যুদ্ধ, পরিবেশ, এবং ‘নিউক্লিয়ার শীতের গোধূলি’

অনির্বাণ ভট্টাচার্য

 


যুদ্ধের খবরে সবকিছুই ক্রমশ প্রকাশ্য। পরিবেশধ্বংসের কথায়, হিসেবে তাই সেভাবে ছেদ নেই। ফরাসি উপন্যাস লে ফিউ-তে লেখক অঁরি বারবুস বলেছিলেন, “নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করা দুটো দল আসলে সমবেত আত্মহত্যা করা একটা বড় দল।” যুদ্ধের পরিবেশগত দিকেও তেমনই কিছু প্রশ্ন জড়িত। তেজস্ক্রিয় অর্ধ-জীবন বেশি হলেও ডিপ্লেটেড ইউরেনিয়াম আসলে পরিবেশ এবং শরীরের যে দীর্ঘকালীন ক্ষতি করে, তার হিসেব কে দেবে? যে ক্লাস্টার বোমাগুলো না ফেটে দীর্ঘদিন মাটিতে পড়ে থেকে শেষমেশ ল্যান্ডমাইনে পরিণত হয়ে বিলম্বিত ফেটালিটি তৈরি করছে, তার হিসেব কোথায়? তথাকথিত পিনপয়েন্ট বম্বিংয়ের থেকে যে রাসায়নিক রেসিড্যু জমা হয়ে মাটি, জলাশয় হয়ে শেষমেশ খাদ্যশৃঙ্খলে মিশছে, তার রিপোর্ট কীভাবে হবে? যুদ্ধের বিষাক্ত রাসায়নিকে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ-মানুষীর সন্ততিদের জিনগত বদল এবং দীর্ঘকালীন ক্ষতির বিশদে ঢোকার ক্ষমতা কোন ‘প্রেসিশন ওয়ারফেয়ার’ দেবে? অধ্যাপক সৈয়দ বাঘেরির সেই কথাগুলোর রেশ ধরেই বলা যায়, শুধু গাজা নয়, প্রকৃতি ও পরিবেশ বিশ্বজুড়ে সমস্ত যুদ্ধেরই নীরব শিকার। সাইলেন্ট ভিক্টিম

 

১৯১৫-র ২১ মার্চ। হেনরি জেমসের দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারের অংশবিশেষ— ‘The war has used up words; they have been weakened, deteriorated like motor car tires; … we are now confronted with a depreciation of all our terms … that may well make us wonder what ghosts will be left to walk.’

কোন কোন প্রেত পড়ে আছে শেষে? কী তার খাবার? এই সমস্ত ভাবনা অতিরিক্ত ডিস্টোপিক মনে হতে পারে। হিউম্যান কিলিং এবং মনুষ্যকেন্দ্রিক ক্ষতির পাশাপাশি যুদ্ধ, সামরিক অশান্তি ইত্যাদি একটি দেশে, একটি গ্রহের পরিবেশে ঠিক কীরকম প্রভাব ফেলতে পারে, তার চেহারা, পোশাক— দুই-ই আসলে যথেষ্ট ডিস্টোপিক।

খুব স্বাভাবিকভাবে পরিবেশের ক্ষতির দিকটি বরাবরই তলানিতে চলে যায়, মনুষ্যকেন্দ্রিক পৃথিবীর সমস্যাগুলির সঙ্গে তুলনায়। যুদ্ধ ও রাজনৈতিক অশান্তি এবং পরিবেশ-সমস্যার পারস্পরিক সম্পর্কের ওপর কাজ করে যাওয়া সংস্থা ‘কনফ্লিক্ট অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল অবজারভেটরি’-র হিসেব বলছে, গ্রহের মোট গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের ৫.৫ শতাংশ আসে মিলিটারি অ্যাকটিভিটি থেকে। পৃথিবীর মোট স্থলভাগের ১-৬ শতাংশের মালিকানা রয়েছে বিভিন্ন দেশের সামরিক বাহিনীর হাতে।

যুদ্ধ ও সামরিক আক্রমণে পরিবেশধ্বংসের সম্পর্ক অনুমেয় এবং খুব স্বাভাবিক। তবে যুদ্ধ এবং পরবর্তী সময়ে হিউম্যান ক্যাজুয়ালটির তুলনায় পেছনে পড়ে গেছে পরিবেশধ্বংসের ক্রনোলজি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানি, ফ্রান্স ও ব্রিটেনের ছোড়া প্রায় ১.৪৫ মিলিয়ন অগ্নিনিক্ষেপক ফ্রান্স, বেলজিয়াম ও আশেপাশের অঞ্চলে ভয়াবহ বৃক্ষধ্বংসের কারণ হয়েছিল। এসেছে ‘উইপন অফ মাস ডেস্ট্রাকশন’-এর ব্যবহার। এজেন্ট অরেঞ্জ। মালয় যুদ্ধের সময় ব্রিটিশ এবং পরবর্তীকালে ভিয়েতনাম যুদ্ধে অপারেশন র‍্যাঞ্চ হ্যান্ডে মার্কিন রেইনবো হার্বিসাইড— এই এজেন্ট অরেঞ্জের কুখ্যাতির কথা স্মরণ করা যেতে পারে।

১৯৬১ থেকে ১৯৭১— এই দশ বছরে মার্কিন তাণ্ডবে এজেন্ট অরেঞ্জ ও নাপাম মিলিয়ে মোট ৭৩ মিলিয়ন লিটার তরল রাসায়নিক প্রয়োগ করা হয়েছিল, যার প্রকোপ ভিয়েতনামে এখনও দেখা যাচ্ছে। মার্কিন এয়ারক্র্যাফটের লক্ষ্যে ছিল ভিয়েতনামের ৪.৫ মিলিয়ন একর অরণ্য এবং চাষের জমি। রাসায়নিক বাতাস থেকে মাটি, মাটি থেকে চুইয়ে চুইয়ে ভূগর্ভস্থ জল, প্রায় ৫০ শতাংশ শেষ হয়ে যাওয়া দেশের সমুদ্র-উপকূলবর্তী ম্যানগ্রোভ— কোথায় পড়েনি অবিশ্বাস্য দূষণের প্রকোপ?

