
সর্বজিৎ সরকার
আমি হেসে বলতাম, আপনি আর আমি কি আলাদা? ঠাট্টা করে বলতেন, অবশ্যই! তোদের গায়ে ইট, সিমেন্ট আর স্টোনচিপসের গন্ধ লেগে আছে। আমার গায়ে দ্যাখ, নদীর আঁশটে গন্ধ, মাটির সোঁদা গন্ধ, আর চারপাশে যত গাছপালা দেখছিস, তাদের প্রত্যেকের শ্বাসপ্রশ্বাসের হাওয়া-বাতাস আমার চামড়ায় লেগে আছে
শেষবার ফোন এসেছিল বোধহয় তিন বছর আগে। দীর্ঘদিন কথা না হওয়ার যে দূরত্ব তৈরি হয়, তাঁর প্রয়াণ সেই ব্যবধানকে এমন এক পথে দাঁড় করাল, যেখানে বন্ধ দরজাগুলোর নাম শুধু ‘স্মৃতি’। সেগুলো ফের খুলতে বেশ কিছুটা সময় লেগে গেল।
পীযূষ ভট্টাচার্যকে আমি যতটা না চিনতাম লেখক হিসেবে, তার থেকেও অনেক বেশি চিনতাম মানুষ হিসেবে। আন্তরিক, দিলখোলা, আদ্যন্ত সৎ, আড্ডাবাজ— এবং একইসঙ্গে, ‘নতুন করে ভাবব, নতুন ধারায় লিখব, তোদের কলকাতা থেকে এই এতদূর মফস্বল শহরে থাকি বলে আর এত বেশি বয়সে লিখতে এলাম বলে তোরা পাত্তা দিবি না, তো দ্যাখ, আমি কী লিখতে পারি’— এই অনমনীয় জেদ ধরে রাখা একজন মানুষ ছিলেন পীযূষদা।
ওঁর সঙ্গে আমার পরিচয় কিছুটা পারিবারিক, আর কিছুটা কলকাতা থেকে বহু দূরে সীমান্তবর্তী এক শহরে লেখকেরা কেমন জীবনযাপন করেন, কী নিয়ে ভাবেন, কী লেখেন— এইসব বিষয়ে আমার যে কৌতূহল বরাবর ছিল, সেই সূত্রেই।
প্রসঙ্গত বলি, বালুরঘাট— যেখানে পীযূষদা থাকতেন— সেই শহরেই আমার শ্বশুরবাড়ি। সালটা ১৯৮৯। মনে আছে, আমি ঘরে বসে থাকার ছেলে ছিলাম না, ফলে সেখানে প্রথমবার গিয়েই, একই বাড়িতে থাকা অভিজিৎ চক্রবর্তীকে ধরেছিলাম— এখানে কারা কারা ভাল লিখছেন, তাঁদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিন। অভিজিৎ তখন ‘অশোকবন’ নামে একটি ছোট পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। নিরীহ, নির্বিবাদী, ভদ্র অভিজিৎ খুব খুশি হয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন পীযূষদার কাছে।
পীযূষদার সেই আশুতোষ-মার্কা ঝোলা গোঁফ, ঢোলা পাজামা আর খদ্দরের পাঞ্জাবিতে— যে পরিধানে তাঁকে এত বছর ধরে দেখে এসেছি— সেদিনও তাঁকে ঠিক সেইরকমই দেখেছিলাম। আপাত ভারিক্কি গাম্ভীর্যের আড়ালে ঝকঝকে মেধাবী দুই চোখ, ঠোঁটের কোণে পরিহাসপ্রবণ হাসি, আর দু-হাত বাড়িয়ে দিয়ে আন্তরিক স্বাগত জানানোর সেই দৃশ্যটা আমি ভুলিনি।
প্রথম সম্ভাষণ— “আরে তুই কলকাতার লেখক, তার ওপরে আমাদের শহরের জামাই! তোর তো খাতিরই আলাদা হবে। আয়, আয়।”
