গোঁফ — ৪র্থ পর্ব

এস হরিশ

 

অনুবাদ: ব্রতীন্দ্র ভট্টাচার্য

পূর্ব-প্রসঙ্গ: রাভনন

দুটো লোক

লোহার সিন্দুক আর নাটকের দল নিয়ে এড়ুথাচন চলে যাওয়ার অনেকদিন পরেও তার নাটকের দুটি চরিত্র ওখানেই থেকে গেল। যে দুজন ওই চরিত্রদুটোতে অভিনয় করেছিল, পাকাপাকিভাবে ওই চরিত্রগুলোর সঙ্গে তারা জুড়ে গেল। এদের মধ্যে একজন মনের থেকে তদভিনীত চরিত্রটিকে মুছে ফেলতে চাইলেও তার গ্রামের লোকেরা কিছুতেই তা হতে দিল না। আর অন্যজনের পক্ষে সম্ভবই হল না চরিত্রের থেকে বেরিয়ে পূর্বজীবনে ফেরা।

এই দুজনের মধ্যে প্রথমজন হল স্যাঁকরা কৃষ্ণান থাট্টন। নাটকে তার ভূমিকা ছিল এক খল স্যাঁকরার। কেন যে এড়ুথাচন এই চরিত্রটা নাটকে ঢুকিয়েছিল তা ভগবানই জানেন। তার বাড়িরই একতলায় ছিল কৃষ্ণান থাট্টনের দোকান। সেখানে জ্বলন্ত তুষের আগুনের সামনে বসে থাট্টনকে কাজ করতে দেখে এড়ুথাচনের ওইরকম একটা চরিত্র নাটকে ঢোকাবার খ্যাপামিটা চাপে। অত পর্যায়পরম্পরায় ভেবেচিন্তে কাজ করা এড়ুথাচনের সৃজনপ্রক্রিয়ার মধ্যে পড়ত না। যখন যেমন মনে হত, তখন তেমন ভাবনাচিন্তাকে স্ক্রিপ্টে ঢুকিয়ে নেওয়াই ছিল তার অভ্যাস। সে রোজ যে কাজ করে, স্টেজে উঠেও সেই কাজই তাকে করতে হবে, এড়ুথাচনের এই আশ্বাস পেয়ে থাট্টন অভিনয় করতে রাজি হয়ে যায়। আলাদা করে অভিনয় বলতে— সকলে শুনতে পায় এমন জোরে জোরে অল্প কয়েকটা সংলাপ বলতে হবে, আর পান-টান খেয়ে মাঝেসাঝে খুবই নাটকীয়ভাবে পানের পিক ফেলতে হবে। ব্যস। অভিনয় করতে থাট্টনের অবশ্য খুব যে আপত্তি ছিল এমন নয়। বরং এড়ুথাচন, দামোদরন আর তাদের অভিনেতারা মিলে উপরের ঘরে নিজেদের যে আশ্চর্য জগৎ তৈরি করেছিল, তাকে খুব কাছ থেকে দেখার ইচ্ছা ছিল তার। কাছ থেকে দেখে তাতে আরও রং চড়িয়ে সকলের কাছে রসিয়ে রসিয়ে সেই কাহিনি শোনাবে, এমন একটা ইচ্ছাও থাট্টনের ছিল বৈকী।

নাটকের থাট্টন ছিল খল। গয়না গড়ার জন্য তাকে দেওয়া সোনার থেকে সে শুধু টুকরোটাকরা চুরিই করত না, সেটাকে আবার একজন স্যাকরার মৌলিক অধিকার বলে মনে করত। এদিকে ওভারসিয়র থাট্টনকে একটা গয়না দিয়েছে গলিয়ে নতুন গয়না বানিয়ে দেওয়ার জন্য, আবার সাবধানও করে দিয়েছে, যাতে একফোঁটা সোনাও তার থেকে সে মেরে না দেয়। থাট্টন বলে, এত পুরনো অভ্যেস সে কী করে বদলাবে! অসম্ভব! তাই থাট্টন যখন সোনা গলাতে বসে, বাজপাখির দৃষ্টি নিয়ে তার দিকে চেয়ে থাকে ওভারসিয়র। তাকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য একটা ফন্দি আঁটে থাট্টন।

—আমার দ্বারা হবে না গো, বাবু, সে ওভারসিয়রকে বলে। আপনি এভাবে ঠায় তাকিয়ে থাকলে আমি তো কিছুই চুরি করে উঠতে পারব না। আপনিই জিতলেন, বাবু। আমি বরং একটা পান খাই?
—খাও খাও, বিজয়ীর প্রশান্তি নিয়ে ওভারসিয়র বলে। তুমি ভেবেছিলে আমাকেও ঘোল খাইয়ে ছাড়বে!