ভিয়েতনামে অপারেশন র‍্যাঞ্চহ্যান্ডে এজেন্ট অরেঞ্জ স্প্রে করার বীভৎস দৃশ্য

কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের ‘এখনও নামেনি বন্ধু, নিউক্লিয়ার শীতের গোধূলি’ মনে পড়ছে। সে আশ্বাস কত দূর? ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, দুই দেশের অশান্তির পরিবেশ যেভাবে এগোচ্ছে, তাতে খুব বেশি ভরসার জায়গা নেই।

 

সম্প্রতি, ২০১৯-এর ২ অক্টোবর সায়েন্স অ্যাডভান্সেস পত্রিকায় ১৯৮৩ সালের ‘নিউক্লিয়ার উইন্টার’ শব্দবন্ধটির প্রণেতা, প্রখ্যাত বিজ্ঞানী রিচার্ড পি টুর্কোর অধীনে প্রকাশ পেয়েছিল একটি চাঞ্চল্যকর রিপোর্ট, যার শিরোনাম— Rapidly Expanding Nuclear Arsenals in Pakistan and India Portend Regional and Global Catastrophe. অবশ্য ‘চাঞ্চল্যকর’ শব্দটি আপেক্ষিক। যুদ্ধমুখর পৃথিবীর কাছে সেই দেশের মর্টার, রকেট, মিসাইল-তাণ্ডব যতটা চাঞ্চল্য তৈরি করে, পরিবেশধ্বংস, নিউক্লিয়ার শীত— এই সমস্ত শব্দ ও অনুষঙ্গ ততটা নয়। তবু দেখে নেওয়া যাক, কী বলছে সেই রিপোর্ট।

আশ্চর্যজনকভাবে, খোদ ২০২৫-কেই দুই দেশের নিউক্লিয়ার যুদ্ধ শুরুর বছর হিসেবে ধরা হয়েছে সমীক্ষায়। এই বছর ভারত ও পাকিস্তান নিউক্লিয়ার অস্ত্রযুদ্ধে এগোলে, ধরা যাক দুই দেশ মিলিয়ে মোট ৩০০-র কাছাকাছি নিউক্লিয়ার অস্ত্র প্রয়োগ করল একে অপরের প্রতি— সব মিলিয়ে যার ক্ষমতা সর্বাধিক ৫০ কিলোটন। তাতে মোট হিউম্যান কিলিং দুই দেশ মিলিয়ে ৫০ থেকে ১২৫ মিলিয়ন।

পরিবেশের দিক? বিশ্বজনীন ক্ষতির দিকগুলিই বা কী কী?

বিশ্বব্যাপী বৃষ্টির হার কমবে ১৫–৩০ শতাংশ। স্থলভাগ ও সমুদ্রের নেট প্রাইমারি প্রোডাক্টিভিটি কমবে যথাক্রমে ১৫–৩০ শতাংশ ও ১০–২০ শতাংশ। নিঃসৃত মোট ১৬–৩০ টেরাগ্রাম ব্ল্যাক কার্বন স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে গিয়ে অনেকাংশেই আটকে দিতে পারে সূর্যকিরণ; এবং এভাবেই সূর্যরশ্মি ২০–৩৫ শতাংশ কমে গিয়ে তাপমাত্রা কমতে পারে ২–৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস— যা ভয়ঙ্কর নিউক্লিয়ার শীতের জন্ম দেবে। এই অবস্থা থেকে আগের অবস্থায় ফিরে আসতে লাগতে পারে ১২ বছরেরও বেশি সময়। যদিও সেই বারো বছরে নতুন কোনও নিউক্লিয়ার অস্ত্র এবং সেখান থেকে ততোধিক ক্ষতি— কোন মডেল, কোন গবেষণা মাপবে এই ভিসিয়াস সার্কেল, ভয়াবহ ক্ষতির লুপকে?

এই তাপমাত্রা পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বাটারফ্লাই এফেক্ট এবং বিশ্বজনীন কৃষিজ ক্ষতির দিকটিও সমীক্ষায় আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভুট্টার উৎপাদন কমে যাবে ২০ শতাংশ, চিনে প্রথম বছরে গম উৎপাদন কমবে ৫০ শতাংশ, ধান কমতে পারে ২১ শতাংশের কাছাকাছি।

 

ভারত-পাক সমস্যার প্রসঙ্গেই চলে আসে কাশ্মিরের কলোহাই হিমবাহের কথা। একটি সমীক্ষা বলছে, ১৯৬২ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত কলোহাই হারিয়েছে শতকরা ২৩ ভাগ অংশ। অন্য একটি সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ১৯৮০ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত কাশ্মিরের ১৪৭টি হিমবাহ হারিয়েছে শতকরা ২৮.৮২ ভাগ অংশ। হিমালয়ের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় কাশ্মিরে এই গ্লেসিয়ারের রিসিড অনেকটাই বেশি। এসবের অন্যতম কারণ কাশ্মিরজনিত রাজনৈতিক সমস্যা।

