আগের যুদ্ধর স্মৃতির টুকরোটাকরা

অনিল আনন্দ

 



বরিষ্ঠ সাংবাদিক অনিল আনন্দ-এর এই লেখাটি গত ১০ মে গ্রেটার কাশ্মির পত্রিকায় ইংরেজিতে প্রকাশিত

 

 

 

সীমান্ত শহর জম্মুর— এ আমার নিজের শহরও বটে— রাত্রির আকাশ যখন পাকিস্তানি ড্রোন ও অন্যান্য ক্ষেপণাস্ত্রের আলোয় ঝলসে ঝলসে উঠছিল, ‘City of Temples’ নামে পরিচিত এই নগরীতে লক্ষ্যবস্তু খুঁজে নেওয়ার সে-সমস্ত অপচেষ্টা আশ্চর্যরকমভাবে আমার শৈশব ও কৈশোরে দেখা ১৯৬৫ এবং ১৯৭১ সালের যুদ্ধের মঞ্চকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল। যে-সব আধুনিক প্রযুক্তি প্রদর্শিত হচ্ছিল এবার, পার্থক্য শুধু সেখানেই।

১৯৬৫ সাল— পাকিস্তান যখন ভারতের উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়, তখন আমার বাবা নিযুক্ত ছিলেন পাহাড়ি শহর বাতোটে-তে, জম্মু থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরের একটি অপেক্ষাকৃত নিরাপদ জায়গায়। আমি তখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই, একটু সুযোগ মিলতেই, আমরা জম্মুতে চলে এলাম। সম্ভবত, বাবা চেয়েছিলেন আমরা সবাই যুদ্ধের চিহ্ন অন্তত কিছুটা দেখি এবং সেই সময় সমাজের একাংশ যে ত্রাণ ও সহায়তা কার্যে নিযুক্ত ছিল, তার অংশ হয়ে উঠি।

তিনি আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন একটি বোমাবর্ষণের জায়গায়— সে-সময়কার ছোট্ট জম্মু বিমানবন্দরের পাশেই সেনা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায়। এরপর আমাদের নিয়ে যান শ্রীনগরে (কাশ্মির), যা জম্মু থেকে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার দূরে। সেখানকার বাটামালু এলাকায়— যেটি আমার মামাদের বাড়ির কাছেই— পাকিস্তানি অনুপ্রবেশকারীদের খুঁজে বের করতে গিয়ে যেখানে একটি পাড়া পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।

বাবা আমাদের আরও কিছু যুদ্ধ-আক্রান্ত এলাকা ঘুরিয়ে দেখান— যেন আমরা যুদ্ধক্ষেত্রের অভিজ্ঞতা ও তার পরিণতি কাছ থেকে উপলব্ধি করতে পারি। পাকিস্তান তাদের ‘অপারেশন জিব্রাল্টার’-এর অংশ হিসেবে যে সমস্ত অনুপ্রবেশকারীদের ঢুকিয়ে দিয়েছিল, তাদের সম্পর্কে তথ্য দিয়ে ওই সময়ে স্থানীয় কাশ্মিরিরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।

ফিরে এলাম জম্মুতে। আমাদের প্রথম কাজ ছিল, সেই ১৯৬৫ সালে, ব্ল্যাকআউট এবং তার সঙ্গে সম্পর্কিত মহড়াগুলোর সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা। তারপর আত্মীয়স্বজন আর বন্ধুদের খোঁজ নেওয়া— কারণ তখনকার দিনে ফোনের ব্যবস্থা প্রায় ছিলই না। কিন্তু এটা সহজ কাজ ছিল না, কারণ যতবার আমরা বাইরে বেরোতাম, ততবারই সাইরেন বাজত— আকাশ থেকে বিমানহানার সতর্কবার্তা দিয়ে। সবচেয়ে বেশি সেই সময়কার ছোট্ট জম্মু শহরের সরু গলি আর বাজারের ভেতর দিয়ে মুবারক মান্ডি থেকে রঘুনাথ বাজার পর্যন্ত পৌঁছানো যেত মাত্র।