পানের পাতায় সুপুরির কুচি আর একটুখানি জোলো চুন লাগিয়ে থাট্টন মুখে দেয়। ততক্ষণ চিবোতে থাকে, যতক্ষণ না মুখ পানের পিকে ভরে ওঠে। তারপর বাঁকনলটা নিয়ে পাত্রে গলন্ত সোনার থেকে বেরোনো আগুনে ফুঁ দেওয়ার নাম করে কিছুটা গলানো সোনা মুখে টেনে নেয়। ফুটন্ত তরল সোনা মুখগহ্বরে পৌঁছনোর আগেই থু থু করে সোনা আর পিকের মিশেলটা উঠোনে ফেলে দেয়। এদিকে কাজ সারা হল। ওভারসিয়রবাবু তার গয়না নিয়ে বাড়ি ফিরবেন। থাট্টন বলে যাওয়ার আগে জিনিসটা একটিবার ওজন করে নিতে। আরে! ওজন যেন একরত্তি কম! বাবু পাত্রের মধ্যে খোঁজেন, মেঝেতে খোঁজেন, উঠোনে— এমনকি থাট্টনের মুন্দুর ভাঁজেও খোঁজেন, কিন্তু ওই গায়েব হয়ে যাওয়া সোনা আর মেলে না।

—তোমায় মিছিমিছি সন্দেহ করেছিলাম হে, ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গীতে ওভারসিয়রবাবু থাট্টনকে বলেন। হয়তো কাজটা করতে গিয়েই কিছুটা সোনা খরচ হয়ে গেছে…
—কাজ করতে গিয়ে খ… আরে দেখুন দেখুন উঠোনে পড়ে আছে বাবু! থাট্টন বলে ওঠে। তার কণ্ঠে গর্বের ছোঁয়া।

কিন্তু এই গল্পের সবথেকে আশ্চর্য ঘটনাটা ঘটল আরও কিছু পরে। ওই নাটকে অভিনয় করার পর থেকে লোকে থাট্টনের কাছে সোনা নিয়ে আসা বন্ধ করে দিল। যারা নাটক দেখেছে, এমনকি যারা তার গল্প শুনেছে, একপ্রকার বিশ্বাস করতে শুরু করে দিল যে থাট্টন লোকটা আদতে ফেরেববাজ। কাজের জন্য ওর কাছে সোনা রাখলে তার থেকে চুরি ও করবেই। বছরের পর বছর যায়। এড়ুথাচনের নাটকের স্মৃতি লোকের মন থেকে মুছে যেতে থাকে। কিন্তু কৃষ্ণন থাট্টনের নাম অভ্যাসজনিত সোনাচুরির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জুড়ে যায়। তিন দশক পর মৃত্যুশয্যায় শুয়ে শুয়ে থাট্টন শুনতে পায় তাকে শেষ-দেখা দেখতে আসা মানুষজনের সামনে তার নাতি গল্প করছে: কী একটা মানুষ ছিলেন! ওই পান খেয়ে থুথু ফেলার ঘটনাটা তো আপনারা জানেনই…

ততদিনে অবশ্য থাট্টন নিজেই ওই কাহিনি বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, যদিও নাটকে অভিনয়ের স্মৃতি বলতে প্রায় কিছুই তখন অবশিষ্ট নেই। থাট্টনের মৃত্যুর বছর চল্লিশেক পরে তার দেখে না যাওয়া নাতিপুতিরা এট্টুমানুরে একটা গয়নার দোকান খোলে। আর ওদের প্রতিযোগী ব্যবসায়ীরা ভাঙচি দিতে খরিদ্দারদের শোনায় ওদের পূর্বপুরুষের গল্প, যে কী না ছিল এক নামজাদা সোনাচোর।

এদিকে, মালাবারের পুলিশের চরিত্র তাকে ছেড়ে গেলেও নাটকে তার সজ্জার অঙ্গ ওই গোঁফজোড়া বাবচন আর কামাতে চায় না। নাটকের শেষ অভিনয়ের দিন দুই-তিন পর সে কিছু একটা— বা যা-হোক-কিছু— খাবারের খোঁজে খোলা দিগন্ত অবধি বিস্তৃত ক্ষেতের ধার ধরে ধরে হাঁটার পুরনো অভ্যেসটা আবার চালু করল। বহু ঘুরেও, এই অন্তহীন পরিব্রাজনেও খাবার যোগ্য প্রায় কোনও কিছুই সে খুঁজে পেল না। গতরের মাংস তেতো হয়ে যাওয়া কাদার বুড়ো কাঁকড়াগুলোও বাবচনের ক্ষুধাক্লিষ্ট আবির্ভাব দেখে পথের ধারের স্যাঁতস্যাঁতে গর্তে গিয়ে লুকোয়। একটা ডাব, এমনকি অপক্ব একটা ডাবও নারকেলগাছ তাকে দেয় না। একটা জমিতে বেশ কিছু সাগুগাছ, যার শাখাগুলো অর্চনার ভঙ্গিতে আকাশের দিকে চেয়ে আছে। সেই জমির চারপাশে প্রায় সারারাত হামাগুড়ি দিয়েও বাবচনের কোনও লাভ হয় না। সব গেঁড়গুলো নিয়ে গেছে হয় ধেড়ে ইঁদুরে, নয়তো মানুষে। এমনকি নরম পাতাগুলোও তুলে খেয়ে নিয়েছে, ফুটিয়ে নিয়েছে তেতোভাব কাটানোর জন্য। শেষ অভিনয়ের পর এক পাত্র কাঞ্জির পর খাবার বলতে সে খেয়েছে একটুকরো রাঙা আলু। এক বাড়িতে গরুর জন্য ঘাস দিতে গিয়েছিল চেল্লা। তারা চেল্লাকে অনুমতি দেয় একটা মরা নারকেলগাছের গুঁড়ি খুঁড়ে তুলে নিয়ে বাড়িতে জ্বালানির কাজে ব্যবহারের জন্য। খোঁড়াখুঁড়ির সময়েই চেল্লা ওই রাঙা আলুটা পায়।