জেনিফার ক্রুকের নেতৃত্বে একটি রিসার্চ টিম দেখাচ্ছে, দুই দেশের সামরিক বাহিনী আইবেক্স, অ্যান্টিলোপ, বিগ-হর্নড শিপ, ব্লু শিপ, স্নো লেপার্ড, লং-টেইল্ড হিমালয়ান মারমট, ফ্লাইং স্কুইরেল শিকার করছে— যাদের অধিকাংশই ক্রমশ নিশ্চিহ্ন হওয়ার দিকে এগোচ্ছে। মধ্য কাশ্মিরের বাদ্গাম জেলার তোশাময়দান গ্রাসল্যান্ড ভারতের সামরিক বাহিনী কর্তৃক আর্টিলারি ফায়ারিং রেঞ্জ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে ১৯৬২ থেকে। ২০১৪ পর্যন্ত সেই ব্যবহার চলার পর, সামরিক বাহিনী তোশাময়দান ছেড়ে দেয় ২০১৬-তে। ততদিনে বীভৎস পরিবেশগত ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে। যদিও ২০১৮ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত রাজ্যের বনদপ্তর ‘কম্পেনসেটরি অ্যাফরেস্টেশন’ প্রকল্পের মাধ্যমে ২০৭ হেক্টর ক্ষতিগ্রস্ত জমির ওপর লাগিয়েছে ১.৪৯ লক্ষ চারাগাছ। তবু, জবরদখল, যত্রতত্র গাছ কাটার ট্র্যাডিশন এখনও চলছে।

 

সিরিয়া

‘সিরিয়ান মনিটরিং অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল রিসোর্সেস’-এর তথ্য বলছে, ১৯৯৭ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত পরিবেশমুখী পদক্ষেপে দেশের বনভূমির পরিমাণ বাড়ার বার্ষিক হার ছিল ০.৪৮ শতাংশ। ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশনের ডেটা অনুযায়ী, ১৯৯০ থেকে ২০১০ পর্যন্ত সিরিয়ায় বনভূমি বেড়েছিল ১,১৯,০০০ হেক্টর।

ওইটুকুই। বাদবাকি শুধুই অন্ধকার।

পশ্চিম সিরিয়ায় করা একটি সমীক্ষা বলছে, যুদ্ধ ও রাজনৈতিক সমস্যাজনিত কারণে ২০১০ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত সিরিয়া হারিয়েছে ১৯.৩ শতাংশ বা ৬৩,০০০ হেক্টর বনভূমি— যা গোটা একটি মাদ্রিদের সমান। পালসার ও ল্যান্ডস্যাট উপগ্রহের তথ্য অনুযায়ী, দেশের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চল উত্তর-পশ্চিম সমুদ্রতীরবর্তী এলাকা এবং দামাস্কাসকে ঘিরে দক্ষিণাঞ্চল। ২০১০ থেকে ২০১৫-র মধ্যে এই বনধ্বংসের হার সর্বাধিক— ১১.৫ শতাংশ বা ৩৮,০০০ হেক্টর। ২০১৫ থেকে ২০১৮-র মধ্যে ক্ষতি কিছুটা কমে এসেছে ৭.৮ শতাংশে।

কী কী কারণ থাকতে পারে এই বৃক্ষচ্ছেদনের?

সরাসরি বোমা বা মিসাইলের আঘাত ছাড়াও আছে আরেকটি দিক। দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে। যুদ্ধের ফলে মানুষ নিজের ঘরছাড়া— ‘ইন্টারনালি ডিসপ্লেসড পিপল’ বা আইডিপি। গ্যাস, বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ। জ্বালানি নেই, সঙ্গে তীব্র শীত। ফলে স্থানীয় ওক গাছ কেটে চারকোল উৎপাদন করে জ্বালানির জোগান মেটানো ও শীত থেকে বাঁচার চেষ্টা চলছে, বাড়িয়ে দিচ্ছে বৃক্ষচ্ছেদনের হার। ইডলিব ও আলেপ্পো সংলগ্ন উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ায় এই চাহিদা সবচেয়ে বেশি। আর এর সঙ্গেই রয়েছে দাবানলের সরাসরি যোগ।

প্রসঙ্গত, কুর্দিশ ওয়ার্কার্স পার্টির সঙ্গে তুর্কি সরকারের দ্বন্দ্বে কুর্দিশদের লুকোনোর জায়গা কমাতে রাষ্ট্র ইচ্ছাকৃত দাবানল সৃষ্টি করার মতো আত্মঘাতী পদক্ষেপ নেয়।

উত্তর সিরিয়ার আল-কাবির নদী-উপত্যকা সংলগ্ন লাটাকিয়া প্রদেশে ২০১২ থেকে ২০১৪-র মধ্যে সরাসরি যুদ্ধের কারণে দাবানল বেড়ে যাওয়ার সুস্পষ্ট ঊর্ধ্বগামী লেখচিত্র মিলেছে। ইউনাইটেড নেশনস মাইন অ্যাকশন সার্ভিস (ইউএনএমএএস), এক্সপ্লোসিভ অর্ডিন্যান্স (ইও), ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি) এবং ল্যান্ডমাইন ব্যবহারের মাধ্যমে বনাঞ্চলে রকেট ও মর্টার হামলা, সঙ্গে আইডিপিদের করা যত্রতত্র স্থানীয় চাষাবাদ, গাছ পুড়িয়ে নতুন জমি তৈরির প্রয়াস— সব মিলিয়ে দাবানলের ঘটনা ভয়াবহ মাত্রায় বেড়েছে। শুধুমাত্র ২০২০ সালেই দাবানল শেষ করে দিয়েছে ৯,০০০ হেক্টর অরণ্য ও কৃষিজমি, যার প্রভাব পড়েছে ১,৪০,০০০-রও বেশি মানুষের উপর।

