‘পোস্টাফিস আবার কেনা যায় নাকি রে, বোকা!’

প্রবুদ্ধ বাগচী

 

নিতান্তই এঁদো মফস্বল, আর তাই সেখানে তখনও ছিল টলটলে জলের পুকুর, বেওয়ারিশ মাঠ, মাঠের প্রান্তে এলোমেলো ঝোপ— যেখানে পথচলতি মানুষ কারও তোয়াক্কা না-করেই সেরে নিত তাঁদের প্রাকৃতিক কম্মোসম্মো। সেইসব মাঠেই আমরা খেলে বেড়াতাম একদিন। গ্রীষ্মবেলায় ফুটবলের পেছনে ছুটে ছুটে ঘেমে ওঠা, হাঁফিয়ে যাওয়া ও টিউবয়েল টিপে আকণ্ঠ জল-খাওয়া— যে জলে ভাইরাস বা ব্যাক্টিরিয়া কিছুই থাকত না। আর শ্যামাপুজোর পরে বাতাসে শীতল আমেজ এসে গেলেই সেইসব মাঠে থানইটের উইকেট সাজিয়ে ক্যাম্বিস বলের দেদার ক্রিকেট। উচ্চাভিলাষী পাড়ার গাভাসকার বা কপিলদেবরা সেইসব মাঠে মকশো করত আগামীতে ঝলসে ওঠার। পাশের বাড়ির দেওয়ালে কোন উচ্চতায় বল পাঠানো গেল তার ওপরেই নির্ভর করত সেই পাড়ার ক্রিকেটে চৌকা বা ছক্কার সিদ্ধান্ত। সেসব খেলায় আম্পায়াররা ‘চোরামি’ করত অনায়াসে এবং বল যদি ব্যাটের বাড়ি খেয়ে সংলগ্ন পুকুরে পড়ে যেত, সাময়িক বন্ধ থাকত ইনিংস। কাঠের লগি দিয়ে বল খুঁজে পেলে আবার তার পুনর্জাগরণ আর না-পেলে খেলা সেদিনের মতো সাঙ্গ— যতদিন না পর্যন্ত আবার চাঁদা তুলে আরেকটা বল কিনে আনা যায়।

আউটডোর খেলার এইসব অকিঞ্চিৎকর আয়োজনের পাশে পাশে আমাদের ছিল ঘরোয়া খেলার নানাকিসিম— লুডো, ক্যারাম, চাইনিজ চেকার, ব্যাগাটুলি, দাবা এবং এক বিচিত্র খেলা ‘ব্যবসায়ী’। আর পাঁচটা খেলার মতোই এই খেলার বোর্ড কিনতে পাওয়া যেত স্থানীয় মনিহারি দোকানেই— একটা প্যাকেটের মধ্যে লুডোর বোর্ডের মতোই একটা চৌকো বোর্ড, ঘুটি আর বাড়তি পাওনা ছিল সস্তা কাগজে ছাপানো টাকার রকমারি নোট। এই নোট ভাগ হত খেলার শুরুতে, তারপর ঘুটি চালানো। বোর্ডের মধ্যে ছবি দেওয়া কিছু চিহ্নিত ঘরে রেল, পোস্টাফিস, ব্যাঙ্ক, জাহাজ ইত্যাদি ইত্যাদি এবং তাদের মূল্য। খেলুড়েদের ঘুটি ওইসব ঘরে এলে তারা নিজেদের হাতের টাকা থেকে ওগুলি কিনতে পারে, পরে আবার সুযোগ এলে তা বেচতেও পারে সহ-খেলুড়েদের কাছে। এরই মধ্যে আছে লাভ ও ক্ষতির ঘর, অনেকটা সাপ লুডোর মতোই। এইরকম কেনাবেচার খেলায় যার হাতে যত ‘প্রতিষ্ঠান’ সে-ই খেলায় জয়ী বিবেচিত হবে।

