রাম পুনিয়ানি
আপাতত যেটা বলা যায়, হিন্দুত্বের তৃতীয় স্তম্ভ— অভিন্ন দেওয়ানি বিধি— সেটা বেশ কিছুদিনের জন্য বিলম্বিত হল। সিএএ-র মতো মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ বিভাজনমূলক আইন ইতিমধ্যেই ঝুলন্ত তরবারি হয়ে রয়েছে। সময়ই একমাত্র বলতে পারে এই আইন কার্যকর করার জন্য বিজেপি কতটা শক্তি ব্যয় করবে। মনে রাখতে হবে চন্দ্রবাবু নাইডু বা নীতীশ কুমার কিন্তু এ-বিষয়ে যথেষ্ট কৌশলী। চন্দ্রবাবু ইতিমধ্যেই নিজের রাজ্যে মুসলিমদের জন্য ৪ শতাংশ সংরক্ষণ চালু করতেও উদ্যোগী হয়েছেন
বিজেপি একা ২৭২ পার করতে না পারায় এনডিএ আবার সামনে চলে এসেছে। ১৯৯৮ সালে বাজপেয়ি যখন এনডিএ সরকারের নেতৃত্ব দিয়ে মসনদে বসেছিলেন, তখন সেই সরকারেও কিন্তু বিজেপির রাজনীতির একটা গভীর ছাপ ছিল। আরও অনেক বিষয়ের সঙ্গে আমরা সেই সময়ের হিন্দুত্ববাদী অ্যাজেন্ডার দুটি প্রয়োগের কথা নিশ্চিতভাবে স্মরণ করতে পারি— সংবিধান পর্যালোচনার জন্য বেঙ্কটচালিয়া কমিশনের নিয়োগ এবং পাঠ্যপুস্তকগুলির গেরুয়াকরণ, জ্যোতিষ এবং পৌরোহিত্য-কে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করা। ২০১৪ এবং ২০১৯, এই দুবার মোদি এনডিএ সরকার হিসেবে ক্ষমতায় এলেও বিজেপির এতটাই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল যে অন্য শরিকদের ‘সাইলেন্ট মোড’-এ রেখে বিজেপি আগ্রাসীভাবে তাদের হিন্দু জাতীয়তাবাদী কর্মসূচির রূপায়ণ চালিয়ে গেছে। রামমন্দির বানিয়েছে, ৩৭০ ধারা বিলোপ করেছে। এগুলোর সঙ্গে সঙ্গে গরুর মাংস বা লাভ-জিহাদের মতো বিষয়গুলি তুলে মুসলিমদের অবাধে হত্যা করা হয়েছে। এসব ঘৃণ্য কাজ যারা করেছে তারা জানত রাষ্ট্র তাদের কিছু বলবে না।
মোদি সরকারের অন্যান্য স্বৈরাচারী কাজগুলির অন্যতম হল সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে ধ্বংস করা এবং মিডিয়াকে গোদি মিডিয়ায় পরিণত করা। এই সমস্ত বিষয়গুলিই বিরোধীদের ‘ইন্ডিয়া’ জোটে ঐক্যবদ্ধ হতে সাহায্য করেছে। আর সেই বিরোধী জোটের জন্যই বিজেপির এবং স্বয়ং মোদির নির্বাচনী প্রচার কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ে চরম মুসলিম-বিদ্বেষী প্রোপাগান্ডায়। কংগ্রেসের ইস্তেহারকে বলা হয়েছে প্রকৃত প্রস্তাবে মুসলিম লিগের ইস্তেহার। তাদের স্লোগান এবং প্রতিশ্রুতিগুলিকে বলা হয়েছে সবই আসলে মুসলিম-তোষণের কথাবার্তা। মুসলিমদের বলা হয়েছে ঘুষপেটিয়া এবং তারা গাদা গাদা বাচ্চা পয়দা করে। মোদির প্রচার কুরুচির শেষ সীমায় পৌঁছে যায় যখন তিনি বলেন কংগ্রেস মুসলিমদের জন্য মুজরো করবে। এ-ও বলা হয়েছে, কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে সমস্ত সন্ত্রাসবাদীদের মুক্তি দিয়ে বিরিয়ানি খাওয়ানো হবে, দেশে তালিবান আইন প্রতিষ্ঠিত হবে।
