“ও আলোর পথযাত্রী, এ যে রাত্রি”

তিষ্য দাশগুপ্ত

 


যে সুশীল, শিক্ষিত, বিত্তবান সমাজ— যাঁরা এইভাবে কচলে দুমড়ে ছিঁড়ে মেরে কেটে রেখে দিতে পারেন না, তাঁদের মধ্যে মেয়েরা কি আদৌ নিরাপদ? একটি মেয়ে তার নিজের ঘরে, নিজের আত্মীয়পরিজন, বিশ্বস্ত পাড়া-প্রতিবেশীদের মধ্যে, স্কুলে-কলেজে কতটা নিরাপত্তা বোধ করে? "শিক্ষিত" সমাজ কি আদতেই "সুশীল"? প্রশ্নটা সহজ, কিন্তু উত্তরটা বোধহয় অতটাও সরল নয়

 

কল্পনা ১

“মার মার বেহেন*, তেরা মা চো দেঙ্গে।” আরে কী হল দাদা দিদিরা? সুশীল কানে হঠাৎ করে খুব ধাক্কা লাগল বুঝি? না, না, ঘটনা কিছুই না— অনলাইন গেম খেলতে খেলতে বাঙালি চাকুরিজীবী যুবকের কথোপকথন, বাকি খেলুড়েদের সঙ্গে, ছিমছাম ফ্ল্যাটে কানে হেডফোন গুঁজে।

 

কল্পনা ২

অভিজাত কো-এড স্কুলের সায়েন্স ল্যাব। স্কুলের ফিজ বেশ চড়া, অভিভাবকরা সবাই সুপ্রতিষ্ঠিত ও সুশিক্ষিত নিশ্চয়ই। একটি চোদ্দ-পনেরো বছর বয়সী মেয়ে বসে সায়েন্স প্রোজেক্ট বানাচ্ছে। কানে উড়ে এল তারই সহপাঠী ছেলেদের জটলা থেকে কিছু বাছা বাছা শব্দবন্ধ। বিষয়বস্তু, মেয়েটির সঙ্গে সবাই মিলে একে একে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের কাল্পনিক অভিজ্ঞতা। মেয়েটি এখন তেইশ, চাকুরিজীবী। একদঙ্গল ছেলের সঙ্গে একা ঘরে বসতে ভয় লাগে তার।

 

কল্পনা ৩

মা ও মেয়ের দুজনের সংসার। চাকুরিজীবী মায়ের অফিস থাকে রোজ। বাড়ির “নিশ্চিন্ত” ঘেরাটোপে জেঠু, কাকা, দাদা, পাড়ার উচ্চশিক্ষিত দাদু সকলের হাতের স্পর্শে ছোট থেকে বড় হয়েছে মেয়েটি। গা সওয়া হয়ে গেছে, আজকাল বাসে ট্রেনে মেট্রোয় অবাঞ্ছিত স্পর্শগুলোকে নিয়ম হিসেবেই মেনে নিয়েছে ও। আজ সে অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন, কিন্তু একলা মায়ের একলা মেয়ের প্রতিটি পদক্ষেপে সমাজের আতসকাচ আঁটা। প্রতি মুহূর্তে চলে তার চরিত্রের জীবন্ত ব্যবচ্ছেদ— দামি রঙিন স্কচের গেলাসে, প্রতিটি চুমুকে, অথবা ছাপোষা ঘরগেরস্থালির আপাত সাধারণ আলোচনায়। মেয়েটির তেল ফুরোলে নুন ফুরোলে তার দায়িত্ব সমাজ নেয় না, কিন্তু সংবিধান অনুসারে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা প্রত্যেক নাগরিকের আছে।

 

কল্পনা ৪, ৫, ৬, ৭, ৮, ৯, ১০, ১১…….

