রূপ ভট্টাচার্য
আসলে আমাদের আর নেই কিছুই। সব গরিমাই নষ্ট হয়ে গেছে। স্বাস্থ্য-শিক্ষা-সংস্কৃতি সম্পূর্ণ তলানিতে। সমাজবিরোধী আর তোষামুদে চাটুকার ছাড়া আর কেউ সুরক্ষিত নয় এই রাজ্যে। আমাদের এককালের আইকন অধিনায়ক মেরুদণ্ড বেঁকিয়ে ফেলেছেন, আমাদের কবি-গায়কের দল শাসকের পোষ্য, শিল্পী-সাহিত্যিক-অভিনেতাদের সিংহভাগ মাসোহারা ও অনুগ্রহপ্রাপ্ত, প্রায় সবাই মহানায়ক পুরস্কার প্রাপ্তির কিউয়ে দাঁড়িয়ে। আমাদের রাজনীতি ও সমাজ পুরোপুরি কলুষিত। লাভজনক আর ক্রমবর্ধমান দুর্নীতির বিশাল পিরামিডের তলায়, একদম তলানিতে পোকামাকড়ের মতো জীবনযাপন আমাদের। এই ঘোর কালোর মধ্যে একটা রুপোলি বিদ্যুৎরেখা হয়ে উঠে এল যেন সেই একত্রিশ বছরের একটি মুখ। নারকীয় অত্যাচারে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত টানা ছত্রিশ ঘন্টা যে মানুষকে পরিষেবা দিয়ে গেছে। তাই এই অপূরণীয়, অসহ্য ক্ষতির বিচার চেয়ে পথে নেমে পড়ছে মানুষ
ছিঁড়বে মুখোশ আগ্নেয় রোষ
জ্বলবে আগুন পুতুল নাচে
ভাঙবে গরাদ তীব্র সাহস
অনেক ছবি টুকরো কাচে
একটা কুঁড়ি বারুদগন্ধে মাতাল করে ফুটবে কবে
সারা শহর উথাল পাথাল ভীষণ রাগে যুদ্ধ হবে।—নবারুণ ভট্টাচার্য
ওই চির-চেনা খেলাটাই শুরু হয়েছিল। প্রথমে আত্মহত্যার তত্ত্ব, তারপর চরিত্রহননের ইঙ্গিত, খুব তাড়াতাড়ি মৃতদেহ পুড়িয়ে দেওয়া, টাকা দিয়ে মুখ বন্ধের চেষ্টা— যে-কোনও বড় অপরাধ বা নারীনির্যাতনের ঘটনায় যেভাবে সমাধানের রাস্তায় পৌঁছনো হয় এ-ক্ষেত্রেও আলাদা ছিল না কিছু। কিন্তু এইবার এত সহজে হিসেবটা মিলল না। একজন তরুণ চিকিৎসককে তার নিজের কর্মস্থলে ধর্ষণ ও খুন করে দিয়ে, তারপর সেটাকে যথারীতি একটা ছোট ঘটনা বলে চালানোর চেষ্টাটাকে মেনে নিতে পারল না এই নেই রাজ্যের বাসিন্দারাও। প্রথম যে স্ফুলিঙ্গ তিলোত্তমার সহপাঠী, সিনিয়র-জুনিয়ার জ্বালাল তা ক্রমশ দাবানল হয়ে ছড়িয়ে গেল গোটা রাজ্যে। এমনকি দেশ ও বিশ্বের নানাপ্রান্ত থেকে বিচার চেয়ে আওয়াজ উঠল।
স্বাধীনতা দিবসের আগের দিন ১৪ আগস্ট মেয়েদের যে ঐতিহাসিক রাতদখল অভিযানের ডাক দেওয়া হয়েছিল সেখানে কিন্তু আগাম কোনও নির্দেশনা বা পদ্ধতি বলা ছিল না, স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষোভের আগুন উগড়ে দিয়েছে শহর, মফস্বল থেকে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল। ধর্ম, জাত, শ্রেণি, বয়স সব ব্যবধান ভুলে পথে নেমেছে সবাই। একই সঙ্গে প্রথম থেকেই এই জোটবদ্ধ মিছিলগুলোর পরিচয়কে লঘু করার চেষ্টারও খামতি ছিল না। ‘অরাজনৈতিক’ ন্যাকামির মোড়ক জড়ানোর চালাকি ছিল। শাসক আর তার স্তাবকের পাল্টা মিছিল আর সার্কাসও ছিল। কিন্তু শেষ অবধি ধোপে টেকেনি কিছুই। নবান্নের চোদ্দতলা এই প্রথম টের পেল গণবিদ্রোহের আঁচ। আরও দু-দিন পর প্রতিবাদকে অন্য মাত্রা দিল কলকাতার ফুটবল। একশো বছরের বৈরিতা সরিয়ে সম্ভবত প্রথমবারের মতো একটা ইস্যু নিয়ে একজোট হল দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দল। মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল এই দুই ক্লাবের কর্মকর্তাদের ভূমিকা এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ শূন্য হওয়া সত্ত্বেও চার রং, দুই পতাকা আর অগুনতি সমর্থকের মিশে যাওয়া ঝড় থেকে স্পষ্ট চাঁচাছোলা দাবি উঠল—
ডার্বি নিলি নিয়ে নে
মেয়েটাকে ফিরিয়ে দে।
