সিদ্ধার্থ বসু
অনেকদিনের একটা খায়েশ ছিল মনে, অশোকদার কোনও লেখাপত্তর নিয়ে সমালোচনা লিখব। কিন্তু নানা দোরোখা বিঘ্ন বাদ সেধেছে— যেগুলো আবার ভিতরে ভিতরে পরস্পর সম্পৃক্তও বলা চলে।
প্রথমত, প্রথম আলাপের আগেই অশোক মুখোপাধ্যায় নামের এই বিচিত্র মানুষটার আমি এমন কদর্যরকম গুণমুগ্ধ হয়ে পড়েছিলাম যে, যে-কোনও আলাপই শেষতক গিয়ে তোষামুদিতে ঠেকার ঘোরতর সম্ভাবনা ছিল, কিংবা এখনও আছে।
আর দ্বিতীয় যে মুশকিলটা— অশোকদার মতো এক ভুয়োদর্শী, বহু বিষয়ে অবাধ বিচরণক্ষম এবং দ্রষ্টা লোকের সৃষ্টিব্যাপার নিয়ে কোনও ভদ্রগোছের পর্যালোচনা করবার উপযুক্ত এক্তিয়ার আমার আদৌ আছে কি না, সে-বিষয়ে ছিলাম ঘোরতর সন্দিহান।
তা, এ দুই দূষণের মিথোজীবী সন্নিবেশকে ঠেলে এগোতে গিয়ে প্রায় পনেরো বছর লেগে গেল।
এবার আসি মূল আলোচনায়। বাল্যকাল থেকেই— বাড়ির পরিবেশই হোক বা বখা বন্ধুসমাজের সাহচর্যে— হয়ে উঠেছিলাম কড়া ধরনের নিরীশ্বর। নাস্তিক শব্দের নানা তাৎপর্য তখনও শিখিনি। তা, এই ঈশ্বরহীন জীবনচর্যা নিয়ে এগোতে এগোতে একদিন আবিষ্কার করলাম যে, চারপাশের— অন্তত আমি যে দুনিয়াটার ঘনিষ্ঠ হতে চেয়েছিলাম, তার— অধিকাংশ লোকজনই মারমুখী রকমের ঈশ্বরবিশ্বাসী। তা নিয়ে তাঁরা সমাজ-সাহিত্য-দর্শন-বিজ্ঞান-আদি জগতের সমস্ত কিছুকেই উনকোটি পরমান্ন ‘নির্ভুল’ ব্যাখ্যা করেন। আর শুধু তা-ই নয়, ঈশ্বরহীন কোনও যুক্তিক্রমের আভাসমাত্র পেলেই তাঁরা অগ্নির মতো জাজ্জ্বল্যমান হয়ে ওঠেন।
তা, এ সব লোকের কিনারা ঘেঁষে বসত করতে হত বলেই পায়ের তলার জমির খোঁজটা ছিল আন্তরিক এবং আত্যন্তিক। দর্শনের সহজ-সরল বই খোঁজার শুরু সেই থেকে। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় অনেক কিছু শেখালেন। ভারতীয় দর্শনের প্রধান শাখা ও তাদের আস্তিক্য-নাস্তিক্য, সেশ্বরতা-নিরীশ্বরতা বিষয়ে জানতে শুরু করলাম। পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাসেরও নাগাল হাতড়ালাম। সংক্ষেপে বুঝতে শুরু করলাম ভাববাদ ও বস্তুবাদে বিশ্বদর্শনের মূল দ্ব্যগ্র বিন্যাস। সেই সূত্রে মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিনেরও দু-এক কণার হদিশ পেলাম।
কিন্তু সংকট কাটছিল না। অর্থাৎ, তথ্য পাচ্ছিলাম খানিক— যার অধিকাংশই বিস্মৃত হতে দেরি লাগছিল না। তত্ত্বের সঙ্গেও পরিচয় ঘটছিল না তা নয়, কিন্তু দেখবার চোখটা যেন পরিষ্কার হচ্ছিল না— দৃকপাত বা দৃষ্টিভঙ্গির একটা গোলমাল রয়েই যাচ্ছিল। এরকম সময়ে আমার সঙ্গে আশীষ লাহিড়ী এবং অশোক মুখোপাধ্যায়ের পরিচয়। আশীষদার কাছ থেকেও একসময় অনেক পেয়েছি। সে-সব কথা অন্যত্র বলবার সুযোগ অবশ্যই কখনও হবে। কিন্তু অশোকদার কাছে প্রথম যেটা শিখলাম সেটা হল ওই— তথ্য বা তত্ত্বের চেয়েও বেশি— কীভাবে কোনও বিষয়কে দেখতে হবে। সে সমাজব্যাপার হোক বা প্রকৃতিপ্রসঙ্গ, গোদা অর্থে রাজনৈতিক হোক বা সাহিত্য-বিজ্ঞানের দর্শন। এমনকি রোজকার রোজে যেসব মাথাখারাপ ঠোক্কর-চক্কর ব্যতিব্যস্ত করে একেবারে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ে, তাদের কীভাবে দেখলে অন্তত খানিক অর্থবোধের উদ্রেক ঘটবে, সেই নজরিয়ার খোঁজ অশোকদার হাত ধরেই পাওয়া। অবশ্যই তার সিকিভাগও এখনও আয়ত্তে আসেনি। কিন্তু একটা পথের নিশানা যে পেয়েছি, সে কথা নির্জলা।
ফলত, এ-হেন অশোকদার বেশ কিছু বই-পুস্তক পড়া থাকলেও পাঠপ্রতিক্রিয়া দেওয়ার জন্য প্রথম আমি মনস্থ করলাম সাম্প্রতিক বস্তুবাদ ও দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি বইটিকেই। ইতিপূর্বে শ্রদ্ধেয় রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের লেখনীতে বেশ কিছু ক্ষেত্রে মার্কসবাদ তন্ত্র (system) না পদ্ধতি (method), সে বিবেচনা পেয়েছি। এবং তাঁর দৃষ্টিতেও মার্কসবাদ আসলে একটা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি— এই স্বীকার্যেরই সমর্থন পেয়েছি আগাগোড়া। এমতাবস্থায় প্রকাশিত হল অশোক মুখোপাধ্যায়ের পূর্বোক্ত বইখানা।

মার্কসের নিজেরই মার্কসবাদী হয়ে ওঠবার যে এক নাতিদীর্ঘ ইতিহাস আছে, এ বই না পড়লে এত স্পষ্টভাবে তা জানতে— বা হয়তো বুঝতে— পারতাম না। এমনকি ধর্ম, ‘আফিম’ ও ‘হৃদয়হীন পৃথিবীর হৃদয়’-সম্বলিত মার্কসের যে উদ্ধৃতি পক্ষ-প্রতিপক্ষ নির্বিশেষে যত্রতত্র ব্যবহার হয়ে থাকে, ১৮৪৩-এ লিখিত সেই চমৎকার তুলনাবাক্যও যে আসলে বেশিটাই ফয়েরবাখের সরাসরি প্রভাবে সংরচিত, সে খোঁজ— তথ্য-প্রমাণ সমেত— এ বইতেই পাওয়া যায়। কিন্তু, “পার্থক্য শুধু এটুকুই যে মার্কস সমাজ-অর্থনীতিটাকে আরও বেশি করে ধরতে চাইছেন।” “Religion is the opium of the people”-এর মতো বহুলপ্রভাবশালী উক্তিতেও যে ফয়েরবাখের “Religion is the sleep of the spirit”-এর ছায়া, সে কথাটা জানতে— বা তার চেয়েও বড় কথা, জানানোর উপযোগী হিসেবে নির্বাচন করতে— যতখানি খুঁটিয়ে মার্কসবাদী লেখাপত্র-সহ গোটা দর্শনের ইতিহাস আত্মস্থ করতে হয়, তা এক কথায় দুর্লভ। এই ধারাবাহিকতায়ই পাওয়া যায় ১৮৪৪-এর Economic and Philosophical Manuscripts-এর কথা, যেখানে মার্কস বলছেন যে বর্তমান সমাজব্যবস্থায় প্রধান সমস্যা হল ব্যক্তিস্বত্বাধিকার। এবং যতদিন এই ব্যক্তি-অধিকার বা মালিকানা থাকবে, ততদিন শোষণ-বঞ্চনা-বৈষম্য ঘুরে ঘুরে আসতেই থাকবে। অতএব, মানবিক সম্পর্ক বা মানবতাবাদকে ব্যক্তিমালিকানার গ্রাস থেকে মুক্ত করতে হবে। কিন্তু লেখক সেখানেও উল্লেখ করতে ভুলছেন না যে, এই মার্কস কিন্তু তখনও ঠিক মার্কসবাদী হননি।
