
শতানীক রায়
চলে যাওয়ার সপ্তাহখানেক আগে, হঠাৎ এক রাতে— ঠিক সাড়ে ১০টার পর— ফোন করে আমার খোঁজ করেন— “বলো।” আমি তখন বিশেষ কিছু বলতে পারিনি। তারপর আর ফোন করা হয়নি। তারও কিছুদিন পর থেকে তাঁকে ফোন করে পাওয়া যায়নি। উদ্বিগ্ন ছিলাম। পরে ফেসবুকে তাঁর অসুস্থতার খবর পেয়ে আবার একদিন ফোন করি। বউদি জানান, তিনি ভীষণ অসুস্থ— আইসিইউতে ভর্তি, লিভার ফেলিওর। তারপরই এল সেই খবর— চলে যাওয়ার। এখন শুধু কানে বাজে— “বলো।” তাঁর কুয়াশামাখা সেই আওয়াজ আর কোনওদিন ফোনে ভেসে আসবে না। তাঁর লেখা ‘কাকমারা জংশন’-এর শেষটার মতোই— “সব কিছুই অন্ধকারে ডুবে যায়।” মৃত্যুর পর, শুধু অন্ধকার
নিছকই আমি একটি লেখা লিখে উঠতে পারি না— বিশেষ করে যখন লেখার কারণ আমাকে উদ্বিগ্ন করে তোলে। উদ্বিগ্ন মনে শুধু ভাবনাচিন্তা আসে, লেখা আসে না। যেন একটি জংশনে দাঁড়িয়ে আমি ভাবছি মানুষের মৃত্যু নিয়ে। না কি শুধু মৃত্যু নিয়ে নয়? আমি বুঝতে না পেরে সৎকার না-হওয়া একটি মৃতদেহের মতো ঝুলে থাকি। ঝুলে থেকে কল্পনা করি, মৃত মানুষের আর কোনও ভাবনা থাকে না; সে আর ভাবনা জড়ানো গলায় চোরাবালির মধ্যে ডুবতে থাকার ভাষায় লিখে উটবে না কিছু। যেমন উদ্বিগ্ন চলনে জীবন চলে তালপাখায় চেপে। এ কোনও জাদুবাস্তবতা নয়, বিশ্বাস— যা মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। এমনটা ঘটবে না। তবু বারবার ভাবতে থাকা, রহস্যজড়ানো উদ্বিগ্ন ভিতরে চোরা চিন্তার ভাষা মেশানো ঘটমান বাস্তবের লিখিত ভাষ্য আর লেখা হবে না। মৃতের সে-সব লেখা হয় না আর।
তাই বলতে হয়— বড় কষ্টের এই পীযূষ ভট্টাচার্যের চলে যাওয়া। আর তাঁকে ডাকলে তিনি সাড়া দেবেন না। তাল, লয়, সুর— সব হারিয়ে গেছে। শুধু রয়ে গেছে অন্ধকার। তাঁরই স্মৃতিতে কিছু কথা ও তাঁর একটি ছোট আখ্যান নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করব।
চলে যাওয়ার সপ্তাহখানেক আগে, হঠাৎ এক রাতে— ঠিক সাড়ে ১০টার পর— ফোন করে আমার খোঁজ করেন— “বলো।” আমি তখন বিশেষ কিছু বলতে পারিনি। তারপর আর ফোন করা হয়নি। তারও কিছুদিন পর থেকে তাঁকে ফোন করে পাওয়া যায়নি। উদ্বিগ্ন ছিলাম। পরে ফেসবুকে তাঁর অসুস্থতার খবর পেয়ে আবার একদিন ফোন করি। বউদি জানান, তিনি ভীষণ অসুস্থ— আইসিইউতে ভর্তি, লিভার ফেলিওর। তারপরই এল সেই খবর— চলে যাওয়ার। এখন শুধু কানে বাজে— “বলো।” তাঁর কুয়াশামাখা সেই আওয়াজ আর কোনওদিন ফোনে ভেসে আসবে না।
তাঁর লেখা ‘কাকমারা জংশন’-এর শেষটার মতোই— “সব কিছুই অন্ধকারে ডুবে যায়।” মৃত্যুর পর, শুধু অন্ধকার।