দাবানলে পুড়ে যাওয়া অরণ্যের পাশে এক স্থানীয় সিরিয়ান

শুরুতেই প্রাক-যুদ্ধ সিরিয়ার কথা এসেছিল। ২০১১-র আগে বছরে গড়ে ৩০ মিলিয়ন চারাগাছ উৎপাদিত হত, যা ব্যবহৃত হত দেশের অ্যাফরেস্টেশন প্রোগ্রামে। যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে এই সংখ্যা কমে এসে দাঁড়িয়েছে বছরে গড়ে মাত্র ১.৫ মিলিয়নে। বোমাবর্ষণ, ধুলোঝড়, ঘন ঘন দাবানল— সব মিলে বায়ুদূষণ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে, ২০১৯ সালে ৯২টি দেশের মধ্যে সিরিয়ার বায়ুদূষণ ছিল সবচেয়ে ভয়ানক। পার্টিকুলেট ম্যাটার পিএম ২.৫— নিরাপদ সীমার তিন গুণেরও বেশি। ২০১০ থেকে ২০১৭-র মধ্যে দূষণজনিত রোগ এবং মৃত্যু ১৭ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় ৭,৬৮৪-তে। শুধুমাত্র পিএম ২.৫-এর কারণেই শারীরিক অক্ষমতার হার প্রতি লক্ষে ১,৬২৫। এই দূষণজনিত অকালমৃত্যু ও অসুস্থতা আর্থিক দৃষ্টিকোণ থেকে ধরলে দেখা যাচ্ছে, তা দেশের জিডিপি-র ০.৬ থেকে ১.৪২ শতাংশ পর্যন্ত ক্ষতিসাধন করেছে। পিএম ২.৫ বৃদ্ধির ফলেই তৈলবীজ ও গম উৎপাদনের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে।

 

রাশিয়া-ইউক্রেন

২০২৪-এর জানুয়ারি মাসে জার্নাল অফ অকুপেশনাল মেডিসিন অ্যান্ড টক্সিকোলজি পত্রিকায় প্রকাশিত একটি বিশদ রিপোর্টে পরিবেশ-ধ্বংসের তথ্যের পর তথ্য উঠে এসেছে। ২০২২-এর ফেব্রুয়ারি থেকে চলা যুদ্ধ ও দুই দেশের সংকটে পরিবেশ ধ্বংসের আর্থিক পরিমাণ ২০২৩-এর পরিবেশ মন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী মোট ৫৬.৪ বিলিয়ন ডলার। পাশাপাশি, অর্থে মাপা যায় না এমন বীভৎস রাসায়নিক দূষণ। ইউক্রেনের ৩০ শতাংশ অঞ্চল ল্যান্ডমাইন ও অস্ত্রহামলার ফলে দূষিত হয়ে গেছে; ৩০ শতাংশ অরণ্য ও সংরক্ষিত অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত। মিসাইল ও অন্যান্য অস্ত্রহানার ফলে বাড়ছে দাবানলের সংখ্যা— ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২-এ দাবানল বেড়েছিল ২১ গুণ। দেশের অরণ্য ও বৃক্ষসম্পদের ১,৮৩,০০০ হেক্টর এলাকা দাবানলে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।

যুদ্ধের মাত্র এক বছরের মধ্যেই, যুদ্ধ থেকেই সরাসরি ২১.৯ মিলিয়ন টন কার্বন ডাই-অক্সাইড বা সমতুল্য গ্যাস নিঃসৃত হয়েছে, আর যুদ্ধজনিত অগ্নিকাণ্ড থেকে অতিরিক্ত আরও ১৭.৭ মিলিয়ন টন। যুদ্ধ শুরুর ঠিক আগে প্রতিশ্রুত বিকল্প শক্তি প্রকল্পগুলির প্রায় ৬০ শতাংশই যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে বন্ধ হয়ে গেছে।

২০২২-এর ১৯ মার্চ, যখন যুদ্ধের এক মাসও হয়নি, তখন কিয়েভে ফাইন পার্টিকুলেট ম্যাটার (PM 2.5) মেপে দেখা গিয়েছিল, তা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত সর্বোচ্চ সীমার ২৭.৮ গুণ বেশি। যুদ্ধের ১৩ মাসের মধ্যে ৩৬টি ফুয়েল স্টোরেজ ধ্বংস হয়েছিল, যার মধ্যে ছিল ১৭টি তেলের ট্যাঙ্কার— ফলে প্রায় ১,০৮,০০০ টন তেল ও গ্যাসোলিন পুড়ে গিয়ে সৃষ্টি করেছে ভয়াবহ দূষণ।

২০২৩-এর জুলাইয়ে প্রকাশিত দেশের পরিবেশ মন্ত্রকের রিপোর্ট বলছে, ৭২৪টি হাইড্রোলিক স্ট্রাকচার, ৭১টি জল উত্তোলন কেন্দ্র, ৬৪টি পয়ঃপ্রণালী পাম্পিং স্টেশন এবং ২৩টি জলশোধন কেন্দ্র সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। এর ফলস্বরূপ ২০.৭ বিলিয়ন ঘন মিটার বর্জ্য জল ইউক্রেনের নদী ও জলাশয়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। পরিণতি সহজেই অনুমেয়।

২০২৪-এর এপ্রিলে ইউক্রেনের জ্যাপোরিঝিয়া পারমাণবিক কেন্দ্রে আগুন লাগার একটি ভাইরাল ভিডিও স্ক্রিনশট

২০২২-এর ৪ মার্চ ইউক্রেনের জ্যাপোরিঝিয়া পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রুশ বাহিনীর দখলে যায়, এবং ২০২৩-এর ৬ জুন দক্ষিণ ইউক্রেনের নিপ্রো নদীর ওপর নোভা কাখোভকা বাঁধ ধ্বংস হয়— এই দুটি ঘটনা ভয়াবহ পরিবেশ-ধ্বংসের সূত্রপাত করে এবং ৩ মিলিয়ন হেক্টর বনভূমি ধ্বংসের ট্রিগার হয়ে ওঠে। তেজস্ক্রিয় বিকিরণের আশঙ্কা থাকায় ১৯৮৯-এর সোভিয়েত ‘প্রোটোকল ওয়ান’ আইনে পারমাণবিক কেন্দ্রগুলিকে সামরিক আক্রমণ থেকে ছাড় দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল, কিন্তু ২০১৯-এ রাশিয়া সেই আইনে প্রকাশ্য পরিবর্তন আনে। কাখোভকা বাঁধ ছিল জ্যাপোরিঝিয়া নিউক্লিয়ার প্ল্যান্টের কুলার জলের অন্যতম উৎস। বাঁধ ধ্বংস হয়ে কি আরেকটি চেরনোবিলের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে?