১৮৪৪-এ দুই বন্ধুর দেখা হওয়ার পূর্বাপর চমৎকার বিশ্লেষণ-সহ আলোচিত হয়েছে। লিখছেন, “মার্কসের থেকে এঙ্গেলস পেলেন দর্শন। আর এঙ্গেলসের থেকে মার্কস পেয়ে গেলেন সেকালের সবচাইতে অগ্রসর ধনতান্ত্রিক দেশের শ্রমিকশ্রেণির বাস্তব পরিস্থিতি-সংক্রান্ত ধারণা।” অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানজগতের দুই দিক থেকে যাত্রারম্ভ করা এই দুই মনীষী কীভাবে পরস্পরের সন্নিধানে ক্রমশ গড়ে তুলছেন এক সুমহান দার্শনিক পদ্ধতি— “একটা পূর্ণাঙ্গ তাত্ত্বিক সত্তা”— তার নিপুণ বয়ান এ-বইতে পাওয়া যায়।
দুই বন্ধুর ১৮৪৪-এর শরৎকালে লেখা প্রথম বই— যা প্রকাশিত হচ্ছে ১৮৪৫-এর গোড়ায়— The Holy Family or Critique of Critical Criticism— থেকে উদ্ধৃত হয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক অংশ:
Ideas cannot carry out anything at all. In order to carry out ideas men are needed who can exert practical force.
ভাবনা কোনও নিরালম্ব, স্বয়ম্ভূ, স্বতশ্চল সত্তা নয়; তার জন্য প্রয়োজন সেই ভাবনায় ভাবিত মগজযুক্ত মানুষ, যারা সেই ভাবনার বাস্তবিক প্রয়োগ ঘটানোর চেষ্টা করবে। ঠিক এইখানেই এসে গেল মার্কসীয় দর্শনের বস্তুবাদিক পরিণতি। ১৮৪৫–৪৬-এ রচিত হচ্ছে German Ideology-র পাণ্ডুলিপি, যেখান থেকে তাঁরা হয়ে উঠছেন পুরোদস্তুর মার্কসবাদী। তাঁরা বলছেন:
ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যা হিসাবে আমরা বলি, মানুষের সমাজবিকাশের যে ইতিহাস, তার মূল খুঁজতে হবে মানুষের চিন্তাধারার মধ্যে নয়, বাস্তব উৎপাদন-পদ্ধতির মধ্যে।
এই বইতেই রয়েছে সেই যুগোত্তীর্ণ লাইন:
The ideas of the ruling class are in every epoch the ruling ideas; i.e. the class which is the ruling material force of society is at the same time its ruling intellectual force.
এই বোঝাপড়া থেকেই আমরা সুদূর অতীতের ভাববাদী দর্শনের প্রাদুর্ভাবের সম্ভাব্য ও বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা পরবর্তী অংশে পাব।
এ-বইতে তাঁরা আরও বলছেন:
One of the most difficult tasks confronting philosophers is to descend from the world of thought to the actual world.
—যাকে বলা যেতে পারে বস্তুবাদের এক প্রত্যক্ষ ও সক্রিয় ঘোষণা।
কিন্তু এইসব জায়গা থেকে অনেকে— পল্লবগ্রহণে অভ্যস্ত কেউ কেউ— বস্তুবাদকে চেতনার সক্রিয়তার অস্বীকারী বলে দাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। তাঁর Theses on Feuerbach-এর প্রথমেই তাই মার্কস চিনিয়ে দিতে চান নতুন বস্তুবাদকে। তিনি বলেন, এতদিন পর্যন্ত বস্তুবাদীরা চেতনার সক্রিয় দিকটাকে অগ্রাহ্য করেছেন… চেতনার ক্রিয়াশীলতা নিয়ে চর্চা করেছেন ভাববাদীরা। আমাদের এখন এটা তাঁদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে বিকশিত করতে হবে। এবং সেখানেই বলছেন ডায়ালেক্টিক্সের কথাও। লেখক বলেন: “যেটাকে আমরা দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ বলি, সেটার দিকে তাঁরা ধীরে ধীরে এগোচ্ছেন। এই জার্নিটা মোটামুটি বলা যায় কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো-তে গিয়ে একটা পরিণতি পেয়ে যায়।” এইভাবে দার্শনিক পদ্ধতি হিসেবে মার্কসীয় দ্বন্দ্বতত্ত্বের আবির্ভাবের ইতিবৃত্তটা খুব অল্প পরিসরের মধ্যেও খুব স্পষ্ট ও প্রাঞ্জল হয়ে ওঠে।
এর পরের অধ্যায়ে কিনারা হয় আরেক অতি জনপ্রিয় অভিযোগের। ম্যানিফেস্টো-র প্রথম লাইনেই ছিল:
A spectre is haunting Europe — the spectre of communism.
অর্থাৎ, ১৮৪৮ সালে বসে তাঁরা শিল্পোন্নত দেশগুলোতে অচিরাৎ বিপ্লবের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। কিন্তু— আমরা এখন জানি— সেটা মেলেনি। রাশিয়া আর চিন— দুই পশ্চাৎপদ ভূখণ্ডে— প্রথম বিপ্লব হল কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে। সুতরাং, বিরোধীরা বলেন, মার্কসবাদ প্রথম থেকেই ভ্রান্ত।
এ-প্রসঙ্গে লেখক বলছেন: ১৮৪৮-এ যে বা যাঁরাই শ্রমিক রাজনীতি করতেন, তাঁদেরই এরকম মনে হত। ফলত, মার্কস-এঙ্গেলসের তরফেও এটা একটা ভুল ধারণা বা সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কারণ, ফ্রান্স, জার্মানি, বেলজিয়ামের জায়গায় জায়গায় এ সময়পর্বে বিপ্লবী সংগ্রাম ফেটে পড়ছিল, বড় বড় মিছিল-ধর্মঘট হচ্ছিল। ফলে: “ধনতন্ত্রকে উচ্ছেদকারী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সাপেক্ষে শ্রমিকশ্রেণির সমকালীন বাস্তব সাংগঠনিক প্রস্তুতি ও মতাদর্শগত সামর্থ্যকে তাঁরা অনেকটা বাড়িয়ে দেখেছিলেন।”
পরে, মার্কসের ১৮৪৮–৫০ সালে লেখা The Class Struggles in France বিষয়ক রচনাগুলি বহু কাল বাদে পুস্তকাকারে প্রকাশের সময় এঙ্গেলস যে ভূমিকাটি লেখেন (১৮৯৫), সেখানে পাওয়া যায় এই স্বীকারোক্তি:
History has proved us, and all who thought like us, wrong. It has made it clear that the state of economic development on the Continent at the time was not, by a long way, ripe for the elimination of capitalist production.