একদিন এই ‘ব্যবসায়ী’ খেলায় আমাকে সঙ্গী হতে দেখে আঁতকে উঠল আমার বাবা। কী সর্বনাশ! এ আবার কী খেলা, যেখানে ব্যাঙ্ক রেল পোস্টাফিস এসব কিনে ফেলা যায়! পুরনো বামপন্থী ঘরানার মানুষ, ব্যাঙ্ক বা রেলের মতো রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা নিয়ে যে এমন বেচাকেনা করা যায় এসব তাঁর কল্পনাতেও আসত না, আসার কথাও নয়। প্রায় সর্পদংশনের মতো তিনি স্বগতোক্তি করলেন, পোস্টাফিস আবার কেনা যায় নাকি রে, বোকা! কিন্তু এখানেই তিনি থামেননি। তার আত্মজ যাতে আরও নির্বুদ্ধিতার অতলে তলিয়ে না যায়, তাই দিন পনেরোর মধ্যে মাথা খাটিয়ে বাবা বার করে ফেলল প্রায় একই ধরনের একটা খেলা এবং তার বোর্ডের নকশা— বলা বাহুল্য, সেই খেলায় কেনাবেচা থাকল কিন্তু তার আওতা থেকে বাদ থাকল ওইসব রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলি। আর ওরকম নকল টাকার বদলে বাবা চালু করল পয়েন্ট, একেকটা লেভেলে লাভ-ক্ষতির ভিত্তিতে যা নির্ধারিত হল। ঘরে পিচবোর্ড কেটে তৈরিও হল সেই বোর্ড আর লুডোর ঘুটি দিয়েই দিব্যি চালু করা গেল ব্যবসার ঘরোয়া আসর। কিন্তু তার আওতার বাইরেই ওইসব সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলির অবস্থান। গল্পগুলো সত্তর দশকের দ্বিতীয় অর্ধের।

কাট টু। দেশের প্রধানমন্ত্রী যখন নতুন অর্থনৈতিক জমানা নিয়ে টইটম্বুর ভাষণ দিচ্ছেন সংসদে তার আগেই বাবা ছেড়ে গেছেন দেশের আলোবাতাস। ঠিক এর পরেই, অর্থমন্ত্রী তার বাজেট ঘোষণায় জানিয়ে দিলেন এবার থেকে আমরা চলব এক নতুন পথে। সেই পথে সরকারি বিনিয়োগ, রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প এগুলোর আর কোনও কৌলীন্য থাকবে না, বরং সরকার ধীরে ধীরে হাত তুলে নেবে সমস্ত সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে। দেশি-বিদেশি লগ্নি উদ্বাহু স্বাগত এর প্রতিটি বাঁকে বাঁকে, যেখানে যেমন সম্ভব। এটা নব্বই দশকের শুরুর দিক। সোভিয়েত-এর পতন ঘটেছে, গোটা পূর্ব ইউরোপে ভেঙে পড়ছে তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা। মার্কসবাদী মহল বিভ্রান্ত, হতোদ্যম। আর জাতীয় ব্যাঙ্কগুলির পাশে পাশে দেখা দিচ্ছে বেসরকারি ব্যাঙ্ক, জীবনবিমা-সহ সাধারণ বিমা কোম্পানিগুলোও কিছুটা ত্রস্ত, রেল-ডাক-টেলিফোন দফতরেও আশঙ্কার ঘন ছায়া। ইতিউতি তাঁদের বামপন্থী কর্মী ইউনিয়নগুলি বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন দেশজুড়ে। বামপন্থী সাংসদরা প্রশ্ন তুলছেন, সরকারি নীতিকে তীব্র সমালোচনায় বিদ্ধ করছেন সংসদে। বেশ কয়েকটা দেশব্যাপী হরতাল, তাও সম্ভব হল। অন্তত তখনও এগুলো করা যেত। এসব দেখতাম, শুনতাম— কখনও কখনও শরিকও থেকেছি এসব প্রতিবাদের। মনে পড়ত বাবার চেতাবনি— পোস্টাফিস আবার কেনা যায় নাকি রে, বোকা!