এমনভাবে সিস্টেম করা হয়েছে যে মুসলিমদের অনেকেই ভোটার তালিকায় তাঁদের নাম খুঁজে পাননি, অনেককেই পুলিশ ভোটবুথ থেকে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে। বাস্তবতই মুসলিমদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক বানিয়ে দেওয়া হয়েছে, করে দেওয়া হয়েছে রাজনৈতিকভাবে অদৃশ্য। এবং এই সব কিছুর মধ্যে দিয়েই এই অসহায় সম্প্রদায়ের ওপর সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জনগণের ঘৃণা তীব্রতর হয়ে উঠেছে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে বিজেপি যখন তাদের বহুল প্রচারিত আসন সংখ্যার ঘোষণার (এনডিএ— ৪০০+, বিজেপি একাই ৩৭০+) ধারেকাছেও যেতে পারল না, তখন মুসলিমরা স্বাভাবিকভাবেই স্বস্তির একটা বিরাট শ্বাস ফেলেছেন। ফল প্রকাশের পর মোদি যখন নিজেকে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করলেন, দেখা গেল তাঁর গলা অনেক খাদে নেমে এসেছে এবং তিনি ‘সর্ব ধর্ম সম্ভব’ (সব ধর্মকে সম্মান দেওয়া)-র কথা বলছেন। গত দশ বছরে দেশে মুসলিমদের (এবং খ্রিস্টানদেরও) সঙ্গে যা হয়েছে, তা মনে রাখলে একে হিপোক্রিসির চূড়ান্ত বলে মনে হওয়া ছাড়া কোনও উপায় নেই।
সামনের দিনগুলিতে এই সম্প্রদায়ের বরাতে কী আছে? কিছুটা স্বস্তি হয়তো তাদের মিলবে, কারণ হিন্দুত্ববাদী গুণ্ডাবাহিনি এতদিন যে আজাদি উপভোগ করে এসেছে তা হয়তো কিছু কমবে। যদিও এখানে একটা বড়সড় ‘যদি’ আছে। কারণ এই গুণ্ডাবাহিনি এবং তাদের মানসিকতার শিকড় এতদিনে সিস্টেমের অনেক গভীরে ঢুকে পড়েছে। নীতীশ এবং নাইডুর মতো সহযোগীরা মুসলিম-বিরোধী হিংসার বিরুদ্ধে কতটা সোচ্চার হবেন তা-ও এখনও দেখা হয়নি। মোদির পার্টির আগ্রাসী রাজনীতির বিরুদ্ধে তাঁরা কতটা কার্যকরী ভূমিকা নিতে পারেন সে উত্তরও ভবিষ্যৎই দেবে। মনে রাখতে হবে, হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা এতদিন ধরে যে লাগামছাড়া ঘৃণার চাষ করেছে তা যথেষ্ট বিস্তার লাভ করেছে এবং তাকে কমানো খুব একটা সহজ হবে না।
আপাতত যেটা বলা যায়, হিন্দুত্বের তৃতীয় স্তম্ভ— অভিন্ন দেওয়ানি বিধি— সেটা বেশ কিছুদিনের জন্য বিলম্বিত হল। সিএএ-র মতো মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ বিভাজনমূলক আইন ইতিমধ্যেই ঝুলন্ত তরবারি হয়ে রয়েছে। সময়ই একমাত্র বলতে পারে এই আইন কার্যকর করার জন্য বিজেপি কতটা শক্তি ব্যয় করবে। শাহিনবাগের দুর্ধর্ষ আন্দোলনের পর এটা নিশ্চিত যে সাম্প্রদায়িক বিজেপি যতক্ষণ না নিশ্চিত হচ্ছে যে নাইডু-নীতীশরা থাকা সত্ত্বেও তারা এই আইন কার্যকর করতে সক্ষম হবে ততক্ষণ তারা এ নিয়ে বাড়াবাড়ি করবে না। মনে রাখতে হবে চন্দ্রবাবু নাইডু বা নীতীশ কুমার কিন্তু এ-বিষয়ে যথেষ্ট কৌশলী। চন্দ্রবাবু ইতিমধ্যেই নিজের রাজ্যে মুসলিমদের জন্য ৪ শতাংশ সংরক্ষণ চালু করতেও উদ্যোগী হয়েছেন।
আরেকটা বড় ইস্যু হল জাতগণনা। বিজেপি এতদিন এর বিরোধিতা করে এসেছে। কিন্তু এখন তাদের সঙ্গী নীতীশ কুমার, যিনি বিহারের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে বিহারে জাতগণনা করিয়েছেন এবং সে-রাজ্যে এই বিষয়ে একটা ব্যাপক গণদাবি তৈরি হয়েছে। মোদি যে প্রচার চালিয়েছিলেন যে ইন্ডিয়া জোট ক্ষমতায় এলে এসসি-এসটিদের সংরক্ষণ বাতিল করে সব মুসলিমদের দিয়ে দেবে সে-প্রচার সে-রাজ্যে কেউ বিশ্বাস করেনি। সব মিলিয়ে জাতগণনা নিয়েও নতুন করে চিন্তাভাবনা করতে হবে।