এবং ১৮৪৬-এ তাঁরা দুজনেই একটি পশ্চাৎপদ দেশে সর্বহারা বিপ্লবের সম্ভাবনার কথা লেখেন:
The competition with industrially more advanced countries, brought about by the expansion of international intercourse, is sufficient to produce a similar contradiction in countries with a less advanced industry (e.g., the latent proletariat in Germany brought into more prominence by the competition of English industry).[1]
অতএব, “তাঁরা যেটা জার্মানির জন্য ভেবেছিলেন, সেটা রাশিয়ার জন্যই বা প্রযোজ্য হতে পারবে না কেন?”
এভাবে, কোনও অপধারণার নিষ্পত্তি ঘটানোর মতো পড়াশোনা কারও কারও থাকলেও, সেই সদিচ্ছা, পরিমিতিবোধ ও প্রয়োগদক্ষতা অত্যন্ত বিরল। এ বইতে— আরও কোনও কোনও লেখার মতোই, বা তারও চেয়ে খানিক বেশিই— অশোকদা সে কাজ বারবার করেছেন।
এরপর ১৮৪৪-এর Economic and Philosophical Manuscripts-এ ইউটোপীয় সমাজতন্ত্র থেকে প্রয়োজনীয় বিচ্ছেদ ঘটিয়ে ফেলছেন মার্কস। লিখছেন, কমিউনিজম হচ্ছে এমন এক আর্থসামাজিক সংগঠন যেখানে ব্যক্তিসম্পত্তির কোনওরকম অস্তিত্ব থাকবে না। তবে এই পর্বের আলোচনাতেও লেখক মনে করিয়ে দিতে ভুলছেন না যে “তখনও তিনি মার্কসবাদী হননি।” যদিও সেই মার্কস লিখছেন:
Communism is the genuine resolution of the conflict between man and nature and between man and man — the true resolution of the strife between existence and essence… Communism is the riddle of history solved, and it knows itself to be the solution. (Marx)
এরপর ইতিহাসের বস্তুবাদী ভাষ্যনির্মাণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব, এবং প্রকৃতিবিজ্ঞান ও মানববিজ্ঞানের ক্রমশ অঙ্গাঙ্গী হয়ে ওঠার, বা আরও সঠিকভাবে বললে, “জ্ঞানজগতের সমস্ত ক্ষেত্রে একই দার্শনিক বিচারপদ্ধতি, অর্থাৎ দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির সর্বময়গ্রাহ্যতার” উপলব্ধি তাঁকে আসল মার্কসবাদী রূপে তুলে আনছে। এবং তারই সঙ্গে আর-এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে: পুঁজিবাদী অর্থনীতির প্রবক্তা অ্যাডাম স্মিথকে উদ্ধৃত করে ইপিএম-এ মার্কস দেখাচ্ছেন, যে পুঁজিবাদী উৎপাদন পদ্ধতিতে পুঁজিপতিরা সমাজের সব পক্ষকে তাদের নিজস্ব পাওনা বুঝে দেওয়ার পরও নিজেরা লাভ করছে, অথচ সমাজে দারিদ্র্য-শোষণ-অভাবের শেষ হচ্ছে না। এর কারণ হিসেবে স্মিথ যে কোনও এক “অদৃশ্য হাত”-এর কথা বলেছিলেন, সেটাই তখনও অবধি মার্কস খুঁজছেন, কিন্তু পাচ্ছেন না।
খুব উল্লেখযোগ্যভাবে অশোকদা তুলে ধরেছেন: “দ্বন্দ্বতত্ত্বকে দর্শনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের সমকালীন কতকগুলো আবিষ্কারের খুব গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল।” এর মধ্যে প্রথমে উদ্ভিদ ও প্রাণীকোষের আবিষ্কার এবং জীবদেহের গঠন ও কার্যমূলক একক হিসেবে তার স্বীকৃতি জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। একইসঙ্গে, প্রকৃতিবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিভিন্ন শক্তির পারস্পরিক রূপান্তর এবং মোট শক্তির পরিমাণ সংরক্ষণের তত্ত্ব কীভাবে হেগেলের “পরিমাণগত থেকে গুণগত পরিবর্তন” ধারণাটিকে আরও স্পষ্টভাবে বোঝাতে কাজে লেগেছিল, তার উল্লেখ করেছেন লেখক। এ-প্রসঙ্গে ১৮৫৮ সালের ১৪ জুলাই মার্কসকে উদ্দেশ করে এঙ্গেলসের লেখা চিঠির অবতারণাও অত্যন্ত মূল্যবান।
এরপর ১৮৪৭-এর The Poverty of Philosophy-তে ‘লেবার’ শব্দের পুরনো ব্যবহারিক রূপের মোড়কে উদ্বৃত্ত মূল্যের ধারণার প্রথম উদ্ভব ঘটে। সেখান থেকে অগ্রসর হয়ে ১৮৫৯ সালের A Contribution to the Critique of Political Economy-তে প্রথমবার ‘লেবারপাওয়ার’ শব্দটি তার প্রকৃত অর্থে ব্যবহৃত হয়। এ-পর্যায়ে মার্কস আগেকার accounting from the bourgeois point of view পেরিয়ে পৌঁছন social accounting নামক শ্রেণি-দৃষ্টিভঙ্গিতে। মার্কস দেখাচ্ছেন, মালিক আসলে শ্রম (labour) কিনছে না; শ্রম প্রযুক্ত হওয়ার আগেই কিনছে— কেনার চুক্তির মাধ্যমে। অর্থাৎ এখানে বিক্রি হচ্ছে the capacity of the worker to work for the owner, অর্থাৎ শ্রমশক্তি বা labour-power। উৎপাদনে শ্রম প্রবেশ করলে সে যে মূল্য যোগ করছে, শ্রমশক্তি কেনা হয়েছে তার চেয়ে কম দামে। ফলে উৎপন্ন দ্রব্যের মূল্য বেড়ে যায়। এভাবেই সমাধান হয় শতাব্দী-প্রাচীন এক ধাঁধা।
