ছেলেটার পুকুর পুকুর চোখ

সোমেন বসু

 

ছেলেটার পুকুর পুকুর চোখ ছিল। পুকুরঘাটে আড্ডা মারত বলে হয়তো। এটা পাশকাটা আড্ডা। পাড়ার বন্ধু, ক্লাব, সরস্বতী-কালীপুজো, সান্ধ্য ক্যারম-ব্রিজ বা কালার টিভিতে অবিশ্রান্ত গাঁকগাঁকরত সদ্য আসা কেবল টিভি থেকে পাশকেটে ঘণ্টাদুয়েক। পাড়ায় খিল্লি, কখনও মা খোঁজ নিতে আসলে ‘ও তো ঘাটে গেছে!’ মায়ের রাগ, ‘ও আবার কী কথা!’ ‘আরে সত্যি গো! ওরা তো তাই বলে, ঘাটে যাচ্ছি!’ এরপর ওরা আস্তে আস্তে খেলা-টিভির বখরা কমাবে জীবন থেকে। পার্টি এবং প্রোমোটারের তুলতুলে শক্ত থাবা, সাপ্লাই সিন্ডিকেটের কাঁচা টাকা আর ক্ষমতার নেশাড়ু মোহ আসবে অনিবার্য। ঘাটে থাকা ছেলেগুলো সে সময়েই ডুব মারবে পাশের কালো পুকুরটায়। এক ডুবে ভেসে উঠবে সাবেক উত্তর কলকাতার বহু শরিক বহু ভাড়াটে বহু বট অশ্বত্থ বহু ইতিহাসের এক দালানকোঠার একতলার এককোণের এক অন্ধকার আলো আলো ঘরে। ঘরের বাইরে বারোয়ারি কলতলায় সাবানের ফেনার গন্ধ, একটু পাশে ড্রেন থেকে আধপচা এঁটোকাঁটার গন্ধ, ঘরের ভেতরে মড়মড়ে নতুন কাগজের খোশবাই। বাইরে ঝগড়া, ভেতরে গুটেনবার্গের নাতিপুতিদের ঘটাংঘট। ঘরে ঢুকেই বাঁপাশে একটা মরা আলোর টিউবলাইটের নিচে কাঠের চেয়ারটেবিলে সাহেবদা। বলল, ‘এখানেই শুরু করো। দুতিন বছর পর যেও অফসেটে।’ বলল, ‘হাজার ছাপো। পড়তায় পড়বে। একটু ঘুরে ঘুরে বেচবে, ট্রেনে হকিং করবে। নিজেদের কাগজ, এটুকু পারবে না?’ হাতে ধরে প্রুফ দেখা শেখাল। হ্যাশ মানে ফাঁক, উপরনিচে ব্র‍্যাকেট মানে জোড়া, ছোট ডেল্টা মানে ডিলিট, সি কপি মানে…। নাঃ, প্রুফ রিডিং শেখাচ্ছি না। সাহেবদাকে খুঁজছি।

বা রফিকুলদাকে। উলুবেড়িয়া থেকে আসে রোজ সাত সকালে মধ্য হাওড়ায়। অরূপদার ডিটিপি কাম জেরক্স অফসেটে। রোগাসোগা নিরীহ ভালোমানুষ চেহারার ডিটিপি অপারেটর। লেখকদের সযত্ন সৃষ্টিগুলি ফুটে ওঠে তার আঙুলের নির্মোহ টরেটক্কায়। ভারত পাকিস্তানের খেলা থাকলে অরূপদা আর অরূপদার জেরক্স অফসেট কারিগর রাজু দুজনে মিলে পেছনে লাগে ‘দাদা তো আজ পাকিস্তানের সাপোর্টার’ বলে। কাজকাম ছেড়ে ওই নিরীহতায় যতটা সম্ভব উষ্মা আরোপ করে রুখে দাঁড়াত লোকটা, ‘কেন? কেন বললেন এ কথা?’ বৌদি চা নিয়ে এসে কপট রাগ ‘তোমাদের দাদাকে রাগানো ছাড়া আর কোনও কাজ নেই?’ এইরকমই পুরোটাই। এখানেই শুরু এখানেই শেষ। এরপরেই একটা স্টিলের গামলায় তেল পেঁয়াজ চানাচুর দিয়ে মেখে মুড়ি খাবে তিনজন একসঙ্গে।

কিন্তু কলকাতার এই শেষ শীতের শেষ বিকেলের মরা আলোয় বনবিতানের প্রথম বইমেলায় উড়ুংফাড়ুং ঘুরে বেড়ানো আমি সাহেবদার মতো রফিকুলদাকেও খুঁজে পাচ্ছি না!