আসলে আমাদের আর নেই কিছুই। সব গরিমাই নষ্ট হয়ে গেছে। স্বাস্থ্য-শিক্ষা-সংস্কৃতি সম্পূর্ণ তলানিতে। পর্যাপ্ত রোজগারের সুযোগ নেই। সমাজবিরোধী আর তোষামুদে চাটুকার ছাড়া আর কেউ সুরক্ষিত নয় এই রাজ্যে। আমাদের এককালের আইকন অধিনায়ক মেরুদণ্ড বেঁকিয়ে ফেলেছেন, আমাদের কবি-গায়কের দল শাসকের পোষ্য, শিল্পী-সাহিত্যিক-অভিনেতাদের সিংহভাগ মাসোহারা ও অনুগ্রহপ্রাপ্ত, প্রায় সবাই মহানায়ক পুরস্কার প্রাপ্তির কিউয়ে দাঁড়িয়ে। আমাদের রাজনীতি ও সমাজ পুরোপুরি কলুষিত। পুলিশ-প্রশাসন সঙ্ঘটিতভাবে প্রভাবশালীদের তুষ্ট করে আর তাদের যাবতীয় অন্যায় ঢেকে সুরক্ষা দিতে ব্যস্ত। সংবাদমাধ্যম বিজ্ঞাপনের লোভে বিক্রীত ও বিকৃত। সব জায়গা মিলিয়ে দুষ্টচক্রের মিথোজীবিতা আকাশছোঁয়া। লাভজনক আর ক্রমবর্ধমান দুর্নীতির বিশাল পিরামিডের তলায়, একদম তলানিতে পোকামাকড়ের মতো জীবনযাপন আমাদের। আমাদের সাহস নেই, নিজস্বতা নেই, লোভসর্বস্ব ভীষণ অন্ধকার ছাড়া কোনও রং নেই। এই ঘোর কালোর মধ্যে একটা রূপোলি বিদ্যুৎরেখা হয়ে উঠে এল যেন সেই একত্রিশ বছরের একটি মুখ। নারকীয় অত্যাচারে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত টানা ছত্রিশ ঘন্টা যে মানুষকে পরিষেবা দিয়ে গেছে। তাই এই অপূরণীয়, অসহ্য ক্ষতির বিচার চেয়ে পথে নেমে পড়ছে মানুষ। শুরু থেকে তারা হয়তো অসংগঠিত, বিক্ষিপ্ত ভিড় ছিল। কিন্তু হাসপাতাল আর পুলিশের মিথ্যাচার, স্তাবকদের ধূর্ততা, নেতাদের হুমকি, মুখ্যমন্ত্রীর একের পর এক অসংবেদনশীল স্লোগান, মন্তব্য সব মিলিয়ে অনুঘটক হয়ে জুড়ে দিচ্ছে সাধারণ মানুষকে, বিক্ষিপ্ত প্রতিটা প্রতিবাদ আর মিছিলকে। জায়গায় জায়গায় ব্যারিকেড করে, শাসিয়ে যত দমনের চেষ্টা হচ্ছে, মানুষের ব্যারিকেড তত দীর্ঘ হয়ে জনবিচ্ছিন্ন করে তুলছে এই শাসকদল আর প্রশাসনকে।
তিলোত্তমার ধর্ষণ ও হত্যার কী বিচার হবে তা এখনও অজানা। পাশাপাশি এই অপরাধকে ধামাচাপা দিতে গিয়ে, অদৃশ্য ও অসীম শক্তিধারীর মদতে অপরাধের প্রমাণ ধ্বংস করতে গিয়ে, সময় নষ্ট করে করে সাধারণ মানুষকে সবটা ভুলিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা করে, পরপর যে প্রশ্নগুলো উঠে আসছে সেগুলো হল—
পার্থ-মানিকরা যেভাবে শিক্ষা দেখত, এই দুর্নীতিগ্রস্ত ও অসীম ক্ষমতাধর সন্দীপদের মতো আর কতজন মৌসরিপাট্টা জমিয়ে বসে আছেন স্বাস্থ্যব্যবস্থায় তাদের প্রত্যেককে খুঁজে বের করা জরুরি, তাদের যাবতীয় কুকীর্তি সামনে এনে, এতদিনের নির্মিত বিষাক্ত মাকড়সার জাল থেকে সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা আর হাসপাতালগুলোকে রক্ষা করতে হবে।
প্রশ্ন উঠছে এই যে এত নেতা-মন্ত্রীর ছেলেমেয়েরা ডাক্তারি পড়ে তারা সঠিক নিয়ম মেনে, নিট ও অন্যান্য পরীক্ষায় পাশ করে পড়ে কিনা তার উত্তর দিতে হবে।
মানুষের কোনও কাজে লাগে না, না হোমে না যজ্ঞে, স্বঘোষিত যুবরাজ আর উদ্ধত চ্যালাদের সর্বদা পঞ্চাশ গাড়ির কনভয় বা হাজার হাজার পুলিশ দিয়ে মুড়ে না রেখে দিয়ে তার বদলে হাসপাতাল, বিকেল থেকে ভোর অবধি স্টেশন-রাস্তাঘাট, কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের নিরাপত্তা আরও বাড়াতে হবে।
একই সঙ্গে, ওই হারিয়ে যাওয়া তারা তিলোত্তমা, আর তার হঠাৎ বয়স বেড়ে যাওয়া বাবা-মা, এই তিনটে ব্যাথাতুর মুখ যেন বিচার পায়, জড়িত প্রত্যেক অপরাধী ও তাদের আশ্রয়দাতারা যেন উপযুক্ত সাজা পায় তা নিশ্চিত করতেই হবে।
ততদিন অবধি ভুলবে না, ততদিন কাউকে মানবে না, ততদিন কিছু বুঝবে না, ততদিন রাস্তা ছাড়বে না এই রাগী শহরের মানুষ।
*মতামত ব্যক্তিগত