মার্কসের labour theory of value দেখাচ্ছে যে, শ্রমশক্তি নামক পণ্যটিই উৎপাদনে শ্রম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে পণ্যের বস্তুগত মূল্যের সঙ্গে অতিরিক্ত মূল্য যোগ করছে। এর একটি অংশ শ্রমিক পাচ্ছে মজুরি হিসেবে, আর বাকি অংশ উদ্বৃত্ত মূল্য (surplus value) আকারে পুঁজিপতির মুনাফার পকেটে জমা হচ্ছে।
এর পর লেখক প্রবেশ করেছেন এক অত্যন্ত প্রয়োজনীয় আলোচনায়। এঙ্গেলসকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, বস্তু থেকে চিন্তার জন্ম হয়, নাকি চিন্তা থেকে বস্তু— এই মৌলিক প্রশ্নের উত্তরের উপর দাঁড়িয়েই দর্শনের প্রাথমিক দুটি শিবির: ভাববাদ ও বস্তুবাদ। কিন্তু এখানেই অশোক মুখোপাধ্যায় যুক্ত করেছেন আরও দুটি মৌলিক প্রশ্ন, যেগুলি— তাঁর মতে— এই প্রধান দুই দার্শনিক ধারার নির্ণায়ক চরিত্র হিসেবে দেখা দেয়।
প্রথমত, এই বিশ্বজগৎ আদৌ জ্ঞানসম্ভব কি না, অর্থাৎ এটি অজ্ঞেয় কি না। দ্বিতীয়ত, জ্ঞান কি মানুষ বাইরের জগৎ থেকে আহরণ করে, নাকি তা অন্তর থেকে উদ্ভূত হয়— অন্তর্দৃষ্টি বা অনুপ্রেরণার মাধ্যমে। এর সঙ্গে এসেছে দর্শনের এই প্রধান দ্বিভাজনের ঐতিহাসিক বা/ও সামাজিক কার্যকারণ। অশোকদা দৃষ্টান্ত-সহ উল্লেখ করেছেন যে, “শ্রেণিবিভক্ত সমাজের আবির্ভাবকালের সঙ্গে ভাববাদের উদ্ভবের একটি সময়ানুগ সম্পর্ক রয়েছে।” এবং সেটি নিছক কাকতাল নয়, বরং কার্যকারণের সম্পর্ক। এই প্রসঙ্গে অশোকদা একাধিক লেখকের মতামত উল্লেখ করেছেন এবং ইতিহাসের উদাহরণ দেখিয়ে স্পষ্ট করেছেন যে, শাসকশ্রেণির দর্শন ভাববাদ এবং শোষিতশ্রেণির দর্শন বস্তুবাদ— এরকম কোনও ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত এখনও পর্যন্ত স্রেফ অনুমানমাত্র, প্রামাণ্য সত্য নয়। এই বিষয়ে পণ্ডিতদের মধ্যেও মতভেদ বিদ্যমান।
শ্রেণিবিভাজনের আগের সমাজজীবনে ধর্ম নয়, বিদ্যমান ছিল সমষ্টিগত ম্যাজিক-সংস্কৃতি। সেখানে সমস্ত ম্যাজিকই বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত হলেও, তার ভিতরে এক ধরনের কঠোর কার্যকারণ পরম্পরা নিহিত ছিল। তবে এটিও সত্য যে, “ধর্মীয় বিশ্বাস যেহেতু ভাববাদের আদি রূপ, তাই প্রথম থেকেই ভাববাদের মধ্যে ‘বিশ্বাস’ একটি প্রধান উপকরণ হয়ে আশ্রয় লাভ করেছিল। বলা ভালো, এই বিশ্বাসের জোরেই তা ভাববাদ হিসাবে পরিস্ফুট হয়েছিল।” (অ.মু.)
এর ঠিক পরেই, মার্কস-এঙ্গেলসকে উদ্ধৃত করে অশোকদা জানাচ্ছেন: শ্রেণিবিভক্ত সমাজে শ্রমবিভাজনের ফলে যখন কায়িক ও বৌদ্ধিক শ্রম আলাদা হয়ে গেল, এবং পুরোহিতজাতীয় কর্মীদের উদ্ভব ঘটল, তখন থেকে সমাজে যারা মূলত বুদ্ধি বা চিন্তার কাজ করত, এবং অন্যদের কাজে নির্দেশ দিত, তাদের মনে হতে লাগল যে এই চিন্তা-চেতনার গঠন বাইরের বস্তু বা সামগ্রীর উপর আর নির্ভর করছে না। প্রকৃতিতে যা-ই থাকুক বা ঘটুক না কেন, তারা কেবল চিন্তা করেই অনেক কিছু জেনে ফেলতে, এমনকি অনেক কিছু ঘটিয়েও ফেলতে সক্ষম। এরপরেই তিনি উদ্ধৃত করছেন The Fundamentals of Marxist-Leninist Philosophy (সোভিয়েত ইউনিয়ন, ১৯৭৪) থেকে:
Intellectual activity as it is broken away from manual labour, acquires a relatively autonomous character, and becomes the privilege of the property owning, exploiting classes. The ideologists of these classes, who treat manual work with contempt, are deluded into thinking that mental activity is the determinative factor in the existence and development of society.
মানব-ইতিহাসে ভাববাদী দর্শনের উদ্ভবের এই পরিচ্ছন্ন ব্যাখ্যা আসলে মার্কসবাদের মূল আকরগ্রন্থগুলির মধ্যেই ছড়িয়ে আছে। অধিকাংশ মার্কসবাদী এ-বিষয়ে অবগত থাকলেও, এতটা স্বচ্ছভাবে তা তুলে ধরতে দেখা যায় খুব কম লেখককেই।
এরপর অশোকদা মরিস কর্নফোর্থকে টেনে আনছেন। ধর্মীয় বিশ্বাসের ভেতরে কীভাবে বাস্তব সামাজিক সংগঠনের এক ধরনের ডুপ্লিকেট রূপ তৈরি হয়— সেই প্রসঙ্গেই তিনি কর্নফোর্থকে উদ্ধৃত করেছেন। এখান থেকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে ভাববাদ ও ধর্মের নিবিড় সম্পর্ক, এবং পাশাপাশি ভাববাদ ও বস্তুবাদের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলোকে আলাদা আলাদা করে চিহ্নিত করা যায়।
এরপর অশোকদা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে আনেন:
বস্তুবাদ গত দু-হাজার বছর ধরে খুব একটা মাথা তুলতে পারেনি। চিন্তার জগতে মূলত ভাববাদেরই প্রাধান্য। (অ.মু.)
