ভোট তো একটা অধিকার— কিন্তু এর সঙ্গে অবস্থা পরিবর্তনের সম্পর্ক নেই

রহিম শেখ

 


দেশ বা রাজ্য কেমনভাবে চলে তার অতশত বুঝি না। তবে রোজগারটা বাড়লে বাড়িটা সারাতাম। কোনও সরকার এলেই অবস্থার বিরাট পরিবর্তন হবে মনে করি না। ভোটের আগে সবাই এসে পাশে বসে। কিন্তু পরে কেউ চেনে না। তবে আনন্দ করে সবাই মিলে ভোট দিতে যাই। ভোট তো একটা অধিকার— তাই না? কিন্তু এর সঙ্গে অবস্থা পরিবর্তনের সম্পর্ক নেই

 

আমার বাড়ি উত্তর ২৪ পরগণার গুমা। এখানে জন্মেছি। ধর্মে মুসলমান। বয়স ৩৮ বছর। আমার পেশা পুরনো খবরের কাগজ ও ভাঙা জিনিসপত্র বাড়ি বাড়ি ঘুরে কেনা আর সেগুলো রিসাইক্লিং সেন্টারে বিক্রি করা। বাবা মারা গেছেন। মা, আমি, আমার স্ত্রী ও এক ছেলে, এক মেয়ে নিয়ে পাঁচজনের সংসার। দাদা, দিদিও আছে। তাদের সংসার অন্যত্র। ওদের আর্থিক অবস্থা আমার চেয়ে ভাল। আমাদের সংসার আমার একার আয়ে চলে। স্ত্রী লকডাউনের আগে সেলাইফোঁড়াই, চুমকি, জরি বসানো এসব কাজ করে টুকটাক আয় করতেন। কিন্তু এখন আর তেমন কাজ পান না। আমার কোনও চাষ-জমি নেই। বসতভিটার সঙ্গে অল্প জমি আছে। বাড়ির দশা ভাল না। কিন্তু সারানোর মতো সঙ্গতি নেই। শুনি, বাড়ির জন্য সরকারি সাহায্য পাওয়া যায়। কিন্তু আমি পাইনি। তবে চেষ্টাচরিত্রও করিনি। বারোমাস কাজ থাকলেও রোজগার সবসময়ে সমান থাকে না। বিশেষ করে লকডাউনের পর রোজগার অনেক কমে গেছে। এখন নিয়মিত কাগজ কেনার লোক অনেক কমে গেছে। লকডাউনের সময়ে সবাই কাগজ রাখা বন্ধ করেছিল। এখন বেশিরভাগই ফোনে খবর পড়ে নেয়। আমার ফোন ছিল না। কিছুদিন হল একজন একটি পুরনো স্মার্টফোন দিয়েছেন। খেলা দেখতে ভালবাসি। আগে একটা টিভি ছিল, তাতে দেখতাম। ওটা খারাপ হয়ে যাওয়ার পর আর কিনতে পারিনি। এখন এই ফোনে দেখি। তবে সবসময় টাকা ভরাতে পারি না। মাসে ৬০০০-৭০০০ টাকা মতো কমবেশি রোজগার আমার।

আমার শরীর-স্বাস্থ্য তেমন ভাল না। তাই ভারী কাজ করতে পারি না। গ্রামের অনেকেই বাইরে জোগাড়ের কাজ করতে যায়। কিন্তু আমি যাইনি। একবার এক দলের সঙ্গে পঞ্জাবে গিয়েছিলাম। খুব ভাল লেগেছিল।

আমার বাড়িতে রান্নার গ্যাস আছে। সবার মতো একই দামে সিলিন্ডার নিতে হয়। শুধু বিনা খরচায় লাইন পেয়েছিলাম। আধার কার্ড আছে, রেশন কার্ডও আছে। ডিজিটাল। তবে রেশন যা পাই আরেকটু বাড়লে ভাল হত। অন্যান্য জিনিসপত্রের দাম যা বেড়েছে তাতে সংসার চালানো কষ্টকর। আমার স্ত্রী লক্ষ্মীর ভাণ্ডারে টাকা পান। খানিকটা সুবিধা হয়। জনধন ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নেই। সাধারণ অ্যাকাউন্ট একটা আছে।

পড়াশোনা খুব একটা করিনি আমি। বাংলা মোটামুটি পড়তে জানি। ইংরেজি একেবারেই জানি না। কাজেই আমার উন্নতি কেমন করে হবে!