তবু অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা এই নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে শিখে ফেললাম— কীভাবে আকাশ থেকে বোমা পড়ার আশঙ্কার মধ্যে নিজেকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে রাখতে হয়, সে অভ্যাসও রপ্ত হয়ে গেল। এরপর শুরু হল হারকিউলীয় এক প্রয়াস— কোথায় কোথায় বোমা হামলায় ক্ষতি হয়েছে, সীমান্তে বা দেশের অন্য অংশে যুদ্ধ পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ, তা বোঝার চেষ্টা।

সংবাদ পাওয়ার একমাত্র ভরসা ছিল অল ইন্ডিয়া রেডিও— ‘রেডিও কাশ্মির, জম্মু’; সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদের আংশিক বিলুপ্তির আগ পর্যন্ত জম্মু ও কাশ্মিরে যা তখন এই নামেই পরিচিত ছিল। তবে যেহেতু খবরের বুলেটিন ছিল সীমিত, বেশিরভাগ সময়ে গুজবই ভর করত চারদিকে— casualty বা হতাহতের সংখ্যা অনেকটাই বাড়িয়ে বলা হত, অথবা ভারত বা পাকিস্তান কে কতটা এলাকা দখল করেছে তা নিয়ে ভুয়ো খবর ঘুরে বেড়াত।

এইসবের মধ্যেই, আমাদের বাড়ির বড়রা আমাদের কিছু সামাজিক কাজকর্মে যুক্ত হতে উৎসাহ দিলেন। তাই আমরা সব তুতো ভাইবোনেরা মিলে ঠিক করলাম— টাকা তুলে একটা তহবিল গড়া হবে। সম্ভবত তখন কন্যাপূজন উৎসব পড়েছিল (যদি স্মৃতি ভুল না করে), আর সেটিকে উপলক্ষ করেই আমরা চাঁদা তুলতে নেমে পড়লাম।

সেই টাকায় আমরা ফল, বিস্কুট ইত্যাদি কিনে স্থানীয় এসএমজিএস হাসপাতালে ভর্তি আহত সৈনিকদের মধ্যে বিতরণ করলাম— যাঁরা সেনা হাসপাতালে আর জায়গা না থাকায় সেখানে ভর্তি ছিলেন। সীমান্ত অঞ্চল থেকে সরিয়ে আনা বহু সাধারণ মানুষকে স্কুল-কলেজগুলিতে আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল— তাঁদের অনেকেও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তাঁদের মধ্যেও আমরা যা পেরেছি বিতরণ করেছি।

আজও স্মৃতিতে গেঁথে আছে সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্য— ছ-ফুটেরও বেশি লম্বা এক শিখ সেনা, যার সারা শরীরে বোমার ধাতব টুকরো বিঁধে ছিল, যন্ত্রণায় ছটফট করছিলেন। আমাদের মধ্যে একজন দ্রুত তাঁর শয্যার পাশে কিছু ফল রেখে এলে আমরা চুপচাপ সরে এলাম। তারপর আমরা এক ওয়ার্ড থেকে আরেক ওয়ার্ডে ঘুরে ঘুরে আহত সৈনিক ও সাধারণ মানুষের খোঁজখবর নিতে লাগলাম, তাঁদের হাতে তুলে দিলাম ফল আর বিস্কুট। আরও অনেক আহত মানুষ ছিলেন— কারও সারা শরীরে মোটা ব্যান্ডেজ, কেউ প্রচণ্ড যন্ত্রণায় চিৎকার করছেন। চারপাশের বাতাস সেইসব আর্তনাদে ভারী হয়ে ছিল।

 

১৯৭১ সালের যুদ্ধ এক ভিন্ন মাত্রা নিয়ে হাজির হয়েছিল। তখন আমি সদ্য কলেজে ভর্তি হয়েছি, একাদশ শ্রেণির ছাত্র। সেই সময় বাবার পোস্টিং ছিল দিল্লিতে, আর আমাকে থাকতে হত আমাদের পুরনো পৈতৃক বাড়িতে— ঠাকুমার দেখাশোনা করার দায়িত্ব ছিল আমার উপর। সঙ্গে সঙ্গে শহরের উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশে পিতৃকুল আর মাতৃকুল— দুই দিকের মধ্যে যাওয়া-আসা, খোঁজখবরও রাখতে হত।