কাট থ্রি। হই হই করে কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠা হল এনডিএ সরকার। ক্ষমতায় আসার আগে ‘স্বদেশি জাগরণ মঞ্চে’র আড়ালে তাঁরা বিরোধিতা করতেন অবাধ বিদেশি বিনিয়োগের। মূলত তা ছিল তৎকালীন আরএসএস-এর লাইন। কিন্তু তখতে বসে তাঁরা চালু করলেন বিলগ্নিকরণ নামের এক দফতর, যাদের কাজই হল বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানকে সুবিধেজনক শর্তে ব্যক্তিমালিকানা বা বহুজাতিকের হাতে বিক্রি করে দেওয়া। বহুক্ষেত্রে সেইসব বিক্রির শর্ত সংসদকেও জানানো হত না। প্রতিবাদ হচ্ছিল নানা স্তরে। কিন্তু পূর্বতন কংগ্রেস সরকার যেভাবে শিয়ালকে বেড়ার ফুটো দেখিয়েছে তারা আর গলা তুলতে পারে কতটা। অন্তত তখনও এই নৈতিক চক্ষুলজ্জাটুকু দেশের রাজনীতির উঠোনে বজায় ছিল। যেটুকু যা বিরোধিতা তা করেছেন সর্বভারতীয় স্তরে বামপন্থীরাই। কিন্তু খুব যে সুবিধে করতে পেরেছেন তা নয়। দেখতে দেখতে সরকারি সার কারখানা, বিমান কারখানা হাতবদল হতে লাগল। কারণ, তখন একটা জনশ্রুতি ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে যে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলি নাকি পেশাদারিত্বে অপদার্থ, তাদের কর্মীরা কাজ করেন না, উৎপাদনে পিছিয়ে থাকেন। আর তাই মুনাফার অঙ্ক কমে যাওয়ায় সরকারি কোষাগার থেকে অনর্থক ভর্তুকি দিতে হয়। কথাটা আংশিক সত্যি। কিন্তু সেই আংশিক সত্যির ছিদ্র দিয়েই ঢুকে পড়ল ব্যক্তিপুঁজির কালসাপ। রেল-বিমা-ব্যাঙ্ক সর্বত্র নিয়োগ বন্ধ, তার ছাপ পড়ছে তাদের পরিষেবায়। আর খোলাবাজারি অর্থনীতি মানুষকে যে ক্রমশ উপভোক্তার সীমানায় বেঁধে দিতে চায় তার একটা নিহিত মন্ত্র হল, তোমার শ্রম দিয়ে তুমি লাভ পাও তাই তুমি শ্রম না দিলে তার দায় তোমার, সে বাবদ যে-ক্ষতি তোমাকেই চোকাতে হবে। অতএব, দেখতে দেখতে রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিফোন সংস্থার ক্ষয় হতে থাকে, পরিষেবা তলানিতে ঠেকে, পোস্টাফিসের স্বল্প সঞ্চয়ে সুদ কমে, মানুষ ছুটতে থাকেন অন্য বিনিয়োগের সন্ধানে। হাতবদল হয় প্রত্যেকটি পাবলিক সেক্টর অথবা দিন গোনে। মনে পড়ে বাবার ভুল আক্ষেপ— পোস্টাফিস আবার কেনা যায় নাকি রে, বোকা!

কাট ফোর। শাইনিং ইন্ডিয়ার কাদায় আটকে গেল এনডিএর ঘোড়াগাড়ি। নতুন শতাব্দীর চারটে বছর অতিক্রান্ত। পূর্বতন অর্থমন্ত্রী এবার প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকায়। তার সিংহাসনে একটা পায়া হয়ে দাঁড়ালেন বামপন্থীরা। সংস্কার কর্মসূচি বলে একটা লব্জ চালু হয়েছে তখন। সেটা অবশ্য সরকার-নিরপেক্ষ। সারা দুনিয়ার বৃহৎ কর্পোরেট সংস্থা, দেশি বিনিয়োগকর্তারা খুব ভাল চেনেন এই প্রধানমন্ত্রীকে। তাঁদের প্রধান ভরসা এই নামজাদা অর্থনীতিক ও অ্যাকাডেমিশিয়ান। ‘রামরথ’ থেমে গেছে তখন, কিন্তু ‘উন্নয়ন’-এর রথে আরও দুর্বার গতি। সারা দেশজুড়ে স্পেশ্যাল ইকোনমিক জোনের জন্য জমি দখল চলছে। শ্রম আইনের গায়ে পড়ছে সংস্কারের হিংস্র আঁচড়। বামপন্থীরা সরকারকে টিকিয়ে রাখার শরিক। খুব কি কিছু পাল্টাল তাতে? এই সময়েই ওডিশার কলিঙ্গনগরে জমি-দখল বিরোধী জমায়েতে পুলিশি গুলি। এই সময়েই কেরলে ভূমিজলের বেআইনি উত্তোলন রুখতে গণপ্রতিরোধ। আর আমাদের ঘরের কাছে সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম। রেলের একটা বড় অংশ বেসরকারি হাতে হস্তান্তরিত। বিমাশিল্পে বিদেশি বিনিয়োগের ঊর্ধ্বসীমা তুলে দেওয়া নিয়ে কথা শুরু হয়েছে। মোবাইল পরিষেবার জন্য লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে বিদেশি সংস্থাগুলিকে। ব্যাঙ্কে ব্যাঙ্কে কর্মীর অনটন। ইস্পাতশিল্পে সরকার হাত গুটিয়ে নিয়ে জমি ছাড়ছে প্রাইভেট সেক্টরকে। কর্পোরেট সংস্থাগুলিকে কে কত সরকারি সুবিধে দিতে পারে তার প্রতিযোগিতা চালু হয়ে গেল। গুজরাত মহারাষ্ট্র যদি পাঁচ টাকা দেয় তাহলে ওডিশা দেবে আট টাকা। আর ততদিনে এই রাজ্যের বাম সরকারটিও কার্যকর করে ফেলেছে নতুন শিল্পনীতি। কার্যত তার সঙ্গে কেন্দ্রীয় নীতির কোনও তফাত নেই। গাড়ি কারখানা, স্পেশ্যাল ইকোনমিক জোন, কেমিক্যাল হাব ইত্যাদি নিয়ে যে বিরোধ বিতর্ক তার মধ্যে অনেক প্রতিক্রিয়ার অভিসন্ধি ছিল। ঠিক। কিন্তু আপাদমস্তক অস্পষ্টতা ও অস্বচ্ছ প্রতিবেদন উস্কে দিয়েছে সরকার-বিরোধী ক্ষোভ, আজ এত বছর পরেও তার কোনও প্রকৃত মূল্যায়ন হতে পারল না। তাছাড়া, রাজ্যের বেশ কিছু অলাভজনক সরকারি প্রতিষ্ঠান ধীরে ধীরে গুটিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত তো সেই আমলেই নেওয়া। সরকারি অফিসে কর্মী নিয়োগ না করে অবসরপ্রাপ্তদের চুক্তিভিত্তিতে কাজ করানোর রীতি স্বীকৃতি পেয়েছে ওই সময়কালেই। রাজ্যের বেশ কিছু দফতরের কাজ আউটসোর্স করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে বাম সরকারের ক্যাবিনেটেই। কে কাকে বলে? কিন্তু মানচিত্র পাল্টাচ্ছে। সরকারি অংশীদারিত্বের সঙ্গে বেসরকারি বিনিয়োগের। পোস্টাফিস যে কেনা যায় না, এই ‘সত্য’ ক্রমশ ফিকে হওয়ার পথে।

