হিন্দু বাবা মুসলমান মেয়ে

শৈলেন সরকার

 

মেয়ের ফোন। ‘হোয়াটসঅ্যাপ খোলো এক্ষুনি, কী আছে দেখো, আর ফোন করে বলো কেমন লাগল।’ বললাম, ‘একটু পরে বললে হয় না?’ না, এক্ষুনি বলতে হবে।

দেখি আমার মেয়ের মেয়ে, মানে নাতনি আলিয়া। আলিয়া গাজী, সাত মাস বয়স যার— ইফতারে বসে ছোট্ট আঙুল দিয়ে এক টুকরো শশা ধরে মুখে ঢুকিয়েছে। লিখলাম, ‘দাঁত-না-ওঠা মুখে প্রথমবারের ইফতার, আলিয়ার সোনার জীবনে যেন ফিরে আসে বারবার।’ লিখেই মনে হল, বারবার কেন? মুছে লিখলাম, শত শত বার। আর স্নেহে অন্ধ হলে যেমন হয়, ফের মুছলাম। এবার লিখলাম, ফিরে আসুক হাজার হাজার বার।

আমি হিন্দু। মানে, ছোটবেলা থেকে হাজারটা ফর্মে বার বার লিখতে হয়েছে ‘রিলিজিয়ন— হিন্দুইজম’। তথাকথিত এই ‘হিন্দু’ আমাকে বাঁচিয়ে দিল আমার ‘মুসলমান’ মেয়ে রেহেনা। দশ-এগারো বছর বয়সের বাচ্চা মেয়েটি কী যে বিশ্বাস করল তখন আমাকে, ওইটুকু বয়সে সঙ্গী হয়ে চলেই এল আমার সঙ্গে শহরে। ওর ‘আব্বা’র স্থানে আর এক ‘বাবা’। আমি একেবারেই একা মানুষ, আমার তখন ‘ঘর নাই, শুধুই বাহির’। ছোট্ট মেয়ে রেহেনা আমাকে ঘরে আনল। আমাদের উত্তর শহরতলি এলাকা। আর উত্তর শহরতলি মানেই কলোনি। পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে পূর্ব-পাকিস্তান থেকে আসা উদ্বাস্তু। রেহেনার টানে ‘বাহির’ থেকে ‘ঘরে’ ঢুকেই দেখি, হিন্দু-মুসলমান টেনশান মিলিয়ে যায়নি তো এতটুকুও। কাজের লোক জানিয়ে দিল, রেহেনার মুখ দেওয়া কাপে চা খেতে পারবে না সে। পাড়ার সবারই যেন মাত্র বছর দশেকের ছোট্ট মেয়েটিকে দেখে পঞ্চাশ-ষাট বছর আগেকার রায়টের কথা মনে পড়ল। স্কুলে ভর্তি হল রেহেনা। সেখানেও বাঙালি নয় সে, মুসলমান। যেন অজানা গ্রহের জীব কোনও। হেডমিস্ট্রেস বললেন, মেয়ে তো আপনার মিশতেই পারছে না সবার সঙ্গে। ওর কাছে জানতে চাইলাম, মন খারাপ লাগছে তোর? বাড়ি যাবি? রেহেনা ঈদের কথা জানতে চাইল। বলল, ঈদ কবে? ঈদ? সে আমি কীভাবে জানব? ঈদ মানে সেই যে গরু জবাই—। ও জানাল, সেই ঈদ নয়, ঈদ নাকি দুরকম। রেহেনার কথায়, পুজোর আগেই ঈদ আছে একটা। রোজার ঈদ, রমজান মাস জুড়ে রোজা। একমাস ধরে একেবারে ভোর থেকে উপোস থেকে সন্ধের পর ফের খাবার মুখে দেওয়া—। আমি যেটা বলছি তা নাকি বকরি ঈদ। বললাম, রোজা করার জন্য বাড়িই যেতে হবে তোকে? এখানে হবে না? এখানে না হয় ভোরবেলা—। এবার মা-ই বলল, রোজার মাসটাতে ওকে রেখেই আয় ক-দিনের জন্য। এখানে দু-পাঁচ মাইলের মধ্যেও মসজিদ নেই কোনও যে আজান শুনবে, বা আর কোনও মুসলমানও নেই।