আমার ভালো লেগেছিল প্রথম দর্শনেই।
বালুরঘাট শহরের বুক চিরে যে নদী বয়ে গেছে, তার নাম আত্রেয়ী। নদীর ধারে ছোট দোতলা একটি বাড়ি, সঙ্গে লাগানো বাগান। নদীর হাওয়ায় মাটির আর কিছু দূরের— একই বাংলাভাষী, অথচ অন্য আর-একটা দেশের মাটির গন্ধ ভেসে আসত। সেই বাড়িতেই পীযূষদা নিমেষে আপন করে নিয়েছিলেন।
কলকাতার লেখালেখির হালহকিকত, লেখকদের পারস্পরিক পলিটিকিং— এসবের কিছু কিছু খবর রাখতেন, কীভাবে জানি না। কিন্তু সে সব নিয়ে কথা শুরু হলেও, অনায়াসে চলে যেতেন বিশ্বসাহিত্যের আঙিনায়। তখন আমার বয়স আঠাশ, আর ওঁর চল্লিশের শেষ পর্ব। থাকেন মফস্বল শহরে, অথচ আগ্রহ আর ঔৎসুক্য পুরোটাই এ-দেশে ও বিদেশে কোথায় কী ভাল লেখা হচ্ছে, তা নিয়ে।
মনে আছে, সেই সময়েই ‘রহু চণ্ডালের হাড়’ উপন্যাসটি পুরস্কার পেয়েছিল। সে-প্রসঙ্গে কথায় কথায় এসে পড়েছিল, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুবাদের সূত্রে আমাদের কাছে সদ্য-আবিষ্কৃত এক নতুন সাহিত্যজগতের— লাতিন আমেরিকান সাহিত্যের কথা। আর তার অবধারিত ফলাফল, ম্যাজিক রিয়ালিজম বা জাদুবাস্তবতা নিয়ে আমাদের দৈনন্দিন চর্চা। পীযূষদার ভাষায়, “এই যে তোকে পাওয়া গেল… এসব নিয়ে যে একটু কথা বলব, তেমন লোকই তো এখানে পাই না! ভাগ্যিস এলি।”
আমি হতবাক! তখন আমার সামান্য পড়াশোনা— কিছু মার্কেজ, কিছু কার্পেন্তিয়ের, আর ফুয়েন্তেসের দু-একটি উপন্যাস। এই সামান্য নিয়ে জ্ঞান দেব, এমন স্পর্ধা আমার সেদিনও ছিল না, আজও নেই।
কিন্তু পীযূষদা ছাড়ার মানুষ নন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চাইতেন, আলোচনা করতেন সেইসব উপন্যাসের আখ্যাননির্মাণ, বাঁকবদল, আর সামাজিক-রাজনৈতিক পটভূমিকে ধরার প্রকল্পগুলি নিয়ে। তবে তাঁকে সবচেয়ে বেশি আলোড়িত হতে দেখতাম, যখন লাতিন আমেরিকান ম্যাজিক রিয়েলিজমে পুরাণের ব্যবহারের প্রসঙ্গ উঠত।
বলতেন, আসলে কী জানিস, প্রতিটি অঞ্চলের নিজস্ব মিথ, প্রবাদ, পুরাণ-কথামালা আছে। আমাদের লেখালেখিতে যদি সেসব নিয়ে আসতে পারি, তাহলে তোদের এই চালু সাহিত্যের বাজার— যেটা মূলত মধ্যবিত্ত সমাজটাকে ধরে— তার চেয়েও অনেক, অনেক বড় একটা পৃথিবীর কথা বলা যাবে। লেখার এই পরিসরটাই আমি ধরতে চাইছি আমার লেখায়। বুঝলি কিছু?
আমি হেসে বলতাম, ‘তোদের!’ কেন, আপনি আর আমি কি আলাদা?