এই অনতিপ্রিয় সত্যের দিকে তিনি নজর ঘুরিয়ে দেখান ভারত, ইউরোপ ও আরবের বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে উদাহরণ টেনে— প্রাণের উৎপত্তি কীভাবে হল? মানুষের চেতনারই বা উৎস কী?— এ-ধরনের কালোত্তীর্ণ প্রশ্নের প্রেক্ষিতে ঈশ্বরের ধারণা টেনে এনে সবখোল চাবির সন্ধান দেওয়ার চেষ্টা ছিল সেই সময়কার মূল অযোগ্যতা। এর ফলে আত্মা, পরমাত্মা ও অন্যান্য অবাস্তবিক ধারণার ক্রমবিকাশ ঘটেছিল।
একই সঙ্গে, প্রাচ্য-পাশ্চাত্য মিলিয়ে বস্তুবাদের যে ধারাবাহিক আন্দোলন চলছিল, সেখানে একের পর এক জ্ঞানী মানুষের অবদান উল্লেখ করেছেন লেখক। গুরুত্বপূর্ণ নামগুলো হল: সোক্রাতেস, আরিস্ততল, লুক্রেতিউস, দেমোক্রিতাস, হাইপেশিয়া, ইবন সিনা, ইবন রুশদ, গণিতবিদ পরিচয়ে ওমর খৈয়াম প্রমুখ। এঁদের অনেকের বিরুদ্ধে ঈশ্বরবাদী ও ধর্মবাদী রাষ্ট্রগুলো শাস্তিবিধানের নামে যথেচ্ছাচার চালিয়েছে। এর মধ্যে ব্রুনো, কোপার্নিকাস, মিগুয়েল সার্ভেতো, রবার্ট গ্রোসেসেস্টে এবং রজার বেকনের নাম উল্লেখযোগ্য।
ইংল্যান্ডে বস্তুবাদের মশালকে জ্বালিয়ে ধরে রাখেন ফ্রান্সিস বেকন, টমাস হবস ও জন লক। এছাড়া রিচার্ড ওভার্টন এবং জন টোল্যান্ডের নামও উল্লেখযোগ্য। লেখক এঁদেরকে সামগ্রিকভাবে অভিজ্ঞতাবাদী (empiricist) হিসেবে দেখান এবং যান্ত্রিক বস্তুবাদের সূচনাকার হিসেবে চিহ্নিত করেন। তাঁর কথায়: “এঁরা আসলে ভাববাদের যে speculative ঝোঁক, মনগড়া ধারণা দেওয়ার যে ঝোঁক, অর্থাৎ, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাকে অগ্রাহ্য করার প্রবণতাকে বিরোধিতা করতেন।” বেকন বলছেন, হাতে-কলমে অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণের ওপর জোর দিয়ে দুনিয়াকে বুঝতে। একই সময়ে গ্যালিলিও বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার মাধ্যমে সত্য খুঁজে বের করার ধারণা নিয়ে আসেন। এরপর টমাস হবসের নৈরাশ্যপন্থী বস্তুবাদ আসে এবং জন লকও জানাচ্ছেন, বহির্বিশ্ব সম্পর্কে জানতে হলে আমাদের বহিরিন্দ্রিয় ও অন্তরিন্দ্রিয় ছাড়া অন্য কোনও পথ নেই। এরপর লেখক ফের বিশুদ্ধ ভাববাদী জোসেফ বার্কলে এবং ডেভিড হিউমের উত্থানের পটভূমি প্রসঙ্গে এঙ্গেলসের এক চমকপ্রদ রসিকতার উল্লেখ করেন:
ইংল্যান্ডে বুর্জোয়া বিপ্লবটা হয়ে যাওয়ার পর বুর্জোয়াশ্রেণির কাছে বস্তুবাদের প্রয়োজন ধীরে ধীরে কমে আসে। সমাজজীবনে ধর্ম পুরোপুরি অবদমিত হয়ে গেলে, বরং কিছু অসুবিধা দেখা দিতে পারে। শ্রমিকরা মালিকের কাছে বশ্যতা স্বীকারে আপত্তি জানাতে পারে। ফলে…” (এঙ্গেলস)
এরপর ব্রিটিশ বস্তুবাদের প্রভাব ফ্রান্সেও লক্ষণীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়। এই প্রসঙ্গে ভোলতেয়ার এবং রুশোর নাম উঠে আসে। তাঁরা ঈশ্বরকে মানলেও সমস্ত বাস্তব জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্র থেকে ঈশ্বরের ধারণাকে বাদ দেওয়ার পক্ষে ছিলেন। এর পাশাপাশি উল্লেখ পাই এমন বহু ব্যক্তির, যাঁরা ঈশ্বরবিরোধী এবং আধ্যাত্মিক যুক্তিতর্কের প্রতীপে অবস্থান গ্রহণ করেছেন। এর মধ্যে দিদরো, কঁদ্রসে, লা মত্রি, এলভেতিয়াস, ওলবাখ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। তাঁদের তথাকথিত অবস্তুবাদিক সংজ্ঞাবিরোধী “বিশ্বকোষ রচনা” প্রকল্পের কথা আসে।
১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের জ্ঞানগত বা চেতনার দিকের বৈশিষ্ট্য উঠে আসে পরবর্তী অংশে। লেখকের ভাষায়: “শুধু রাজতন্ত্র বা জমিদারতন্ত্রের হটে যাওয়া নয়, জমিদারতন্ত্রের সঙ্গে বিজড়িত যা কিছু ছিল… সব কিছুর একটি ব্যাপক পরিবর্তন হয়ে গেল। অসংখ্য চার্চ দখল হয়ে যায়, আর সেগুলো স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মিউজিয়ামে রূপান্তরিত হয়ে গেল।” সংরচিত হতে থাকল বস্তুবাদের প্রাথমিক অগ্রগতির পর্যায়, যাকে মার্কসবাদের প্রেক্ষাপটে যান্ত্রিক বস্তুবাদ (Mechanical materialism) বলা হয়।
কিন্তু এই “মেকানিকাল” নামের উৎস কী? লেখক জানান: “এইভাবে বলার কারণ হল, এই বস্তুবাদের পিছনে বিজ্ঞানের যে পর্যায়টা আছে— অর্থাৎ সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীর ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও আশেপাশের দেশে পদার্থবিজ্ঞানের যে অংশটির প্রভূত উন্নতি হয়েছিল প্রকৃতিবিজ্ঞান হিসেবে, সেটি হচ্ছে মেকানিক্স।” (অ.মু.) ফিজিক্স তখনও বলা হচ্ছে না। অর্থাৎ, কোনও জিনিসকে বোঝার জন্য সেটিকে ক্ষুদ্রতর অংশে ভেঙে তার কাজ পর্যবেক্ষণ করে সমগ্র বিষয় অনুধাবন করার ধারণাই প্রচলিত ছিল। এর আদর্শ মডেল ছিল তৎকালীন জটিলতম যন্ত্র ঘড়ি। এই দৃষ্টিভঙ্গি রনে দেকার্তের নামানুসারে Cartesian approach বা analytical approach নামে পরিচিত। এই পদ্ধতির অনুসরণেই গ্যালিলিও ও কেপলারের কাজের পর নিউটনের যুগান্তকারী সূত্র আবিষ্কার হয়। এগুলোর ব্যবহারিক প্রয়োগে সৌরজগতের নতুন গ্রহ আবিষ্কার এবং ধূমকেতু সংক্রান্ত জ্ঞান অর্জন সম্ভব হয়। এই সময়ের বিজ্ঞানকে আশ্রয় করে গড়ে ওঠা বস্তুবাদও তাই যান্ত্রিক বা বস্তুগত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে অপ্রাণ পদার্থ থেকে প্রাণ-পদার্থ সৃষ্টি করেছে।