পিছন দিকে ছোট্ট করে ডিঙিয়ে যাই একটা শতক। বিংশ শতাব্দী। স্টল ৪২৫। অনিকেত-এর খোঁজে। আমাদের শেষ কৈশোর প্রথম যৌবনের এক আশ্চর্য সঙ্গী এই বইটা। মানে এইরকম — একটা প্রিয় বেকার দিনের রুটিন কেমন হবে? সকালে সাড়ে আটটা-নটায় ঘুম থেকে উঠে চা জলখাবার খেয়ে পাড়ার মাঠ। একটু খেলাধুলো, আড্ডা। দুপুরে বাড়ি গিয়ে চান খাওয়া করে অনিকেত নিয়ে শুয়ে পড়া। বিকেল সন্ধে আবার আড্ডা। রাতে ঘাট। বাড়ি ফিরে খাওয়াদাওয়া সেরে আবার অনিকেত নিয়ে বিছানায়। কেমন সে নেশা? আচ্ছা একটু পড়ে শোনাই। স্মৃতি থেকে। এ ভরা কবি মরশুমে প্রাসঙ্গিকও।

দিনের বেলা ভিড় বাসস্টপে দাঁড়িয়ে আছে দুই বন্ধুহঠাৎ–

‘এই এই… ঘুরে যা… সোমক আসছে..’

লাভ হল নাসোমক দেখে ফেলেছেআর ফেলেই—

‘এই তো তোমাদেরই খুঁজছিলাম!’

এতে অবাক হওয়ার কিছু নেইকারণ সোমক যখন যাকে দেখে, তখন তাকেই খোঁজে

‘কাল রাতেই দুটো নামিয়েছিশোনো…’

‘এই সোমক… এখানে ভিড়ভাট্টা… এখন থাক না..’

‘না না.. ভিড় তো কী হয়েছে? শোনো শোনো…’

পারিপার্শ্বিকের তোয়াক্কা না করে গলার স্বর উঠিয়ে নামিয়ে হাত নেড়ে দুটো কবিতা পড়া হল

‘নাও.. বলো এবার..’

‘দারুণ দারুণ’

‘ধুর ওসব কে শুনতে চেয়েছে? তোমরা একটু কনস্ট্রাক্টিভ ক্রিটিসিজম করো…’

একজন বলল—

‘তোর প্রথম কবিতাটার একুশ নম্বর লাইন নিয়ে আমার একটু আপত্তি আছে!’

‘তাই?… আচ্ছা… ধুর..’

‘কী হল?’

‘সতেরো লাইনের কবিতায় তুমি একুশ নম্বর লাইন পেলে কোথায়?’

এবার দ্বিতীয়জনপ্রথমের অভিজ্ঞতা দেখেশুনে রেডি—

‘আমার তোর দ্বিতীয় কবিতার আট নম্বর লাইনটা নিয়ে আপত্তি আছে সোমক!’

‘আচ্ছা দেখি…’ দেখে মনমরা হয়ে ‘তোমরা কিছুই শোননি, না?’

‘আরে! না শুনলে বললাম কী করে?’

‘আট নম্বর লাইন নিয়ে তোমার আপত্তি থাকতেই পারে না!’

‘পারে না মানে? আলবাত পারেতুই পড় আট নম্বর লাইনটা…’

‘না!’

মানে? পড়বি না?’

‘আরে পড়লাম তো! না! ওই একটাই শব্দ আছে আট নম্বর লাইনে!’

সেই নিরুদ্দিষ্ট অনিকেত ফিরে এসেছে। যেদিন ফিরল, দেবাশিসদা (মৈত্র) ফেসবুকে লিখেছিলেন—

নির্ধারিত তারিখের আগেই প্রকাশিত হল ‘অনিকেত’-এর দ্বিতীয় সংস্করণ

এই বইটির লেখক, কম্পোজিটর, প্রুফ-রিডার, প্রকাশক এবং পরিবেশক আমি নিজেইশিব্রামের পদাঙ্ক অনুসরণ করে, সম্ভাব্য ক্রেতাও আমিইতবু যদি অন্য কেউ কিনতে চান তো জানাই, আজ থেকে বইটি পাওয়া যাচ্ছে কলেজ স্ট্রিটের দে বুক স্টোর এবং ধ্যানবিন্দুতে

প্রচ্ছদ এঁকেছেন এই উপন্যাসের অন্যতম প্রধান চরিত্র মিত্রারুণ হালদারপ্রচ্ছদের ছবিতে প্রত্যেকের (বেড়ালটি সমেত) একটিমাত্র চোখ থাকার জন্য কোনকোনবন্ধু মৃদু আপত্তি জানিয়েছেনসবিনয়ে তাঁদের জানাই, মিত্রারুণ মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে যে দুনিয়ার সব মানুষ, আর সব পশু-পাখি, সব পোকামাকড়, প্রজাপতি আর মথেরা, এমন কি সমস্ত ভাইরাস-ব্যাকটিরিয়া পর্যন্ত সবাই ফাণ্ডামেন্টালি একচোখো

বিংশ শতাব্দীতে বলল, অনিকেত শেষ হয়ে গেছে! ও দেবাশিসদা…. শুনতে পাচ্ছেন??