কিন্তু একচেটিয়া দেশি-বিদেশি পুঁজিকে সব ক্ষেত্রে জায়গা করে দিলে যে আমাদের মতো দারিদ্র্য ও অসাম্যপীড়িত দেশে আদপে চলে না, এটা টের পাওয়া যাচ্ছিল আগেই। প্রথম ইউপিএ সরকারের আওতায় এই বৈষম্যের বিকাশ যে ঘটছিল তার ইতিউতি আভাস পেতে অসুবিধে হয়নি। কার্যত সেই সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিক্ষোভকে সামাল দেওয়ার সেফটি ভাল্ভ ছিল নানা সামাজিক সংস্কার প্রকল্প— বিশেষ করে গ্রামীন কর্মসংস্থানের খানিকটা গ্যারান্টি। তবু কি শেষরক্ষা হয়? নিয়মগিরি পাহাড়ে বক্সাইট-লোভী বহুজাতিকের আগ্রাসন রুখতে আদিবাসী রমণী তাঁর কোলের ছেলেকে পুলিশ সুপারের গাড়ির সামনে শুইয়ে দিয়ে বুক চিতিয়ে বলেন, ওর বুকের ওপর দিয়েই চালিয়ে দাও তোমাদের গাড়ি। আমরা এমনিই মারা যাব, বাচ্চাটা বাঁচবে কীভাবে? পুলিশকর্তা চমকে ওঠার আগেই দেখেছিলেন, দলে দলে রমণীরা তাঁদের কোলের ছেলেদের সার সার শুইয়ে দিয়েছে রাস্তায়। ভারতখ্যাত এক অর্থনীতিবিদ সেই সময় তাঁর সারাদেশ ঘুরে দেখার অভিজ্ঞতা থেকে বলেছিলেন, বিয়াল্লিশের ভারত ছাড়ো আন্দোলনের পর এরকম দেশব্যাপী জনবিক্ষোভ তাঁর অভিজ্ঞতায় নেই। কিন্তু এরই পাশে পাশে আসে নজিরবিহীন সরকারি দুর্নীতি। খনির মালিকানা নিয়ে, টেলিযোগাযোগ দফতরের স্পেক্ট্রাম বণ্টন নিয়ে, আরও আরও আরও। যত কর্পোরেট পুঁজির এলাকা বাড়ছে তত নেতা মন্ত্রীরা সুবিধে বিতরণ করে ডুবে যাচ্ছেন কালো টাকায়। খোদ অর্থমন্ত্রী নিজেই এমন এক বহুজাতিকের ডিরেক্টর যারা খনি কেনার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত।