তাঁর সঙ্গে আমার অনেক অনেক কথা হয়েছে— সাহিত্য নিয়ে, জীবনদর্শন নিয়ে। কিন্তু সেসব আমাদের ব্যক্তিগত। তাঁকে শ্রদ্ধা জানাব তাঁর আখ্যান ‘কাকমারা জংশন’-এর আলোচনার মধ্যে দিয়ে।
২০১৫ সালে প্রকাশিত একটি গল্প— কাকমারা জংশন। এটি আদতে আখ্যান। প্রচলিত গল্পের ছাঁচে তিনি কিছুই লেখেননি কোনওদিন, গরম ভাত গল্পটি ছাড়া। সেটাকে আমার প্রচলিত ধাঁচের গল্পই মনে হয়েছে।
প্রথমেই মনে আসে— এই গল্পের কথক কে? স্বয়ং লেখকই এই গল্পের কথক। তাঁরই দৃষ্টিতে আমরা দর্শন করি কাকমারা জংশন। কোনও উঁচুতলা থেকে যেমন হাইভোল্টেজ তারের এই জংশনকে দেখা হয়েছে, তেমনই দেখা হয়েছে সেই জংশনের তলা দিয়ে যেতে গিয়ে। গল্পের প্রেক্ষাপট প্রতিস্থাপনে এই দ্বৈত দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট।
এক. ওপরে থেকে দেখা: “ওই খুঁটির উপরে হাইটেনশন, তার নীচেই লো ভোল্টেজের ডিস্ট্রিবিউশন লাইন এবং তা কয়েক দিকে ছড়িয়ে গেছে।”
দুই. নীচ থেকে দেখা: “উপরে শুধু আকাশ। যেখানে কোনও কাকটাক নেই। দু-একটা ছোট পাখির নিঃসঙ্গ ওড়াউড়ির পর একসময় তারা কোথায় যে চলে যাচ্ছে জানি না।”
এই আখ্যান সম্পূর্ণভাবে লেখকের দৃষ্টিভঙ্গিতে নির্মিত। সেই মানুষটি কখনও জংশনের নীচ দিয়ে হাঁটছেন, কখনও বা উঁচুতলা থেকে দূরে দাঁড়িয়ে জংশনকে লক্ষ করছেন। এভাবেই এই আখ্যান গড়ে উঠেছে।
গভীরভাবে ভাবলে বোঝা যায়, এই কাকমারা জংশন-এর অস্তিত্ব ছিল না এই গল্পের আগে— এমনকি হাইটেনশন তারেরও অস্তিত্ব ছিল না। “জংশন বলতে এতদিন যে ধারণা ছিল তা রেলপথকে ঘিরেই,…”— এই বাক্যই প্রমাণ করে, এই প্রথম এক হাইটেনশন জংশনের জন্ম ঘটল। আর গল্প কিছুটা এগোতেই বোঝা যায় কেন নাম কাকমারা জংশন। “কিন্তু ইলেকট্রিক পোলেরও জংশন হয় এবং তার নামকরণ হয় ‘কাকমারা জংশন’ এই প্রথম দেখলাম।” মনে পড়ে যায়: “আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ…”。
একজন ভাবছেন, আর বলছেন— এই ভঙ্গির মধ্যে দিয়েই আখ্যান নির্মিত হয়েছে। লেখক সচেতনভাবে বিষয়টিকে দার্শনিকভাবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন, আর সেই কারণেই এমন একটি জংশনের কল্পনা করেছেন, যা বাস্তব হলেও আমি একে কাল্পনিক বলতে চাই। যেন এক যোগাযোগের সিঁড়ি এই জংশন— লেখকের চিন্তাস্রোতকে পাঠকের সঙ্গে জুড়ে দেয়।
আমরা এমন জংশন প্রতিনিয়ত অসংখ্যবার দেখি, কিন্তু সেগুলিকে দেখি খুবই গুরুত্বহীনভাবে। আমাদের সেই তাকানোর যেন কোনও তাৎপর্য নেই— এমন দৃষ্টিপাত। এমন দৃষ্টিপাত তখনই গুরুত্ব পায়, যখন সেই জংশন ঘিরে কিছু ঘটে যায়। যেন মৃত্যু একটি প্রস্থানচিহ্ন, যার ছাপ শরীর বহন করে থাকে।