“আজ শরীরটা খারাপ, প্লিজ আজ না…”
“শরীর খারাপ তো কি আছে, তুমি না আমার বিয়ে করা বউ, তোমার ভালমন্দ তোমার থেকে আমি ভাল বুঝি”…। অগত্যা…

“বাবা, মাকে মারছ কেন?”
“আমার পয়সায় খাচ্ছ, বড় হচ্ছ, পড়াশোনা করছ। তুমি কিন্তু কিচ্ছু দেখোনি।”

কল্পনার কি কোনও শেষ আছে? কল্পনা করতে তো ট্যাক্স লাগে না আর…

 

বাস্তব

আরজিকর হাসপাতালের চিকিৎসক ছাত্রীকে নৃশংসভাবে ধর্ষণ করে খুন। সরকারের তরফে কলেজের অধ্যক্ষকে আড়াল করার চেষ্টা, ক্রমাগত মিথ্যাচার ও কলকাতা পুলিশ কর্তৃক সংগঠিতভাবে প্রমাণ লোপাট। কলকাতা তথা গোটা রাজ্য, দেশ এমনকি সারা দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের চিত্র। সাধারণ মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।

 

প্রশ্ন

এই পৃথিবীর ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ক্ষমতা ও অহঙ্কার প্রদর্শনের প্রাচীনতম অস্ত্র হল ধর্ষণ। যে-কোনও যুদ্ধ হোক কিংবা ক্ষমতা দখলের অভিযান, বারংবার ভূলুণ্ঠিত হয়েছে নারীদের সম্মান— ক্ষমতার আস্ফালনের নির্লজ্জ প্রকাশ হিসেবে। দেশজুড়ে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনাগুলো একটু খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে অভিযুক্তরা মূলত সমাজের বিশেষ কোনও অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্তরে বসবাসকারী, এবং এই অপরাধগুলো মূলত তাদের নিষ্ফলা ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ। এই ঘটনাগুলো আগেও ঘটেছে, এবং ভবিষ্যতেও ঘটবে, কড়া আইন প্রণয়ন এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা প্রণয়ন করা অবশ্যই প্রয়োজন।

কিন্তু, যে সুশীল, শিক্ষিত, বিত্তবান সমাজ— যাঁরা এইভাবে কচলে দুমড়ে ছিঁড়ে মেরে কেটে রেখে দিতে পারেন না, তাঁদের মধ্যে মেয়েরা কি আদৌ নিরাপদ? একটি মেয়ে তার নিজের ঘরে, নিজের আত্মীয়পরিজন, বিশ্বস্ত পাড়া প্রতিবেশীদের মধ্যে, স্কুলে-কলেজে কতটা নিরাপত্তা বোধ করে? “শিক্ষিত” সমাজ কি আদতেই “সুশীল”? প্রশ্নটা সহজ, কিন্তু উত্তরটা বোধহয় অতটাও সরল নয়।

ভারতবর্ষের ন্যায়সংহিতার অনুচ্ছেদ ৬৩-র ব্যতিক্রম ২ অনুযায়ী, ন্যূনতম আঠেরো বছর বয়সী কোনও বিবাহিত মহিলার সঙ্গে তার স্বামীর শারীরিক সম্পর্ক ধর্ষণ বলে গণ্য হবে না, তাতে স্ত্রীর কনসেন্ট না থাকলেও। দেশের আইন মনে করে বিবাহিত পুরুষের স্ত্রী তার কেনা সম্পত্তি অর্থাৎ বিবাহিত নারীর কনসেন্ট বলে কোনও বস্তুর অস্তিত্বই থাকতে পারে না। আর শিক্ষিত ভারতীয় পুরুষদের কাছে কনসেন্টের ধারণা কতটা গুরুত্বহীন তা বোঝানোর জন্য নিচের পরিসংখ্যানগুলোই যথেষ্ট:

  • ২০১৫ সালের ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভের তথ্য অনুযায়ী ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী ৮৩ শতাংশ ভারতীয় মহিলা তাদের স্বামীদের দায়ী করেছেন গার্হস্থ্য যৌনহিংসার জন্য, এদের মধ্যে ৭ শতাংশ সরাসরি তাদের স্বামীদের অফেন্ডার হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
  • ২০১৭ সালে ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর রিসার্চ অন উইমেন ভারতবর্ষের সাতটি রাজ্যে ৯৫০০ মানুষের মধ্যে একটি সমীক্ষা চালায়। সমীক্ষা অনুযায়ী ১৭ শতাংশ মহিলা জানিয়েছেন তাঁরা গার্হস্থ্য যৌননির্যাতনের শিকার এবং ৩১ শতাংশ (প্রতি ৩ জনে ১ জন) পুরুষ স্বীকার করেছেন, তাঁরা কোনও-না-কোনও সময় সচেতনভাবে বা অবচেতনে, তাঁদের স্ত্রীদের সঙ্গে, ইচ্ছের বিরুদ্ধে বলপূর্বক যৌনসম্পর্ক স্থাপন করেছেন।