কাখোভকা বাঁধ ভেঙে এক ধাক্কায় ১৪ কিউবিক কিলোলিটারেরও বেশি জল নিঃসৃত হয়, যা পার্শ্ববর্তী জনপদ ভাসিয়ে দেয় এবং ৫০ জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটে। এই ঘটনার পরে নিপ্রো, জ্যাপোরিঝিয়া, মাইকোলায়েভ ও খেরসন অঞ্চলে ৩০,০০০ শিশু-সহ প্রায় ১.২৫ মিলিয়ন মানুষ বিশুদ্ধ পানীয় জল ছাড়া বেঁচে থাকার লড়াই চালাচ্ছেন। মানুষের পাশাপাশি প্রাণীজগতের ক্ষতিও সীমাহীন— চারপাশ থেকে ২০,০০০-রও বেশি পশুমৃত্যুর খবর এসেছে। নিপ্রো নদীতে আইইউসিএন-এর রেড লিস্টভুক্ত বিপন্ন স্টারজিওন মাছ সংরক্ষণের একটি ফিশ-ফার্ম সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। বিপন্ন মার্বেল পলিক্যাটের প্রজননক্ষেত্র ছিল কাখোভকা সংলগ্ন অঞ্চল— বন্যার পরে একটি পলিক্যাটও আর দেখা যাচ্ছে না। আদৌ এই প্রজাতিগুলি ইউক্রেনে আবার ফিরবে কি না, সে বিষয়ে গভীর অনিশ্চয়তা থেকেই যাচ্ছে।

উপগ্রহচিত্রে দেখা যাচ্ছে, ক্রিমিয়ান উপদ্বীপের বিশুদ্ধ পানীয় জলের একমাত্র উৎস নর্থ ক্রিমিয়ান ক্যানেল শুকিয়ে যেতে শুরু করেছে কাখোভকা ধ্বংসের পর। বাঁধের জলে নির্ভরশীল খেরসন, জ্যাপোরিঝিয়া ও নিপ্রোপেত্রোভস্ক অঞ্চলের সেচব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, ফলে প্রায় সব কৃষিজ জমি শুকিয়ে ভূমিক্ষয় ও মরুকরণের দিকে এগোচ্ছে। আশঙ্কা, অন্তত ৩ থেকে ৫ বছর এই এলাকায় স্বাভাবিক জলের জোগান পাওয়া সম্ভব নয়।

এছাড়াও কাখোভকা-বন্যার জলে প্রায় ১৫০ টন মেশিন অয়েল, জৈব বর্জ্য ও অগুনতি ল্যান্ডমাইন ভেসে নিপ্রো নদীর মাধ্যমে গিয়ে মিশেছে কৃষ্ণসাগরে।

কাখোভকা বাঁধ ধ্বংসের পর ভেসে যাওয়া ইউক্রেনের খেরসন শহর

২০২৪-এ রাশিয়ার টায়োটকিনো গ্রাম থেকে সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃতভাবে বিষাক্ত রাসায়নিক ফেলা হয় সেইম নদীতে, যা দুই দেশের সীমান্ত বরাবর প্রবাহিত। এই রাসায়নিক ইউক্রেনের উত্তর-পশ্চিমের সুমি অঞ্চল অতিক্রম করে একপ্রকার ধ্বংস করে দেয় সম্পূর্ণ সুমি পরিবেশব্যবস্থাকে। ইউক্রেনের দেস্রা ও অন্যান্য নদী ও জলাশয়ে ভেসে ওঠে মরা মাছ, মোলাস্কা, ক্রেফিশ, এবং নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় বিপন্ন স্টারলেট মাছের একটি স্থানীয় উপপ্রজাতি। এর পর দেস্রা-কে ঘোষণা করা হয় ইউরোপের প্রথম সম্পূর্ণ মৃত নদী হিসেবে।

 

গাজা

পূর্ব ভূমধ্যসাগর-সংলগ্ন ২৪ মাইলের সমুদ্রউপকূলবর্তী এই অঞ্চল জুড়ে রয়েছে উর্বর জমি, নিচে বালিয়াড়ি ও স্যান্ড-ওয়েলে ছেয়ে থাকা অগভীর ভূগর্ভস্থ জলের উৎস। ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার বন্যপ্রাণ-করিডরের সংযোগস্থল হওয়ায় গাজা হয়ে উঠেছিল গ্রহের অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ বায়োডাইভার্সিটি হটস্পট— ২৫০টি পাখির প্রজাতি ও ১০০টিরও বেশি স্তন্যপায়ী প্রাণীর আবাসভূমি। মূলত এই উর্বরতার কারণেই ১৯৪৮-এ ইজরায়েল রাষ্ট্র গঠনের পর লক্ষ লক্ষ প্যালেস্তিনীয় আশ্রয়ের খোঁজে ছুটে আসেন গাজায়।