আর দেখার এই সহজ অথচ জটিলতার ভেতর দিয়েই জীবনের নিহিত বাস্তব যেন মনের মধ্যে ঘটে চলে। গল্পের ন্যারেটিভে এটাই লক্ষণীয়— কোনও কিছু ঘটে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার সমান্তরালভাবে বয়ে চলে ভাবনার গতি, যা ঘটনার বাস্তবায়ন ঘটায় গল্পে। এই নতুন ধরনের গল্পরূপ পীযূষ ভট্টাচার্যের এই আখ্যানকে তাঁর অন্যান্য অনেক নন্দিত গল্পের তুলনায় অনেকটাই স্বতন্ত্র করে তোলে।
চলে আসি নামকরণের এমন এক বিচিত্রতায়। “কিন্তু ইলেকট্রিক পোলেরও জংশন হয় এবং তার নামকরণ হয় ‘কাকমারা জংশন’…”— ভাবতে গিয়ে এটিকে একধরনের অধিবাস্তব কল্পনা মনে হয়। যেন এমন একটি জংশনের অস্তিত্ব পৃথিবীতে থাকতে পারে না। অথচ সত্যিই এমন হাইটেনশন তারের জংশন হয়, এবং এই নামহীন জংশনগুলির প্রতিনিধিত্ব করছে এই ‘কাকমারা জংশন’। হয়তো এই জংশনে কাকের মৃত্যু অহরহ ঘটে বলেই নাম হয়েছে ‘কাকমারা’। এমনটাই অনুমান করতে হয়।
এমন নামহীন অস্তিত্বকে নাম দেওয়া অবশ্যই প্রশংসনীয়। কারণ, এইসব জংশনের গুরুত্ব অপরিসীম— তবু আমরা মাথা তুলে দেখি খুব কম, দেখলেও একটু থেমে ভাবি কি? ভাবি তখনই, যখন কাকের মৃত্যু ঘটে, আর অনেকগুলো কাকের কলতানে সে মৃত্যু প্রতিধ্বনিত হয়।
এইসব অবহেলিত, অদৃশ্য হয়ে থাকা অস্তিত্বের কথাই লেখক এখানে তুলে ধরেছেন। আখ্যানের ‘কাকমারা জংশন’ যেন সেইসবের প্রতিনিধিত্ব করে, এমন এক ভয়াবহ ক্ষমতার ইঙ্গিত বহন করে, যা তার অস্তিত্বের মধ্যে দিয়ে জানান দিচ্ছে আমাদের।
একটি কাকের মৃত্যুকে ঘিরেই এই গল্প— যেখানে কাকই একমাত্র চরিত্র। আর কেউ এখানে চরিত্র নয়। শুধু এক কথক আছেন, যিনি কাকমারা জংশন এবং আরও অনেক কিছু বলে চলেছেন, যেন এক স্মৃতির উদ্যাপন।
এই আখ্যানের একটি কাকের মৃত্যু সত্যিই অস্বস্তিকর। জীবিত কাক যেমন বিরক্তিকর, মৃত কাকও তেমনই। কোনও একটি কাকের মৃত্যু হলে কাকদের কা-কা রব বিরক্তিকর। অন্যদিকে, মৃত কাকের শরীর— যদি তা ঝুলে থাকে বা মাটিতে পড়ে থেঁতলে যায়— দুটোই বিরক্তিকর। অসচেতন পথচারীর পায়ে যদি তা লেগে যায়, তবে আবার স্নান করতে হয়।
এই জায়গাতেই একটা ভাবনার দোলাচল তৈরি হয়— আমি যদি কাকের বদলে সেখানে মানুষ বসাই, তাহলে কি এই অস্বস্তি আরও গভীর, আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে না? তাহলে কি লেখক সত্যিই কাক বলতে কাককেই বোঝাতে চেয়েছেন, না কি কাক এখানে মানুষের প্রতীক?