কারও ফেলে দেওয়া একটা জং-ধরা ছুরি পায় বাবচন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে সেটাকে ঘষেমেজে ধারালো করে। তার পর, উপুড় হয়ে শুয়ে খালের টলটলে জলের দিকে তাকায়। আয়নার মতো খালের জলে শান্ত বিকেলের ছায়ার মধ্যে থেকে বিশাল গোঁফওয়ালা একটা ভয়াবহ আগন্তুক তার দিকে চায়। জলে একটুও দাগ না কেটে এক ঝাঁক গোলাপি-লাল মাছ তার গোঁফের মধ্যে দিয়ে পথ করে চলে যায়। গর্ভবতী মাছ ভাবে ঘন গোঁফের আড়ালে প্রসবের কথা। যেন খালপাড়ের গাছপালার জটপাকানো শিকড়বাকড়। মুখে একটু জলের ঝাপটা দিয়ে গালে গজিয়ে ওঠা কয়েকটা এলোমেলো চুলকে কেটে ফেলে বাবচন, অবিন্যস্ত কয়েকটা চুল ছাঁটে। গোঁফজোড়াকে হাত দিয়ে ঠিকঠাক করে গুছিয়ে নেয়।

নারকেলের ছোবড়া বয়ে নিয়ে যাওয়া একটা পাঁচ টাকা ট্যাক্সের নৌকো বাবচনকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ে। তার থেকে নেমে আসে দুজন লোক। দুজনেরই একেবারে খাগড়াসরু চেহারা। কোমরে একইরকমের মুন্দু জড়ানো, আর মুখগুলোও একইভাবে রোদে পোড়া।

—সেই কাইপুড়া থেকে তোমায় খুঁজতে খুঁজতে আসছি, একজন বলে। আমরা আদতে থিরুভাপ্পুর লোক। এই ছোবড়া নেব বলেই প্রভাত্তোমে এসেছি।

নাটকের সেই গোঁফধারী পুলিশকে চিনে নিতে তাদের একটুও সমস্যা হয় না। আরপুরকা থেকে এর গল্প এরা শুনে আসছে। তারা শুনেছে, নাটকে আরও একটা বড় চরিত্র ছিল, কিন্তু তারা জানে, যে মাত্র দুটো দৃশ্যে হাজির হলেও নাটকের কাহিনির মূল চরিত্র ছিল এই গোঁফই। তবে ওই অভিনেতা যে ওখানকারই লোক, এটা অনেকেরই জানা ছিল না।

—নাটকটা আবার কবে হবে? যমজের একজন জানতে চায়।
—আর হবে না, গোঁফ বলে। বাক্সপ্যাঁটরা নিয়ে ওরা সবাই চলে গেছে।

ছোবড়ার গাদা থেকে সরু মুখের একটা পাত্র বের করে খানিকটা পুজো করার ভঙ্গিতে ওরা গোঁফের সামনে রাখে। বিস্মিত হয়ে দেখে, শুকনো নারকেলের টুকরো দিয়ে দেশি মদের পুরোটাই ‘পুলিশ’ খেয়ে নিল। তাড়ি থেকে তৈরি করা এরকম স্বচ্ছ তরল গোঁফ আগে কখনও দেখেনি। পাত্র শেষ করতে তার গাল আর গোঁফজোড়া শিউরে উঠল। চোখদুটো হয়ে উঠল লাল টকটকে। থিরুভারপ্পুর মানুষের নৌকোয় উঠে বিদায় জানাতে গোঁফ তাদের কাছে একটা শুকনো নারকেল চাইল।

—মালয়া যাওয়ার পথ জানা আছে? সে জানতে চায়।
—মালয়া? ওরকম কোনও জায়গার নামই শুনিনি তো, এ ওর দিকে তাকাতে তাকাতে বলে। আমরা যাচ্ছি থাড়াথাঙ্গদি।
—মালাবার যাওয়ার রাস্তা জানো কি?
—নাহ।

ওই খালপাড়কেই বাবচনের মনে হতে থাকে কাঠের তক্তা দিয়ে বানানো সেই নাটকের মঞ্চ, আর ওই লোকদুটো অন্ধকারে বসে থাকা দর্শক। নাটকের মতো একটা বাজখাঁই গর্জন করে বাবচন। পাগলের মতো নৌকা বাইতে বাইতে ওই দুজন অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। পথে নানান জায়গায় ছোবড়া ওঠানো-নামানোর সময়, তারপর বাড়িতে ফিরেও, তারা গোঁফের সঙ্গে মুলাকাতের গল্প করে। তাদের সব গল্পে একমাত্র গোঁফই অপরিবর্তিত থাকে। কখনও সে হয় সাত ফুট লম্বা শুকনো তালগাছের মতো কালো প্রেতাত্মা, আবার কখনও বিশালবপু এক কুস্তিগির।