এই তো এই-ই। বই মেলা… মিলন… মিলেছে অনেক কিছুই। ওয়াচ টাওয়ারের মধ্যে দিয়ে বইমেলার সঙ্গে জেলখানা। হলের মধ্যে দিয়ে প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সীর সঙ্গে রবিশংকর বল। বিদগ্ধ লিটল ম্যাগাজিন আর ঝকঝকে বইয়ের স্টলের মাঝে এক ফোঁকর দিয়ে যে ডেকরেটরের ছেলেদুটো জুলজুল চোখে ভিড় দেখছিল, মিলল কি তারাও? বইমেলা, তোমার সঙ্গে? ওদিকে গণশক্তি, মহাকরণ অভিযানের ডাক দিয়ে এস এফ আই ছেলেমেয়েরা। ওদিকেই জাগো বাংলা, বিশ্ববঙ্গ। মনে পড়ে গেল, ব অক্ষরটাকে সন্দেহজনক ভাবতাম একসময়। বানতলা ইত্যাদির পরের একটা ভোটে কংগ্রেসি দেওয়াল লিখন দেখেছিলাম ‘এত বছরের বামফ্রন্ট শাসন ‘ব’ দিয়ে ঘেরা। ব-এ বিরাটি, ব-এ বানতলা, ব-এ বেঙ্গল ল্যাম্প…।’ সুপ্রভাত রায়কে স্মরণ। সে স্মরণ নিয়ে নোংরামি। পাশাপাশি তো! সেও তো মিলন বটে! যুক্তি প্রতিযুক্তিও তো মিলল মন্দ না। আবেগ যুক্তি দিয়ে মেলার পক্ষে অনেক কথাই শুনেছি আমরা। যাদবপুরের অধ্যাপক অভিজিৎ মুখার্জির একটা পর্যবেক্ষণ এবং তা থেকে উৎসারিত প্রশ্নটাও থাক। লিখেছিলেন কদিন আগে এই কলামেই প্রকাশিত ব্রতীনদার লেখার তলায়—

কাল যা. বি. স্টলে একবার ঢুকেছিলামএক ভদ্রলোক খুব উৎসাহ নিয়ে এসে যে মেয়েটি স্টল সামলাচ্ছিল তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ম্যাজিকাল মোমেন্টস অব নক্সালবাড়ি মুভমেন্টস বইটা পাওয়া যাবে কি নামেয়েটি তার ফোনে সার্চ করে ওনাকে জানাল যে ওটা রাউটলেজের বই, এই মেলায় সেই বই খুঁজতে হবে টেলর অ্যান্ড ফ্রান্সিস স্টলেসেই স্টলে কীভাবে যেতে হবে তাও বলে দিলভদ্রলোক দৃশ্যতই উৎসাহ হারিয়ে ফেললেন, একটু যেন বিরক্তই হলেনযা আমাদের সাবেক আইডেন্টিটির সঙ্গে জড়িত, তার সঙ্গে এতগুলো বিজাতীয় নাম জড়িত হয়ে পড়া ওঁর পছন্দ হল না বলেই মনে হলএ শহর প্রাণপণে পৃথিবীর থেকে নিজেকে অন্তরিত/ইনসুলেট করতে চাইছে, তাই বইমেলা ক্রমেই তাদের কাছে মূলত একটা অপ্রয়োজনীয় তামাশা হয়ে পড়ছে বলে আমার মনে হচ্ছে

প্রসঙ্গত বলে রাখি, অভিজিৎবাবুর অনুবাদে হারুকি মুরাকামির সমুদ্রতীরে কাফকা উপন্যাসটি আজ খুব লোভ হলেও কিনতে পারিনি। যেকোনওদিন হানা দেব কলেজ স্ট্রিটে।

ঘণ্টা বেজে গেল এ বছরের মতো। বসে আছি একপাশে আজকাল, একপাশে আনন্দ নিয়ে ঝলমলে চত্বরটায়। সামনে ছেলেটা নিজের সুবিন্যস্ত অবিন্যস্ত চুল আর থুতনিতে খোঁচামারা দাড়িটুকু নিয়ে নানা কায়দায় ঘাড় বেঁকিয়ে সেলফির পোজ ঠিক করছে। মাইকে বাজছে ‘প্রকাশক বন্ধুরা, আজ রাত সাড়ে বারোটা অব্ধি বই নিয়ে যেতে পারবেন। তারপর আবার কাল সকাল দশটা থেকে…।’ কাল থেকে আবার সাহেবদাদের প্রত্যাবর্তন!

বাচ্চাটা দৌড়ে আসছে হাতে কটা বই নিয়ে। ‘বাবা বাবা, এগুলো স-অ-ব আমার বই! তুমি পড়ে শোনাবে তো?’

যাই… দেখি গিয়ে… বাচ্চাটার পুকুর পুকুর চোখ কিনা…

[অনিকেত পাইনি আজ, বললামই। অনিকেতের মলাটের ছবি দেবাশিসদার ফেসবুক পোস্ট থেকে]

Facebook Notice for EU! You need to login to view and post FB Comments!
About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4243 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...