আবার সেই মিটিমিটি হাসি। ঠাট্টা করে বলতেন, অবশ্যই! তোদের গায়ে ইট, সিমেন্ট আর স্টোনচিপসের গন্ধ লেগে আছে। আমার গায়ে দ্যাখ, নদীর আঁশটে গন্ধ, মাটির সোঁদা গন্ধ, আর চারপাশে যত গাছপালা দেখছিস, তাদের প্রত্যেকের শ্বাসপ্রশ্বাসের হাওয়া-বাতাস আমার চামড়ায় লেগে আছে।
আর আছে এখানকার মানুষজন। কত যে গল্প আছে তাদের! আর সে সব তোদের ওই চার দেওয়ালের মধ্যে গুমরে মরার গল্প নয়— তাদের সুখ, দুঃখ, হিংসা, প্রতিহিংসা, আশা-ভরসা, লড়াই আর প্রতিরোধ, সব হাসি আর কান্না— জ্যান্ত, জীবন্ত। তারা আছে, তাই করে— ব্যাপারটা এমন নয়। তারা করে বলেই আছে। আসল কথা এটাই। আর এই যে এত কিছু করা, তার মধ্যে দিয়েই তো গড়ে ওঠে তাদের মিথ। পুরনো মিথের গায়ে লেপ্টে লেপ্টে জন্ম নেয় নতুন মিথ, নতুন লোককথা। সব উপকথারই একটা লৌকিক প্রেক্ষাপট থাকে— এটা তো মানবি, না-কি?
প্রায় পঞ্চাশ বছর বয়সি এক লেখক নতুন করে ভাবতে শুরু করছেন নিজের লেখার গতি-প্রকৃতি নিয়ে— আমার আঠাশ বছর বয়সে সেটাই ছিল সবচেয়ে বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা।
এখানে একটা একান্ত ব্যক্তিগত কথা শেয়ার করতে ইচ্ছে করছে। পীযূষদা বলতেন, একটা কথা জানবি— মাটি যেমন তার নিজের গাছগাছালিকে গড়ে তোলে, তেমনই তার নিজের মানুষকেও বানিয়ে নিতে পারে। করেও তাই। এই ধর, তুই এই শহরের মেয়েকে বিয়ে করেছিস, তার মানে তোকে এখানকার মাটি, এখানকার নদী— এদেরকেও বুঝতে হবে।
এবার আমার মজা নেওয়ার পালা। বলেছিলাম, সে কেমন?
পীযূষদা বললেন, এই যে নদীটা দেখছিস, এই আত্রেয়ী— এমনিতে খুব শান্ত। তুই পাড়ে দাঁড়িয়ে ওর অতল দেখতে পাবি। কিন্তু যখন বন্যা হয়, গ্রামের পর গ্রাম ভাসিয়ে দিতে পারে। সে প্লাবনে কেউ পার পায় না। এখানকার মেয়েরাও তেমন। এমনিতে শান্ত। কিন্তু চোট লাগলে, আঘাত পেলে— এদের মতো প্রতিহিংসাপরায়ণ, এদের চেয়ে বেশি নির্মম কেউ হতে পারে না।
পরবর্তীকালে নিজের লেখালেখিতে পীযূষ ভট্টাচার্য তাঁর এই মাটির, তাঁর এইসব মানুষজনের উপকথাই তুলে এনেছেন একের পর এক লেখায়।
প্রচলিত বাংলা সাহিত্যের জগৎ তাঁকে তাঁর প্রাপ্য আসন দেবে কি না, সে বিচার সময়ই করবে।
কিন্তু সেই সম্ভাব্য নিখোঁজলিপি না-আসা অবধি, তাঁকে স্মরণে রাখার এই স্মারকলিপিটি আজ লিখে রাখলাম— নিজের দায়িত্বে, নিজের কর্তব্যে, আর তাঁর প্রতি শ্রদ্ধায়।