মুসলিমদের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আমরা কী আশা করতে পারি? সঙ্ঘ পরিবার এই সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে যে বিপুল পরিমাণ ঘৃণা ছড়িয়েছে তা আমাদের সমাজের চিন্তাজগতে অনেক গভীরে ঢুকে গেছে। মুসলিম-বিরোধী চিন্তাভাবনা আজ সমাজের গড়পড়তা ধ্যানধারণার অঙ্গ হয়ে গেছে। একদিকে সঙ্ঘ পরিবারের বিভিন্ন সংগঠনগুলির এই ঘৃণ্য প্রচার, তার সঙ্গে পাঠ্যবইয়ের পরিবর্তন, সাংবাদমাধ্যমের ভূমিকা এবং মুখে মুখে নানা ভুল ধারণার প্রচারের ফলে এই বিষয়টি গুণিতক হারে বেড়ে উঠেছে।
এই মিথ এবং ভুল ধারণাগুলিই সেই ভিত্তির কাজ করেছে যার ওপর ঘৃণার চাষ করা সহজ হয়েছে। এতে সহযোগিতা করেছে সমাজে মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্রচলিত বিরূপ ধারণা। এবং এগুলির ফলশ্রুতিই হল হিংসা এবং মেরুকরণ। ২০২৪-এর নির্বাচনে আরএসএস-এর ভূমিকার গভীর বিশ্লেষণ এখনও হয়নি, কিন্তু এটা নিয়ে সন্দেহ নেই যে এই আরএসএস-ই মুসলিমদের বিরুদ্ধে এবং গত দুই দশক ধরে খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধেও ঘৃণার চাষ করে আসছে। মনে রাখতে হবে মোদি-জমানার দশ বছরে গোটা দেশ জুড়ে আরএসএসের শাখাগুলির সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। সন্দেহ করা অমূলক নয় যে, ওড়িশার মতো রাজ্যে যেখানে কন্ধমাল দাঙ্গা হয়েছিল, গ্রাহাম স্টেইনসকে সপরিবারে জীবন্ত জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল— সেই ঘটনাগুলিই প্রকৃতপক্ষে বিজেপির রাজনৈতিক উত্থানের জমিতে সার-জল দিয়েছে। আজ আমরা তার ফল ফলতে দেখছি।
আবার, জাতীয় স্তরে খ্রিস্টানরা হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতির আক্রমণের অন্যতম লক্ষ্যবস্তু হলেও— খ্রিস্টানদের বিভিন্ন প্রার্থনাসভায় আক্রমণের ঘটনা বৃদ্ধির মধ্যে দিয়ে যা প্রকাশ পাচ্ছে— কেরলে কিন্তু বিভিন্ন কারণে বিজেপি খ্রিস্টানদের একটা অংশের সমর্থন অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।
সবশেষে এটাই বলার যে, মুসলিমদের প্রান্তিক করার কাজ চলতে থাকবে। সমাজে মেরুকরণকে আরএসএস যতটা গভীরে প্রোথিত করেছে, তাকে উৎখাত করা সহজ নয়। আরএসএসের কাজকর্ম সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন দেশের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল। তিনি লিখেছিলেন: “ওদের সমস্ত বক্তব্য সাম্প্রদায়িক বিষে পরিপূর্ণ— যে বিষের ফলশ্রুতিতে আজ দেশকে গান্ধিজির অমূল্য জীবন বলিদান দিতে হল।”[1] আমাদের দেশের রাজনৈতিক পরিসরের এই বিষাক্ত দিকটিকে খর্ব করা বা এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা তো হয়ইনি, বরং আমাদের সমাজের ধর্মীয় বিভাজনের যাবতীয় ক্ষেত্রগুলিকে ব্যবহার করে এটি এখন এক বহু শাখাপ্রশাখা-যুক্ত বিষাক্ত আগাছায় পরিণত হয়েছে। সমাজে গেঁড়ে বসা এই বিপুল ঘৃণাকে উৎখাত করতে না পারলে আমরা আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের স্বপ্নের ভারত গড়তে পারব না।
[1] ১৯৪৮ সালে সঙ্ঘ পরিবারকে নিষিদ্ধ করার পর লেখা।
*নিবন্ধটি সেকুলার পার্সপেকটিভ-এ গত ১৩ জুন ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়।