কিন্তু যান্ত্রিক বস্তুবাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ দুর্বলতার কথাও লেখক উল্লেখ করেছেন। যেহেতু এই দর্শন যে-কোনও জটিল বস্তুকে টুকরো করে ক্ষুদ্রতম অংশগুলো বোঝার মধ্যেই সীমিত ছিল, তাই প্রকৃতি এবং সমাজে নতুন কোনও জিনিস— বস্তু হোক বা সামাজিক অবস্থা— উদ্ভবের বাস্তবতা ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হয়নি। যদি বলা হয় “Man is a product of circumstances”, তাহলে সেই নতুন মানুষের জন্ম হবে কোথা থেকে, যারা আবার নতুন সমাজের সৃষ্টি করবে? এই প্রশ্নের উত্তরে যান্ত্রিক বস্তুবাদে কোনও সমাধান নেই। ফলত, “যে মেকানিক্স সেদিন দার্শনিকদের একটি অংশকে এই বিশ্বজগৎ বস্তুবাদের চোখে দেখবার ক্ষমতা দিয়েছে, তার মধ্যে হেতুবাদের ক্রিয়া বুঝতে সাহায্য করেছে। কিন্তু সেই মেকানিক্সই আবার সমাজ ইতিহাস এবং মানুষের চরিত্র বোঝার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করেছে। এর ভিত্তিতেই আমরা বুঝতে পারি, ফরাসি বস্তুবাদীরা কেন এবং কীভাবে সেদিন বিজ্ঞানের ব্যাখ্যায় বস্তুবাদী হয়ে সমাজ ইতিহাস ও মানবচেতনার প্রশ্নে ভাববাদের সীমানায় থেকে গেলেন।” (লেখক)
এই যান্ত্রিক বস্তুবাদের দুর্বলতা কাটানোর জন্য প্রথম প্রাথমিক শর্তটি ছিল— বিজ্ঞানকে যান্ত্রিক বলবিদ্যা ছাড়িয়ে আরও উন্নত পর্যায়ে উন্নীত করা। প্রকৃতপক্ষে এই উন্নয়ন শুরু হয় ফরাসি বিপ্লবের সময়কাল থেকেই। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিকে ল্যাভয়শিয়া, ডালটন, অ্যাভোগাড্রো প্রমুখের কাজের মাধ্যমে প্রকৃতিবিজ্ঞানে এবং লিনিয়াস প্রমুখের কাজের মাধ্যমে জীববিজ্ঞানে বস্তুবাদের সমস্যাগুলো কাটানোর প্রেক্ষাপট তৈরি হতে থাকে।
অতঃপর খুঁটিয়ে আলোচিত হয় ধ্রুপদী জার্মান দর্শনের বিকাশ। কান্ট ছিলেন জার্মানির আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে ‘দর্শনের দিক থেকে বিজ্ঞানের লোক’। তাঁর নীহারিকা সংক্রান্ত তত্ত্ব প্রায় ৪০ বছর পর লাপ্লাসের গাণিতিক হিসাবনিকাশের ওপর দাঁড়িয়ে গড়ে ওঠে কান্ট-লাপ্লাস নেবুলার হাইপোথিসিস (১৭৯৬), যা দিয়ে এখনকার সময়েও জ্যোতির্বিজ্ঞানে সৌরজগতের বিবর্তন ব্যাখ্যা করা হয়। বার্কলে ও হিউমের চূড়ান্ত ভাববাদের পর্ব পার হয়ে, কান্ট ভাববাদী হলেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ চিন্তাকে সামনে আনলেন। তিনি “বললেন যে বস্তুজগৎ আছে, আমাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা বা চেতনা নিরপেক্ষভাবে বস্তুজগৎ বিদ্যমান; এই বস্তুজগৎ থেকেই আমরা অভিজ্ঞতা লাভ করি। আমাদের অস্তিত্বের উৎস এই বহির্জগৎ… যার ভিত্তিতে বস্তুবাদই যেন আবার ফিরে এল।” (লেখক) বহির্জাগতিক অভিজ্ঞতা এবং তার যৌক্তিক যাচাই-নিশ্চয়তার ওপর দাঁড়াল তাঁর দার্শনিক কাঠামো। ভাববাদ খানিকটা পিছু হটল।
কিন্তু এরপরই তিনি দেশ, কাল, হেতুত্ব ইত্যাদি সংক্রান্ত পূর্বজ বা সহজাত ধারণা (intuition) নিয়ে এলেন। সেই সূত্রে বললেন, “কারণ বলে কিছু হয় না; কারণের ধারণাই হল আমাদের এক সহজাত বোধ, যার নাম তিনি দেন a priori, যার কোনো ইন্দ্রিয়জ ভিত্তি নেই।… এটি কেবল আমাদের নিজেদের অন্তস্থিত ধারণা।”
এরপর কান্ট “বললেন, অভিজ্ঞতার যে অংশটুকু আমরা জানতে পারি, তার বাইরেও বস্তুর অংশ আছে।” আমাদের ইন্দ্রিয়জ সীমার বাইরে চিরকাল অজ্ঞেয় থাকা এই বস্তুর নাম তিনি দেন thing-in-itself বা স্ববস্তু, অর্থাৎ বস্তু যা নিজে। এই বিন্দুতে গিয়ে কান্ট ফের ভাববাদের চৌহদ্দিতেই শুধু ফিরে আসেন না; বরং তার ভিতকে আরও শক্ত ও যৌক্তিক করে তোলেন।
কিন্তু এখানেই কান্টের এক অতি উল্লেখযোগ্য বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন লেখক: “We have to remove knowledge in order to create space for God.” (Kant) ভাববাদের তরফে এর ইতিবাচক ব্যাখ্যা হল যে, ভৌতজগতের জ্ঞান-বুদ্ধির বাইরে ঈশ্বরের অনিবার্যতা রয়েছে; অতএব তাঁকে না মেনে আর পথ নেই। অথচ পরবর্তীতে এঙ্গেলস ও অন্যান্য মার্কসবাদী দার্শনিকদের মতে, কান্টের কাজ দর্শনের বিকাশে ফরাসি বা যান্ত্রিক বস্তুবাদের সাপেক্ষে “একটা বৃহচ্ছেদ (breakthrough) ঘটাচ্ছে।”
এই বৈপরীত্যের সমাধান হিসেবে লেখক হাইনরিখ হাইনের কথা তুলে আনেন, যিনি দেখান: “আসলে কান্টের কথাটা উল্টো করে ধরলে মানে দাঁড়াবে, তুমি যদি জ্ঞানী হও, যদি জ্ঞান অর্জন করো, তাহলে আর ভগবানকে পাবে না। অর্থাৎ যুক্তি ও অভিজ্ঞতা কোনওটা দিয়েই ভগবানে পৌঁছনো যাবে না— এটা দার্শনিক পর্যায়ে কান্ট প্রতিষ্ঠিত করেছেন।”
ফলত হাইনে এক কথায় কান্টকে তুলনা করেন ফরাসি বিপ্লবী নেতা রোবস্পিয়ারের সঙ্গে: একজন রাজাকে বাতিল করে দিলেন, অন্যজন ভগবানকে। কেননা,— লেখকের অনন্য প্রাঞ্জলতায়— “কান্ট চাইছেন ভগবানকে মানতে, এতে যুক্তি, তর্ক, অভিজ্ঞতা যা যা বাদ যায়, যাক। কিন্তু সমস্যা হল, এমন দর্শনগত কাঠামো তিনি দাঁড় করিয়ে ফেলেছেন… সেও দর্শনটা মানলে, বহির্জগতের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব মানলে, যুক্তি দিয়ে ধাপে ধাপে এই জিনিসগুলো মানলে আর আপনি ঈশ্বর মানতে পারবেন না। আপনাকে বলতেই হবে যে জ্ঞান এবং যুক্তি যদি গ্রহণ করো, তাহলে কোনও ভগবানের অস্তিত্বের প্রমাণ তুমি পাবে না।” লেখকের মতে, “যে যান্ত্রিক বস্তুবাদ অভিজ্ঞতার বাইরে বেরোতে পারছিল না, তাকে কান্ট দেখিয়ে দিলেন, কীভাবে বেরোতে হবে।” তুলে এনেছেন সোভিয়েত তাত্ত্বিক ওইজারম্যানের মন্তব্যও: “Kant’s historic contribution was that he criticized (and to a certain degree overcame) the limitations of both the rationalism and empiricism of his time.” (Oizerman) লেখকের ভাষায়: সংশ্লিষ্ট তথ্যের ওপর যুক্তি প্রয়োগ করেই জ্ঞান অর্জন করতে হবে… এইটা দর্শনের বৃত্তে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল।”