কাট ফাইভ। আচ্ছে দিন-এর স্বপ্ন ফেরি করে আবার পালাবদল। আর এবার আরও গতি পেল আর্থিক সংস্কার। সংসদে সন্তোষজনক সংখ্যাধিক্য। চাইলেই যা কিছু করে ফেলা যায়। বিমানবন্দর, জলবন্দর, জাহাজ কোম্পানি সব জলের দরে বিকিয়ে যাচ্ছে এবার। রেলের স্টেশন, আরও নানা পরিষেবা এমনকি ট্রেনগুলিও এবার চলছে বেসরকারি নেতৃত্বে। প্রতিরক্ষার সরঞ্জাম থেকে নেট পরিষেবা, স্কুল-কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়-হাসপাতাল সবই এখন চালানো যায় প্রাইভেটে। স্থায়ী নিয়োগ নেই। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের সংখ্যা কমিয়ে মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে এর সঙ্গে ওকে। হাপিস করে দেওয়া হচ্ছে ঋণখেলাপিদের তথ্য। আচ্ছে দিন। খুচরো ব্যবসায় অবাধ হয়ে গেল বহুজাতিকের দাবি। পোস্টাফিসে আর পোস্টকার্ড-খাম-ইনল্যান্ড লেটার পাওয়া যায় না। বহুমূল্য স্পিডপোস্ট ছাড়া গতি নেই, ইদানিং তাও আবার পাওয়া যায় নানা বেসরকারি এজেন্সিতে। অথচ নাকি গরিব কমে যাচ্ছে সারা দেশে। গ্যাসের ভর্তুকি দু-কাপ চায়ের দামের থেকেও কম। কলকাতার মেট্রোরেলের প্রত্যেকটি স্টেশনের গায়ে নতুন নাম— প্রতিটিই কিনে নিয়েছে কোনও-না-কোনও প্রতিষ্ঠান। অথচ বিকাশের ঢল নেমেছে সারা দেশে। সবার নাকি উন্নতি হচ্ছে। দেশের অমৃতকালে কল্পতরু সরকার, যা চাইবেন তাই পাবেন। পাবেনই। জল মাটি পাহাড় সমুদ্র নদী অরণ্য সব এখন কিনতে পাওয়া যায়। এমনকি তার ‘গণতান্ত্রিক’ সম্মতিও।

ইদানিং মার্কসবাদ বা মার্কসবাদীদের কেউ খুব একটা পোছে না। ‘অভ্রান্ত’ বিজ্ঞান বলে কিছু হয় কি না তাও জানি না। তবে যদি খুব ভুল না করি তবে মহামতি মার্কসসাহেবের সঙ্গে পূর্বসূরি হেগেলসাহেবের কিছু ঝগড়াঝাঁটি ছিল। হেগেল মনে করতেন, রাষ্ট্র আসলে সকলের ভাল চায়। তর্ক তুলে মার্কস বলতেন, ওরকম আসলে মনে হয়। আসলে রাষ্ট্র শ্রেণির স্বার্থের দিকেই ঝোল টেনে চলে। সেটা ছিল উৎপাদনের উপায়গুলির মালিকের শ্রেণির কথা, আজ তার সবটাই বৃহৎ পুঁজির হাতে। হালে সেই ক্রোনি-পুঁজির সঙ্গে আকাট ধর্মীয় মৌলবাদের আইনি বিবাহবাসর ও ফুলশয্যার বিপুল আলোয় ধাঁধিয়ে গিয়েছে আমাদের চোখ।

ডিজল্ভ। ‘মডার্ন টাইমস’-এর সেই রোলিং মিল আজও ঘুরে চলেছে। গোটা দেশটাই ‘ব্যবসায়ী’ খেলার প্রকাণ্ড উল্লাসমঞ্চ। এর মধ্যে বাবার আর্তনাদ, পোস্টাফিস কেনা যায় নাকি রে বোকা— আপাতত তামাদি হয়ে গেছে। বাবা বেঁচে গেলেন, এই ইতর সময়ের ভিতর তাঁকে প্রশ্বাস নিতে হল না বলে।

পরবর্তী স্টেশন রসাতল। প্ল্যাটফর্ম ডানদিকে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4664 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...