অবশ্য যুদ্ধ আর দীর্ঘমেয়াদি অস্থিরতার আবহে এই প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য আজ ধ্বংসের মুখে। অধ্যাপক সৈয়দ বাঘেরির কথায়, প্রকৃতি ও পরিবেশ গাজায় ইজরায়েলি যুদ্ধের নীরব শিকার।” রিমোট সেন্সিং ডেটা বলছে, গাজার ৮০ শতাংশ গাছ ইতিমধ্যেই নিশ্চিহ্ন; বিশেষত উত্তর গাজায় এই হার প্রায় ৯০ শতাংশের কাছাকাছি। জনসংখ্যা বেড়ে ২ মিলিয়ন ছাড়িয়ে গেলেও, গাজার জীবনরেখা ওয়াদি গাজা নদী কিংবা অন্য উৎস থেকে ভূগর্ভস্থ জলের রিচার্জ হচ্ছে খুব সামান্য, যা হচ্ছে তার তিনগুণ বেশি জল উত্তোলন হচ্ছে। ফলে জলস্তর ক্রমশ নিচে নামছে, সমুদ্রের লবণাক্ত জল ঢুকে পড়ছে অ্যাকুইফারে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানাচ্ছে, ২০২৩ সালে গাজার ভূগর্ভস্থ মিষ্টি জলের রিজার্ভের ৯৭ শতাংশই পানযোগ্য নয়। ইজরায়েল হামাসের ভূগর্ভস্থ ৩০০ মাইল টানেল নষ্ট করতে সমুদ্রের জল ঢোকানোর যে পরিকল্পনা করেছে, তাতে অবশিষ্ট যা কিছু জল ছিল, তাও শেষ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে— এমন সতর্কবার্তা দিচ্ছে খোদ জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি (UNEP)। একইসঙ্গে, প্রতিদিন ৩.৫ মিলিয়ন কিউবিক ফিট অপরিশোধিত পয়ঃপ্রণালীর জল ও কঠিন বর্জ্য ভূমধ্যসাগরে গিয়ে মিশছে—গাজার ছিদ্রযুক্ত মাটি এর গতিপ্রবাহ আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।

জাতিসংঘের হিসেব অনুযায়ী, গাজায় জমা পড়েছে ৪০ মিলিয়ন টন ধ্বংসাবশেষ— এর মধ্যে রয়েছে রেচন পদার্থ, অ্যাসবেস্টস, বিপজ্জনক রাসায়নিক, না-ফাটা বোমা। বর্জ্যব্যবস্থার ধ্বসের ফলে এসব এক মরণচক্রে পরিণত হয়েছে। খোলা বাতাসে জ্বালিয়ে ফেলা বর্জ্য থেকে তৈরি হচ্ছে ব্ল্যাক কার্বন, যা উড়ে যাচ্ছে জনবহুল অঞ্চলের আকাশে।

জীবনদায়ী ওয়াদি গাজার কথা হচ্ছিল। হেরন, ফ্লেমিঙ্গো, র‍্যাপ্টর এবং জাতীয় পাখি প্যালেস্টাইন সানবার্ড-সহ বহু পরিযায়ী পাখির প্রিয় আশ্রয়স্থল এই নদীকে ২০০০ সালে প্যালেস্তাইন সরকার অঞ্চলটির একমাত্র প্রাকৃতিক রিজার্ভ ঘোষণা করেছিল। ২০২২ সালে রাষ্ট্রসংঘের সহায়তায় ৫০ মিলিয়ন ডলারের একটি প্রকল্পে ওয়াদি গাজাকে বর্জ্যমুক্ত করার কাজ শুরু হলেও, যুদ্ধ এসে তা থামিয়ে দেয়। বর্তমানে এটি এক বর্জ্যের স্তূপমাত্র।

ওয়াদি গাজা নদী ও বিষাক্ত বর্জ্য

ওয়াদি গাজার পাশাপাশি ইজিপ্ট-সংলগ্ন সীমান্তবর্তী আল-মাওয়াসি অঞ্চলটিও ছিল আরেকটি জীববৈচিত্র্যের আশ্রয়স্থল— যেখানে ছিল ১৪টি স্তন্যপায়ী, ২০টি সরীসৃপ এবং সানবার্ড-সহ ১৩৫টি পাখির প্রজাতি। যুদ্ধের সময় হামাস যোদ্ধাদের খোঁজে এই অঞ্চলে চালানো ইজরায়েলি বোমাবর্ষণে অঞ্চলটি প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। বনভূমি, বৃক্ষ— সব শেষ।

 

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বের ঘন বনভূমি ২০১৬ সালে ছিল ৮.৫৩ হেক্টর, যা ২০১৮-তে কমে দাঁড়ায় ৪.৪৯ হেক্টরে। একই সময়সীমায় ওই অঞ্চলে রোহিঙ্গাদের বসতি ২৭১ হেক্টর থেকে বেড়ে হয় ২,৬৭৯ হেক্টর। খুব স্বাভাবিক, বেঁচে থাকার ন্যূনতম শর্তগুলো না পেলে বৃক্ষ, পরিবেশচিন্তা তখন তলানিতে পৌঁছয়। রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে যেমন, গোটা বিশ্বের পরিবেশধ্বংসের অন্যতম একটি কারণ এটিই।