তবে যে ঘটনাটা কাইপুড়া, নিন্দুর আর আশেপাশের জায়গাগুলোতে একেবারে আলোড়ন তুলল, তা ঘটতে তখনও কিছু বাকি। মালয়ার রাস্তা বাতলাতে পারবে, বা অন্ততপক্ষে এড়ুথাচনের কাছে পোঁছতে সাহায্য করতে পারবে, এই আশায় দামোদরনকে খুঁজতে সাঁতরে খাল পার হয়ে নান্নুত্তমপাড়াভু ক্ষেত আর চাথঙ্করির কাঠের সেতু পেরিয়ে পুবের দিকে হাঁটা লাগালো বাবচন। গরু-মোষের গাড়িচলা ওই পথে কেবলমাত্র বয়স্ক পুলয়নরাই হাঁটত, তাও মাঝেমধ্যে। ওই পথের দক্ষিণ ধরে ক্ষেত আর তারপরের জমিজিরেতের মধ্যে দিয়ে আড়াআড়ি গেলে দামোদরনের বাড়ি আধ মাইলের থেকেও কম। তবে ওই পথ ধরে গেলে যে দামোদরনের মায়ের দিকের এক দূরসম্পর্কের আত্মীয় কেসাভা পিল্লার বাড়ি, এ-কথা বাবচনের জানা ছিল না। শয়ে শয়ে একর জমির মালিক কেসাভা পিল্লা সেই মুহূর্তে নজভারা ধানের ক্ষেতের পাশে খালপাড়ে এথা কলার বাগানে আয়েশ করে চেয়ারে বসে সদ্য ধরা তাড়ি খাচ্ছিলেন। ওই অঞ্চলের কোনও নায়ার বা মাপ্পিলার ক্ষমতা ছিল না তাঁর সামনে মাথা তুলে দাঁড়ায়। অবাঞ্ছিত মানুষজন বা কথাবার্তার শাস্তি হিসাবে তাঁর কান-ফাটানো থাপ্পড় ছিল সর্বজনবিদিত। একটা দুধেল গাইয়ের দুধভর্তি বাঁট নিয়ে মন্তব্য করায় একবার এক চোভতিকে উনি এমন শিক্ষা দিয়েছিলেন যা ওই অঞ্চলে প্রায় কিংবদন্তি হয়ে গেছে। চোভতির মুন্দু একটানে ছিঁড়ে নিয়ে কেসাভা পিল্লা তাকে গরুটার পশ্চাদ্দেশ চাটতে বাধ্য করেন। এই ঘটনায় বিচলিত হয়ে ওই চোভতির আত্মীয়েরা তাঁকে শাসাতে আসে, কিন্তু তাঁর মুখোমুখি হয়ে অনবধানতাবশত তারা পিল্লার কাজকেই সমর্থন করে বসে। একটা দুধেল গাইকে যা মুখে আসে তা বলা যায় নাকি?

হাতের তাড়িটা শেষ করে কেসাভা পিল্লা তাঁর পারিষদকে নজাভরা ধানের একটা গল্প শোনাতে বসেন। কেসাভা গল্প করতেন রসিয়ে। সে গল্প শুনে কে কী বলল তা নিয়ে বড় একটা মাথা ঘামাতেন না।

—নজাভরা আসলে কিছু লোকের মতো, বুঝলে? পিল্লা বলেন। যখন বাড়ে তখন বাড়তেই থাকে, কিন্তু ফসল ধরার আগেই মাটিতে নুয়ে পড়ে। তারপর, যেখানে পড়েছে সেখান থেকে মাথাটা একটু তোলে একমুঠো শস্যদানা ফলানোর জন্য। কেন যে আর পাঁচটা ধানের মতো খাড়া হয়ে ঠিকমতো বাড়তে পারে না, সে আমি বলতে পারব না বাপু!

বাবুর কথায় সম্মতি জানাতে পারিষদ আর তাড়িওয়ালা হেসে ওঠার আগেই গাছের আচ্ছাদন ভেদ করে বজ্রের মতো চকিত গতিতে একটা ভয়ঙ্কর প্রাণী তাদের সামনে দিয়ে চলে যায়। পিল্লাবাবু ভাইকোম আর কোট্টায়ম গেছেন, কিন্ত এমন জাঁদরেল গোঁফযুক্ত মানুষ আগে কখনও দেখেননি। ছোটবেলায় একটা মন্দিরের উৎসবে তিনি এক পাগলা হাতিকে একদল মানুষ মারতে দেখেছিলেন। একে দেখে তারই কথা মনে পড়ে পিল্লার। সেই হাতিটাও ছিল এমন কুচকুচে কালো, তারও ছিল দু-পাশে ছড়িয়ে থাকা লম্বা লম্বা দাঁত। টকটকে লাল চোখ নিয়ে উদভ্রান্তের মতো ছুটোছুটি করছিল সে-ও। তিনি নিজেকে একটু সাব্যস্ত করে নেওয়ার আগেই পুরনো ভয়ের কথা স্মরণ করে কিছুটা শ্রদ্ধামিশ্রিত উদ্বেগ নিয়ে চেয়ার থেকে উঠে পড়তে বাধ্য হলেন। মনিবের এই আপাত-রূপান্তর দেখে সেই তাড়িওয়ালা আর পারিষদ বেশ ঘাবড়ে গেল।