 

পড়ুন, ইলেকশন এক্সপ্রেস ২০২৪

 

আমার মেয়ের বয়স ১৫। ক্লাস নাইনে পড়ে। তিন জায়গায় টিউশন পড়ে। ভাল টাকা লাগে। শরীর খারাপ হলে বা রোজগার কম হলে মাঝেমধ্যেই টাকা ধার করতে হয়। তবে আত্মীয়দের কাছ থেকেই ধার করি। সুদে টাকা ধার করি না। আর আমার যা পেশা কেউ দেবেও না। আমার ছেলের বয়স ১৯। মাধ্যমিক পাশ করেছিল। কিন্তু লকডাউনের পর আর পড়াতে পারিনি। ও এখন এক জায়গায় মার্বেল বসানোর কাজ শেখে। পয়সা পায় না। তবে কিছুদিনের মধ্যে কাজ শিখে গেলে রোজগার করতে পারবে নিশ্চয়ই। মেয়েকে পড়াতে চেষ্টা করব। মেয়েদের জন্য তো দিনকাল ভাল না। কন্যাশ্রীর টাকা দিয়ে অনেকে বিয়ে দেয়। ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনও বড় পরিকল্পনা করি না। কারণ আমার পক্ষে সেটা সম্ভব নয়। আমার রোজগার বাড়ার সম্ভাবনা নেই তেমন। আর লকডাউনের ফলে যে ক্ষতি হয়েছে তা পূরণ করে ওঠা দুঃসাধ্য। পাঁচটা পেট চালানো, আর মেয়ের পড়াশোনা চালানো— দুটোই বেশ কঠিন ব্যাপার।

চিকিৎসা চলে যায় কোনওমতে। এখনও অব্দি বিরাট কোনও খরচ হয়নি। তবে মায়ের বয়স বাড়ছে। অনেকগুলো ভাইবোনের মধ্যে আমি সবচেয়ে ছোট। তবে মায়ের জন্য সবাই করবে।

খবর শুনি, তবে খেলা দেখতেই বেশি ভাল লাগে। দেশ বা রাজ্য কেমনভাবে চলে তার অতশত বুঝি না। তবে রোজগারটা বাড়লে বাড়িটা সারাতাম। কোনও সরকার এলেই অবস্থার বিরাট পরিবর্তন হবে মনে করি না। ভোটের আগে সবাই এসে পাশে বসে। কিন্তু পরে কেউ চেনে না। তবে আনন্দ করে সবাই মিলে ভোট দিতে যাই। ভোট তো একটা অধিকার— তাই না? কিন্তু এর সঙ্গে অবস্থা পরিবর্তনের সম্পর্ক নেই।

আমাদের গ্রামে হিন্দু বেশি। বেশিরভাগেরই বাড়ি আগে বাংলাদেশে ছিল। আমাদের মধ্যে সদ্ভাব আছে। সবাই সবার বিয়েশাদি অনুষ্ঠানে যাই। ছোটবেলা থেকে একসঙ্গে আছি। বিভেদ কিছু বুঝি না। তাই মনে হয় এমন কোনও দল যদি ক্ষমতায় আসে যারা বিভেদ ছড়ায় তবে অসুবিধা হবে। তার বদলে এমন কোনও সরকার আসুক, যাদের কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে, যারা গরিব মানুষের জন্য কিছু সুব্যবস্থা করতে পারবে।

মন্দির-মসজিদ নিয়ে আমার মতো মানুষ কী করবে? তবে নতুন মন্দিরটা শুনেছি দারুণ দেখতে। কখনও সুযোগ হলে দেখব। মন্দির-মসজিদ পাশাপাশি একই জমিতে হলে ভাল হত।

 


*সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত। চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের পক্ষ থেকে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অপর্ণা ঘোষ

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4760 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...