যান্ত্রিক বস্তুবাদের metaphysical approach বা “নিথর দৃকপাত’’ কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে কান্ট একটি বড় পদক্ষেপ— হয়তো অনবধানেই— নিয়ে ফেলেছেন। এখানে তাঁর নীহারিকা তত্ত্বেরও ভূমিকা উল্লেখযোগ্য, যা প্রথম খুব স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয় যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড, সৌরজগৎ ও তার বিভিন্ন সদস্য— কোনও কিছুই স্থির নয়, এক রকম নয়, বরং চির পরিবর্তনশীল। এছাড়া, কোনও বস্তুকে টুকরো বা বিচ্ছিন্নভাবে ধরা যাবে না। অর্থাৎ, আজকের পৃথিবীর ঘটমান বাস্তবকে সৌরজগতের সামগ্রিক বিবর্তনের প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে উপলব্ধি করার দৃষ্টিভঙ্গি এসেছে কান্টের কাজ থেকে।
এভাবেই প্রথম প্রকাশিত হল বস্তুর দ্বান্দ্বিকতা।
চেতনার ভূমিকা ও উৎপত্তির প্রশ্নে যান্ত্রিক বস্তুবাদ ছিল অক্ষম। কান্টের পর ফিখটে, শেলিং প্রমুখ ভাববাদীরা নানা আলোচনার মাধ্যমে দেখালেন যে, চিন্তা বা চেতনাই সমাজবদল ঘটায়। এবং সেই চিন্তা কোনও বস্তু বা বস্তুগত পরিবেশ থেকে আসে না। এভাবে ফের জায়গা নিল ভাববাদ।
কান্টের পর হেগেল এসেও এই চেতনার প্রশ্নটাকেই ধরলেন। তিনি জানালেন, সমাজ, বস্তু ইত্যাদি সবকিছু— অর্থাৎ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবকিছুর পিছনে আদিতে হচ্ছে পরম চেতনা (absolute idea), এবং তারই বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে বস্তুজগৎ ও সমাজ ইতিহাসের বিকাশ ঘটে।
কিন্তু— আবারও লেখকের কথায়— হেগেল এরকম দৃশ্যমান ভাববাদী অবস্থান নিলেও, অন্যান্য বহু ধারণার জন্ম দেওয়ার মধ্যে দিয়ে বস্তুবাদের আটকে থাকা পথ খুলে দেওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করলেন।
এইবার লেখক ঢুকলেন দ্বন্দ্বতত্ত্বের নীতি প্রণয়নের ইতিহাসে। নৈয়ামিক তর্কশাস্ত্রে (formal logic) আরিস্টটলের দেওয়া তিনটি মৌলিক নিয়ম সুদীর্ঘ সময় ধরে বস্তুজগৎ বোঝার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হত। এই তিন নিয়মের সহজ ব্যাখ্যা দিয়েই এ অংশের সূচনা। এতদিনকার যান্ত্রিক বস্তুবাদের সঙ্গে এই ফরমাল লজিকের গলায় গলায় মিলমিশ ছিল।
এখানেই দর্শনের ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিলেন হেগেল। তিনি শতাব্দীপ্রাচীন এই তিন নিয়মকে চ্যালেঞ্জ জানালেন এবং দেখালেন যে সদা গতিশীল বস্তু এবং নিয়মিত পরিবর্তনশীল ব্যবস্থার ব্যাখ্যা নৈয়ামিক তর্কশাস্ত্রের আরিস্টটলীয় লজিকের মধ্যে পাওয়া যায় না। কোনও বস্তু গতিশীল অবস্থায়, কোনও প্রদত্ত সময়বিন্দুতে, তার নির্দিষ্ট অবস্থান ধরে রাখা এবং ছেড়ে যাওয়ার এক জটিল সমন্বয়ের মধ্যে থাকে। ঠিক তেমনই কোনও পরিবর্তনশীল ব্যবস্থা, প্রদত্ত কোনও সময়বিন্দুতে, তার ঠিক সেই সময়ের পরিস্থিতিতে থাকে এবং তা থেকে বিবর্তিত হয়ে যাওয়ার এক আনুপাতিক সংশ্লেষের মধ্যে থাকে। ফর্মাল লজিক এই ক্ষেত্রে অচল।
এই পর্যায়ে হেগেল দর্শনের ক্ষেত্রে তিনটি নতুন ন্যায়শাস্ত্রীয় হাতিয়ার (logical tools) উপস্থাপন করলেন: বিরোধী সত্তার ঐক্য (unity of opposites); পরিমাণগত পরিবর্তন থেকে গুণগত পরিবর্তন (quantitative change to qualitative change); এবং মোচনের মোচন (negation of negation)। এই শেষ নিয়মটাকে লেখক অত্যন্ত সতর্কভাবে ব্যাখ্যা করেছেন যে, মোচনের মোচন আসলে দুবার মোচন নয়, এটি হল আসলে negation of negation of negation…— এক অবিরাম পদ্ধতি।
হেগেল দেখালেন— এবং লেখকও যথোপযুক্ত উদাহরণের মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন— যে এই তিন ন্যায়শাস্ত্রীয় নিয়মের সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে যে-কোনও প্রাকৃতিক, জৈবিক এবং সমাজ-ঐতিহাসিক গতি ও পরিবর্তন ব্যাখ্যা করা যায়। প্রত্যেক উদাহরণ দ্বন্দ্বতত্ত্বের বোঝাপড়ার জন্য অত্যন্ত সহায়ক। পরবর্তী সময়ে নিজে বস্তুবাদী হলেও তীব্র হেগেলপন্থী (left Hegelian) এঙ্গেলস লিখেছেন:
হেগেলীয় দ্বন্দ্বতত্ত্বের সারকথা হল: All that exists deserves to perish. এই সূত্রের সাহায্যে গতি বা পরিবর্তন প্রক্রিয়ার এগিয়ে চলার বৈশিষ্ট্য … বোঝা অনেক সহজ হবে।
মার্কসও তাঁর পুঁজি গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে কুটিরশিল্প বা গিল্ডের সমাজ থেকে শুরু করে পুঁজিবাদের বিকাশ এবং সমাজতন্ত্রের সম্ভাবনা পর্যন্ত সমাজের বিবর্তন হেগেলের দ্বন্দ্বতত্ত্বের নিয়মে নির্ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা যায় বলে দেখান। ফলে, নিজে পুরোদস্তুর ভাববাদী হলেও হেগেলকে লেখক উল্লেখ করেন ‘much more resolute materialist than the modern natural scientists’ (Engels) হিসাবে। ফলে বামপন্থী হেগেলিয়ান মার্কস-এঙ্গেলস বুঝেছিলেন যে— লেখকের ভাষায়— হেগেলের দর্শন যদিও ভাববাদী, তবুও এটি একটি অগ্রগতি, যা ক্রমশ বস্তুবাদী দর্শনের নিকটবর্তী হচ্ছে।