দামোদরনের ছোট বোন ছিল ধানমাড়াইয়ের ঘরে। এই ঘর চারটে খুঁটির ওপর দাঁড়িয়ে। একটা ছাদ আছে, কিন্তু দেওয়াল নেই কোনও। সাগুর সঙ্গে কুচোনো নারকেল মাখা একটা গ্রাস সে তার তিন বছরের শিশুকে খাওয়ানোর চেষ্টা করছিল। টক টক, একদিনের পুরনো সাগুমাখা মুখে যেতেই বাচ্চাটা থু থু করে ফেলে দেয়।

—খাবার ফেলা বন্ধ কর। নইলে কিন্তু এক্ষুনি মক্কন আসবে আর ধরে নিয়ে যাবে, উঠোনের দিকে দেখিয়ে বাচ্চাকে বকা দেয় সে।

মায়ের আঙুল যেদিকে দেখাচ্ছিল, বাচ্চার চোখ সেদিকে যায়। এতদিন অবধি মক্কনের চেহারা সম্বন্ধে তার একটা ঝাপসা ধারণা ছিল। গাছগাছালির অন্ধকারে লুকিয়ে থাকে মক্কন। তাকে এমনিতে চোখে দেখা যায় না। কিন্তু তার চেহারা খুব ভয়ানক, আর অবাধ্য বাচ্চাদের একদমই পছন্দ করে না সে। কিন্তু এ যে সত্যি সত্যিই মক্কন! গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে হেঁটে হেঁটে এদিকেই আসছে! শিশুর রুদ্ধশ্বাস চিৎকারে মা মুখ তুলে চায়। ওই দৃশ্য দেখে কোনওক্রমে বাচ্চাকে কাঁখে করে সেও সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করতে করতে বাড়ির দিকে দৌড় লাগায়।

দামোদরন বাড়িতে নেই, এ কথা বুঝতে পেরে গোঁফও ওখানে আর কালক্ষয় করে না। উদ্দেশ্যহীনভাবে এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়ায় কিছুক্ষণ। একটু পরে সন্ধে নামল। একটা সদ্য নিড়ানো জমির ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সে ঠোক্কর খেল একটা শক্ত মাটির ঢেলায়, আর তার মাথাটা ঠুকে গেল তালগাছে। খরখরে গাছের গায়ে গোঁফটা গেল আটকে। যন্ত্রণা পেয়ে প্রচণ্ড ক্ষেপে গিয়ে গাছটার মজবুত গোড়া ধরে সে দিল একটা জোরদার ঝাঁকি। তারপর থেকে শুকোতে শুরু করে দিল গাছটা। দিনের পর দিন যায়, আর তার পাতা আর ফুলের বাহার নষ্ট হয়ে যেতে থাকে। পাতাগুলো খসেই পড়তে থাকে একে একে। শেষকালে গাছের ডগা একেবারে শুকিয়ে গেলে সেটা হয়ে গেল পাখিদের ডিম পাড়ার জায়গা।

জমির বেড়া ডিঙিয়ে, খালবিল ডিঙিয়ে বাবচন জংশনের পিছনের পতিত জমিটায় এসে পৌঁছয়। রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখে, সব শুনশান। শুধু এক বাতিওয়ালা হাঁটু গেড়ে রাস্তায় বসে বিড়ি টানছে। আলোর সলতেগুলো নিভুনিভু হয়ে গেলে নিভিয়ে দিয়ে তবে যাবে। এই লোকটাকে আগে দেখেনি বাবচন। কিন্তু এই লোকটা নাটকটা পর পর তিনদিনই দেখেছে। বাবচনকে দেখে সে সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়ায়। গোঁফের দিকে সোজাসুজি না তাকিয়ে চোখটা একটু নামায়।

—মালয়া যাওয়ার রাস্তা কোনটা? গোঁফ জিজ্ঞাসা করে।

বাতিওয়ালা কথা কইতে পারে না। তার মনে হয় সে বুঝি নিজের জিভটাই গিলে ফেলেছে। সে আস্তে আস্তে পিছু হটতে শুরু করে। লোকটাকে বারকয়েক একই প্রশ্ন করে। উত্তর না পেয়ে বিরক্ত হয়ে নারকেলগুঁড়ির ল্যাম্পপোস্টে একটা লাথি কষায় বাবচন। সেটা দু-টুকরো হয়ে যায়। রাতের অন্ধকারে বাবচন মিলিয়ে যায়।

ঠিক তখনই দুজন ছোকরামতন ছেলে সেই পথে আসে। তারা ফিরছে কুথাট্টুকুলম থেকে, একটা রাজনৈতিক জমায়েত সেরে। এদের মধ্যে একজন আবার নিন্দুর থেকে প্রথমবার কলেজে গেছে, কোট্টায়মে। ভাঙা ল্যাম্পপোস্ট দেখে তারা রেগে যায়।