এবার আর কেউ ভয়ে কাঁপছিল না। নিরাপদ স্থানে থাকার এবং ঘরের ভিতরে থাকার যে নির্দেশ ছিল, সেসব উপেক্ষা করেই মানুষ ছাদে উঠে বসত পাক বিমানবাহিনীর সাবারজেট-এর বোমা হামলা দেখতে, যেগুলো প্রায় ব্যতিক্রমহীনভাবে আইএফ মিগ দ্বারা আকাশ থেকে নামিয়ে আনা হত। এরপর যে দৃশ্যটি ঘটত, তা হল— লোকেরা তুমুল অভিবাদন করে প্রশংসা জানাত আইএফ-এর পাইলটদের বীরত্বের জন্য।

অনেকবার পাক বিমানবাহিনীর পাইলটরা ছাদে থাকা সাধারণ নাগরিকদের লক্ষ্য করে হামলা করেছিল, কিন্তু তাতে কখনওই মানুষ ভয় পেত না। এখানে বলা দরকার, সরকারি নিরাপত্তা নির্দেশিকা কিন্তু অবশ্যই মেনে চলা উচিত— একদম আক্ষরিকভাবে, হৃদয় দিয়ে— নিশ্চিত করা উচিত যেন আক্রমণকারীদের সহজ লক্ষ্য পাওয়ার সুযোগ না মেলে।

শহরটা ভরে উঠেছিল “পাকিস্তানকে চূর্ণ করে দাও” আর ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর প্রশংসায় অন্যান্য নানা স্লোগানে। দোকানগুলোতে আর শহরের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে সেসব স্লোগান সম্বলিত প্ল্যাকার্ড ঝুলছিল। আমরা, ছাত্ররা, আমাদের বুকের ওপর সেসব স্লোগান লেখা ব্যাজ পিন করে নিতাম।

এই যুদ্ধে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল আমাদের কলেজের অধ্যক্ষ বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ডঃ এসএম ইকবালের কলেজ খোলা রাখার সিদ্ধান্ত। ঐতিহাসিক ব্রিটিশ যুগের জিজিএম সায়েন্স কলেজ (যার আগে নাম ছিল প্রিন্স অব ওয়েলস কলেজ) হয়ে উঠেছিল সীমান্তের গ্রামগুলির ঘরছাড়া মানুষদের আশ্রয়স্থল। আমাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, বিভিন্নভাবে এসব মানুষের যত্ন নেওয়া এবং তাঁদের সাহায্য করা। মূলত, তা ছিল খাবার বিতরণ এবং চিকিৎসা সেবা দেওয়া, যা বিভিন্ন সরকারি এবং সামাজিক সংস্থা সরবরাহ করেছিল।

অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট গান বসানো হয়েছিল আমাদের কলেজের চারটি কোণায় এবং আমাদের পুরনো পাহাড়ি শহরটির কিছু উঁচু জায়গায়। এগুলির লক্ষ্য ছিল তাউই নদীর ওপর অবস্থিত একমাত্র সেতুটি রক্ষা করা, কারণ এই সেতুটিই জম্মু ও কাশ্মিরের সঙ্গে ভারতের অন্য অংশের একমাত্র সংযোগসূত্র। সেই বন্দুকগুলির গুলিচালনার শব্দের মধ্যেই আমরা প্রতিদিন রক্তদান শিবির আয়োজন করতাম।

হ্যাঁ, রক্তদান করার জন্য অনেক উৎসাহী ছাত্র ছিল, কিন্তু এরকমও কিছু ছাত্র ছিল যারা রক্ত দিতে চাইত না, আর তাদের এই মনোভাবের জন্য তাদের আমাদের অধ্যক্ষের রোষের মুখে পড়তে হত।

এক সকালে, যখন ছাত্রদের রক্তদান শিবিরে অংশ নিতে বলা হয়েছিল, আমরা দেখতে পেলাম ডঃ ইকবালকে, যিনি ক্লাসরুম থেকে আনা একটি ডেস্কের ওপর দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন। তিনি রেগে আগুন হয়ে ছিলেন, কারণ সেদিন খুব কম ছাত্রই রক্ত দিতে হাজির হয়েছিল। “যদি রক্ত দিতে না চাও, তাহলে এই ‘পাকিস্তানকে চূর্ণ করে দাও’ স্লোগান লেখা ব্যাজ পরা বন্ধ করো,” তিনি গর্জে উঠলেন। এর ফলস্বরূপ— পরের রক্তদান শিবিরটি বিশাল সফল হয়েছিল।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5134 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...