লাতিন আমেরিকার কলম্বিয়ার প্রসঙ্গ আসতে পারে। টানা পাঁচ দশকের গৃহযুদ্ধ শেষে ২০১৬-র নভেম্বরে কলম্বিয়া সরকারের সঙ্গে শান্তিচুক্তিতে সই করে বিদ্রোহী রেভলিউশনারি আর্মড ফোর্সেস অফ কলম্বিয়া বা এফএআরসি। কিন্তু সমস্যা মেটেনি। চুক্তির বিরোধী একাধিক প্রাক্তন এফএআরসি সদস্য, ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মির গেরিলা দল, ব্ল্যাক ঈগেলের মতো ড্রাগ কার্টেল এবং বিভিন্ন প্যারামিলিটারি গোষ্ঠীর নেতৃত্বে চলছে অবাধ ক্যাটল র‍্যাঞ্চিং, চোরাচালান, অবৈধ বৃক্ষচ্ছেদন, সোনার খনি দখল, জমি দখল ও কোকেন চক্র। শেষ হচ্ছে বন, পরিবেশ, মানুষ। এফএআরসি থেকে বেরিয়ে এসে সমাজের পক্ষে যাঁরা কাজ করতে চাইছেন, তাঁরা এক অসম্ভব অনিশ্চয়তার দড়ির উপর দিয়ে হাঁটছেন। দেশের পরিবেশ-নজরদারি সংস্থা ‘কলম্বিয়ান ইনস্টিটিউট অফ স্টাডিজ ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড পিস’ বা ‘ইন্ডেপাজ’-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৬-র পর শান্তিচুক্তিতে সই করা ৩৮৫ জন প্রাক্তন এফএআরসি সদস্য খুন হয়েছেন, যাঁদের মধ্যে ১১ জন মহিলা।

অথবা কঙ্গো-রুয়ান্ডা। কঙ্গোর বৃক্ষচ্ছেদনের দিকে তাকানো যাক। ‘গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচ’-এর হিসেব বলছে, ২০০২ থেকে ২০২২-এর মধ্যে ৬.৩৩ মিলিয়ন হেক্টর হিউমিড প্রাইমারি ফরেস্ট ধ্বংস হয়েছে, যা এই সময়সীমায় মোট ১৮.৪ মিলিয়ন হেক্টর ট্রি-কভার হ্রাসের ৩৫ শতাংশ। ১৯৯৪-র রুয়ান্ডা গণহত্যার পর কঙ্গোর গোরিলা-খ্যাত ভিরুঙ্গা ন্যাশনাল পার্ক উদ্বাস্তুদের চাপ পড়ে। সেইসঙ্গে গোরিলা ও অন্যান্য বন্যপ্রাণী হত্যাকাণ্ড এবং রেঞ্জার-পোচার দ্বন্দ্বও শুরু হয়। মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০১৭ থেকে ২০১৮-র মধ্যে ভিরুঙ্গায় বৃক্ষচ্ছেদন প্রায় তিনগুণ বেড়েছিল, যা ২০১৯ ও ২০২০-তে সাময়িকভাবে স্থিতিশীল হলেও ২০২১-এ আবার আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যায়। দারিদ্র্য, চারকোল তৈরির জন্য কাঠ সংগ্রহ, গাছ কাটার প্রলোভন, ও স্থানীয়দের ক্ষুধা থেকে পশুহত্যা পরিবেশ ধ্বংসের চক্রকে চালিয়ে যাচ্ছে। ২০১৭ সালে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক-এর একটি রিপোর্ট বলছে, ওই বছর রেবেল গ্রুপগুলোর মোট আয় ১৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা এসেছে অবৈধ গাছ কাটা ও পশুহত্যা থেকে।

কঙ্গোর ভিরুঙ্গা ন্যাশনাল পার্কে আর্মড কনফ্লিক্ট, উদ্বাস্তু সমস্যার ফলে বেড়ে যাচ্ছে বৃক্ষচ্ছেদন ও চারকোল পোড়ানোর ঘটনা

২০২৩-এর মে মাসে মাউন্ট নাইরাগঙ্গোর অগ্ন্যুৎপাত এবং এম-টোয়েন্টিথ্রি ও এফডিএলআর রেবেলদের সঙ্গে কঙ্গো সরকারের সংঘর্ষে বহু মানুষ ঘরছাড়া হয়ে ভিড় করেন উদ্বাস্তু শিবির ও নাইরাগঙ্গোর আশপাশে। ২০২৩-এর জুন থেকে নভেম্বরের মধ্যে গোটা ভিরুঙ্গায় ৯৬৪ হেক্টর গাছ কাটা হয়, যার মধ্যে নাইরাগঙ্গোর পাদদেশে ২০৯ হেক্টর বৃক্ষচ্ছেদন হয়েছে। জীবনধারণের জন্য বাধ্যতামূলক চারকোল সংগ্রহ, কাঠ ও পশুমাংসের জন্য নিরন্তর বননিধন— রাজনীতি তৈরি করছে বৃক্ষচ্ছেদন, পরিবেশ-হনন, গোরিলা শিকার ও রেঞ্জার হত্যার এক শৃঙ্খল। ২০১৮-তে বৃক্ষচ্ছেদন সরকারিভাবে নিষিদ্ধ হলেও চোরাগোপ্তা গাছকাটা এখনও অব্যাহত। ১৯৯৬ থেকে আজ পর্যন্ত পরিবেশ রক্ষায় কর্তব্যরত অন্তত ২০০ জন ফরেস্ট রেঞ্জারকে প্রাণ হারাতে হয়েছে।

 