তারপর ভাবি, এই আখ্যানে যা কিছু ঘটছে— তার মানচিত্র আমাদের বর্তমান সময়ে কতটা প্রাসঙ্গিকতা বহন করে? না কি কেবল একটি আখ্যান হিসেবেই তার গুরুত্ব অপরিসীম? আখ্যানের সম্পূর্ণ মানচিত্র একটি চিন্তাপ্রক্রিয়ার মানচিত্রের মতো— যা ভার্টিকাল হতে পারে, বা হরাইজন্টাল। এখানে তা ভার্টিকাল। উদাহরণস্বরূপ:
কিন্তু কিছুতেই ইলেকট্রিক খুঁটিটাকে জংশন বলে ভাবতে পারি না। অথচ জংশন। ওই খুঁটির উপরে হাইটেনশন, তার নীচেই লো ভোল্টেজের ডিস্ট্রিবিউশন লাইন এবং তা কয়েক দিকে ছড়িয়ে গেছে। শহরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতার কেন্দ্র কালেক্টরেট আপিস ও থানার দিকে। আরও আছে, এই দুটিই প্রধান বলে উল্লেখ করলাম। হাইটেনশন লাইন ওখান থেকে বেরিয়ে নদীর দিকে ছুটেছে। নদী টপকাতে পারলেই গ্রামীণ শহর থেকে একেবারে গ্রামে পৌঁছে যাওয়া যেন।
নিছকই একটি আখ্যান লেখা হল। ‘কাকমারা জংশন’। তবে এটি শুধু একটি কাকের মৃত্যু কিংবা খানিকটা কৌতুক নয়। এর অভিপ্রায় অনেক গভীরে। সেই গভীরতায় একবার পৌঁছে গেলে বারবার ফিরে গিয়ে পুনরায় পড়তে ইচ্ছে করে। ফলে এই আখ্যান কেবল মিলনাত্মক না থেকে ক্রমশ বিয়োগাত্মক রূপ নেয়।
যদি কাকের মৃত্যু না ঘটত, তবে কাক এসে জংশনে বসত, আবার উড়ে যেত। উপরে আকাশ, পাখির ওড়া চোখে পড়ত উপরে তাকালে। কিন্তু “দু-একটা ছোটো পাখির নিঃসঙ্গ ওড়াউড়ির পর একসময় তারা কোথায় যে চলে যাচ্ছে জানি না”— এই পঙ্ক্তিতে আখ্যান নিছক দৃষ্টিপাত থেকে সরে এসে এক শূন্যতার অভিঘাতে পৌঁছায়। ছোট পাখি, আকাশ, নিঃসঙ্গ ওড়াউড়ি, আর কোথাও হারিয়ে যাওয়া— আখ্যানে মৃত্যুর বিরহের পাশাপাশি এক শূন্যতা আনে। মৃত্যুও নিঃসঙ্গ। তার পর কাকের দলের একযোগে কা-কা। তারপর সব উধাও।
জংশনের পাশে একটি থানাও রয়েছে। যেখানে কাকেদের কা-কা ইন্টারোগেশন ব্যাহত করে। মৃত কাকের শরীরের যেমন কোনও মীমাংসা হয় না— ঝুলে থাকে, পড়ে গেলে থেঁতলে যায়, তবুও ওভাবেই পড়ে থাকে— ঠিক তেমনই থানার আসামিরও ইন্টারোগেশন হয় না। অপরাধের মীমাংসা হয় না। সেও ঝুলে থাকে। চ্যাপটার ক্লোজড হয়ে যায়।
এই গল্প কেবল কাকদের গল্প হয়ে উঠতে পারত, কিন্তু হল না। হয়ে উঠল এক অমীমাংসিত অন্ধকারের গল্প— যেখানে মৃত কাক জংশনে ঝুলে থাকে কিংবা পিষ্ট হয় মাটিতে। আবার যাওয়া-আসা। মিলন-বিয়োগ। সময়-অসময়। নিঃসঙ্গতা। অপেক্ষা। আশঙ্কা। একটি ‘নগণ্য’ অস্তিত্বের মৃত্যু। যার দিকে আমরা তাকাই না যতক্ষণ না তার মৃত্যুর কারণে লোডশেডিং হয়।
কাককে এখানে মার্জিনে থাকা মানুষের প্রতীক হিসেবেই দেখতে পারি। শেষপর্যন্ত, যখন আর কিছুই করা যায় না, তখন অন্ধকার নামে।