—এভাবে চলতে পারে না। যে নাটকে পুলিসের অভিনয় করে, সেই নিজেই কী করে যা খুশি তাই করে বেড়ায়? সেই ছেলেটা বলে। বাতিওয়ালার হাত ধরে তাকে ওঠাতে ওঠাতে জিজ্ঞাসা করে, তোমায় গায়ে হাত তোলেনি তো?
—হাত তোলেনি মানে? আমার পা দুটো ধরে একেবারে শূন্যে তুলে দিয়েছিল, খুব একটা রং চড়িয়ে বাতিওয়ালা বলে। আমায় মাটিতে আছড়ে মাথা ফাটিয়ে দিতে চেয়েছিল। আপনাদের আসতে দেখে আমায় নামিয়ে রেখে চলে গেছে।

পরদিন সকালে পাঁচ-ছয়জন নায়ার যুবক পশ্চিমের দিকে যাত্রা করে। তাদের হাতে মুখ ছুঁচোলো করা সদ্য-কাটা গাছের ডাল। বেশিদূর তাদের যেতে হল না, যদিও রোদ্দুরে পুড়তে পুড়তে ক্ষেতের ভিতর দিয়ে এই যাত্রা ছিল তাদের এই ধরনের প্রথম অভিজ্ঞতা। ভাঙা ল্যাম্পপোস্ট নয়, তাদের গায়ে লেগেছিল কেসাভা পিল্লার অপমান।

—সত্যি কথা বলতে কী, আমি লোকটাকে ঠিকমত দেখতেই পাইনি, সক্কাল সক্কাল বাড়িতে আসা লোকজনকে কেসাভা পিল্লা বলেন। আর, আমি মোটেও ভয় পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়িনি। আমি দাঁড়িয়েছিলাম পাদব বলে। একটা পুলয়নের আমার সামনে এসে দাঁড়ানোর সাহস হবে না কি?

লোকেরা সব হেসে ওঠে। একটু আশ্বস্তও হয়, যদিও পিল্লা তাঁর অস্বস্তি ঢাকতে স্বাভাবিকের থেকে যে একটু বেশিই বড়বড় করছিলেন এটা তাদের চোখে ধরা পড়ে।

—তবুও, লোকটাকে তো একটা শিক্ষা দেওয়া দরকার। এই পুলয়নগুলো দিনে দিনে খুবই বেপরোয়া, বেহায়া হয়ে উঠছে। সেদিন ওদের একটা মেয়েছেলে কাটা ধানের ওপরেই মুততে বসে পড়েছিল। মাগীর পেটে একটা জোর লাথি কষিয়ে দিয়েছি।

ওদের রওনা করার সময় পিল্লা জানিয়ে দিতে ভোলেন না যে পথিমধ্যে একটি কুটিরে যথেষ্ট পরিমাণে তাড়ি মজুত করা আছে, এবং যে যতটা ইচ্ছে তার সদ্ব্যবহার করতে পারে। আরও বলে দিলেন, সন্ধেবেলায় ফিরতি পথে তারা যেন পিল্লার সঙ্গে দেখা করে যেতে না ভোলে।

যাওয়ার পথে পিল্লার নির্দেশমতো যথেচ্ছ তাড়ি সেবন করে যুবকেরা গোঁফকে পাকড়াও করার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। চলার পথে যাকে যাকে সামনে পায়, মারতে মারতে আধমরা করে রেখে চলে যায়। ক্ষেতে কর্মরত পুলয়নরা এদের রণমূর্তি দেখে কোনওক্রমে পালাবার চেষ্টা করলেও এরা তাদের তাড়া করে। যাদের ধরতে পায়, লাঠির বাড়ি মারতে মারতে পেছনের ছাল তুলে নেয়। একজন অল্পবয়সি পুলয়ন মহিলাকে ধরে তার কাপড়চোপড় ছিঁড়ে তাকে সামনে সামনে গরুর মতো চলতে বাধ্য করে। মহিলার পাছায়, জাঙে ততক্ষণ লাঠির বাড়ি মারে যতক্ষণ না চামড়া ফেটে রক্ত বেরিয়ে পড়ে। তারপর এক লাথিতে তাকে জল জমে থাকা একটা গর্তে ফেলে দিয়ে তারা চলে যায়।

পাভিয়নের কুঁড়েতে তারা যখন পৌঁছয়, সেখানে কেউ তখন ছিল না। তারা ঘরের মাটি খুঁড়ে সব ছত্রাখান করে কুঁড়েটা প্রায় ধূলিসাৎ করে ফেলে। চলে যাওয়ার আগে নারকেলগাছের কচি ফল ধরা শাখাগুলোকে কেটে ফেলে। গাছের গায়ে বেঁধে রাখা তাড়ির কলসি ভেঙে চুরমার করে দেয়।

