডের পেছনে আছে পাকা মাথার পূর্বপরিকল্পনা। আর সেই সব পাকা মাথা হচ্ছে সেই সমস্ত মৌলবাদী সংগঠন যারা ধর্ম আর রাজনীতিকে একসঙ্গে মিলিয়ে দেশের রাজনৈতিক প্রশাসনিক ক্ষমতা দখল করে রাখতে সচেষ্ট। সেই কারণেই এই সব হত্যাকাণ্ড সংক্রান্ত তদন্তে শ্লথগতি আর দীর্ঘসূত্রিতা, আদালতের সামনে অপরাধ ও অপরাধীদের সঠিকভাবে উপস্থাপিত করার অনীহা। স্বভাবতই প্রচণ্ড রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক চাপের মধ্যে ডঃ দাভোলকর হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে হয়েছে বিচারক প্রভাকর পি যাদব-কে। তা সত্ত্বেও তিনি সাহসের সঙ্গে যে ভূমিকা পালন করেছেন এবং তাঁর রায়ে যে সব মন্তব্য করেছেন তার জন্য তাঁকে ধন্যবাদ জানানো আমাদের অবশ্যকর্তব্য। এই মামলা পর্যালোচনার জন্য অবশ্যই উচ্চ আদালতে যাবে। সে সময়ে বিচারক শ্রী যাদবের করা মন্তব্য প্রসঙ্গে কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করে আদালত সেদিকে আমাদের নজর থাকবে। তবে এই ধরনের সন্ত্রাসবাদী হত্যাকাণ্ড ও আক্রমণ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক-প্রশাসনিক নেতাদের ভূমিকা বিস্তারিতভাবে জনসমক্ষে আলোচনা করা প্রয়োজন।

 

তথ্যসূত্র:

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4874 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...