সুতরাং এ-কথা দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট, শিক্ষিত সুশীল সমাজের প্রতিভূ আমরা যতই মিছিলে হাঁটি না কেন রাত্রিবেলা ঘরে ফিরে স্ত্রী বা পার্টনারের অনুমতি নেওয়ার বিন্দুমাত্র প্রয়োজন বোধ করি না। ঘরোয়া আড্ডায় চেনা-অচেনা মহিলাদের সম্পর্কে খাপ পঞ্চায়েত বসাতেও খুব একটা বেশি সময় লাগে না।

আর কথায় কথায় অবজেক্টিফিকেশন, মিসোজিনিস্টিক মন্তব্য, সেক্সিস্ট যৌনগন্ধী জোক ইত্যাদি নিয়ে বেশি কথা না বাড়ানোই ভাল।

 

করণীয় কী?

ছোটবেলা থেকে বাবা-মা, শিশু পুত্র বা কন্যা দুজনকেই গুড টাচ ব্যাড টাচ শেখান। শিশুপুত্রকে বুঝতে দিন পিরিয়ড একটি স্বাভাবিক বায়োলজিকাল ঘটনা, কী অপরিসীম যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে তার মা, বোন, দিদিকে যেতে হয় প্রত্যেক মাসে— সেটা বুঝতে শেখান। “শরীর খারাপ হয়েছে”— এই জাতীয় বস্তাপচা শব্দবন্ধ থেকে বেরিয়ে আসতে শিখুন। “না” মানে “না”, তার কোনও ধরাবাধা সময় হয় না— এই বোধটা তৈরি হওয়া খুব প্রয়োজন, এবং তা একমাত্র সম্ভব পারস্পরিক সম্মানের সেতুটি মজবুত থাকলে। শিশুকন্যাকে বিবাহ নামক বস্তুটির সঙ্গে পরিচয় করানোর আগে প্রয়োজন তাকে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার গুরুত্ব শেখানো। শিশুকন্যা আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী কারও দ্বারা নিগৃহীত হলে “সমাজ কী বলবে” ভেবে কন্যাকে চুপ না করিয়ে আগে সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করুন। অল্প বয়সে, স্কুলস্তরে সঠিক জীবনশৈলীর পাঠ পেলে ভবিষ্যতে হয়তো মানুষ কিছুটা সংযত হবে, এই আশাটুকু অন্তত রাখা যায়। আর আমরা পুরুষেরা, যদি এখনই নিজেদের সামনে আয়নাটি তুলে না ধরি, নিজেদের বদলানোর প্রক্রিয়া শুরু না করি— তাহলে একদিন হয়তো মূল্য আর বোধের লড়াইয়ে শুধু মূল্যটুকুই থেকে যাবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। মানুষ নিজেদের না বদলালেও প্রকৃতি কিন্তু প্রতিশোধ নেবেই একদিন, তার প্রক্রিয়াও হয়তো শুরু হয়ে গেছে ধীরে ধীরে, অতএব সাধু সাবধান।


*মতামত ব্যক্তিগত

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4888 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. তিষ্য আমাদের মানে পুরুষদের আয়নার সামনে দাঁড়াতে বলেছেন। খুব ভালো লাগলো লাইনটা। কতগুলো টুকরো টুকরো ছবির সূত্রে এগিয়ে নিয়ে গেছেন তাঁর আলোচনা। ঐ ছবিগুলো কাল্পনিক মনে করার কোনো কারণ নেই, কেননা এমন টুকরো টুকরো দৃশ্যগুলো প্রতিদিনের দৃশ্যপটে দেখতে দেখতেই আমাদের বেড়ে ওঠা। কেমন একঘেয়ে,গা সওয়া হয়ে যাচ্ছিল। কোনোরকম রাজনৈতিক দলের পৃষ্ঠপোষকতায় নয়, পরিবর্তন আসুক নতুন বিশ্বাসকে সঙ্গে নিয়ে। দেশের সমস্ত তিলোত্তমার স্বপ্ন পরিপূর্ণতা পাক।
    ধন্যবাদ তিষ্য’কে ।

আপনার মতামত...