সন্ধে নামলে তারা আবার পুবের দিকে রওনা দেয়। যাওয়ার পথে কয়েকটা নারকেলগাছ লাগানো একটা বাঁধে থামে। কিছুদিন আগেই এই বাঁধে নতুন মাটি লাগিয়ে জোর বাড়ানো হয়েছে। ওই নতুন মাটি যেখানে একটু শুকিয়েছে, সেখানে গোল হয়ে বসে সকলে। সারাদিনের কর্মকাণ্ডের হিসেবনিকেশ করে। অন্ধকারেও তাদের চোখমুখ সমাজ ও সম্প্রদায়ের সেবার উদ্দেশ্যে সারাদিনের বীরত্ব প্রদর্শনের আভায় উজ্জ্বল। এই কৃতিত্বের কথা যে দীর্ঘদিন ধরে সকলে, বিশেষ করে তাদের উত্তরপুরুষেরা মনে রাখবে, উদযাপন করবে— তাদের কথায় এই বিশ্বাস ধ্বনিত হতে থাকে। গভীর অনুধ্যানের সঙ্গে তারা আলোচনা চালিয়ে যায়, যতক্ষণে না দুজন খালের জলে ঝাঁপ দেয় উত্তেজিত, গরম শরীরকে ঠান্ডা করার জন্য। ক্রমে আলোচনা হাস্যপরিহাসে বদলায়। রাগ কমে আসে, ঘাড় থেকে দায়িত্বের ভারী বোঝা নেমে মন শান্ত হয়। মাথা ঠান্ডা হলে সেখানেই, খালের ঠান্ডা বাতাসে, তারা একটু ঘুমিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি নেয়। জীবন সুন্দর হয়ে ধরা দেয় তাদের কাছে। একে অপরকে তারা তাদের প্রকৃত ও কল্পিত যৌনবিজয়সমূহের গল্পগাছা করতে আরম্ভ করে।

—ওর কোমরের তলা থেকে… আহা! একেবারে ঈশ্বরের দান, এক জোয়ান বলে।

গাঁট্টাগোট্টা চেহারার সেই জোয়ানের কানে লাল দুল, অন্ধকারেও যেন জ্বলছে। সব ব্যাপারকে লঘু করে ব্যাখ্যা করা ওর স্বভাব। কিন্তু একদম ফালতুস্য ফালতু কথাও সে বলে একেবারে মন্দ্রস্বরে। ফলে, ওর কথা কোনও নতুন লোকে শুনলে বেশ গুরুত্ব দিয়েই শোনে। ও যে ওই পুলয়ন মহিলার কথা বলছে, যাকে ওরা মারধর করে, উলঙ্গ করে হাঁটিয়েছে, সেটা বুঝতে বাকিদের তাই কিছুটা সময় লাগে। বুঝতে পেরে প্রচণ্ড আমোদে সবাই হো হো করে হেসে ওঠে। আগে যারা জলে নামেনি, এবার তারাও খালে ঝাঁপ দিয়ে জলখেলায় লেগে পড়ে।

একজন জলেই পেচ্ছাপ করে দেয়।

—ওই হারামজাদাকে পেলাম না, এটাই যা দুঃখ, সে বলে। ওকে হাতে পেলে শুধু গোঁফ কেন, ওর শরীরের সবকটা চুল আমি টেনে টেনে ছিঁড়তাম। যন্তরটাও কেটে নিতাম শালার।

চাঁদের আলোয় সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে সে ভিজে মুন্দুর জল নিংড়োয়।

—চলো এবার যাওয়া যাক। এখানে সময় নষ্ট করে লাভ নেই।
—কেন? ভয় পেয়ে গেলে নাকি?
—ধুর! ভয়ের কী আছে। দেরি হয়ে যাচ্ছে। আর কিছু না।

নাসারন্ধ্র ফুলিয়ে গভীর নিঃশ্বাস টানে লোকটা।

—গন্ধটা পাচ্ছ? ফোটানো সাগুর গন্ধ? গোখরো হাই তুলছে।

জল থেকে উঠে, গা মুছে ওরা তাড়াতাড়ি করে ফেরার পথ ধরে। বাড়ি ফেরার তাড়ায় কারও মুখে কথা নেই।

দিনভর এত মারদাঙ্গার মধ্যেও ওরা গোঁফ নামটা একবারের জন্যও উচ্চারণ করেনি। স্বেচ্ছার্পিত পবিত্র কর্তব্য মনে করে পাভিয়নের বাড়ি আক্রমণ করেছে। তবে যে পথ তারা বেছেছে, বা তাদের তর্জন-গর্জন, এগুলোর থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল যে গোঁফের সঙ্গে মুখোমুখি হওয়ার বাসনা তাদের খুব একটা ছিল না। যদিও নিজেদের মধ্যে এ কথা স্বীকার করতে তারা, বলাই বাহুল্য, রাজি ছিল না। পাভিয়নের বাড়ি আক্রমণ করার আগে একটা ধানের ক্ষেতে দাঁড়িয়ে তারা যৎপরোনাস্তি হইহল্লা ও খিস্তিখেউড় করেছিল, ভাবখানা এমন, যে গোঁফ বাড়িতে থাকলে তাকে পালাবার একটা সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে। এক হতভাগ্য জেলে, বেচারা ওই পথে কোথাও যাচ্ছিল, তার থেকে মাছ ধরার জালটা কেড়ে নিয়ে ছুড়ে নারকেলগাছের মাথায় পাঠিয়ে দিয়েছিল।