যুদ্ধের খবরে সবকিছুই ক্রমশ প্রকাশ্য। পরিবেশধ্বংসের কথায়, হিসেবে তাই সেভাবে ছেদ নেই। হিসেব, সংখ্যা বাড়বে, শুধুই বাড়বে। ফরাসি উপন্যাস লে ফিউ-তে লেখক অঁরি বারবুস বলেছিলেন, “নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করা দুটো দল আসলে সমবেত আত্মহত্যা করা একটা বড় দল।” রব নিক্সনের সেমিনাল বই স্লো ভায়োলেন্স অ্যান্ড দ্য এনভায়রনমেন্টালিজম অফ দ্য পুওর যুদ্ধকে মহিমান্বিত করে ‘প্রেসিশন ওয়ারফেয়ার’, ‘মিরাকল ড্রোন’, ‘স্মার্ট ওয়ার’ বা উপসাগরীয় যুদ্ধ থেকে ক্রমশ জনপ্রিয় হওয়া ‘ডিপ্লেটেড ইউরেনিয়াম’ ইত্যাদি গালভরা শব্দবন্ধ— আসলে স্রেফ ইউফেমিজমের আড়ালে বীভৎসতাকে বৈধ করার বিশ্বজনীন প্রক্রিয়ার ওপর প্রশ্ন তুলেছিল। যুদ্ধের পরিবেশগত দিকেও তেমনই কিছু প্রশ্ন জড়িত। তেজস্ক্রিয় অর্ধ-জীবন বেশি হলেও ডিপ্লেটেড ইউরেনিয়াম আসলে পরিবেশ এবং শরীরের যে দীর্ঘকালীন ক্ষতি করে, তার হিসেব কে দেবে? যে ক্লাস্টার বোমাগুলো না ফেটে দীর্ঘদিন মাটিতে পড়ে থেকে শেষমেশ ল্যান্ডমাইনে পরিণত হয়ে বিলম্বিত ফেটালিটি তৈরি করছে, তার হিসেব কোথায়? তথাকথিত পিনপয়েন্ট বম্বিংয়ের থেকে যে রাসায়নিক রেসিড্যু জমা হয়ে মাটি, জলাশয় হয়ে শেষমেশ খাদ্যশৃঙ্খলে মিশছে, তার রিপোর্ট কীভাবে হবে? যুদ্ধের বিষাক্ত রাসায়নিকে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ-মানুষীর সন্ততিদের জিনগত বদল এবং দীর্ঘকালীন ক্ষতির বিশদে ঢোকার ক্ষমতা কোন ‘প্রেসিশন ওয়ারফেয়ার’ দেবে? অধ্যাপক সৈয়দ বাঘেরির সেই কথাগুলোর রেশ ধরেই বলা যায়, শুধু গাজা নয়, প্রকৃতি ও পরিবেশ বিশ্বজুড়ে সমস্ত যুদ্ধেরই নীরব শিকার। সাইলেন্ট ভিক্টিম।

শেষটুকুতে স্লো ভায়োলেন্স থেকে রব নিক্সনের সেই সমস্ত ফোরকাস্টকে উদ্ধৃত করা যাক—

We need to find (as Rachel Carson did some fifty years ago) new ways to tell the slow-moving stories about the long dying; about last year’s cluster bombs that turn into next year’s killers, about depleted uranium that treats as its arbitrary enemy the child of a child as yet unborn.

 

তথ্যঋণ

  1. Cox, Janice & Zee, Jackson. How animals are harmed by armed conflicts and military activities. Conflict and Environmental Observatory. March 18, 2021.
  2. Crook, Jennifer. War in Kashmir and its effect on the environment. Mandala Projects. April 16, 1998.
  3. Daiyoub, Angham; Gelabart, Pele; Saura-Mas, Sandra & Vega-Garcia, Cristina. War and deforestation: using remote sensing and machine learning to identify the war-Induced deforestation in Syria 2010–2019. Land. July 28, 2023.
  4. Gaafar, Roba. The Environmental impact of Syria’s conflict: a preliminary survey of issues. Arab Reform Initiative. April 7, 2021.
  5. Harding, Luke & Mamo, Alessio. ‘We’ve lost some parts of nature for ever’: Ukraine war’s impact on environment – photo essay. The Guardian. Febrary 24, 2025.
  6. Hess, G D. The impact of a regional nuclear conflict between India and Pakistan: two views. Journal for Peace and Nuclear Disarmament. May 28, 2021.
  7. Hryhorczuk, Daniel; Levy, Barry S; Prodanchuk, Mykola; Kravchuk, Olaksandr; Bubalo, Nataliia, Hryhorczuk, Alex; Erickson, Timothy B. Illegal logging, encroachment & tourism threaten Tosamaidan. Kashmir Observer. November 18, 2024.
  8. McKeough, Kate. What was the impact of trees in the Vietnam War. Issuu. April 30, 2021.
  9. Medina, Miguel Angel. How does war affect nature? Syria has lost 20% of its forests in 10 years. El Pais. March 25, 2024.
  10. Nixon, Rob. Slow violence and the environmentalism of the poor. Harvard University Press. 2013.
  11. Pearce, Fred. As war halts, the environmental devastation in Gaza runs deep. Yale Environment 36. February 6, 2025.
  12. Robock, Alan; Toon, Owen B, Bardeen, Charles G; Xia, Lili; Mckinzie, Matthew; Kristensen, Hans M; Peterson, R J; Harrison, Cheryl S; Lovenduski, Nicole S & Turco, Richard P. How an India-Pakistan nuclear war could start – and have global consequences. Bulletin of the Atomic Scientists. October 31, 2019.
  13. Salak, Kira. Places of darkness: Africa’s Mountain Gorillas and the war in Congo. National Geographic Adventure. 2004.
  14. Sidiq, Nusrat. Environment paying price of conflict in Kashmir. Anadolu Agecy. November 6, 2021.
  15. The environmental health impacts of Russia’s war on Ukraine. Journal of Occupational Medicine and Toxicology. January 5, 2024.
  16. Toon, Owen B; Bardeen, Charles G; Robock, Alan; Xia, Lili, Kristensen, Hans; Mckinzie, Matthew; Peterson, R J; Harrison, Cheryl S; Lovenduski, Nocole S & Turco, Richard P. Rapidly expanding nuclear arsenals in Pakistan and India portend regional and global catastrophe. Science Advances. October 2, 2024.
  17. Weir, Doug. How does war damage the environment? Conflict and Environmental Observatory. May 5, 2025.

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5088 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...