সুতরাং ওর সেই দেশ-গাঁ। সেই নদীর পর নদী। সেইসব দ্বীপ আর জঙ্গল। ধানজমি আর আলপথ। গরু-মুরগি-হাঁস। শহর থেকে অনেক দূরের পথ। সকালে রওয়ানা হলে ওর বাড়ি পৌঁছতে বেলা শেষ। রাস্তায় ও খেল না কিছুই। একবারে নাকি ইফতার করবে ঘরে গিয়ে। ইফতার? সে আবার কী? আমার অজ্ঞতায় হেসে ফেলে ছোট্ট মেয়েটি। বলল, রোজা ভাঙার পর খাবে সবাই মিলে। আমার আব্বা, মা, সেজবু। ছোলাসেদ্ধ, শশা, তেলেভাজা।

রায়দীঘিতে নৌকা ধরব। ওদের দুই নম্বর ঘাটে নৌকা পৌঁছতে সময় নেবে আড়াই ঘন্টা। ঘাটের লাগোয়া সার দেওয়া ফলের দোকানগুলির সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল রেহেনা। ফল কিনবে, এ ছাড়া সিমুই। বললাম, আগে বললে আমাদের ওখানেই কিনে নিতে পারতাম তো, ওখানে কত ভাল—। ওকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে রাতটা কাটিয়েই বেরিয়ে পড়ি। দিন সাতেক পর এসে ঈদ পার করে ওকে নিয়ে ফিরব।

ঈদের আগের দিন ওদের বাড়ি পৌঁছতে সন্ধে হয়ে গেছে। দেখি যেন পাড়াশুদ্ধই বেরিয়ে গেছে রাস্তায়। রেহেনা  কোথায়? ও নাকি চাঁদ দেখতে বেরিয়েছে, আছে কোথাও। চাঁদ দেখা? সে আবার কী? হ্যাঁ, এই চাঁদ দেখা মানে এবার খুশির ঈদ। একমাসব্যাপী রোজার সমাপ্তি। হঠাৎ দেখি, মেয়ে আমার হাজির কোত্থেকে। বলল, চাঁদ দেখেছ? বললাম, না তো। বলল, এসো আমার সঙ্গে। বলে, একেবারে নদীবাঁধের কাছে নিয়ে হাজির। এবার বাঁধের উপর উঠে দূরের এক শিরীষগাছের মাথার পাশ দিয়ে তাকাতে বলে জানতে চাইল, দেখতে পাচ্ছ? পাচ্ছ না? না তো। বড়জোর একটা-দুটো তারা। কিন্তু ছোট্ট মেয়েটিকে আমি বলতে পারি না। আমি সত্যিই তখন মেয়েটির মুখ ছাড়া আর কিছুই দেখছি না।

পরদিন ঘুম থেকে ওঠার আগেই শব্দ শুনে বুঝতে পারি এ বাড়ির উঠে গেছে সবাই। ওর মা, সেজবু সবাই রান্নাঘরে কাজে ব্যস্ত খুব। রেহেনা ডেকে ডেকে ঘুম ভাঙাল আমার। বলল, ওঠো, আব্বার সঙ্গে ঘুরে আসো ঈদগা থেকে, দেখে আসো—। ঘুম ভেঙে তাকিয়ে মেয়েকে তো চিনতে পারি না। নতুন চুড়িদার, পাজামা, লাল ফিতেয় বাঁধা চুল। বললাম, বাহ্ এই নতুন জামা কে কিনে দিল তোকে? কবে? ও-ই নাকি কিনেছে। তবে শুধু ওর জন্য তো নয়, কিনেছে সবার জন্য। এমনকী আমার জন্যও? —কেন? বলল— ঈদ না আজ! দূর্গাপূজায় যেমন যার যার মতো করে—। বললাম, পয়সা পেলি কোথায় এত? ও নাকি স্কুলের টিফিনের পয়সা থেকে জমিয়েছে। দূরে বাঁধের উপর দিয়ে দু-তিনজন করে মানুষ রওয়ানা দিয়েছে ঈদগা-র দিকে। শোঁ-শোঁ শব্দ উঠেছে খুব। তার মানে জোয়ার। বড় গাঙের জল আছড়ে পড়ছে বাঁধের গায়ে। আছড়ে পড়েই বুদবুদের চিহ্ন রেখে ফের ফিরে যাচ্ছে। রেহেনা পাঞ্জাবি কিনেছে একটা আমার জন্য। এখান থেকেই। এক-দেড়শো টাকায় ওর মতো করে। জল ফের উজিয়ে আসছে গাঙ ছাপিয়ে। ঝাঁপিয়ে পড়বে কোথাও। আল্লার দান, আমার পাওয়া জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান উপহার আমার মেয়ে, ছোট্ট রেহেনা অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে আমাকে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4664 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...