—পেছনে কেউ আসছে মনে হচ্ছে, অন্ধকারে পথ চিনে চিনে ফিরতে থাকা দলের সবশেষের লোকটা বসে ওঠে।

প্রথমটায় কেউ বিশেষ আমল দেয়নি, কিন্তু লোকটা বারংবার একই কথা বলতে বলতে দলের সামনের দিকে চলে আসার চেষ্টা করতে সবার টনক নড়ল। ঘাসজমির একটা জায়গা একটু খালিমতন, গরুরা ওখানকার ঘাস খেয়ে গেছে, সেখানে দাঁড়িয়ে অন্ধকারের দিকে চেয়ে ওরা ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করে। কেউ পিছু নেয়নি দেখে নিশ্চিন্ত হয়। আবার তাড়াতাড়ি চলা শুরু করলেও মনে একটা ভাবনা থেকেই যায় ওদের। আবার ফিরে তাকায়। এবার মনে হয়, খালের ধারে ফুল-ধরা কেয়াঝোপের আড়ালে কী যেন একটা সরে গেল। মাটির ঢেলা তুলে সেদিকে ছুড়ে মারে। এবার একটা আওয়াজ হয়। মনে হয় ঢেলাটা কারও মোটা চামড়ায় লাগল। মনে মনে খুশি হলেও এবার তারা দৌড় লাগায়। তাদের বুকে এত ধুকপুক, যে হৃদপিণ্ড মনে হয় ওদের পাগুলোকে ছোটাবার ইঞ্জিন।

বেশিদূর যাওয়ার আগেই গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে একটা ভীষণ মুখ তাদের চোখ এড়ায় না। মুখটা হাতপাখার মত চওড়া, আর তার পুরোটাই প্রায় একটা মস্ত গোঁফে ঢাকা। বিশাল সেই গোঁফের চুলগুলো সোমত্থ শিমগাছের শুঁড়ের মতো দুপাশে ছড়ানো। দুদিকে হাত ছড়ালে যতটা হয়, তার থেকেও ছড়ানো বিন্নাঝোপের মত ঘোর কালো ওই গোঁফ। অদ্ভুত দানবিক সৌন্দর্য, অশিষ্ট কিন্তু সুঠাম।

তবে এটা নিশ্চয়ই ওদের মনের ভুল ছিল। সারাদিনের অনভ্যস্ত পরিশ্রমের ফলে ক্লান্ত মনের বানিয়ে নেওয়া একটা ভুল। কারণ, সেই মুহূর্তে, তাদের থেকে অন্তত এক ঘণ্টার হাঁটাপথের দূরত্বে, একটা বাঁধের ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছিল বাবচন। দেশি মদের নেশা, দীর্ঘ পথশ্রম আর অবিশ্রান্ত খিদেয় তার শরীরে কোনও শক্তি অবশিষ্ট ছিল না। এমনিতে অনেকদিন না খেয়ে থাকার অভ্যাস থাকলেও খিদে সহ্য করার ক্ষমতা অনেকটাই কমে গেছিল বাবচনের। পাভিয়ন, চেল্লা বা তার অন্যান্য ভাইবোনেদের মত অতটা আর ছিল না। এড়ুথাচন আর তার নাটকের দলের সঙ্গে থেকে, আর নিয়মিত খাওয়াদাওয়া করে তার শরীরের নিয়মকানুন বদলে গেছিল অনেকটাই। অন্য পুলয়নদের মতো তার পক্ষে খাবারের অভাবে বাতাস বা সূর্যের আলো থেকে শক্তি নেওয়ার ক্ষমতা আর ছিল না। এতদিন বাপ পাভিয়নের মতো মাঝেমধ্যে এক-আধ থালা কাঞ্জির খোঁজে থাকত সে-ও। কিন্তু এখন বাবচন এমন একটা জায়গায় পৌঁছনোর রাস্তাটা খুঁজছে, যেখানে গেলে যখন খুশি, যতটা খুশি কাঞ্জি পাবে বলে সে মনে মনে কল্পনা করে। সেই খোঁজ তার সমস্ত শক্তি শুষে নিয়েছে।

একথালা কাঞ্জি আর তার মধ্যিখানে নারকেলকোরা মাখানো একতাল সেদ্ধ রাঙা আলুর স্বপ্ন দেখতে দেখতে ঘুমোয় বাবচন। খুব শীঘ্রই তার ঘুম ভাঙবে। জীবনের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত তাকে নিতে হবে।

 

[আবার আগামী সংখ্যায়]

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4662 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. যত এগোচ্ছে এ উপন্যাস, মুগ্ধ হচ্ছি তত বেশি করে। অনুবাদ অনবদ্য। মূল বাংলায় এরকম ছত্রেছত্রে একটা করে নতুন ঝরোখা খুলে দেওয়া নির্মাণ বহুদিন পাঠ করিনি।
    ‘স্যাঁকরা’ শব্দটির ওই ঐশ্বরিক চন্দ্রবিন্দুটি বর্জন করলে বাংলাভাষা সম্ভবত উপকৃত হবে!

আপনার মতামত...