এখানে বলা দরকার যে, হেগেল-পূর্ব যে দার্শনিকরা দ্বান্দ্বিক তত্ত্বের আভাস দিয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়— যেমন আমরা রাহুল সাংকৃত্যায়ন থেকে রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য প্রমুখের লেখাতেই পাই— প্রাচীনকালে হেরাক্লিতাস, আরিস্ততল, গৌতম বুদ্ধ প্রমুখ, কিংবা আধুনিককালে কান্ট, ফিখটে ইত্যাদি— তাঁরা কেউই দ্বান্দ্বিক বিচারের এমন কোনো ন্যায়শাস্ত্রীয় হাতিয়ার তৈরি করতে পারেননি, যার মাধ্যমে নিয়ত গতিমান ও পরিবর্তনশীল বস্তুজগতের সঠিক ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব হত। এই বিষয়টি কিন্তু অনেক মার্কসীয় দ্বন্দ্ব আলোচকই বিবেচনায় আনে না।
লেখক অত্যন্ত লক্ষণীয়ভাবে তুলে আনেন লেনিনের হেগেল-চর্চার নিদর্শনও। লেনিন হেগেলের intelligent idealism-কে rigid, metaphysical বা crude materialism (যাঁকে তিনি stupid materialism আখ্যা দিয়েছেন)-এর চেয়ে বেশি সমীপবর্তী মনে করেছিলেন intelligent materialism-এর। অর্থাৎ, হেগেলীয় দ্বন্দ্বের ধারণা প্রকৃত অর্থে বস্তুবাদের অগ্রগতির সহায়ক হবে, সে বিষয়ে মার্কস-এঙ্গেলসের দিশা যথাযথ ছিল এবং সে বিষয়ে লেনিনও পুরোপুরি সহমত।
উপরন্তু, লেনিন এও লক্ষ করেন যে “হেগেলের যে পরম ভাব (absolute idea)-এর ব্যাখ্যা— সেখানেই তিনি সবচাইতে দৃঢ়ভাবে বস্তুবাদী বক্তব্য পেশ করেছেন” (লেখক)। একবারের জন্যও সেখানে হেগেল ‘ঈশ্বর’ (God) বা ‘স্বর্গীয়’ (divine) ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করছেন না। কোনওরকম ভাববাদী ধারণা প্রতিষ্ঠার বন্দোবস্ত না করে, হেগেল তাঁর দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির আলোচনার ওপরেই সর্বাধিক জোর দিয়েছেন।
এই অংশের উদ্ধৃতিও সযত্নে তুলে আনবার জন্য লেখককে আমাদের হার্দিক ধন্যবাদ।
যাই হোক, বামপন্থী হেগেলিয়ান পর্ব শেষে মার্কস-এঙ্গেলস সরাসরি ফয়ারবাখের ভাবশিষ্য হয়ে পড়েন। এই সময় থেকেই বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও সামাজিক বিষয় ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে তাঁরা স্পষ্টভাবে ফয়ারবাখের শরণাপন্ন হতে শুরু করেন। তবে ক্রমশ বাস্তব সমাজ ও অর্থনীতির বিশ্লেষণে ঢোকার চেষ্টা করতে গিয়ে দেখেন যে, ফয়ারবাখের বস্তুবাদ অনেকটাই abstract, এবং একসময় তাঁরা বুঝতে পারেন যে, শুধু ফয়ারবাখ দিয়ে সব ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। হেগেলের দ্বন্দ্বতত্ত্ব অপরিহার্য। কারণ চেতনার প্রশ্নকে তিনিও যথাযথভাবে বিবেচনা করতে পারছেন না।
মার্কসের উদ্ধৃতি পাই এরপর: এতদিনকার যাবতীয় বস্তুবাদী তত্ত্বের মূল দুর্বলতা হল— তারা কেউই চিন্তা প্রক্রিয়ার স্ব-সক্রিয়তার দিকটাকে বিচারে আনেননি। অথচ, তাঁদের মতে, চেতনার একটি সীমিত অর্থে হলেও স্বাধীন সক্রিয় ভূমিকা আছে, যা আগেকার কোনো বস্তুবাদে ধরা হয়নি।
অন্যদিকে, ভাববাদীরা চেতনার দিকটি ধরেছেন ও বিকশিত করেছেন। কিন্তু তাঁরা চেতনার বা ভাবের বিষয়টিকে পরম বা নির্বিশেষ ধরে নিয়েছেন, অর্থাৎ তা বস্তুর সঙ্গে সংশ্লেষহীন। ফলে মার্কস-এঙ্গেলস চাইছিলেন এমন এক বস্তুবাদের সূচনা যেখানে চেতনার ভূমিকাও স্পষ্টভাবে অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি উদ্ধৃতি তুলে ধরেছেন লেখক:
Consciousness can never be anything else than conscious being.[2]
অর্থাৎ, অস্তিত্ব ছাড়া চেতনার অভিজ্ঞতা অবাস্তব। অশোকদা লেখেন: ‘ভারতীয় প্রাচীন দর্শনের পরিভাষায় বলা যেতে পারে, চিৎ-বস্তুর অস্তিত্ব ব্যতিরেকে চেতনার অস্তিত্ব নেই।’ এছাড়া:
It is not consciousness that determines life, but life that determines consciousness.[3]
তাঁরা এ-ও দেখাতে চাইলেন, যদিও চেতনার দ্বারা সামাজিক অস্তিত্ব নির্ধারিত হয় না, তবুও সামাজিক অস্তিত্বের ওপর চেতনার একটি সক্রিয় প্রভাব আছে। এইভাবে প্রতিষ্ঠিত হল মার্কসবাদী বা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের ভিত।
লেখক উল্লেখ করেন, ১৮৪৪ সালের নাগাদ মার্কস-এঙ্গেলস তাঁদের কাঙ্ক্ষিত দার্শনিক লক্ষ্য প্রায় স্থির করে ফেলেন। তাঁরা নির্ধারণ করলেন যে চিন্তার ভিত্তিটা হবে বস্তুবাদ, এবং চিন্তার পদ্ধতিটা হবে দ্বন্দ্বমূলক। ফলে, দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদেও তাঁরা দ্বন্দ্বতত্ত্বের অংশ হিসেবে হেগেলীয় বিশ্লেষণাত্মক তিন নিয়ম বা হাতিয়ার গ্রহণ করেন।
এখানে লেখক হেগেলীয় ত্রিত্ব বা Hegelian triad সম্পর্কিত বহুল প্রচলিত কিছু সরল ব্যাখ্যার স্বরূপ উন্মোচন করেছেন। সাধারণভাবে বলা হয়ে থাকে, স্থিতি (thesis) এবং অস্থিতি (antithesis)-র মধ্যে দ্বন্দ্বসংঘাতের মাধ্যমে সংস্থিতি (synthesis) জন্মায়। কিন্তু লেখকের মোক্ষম মন্তব্য: “হেগেল থেকে শুরু করে মার্কস-এঙ্গেলসের লেখাতে কোথাও কোনও triad আলোচনা নেই।… মানে এই দ্বন্দ্বমূলক নীতির প্রসঙ্গে নেই।”
এ-প্রসঙ্গে ফিখটের কথা উল্লেখযোগ্য, যিনি কান্টের প্রতিসত্তা (antinomy)–র পরিবর্তে দ্বন্দ্বসংঘাত (contradiction)-এর ধারণা আনেন। লেখক বলছেন, “এই দ্বন্দ্বসংঘাতে দুটো বিপরীত শক্তিকে বোঝাতে গিয়ে অনেক জায়গায় থিসিস-অ্যান্টিথিসিসের ব্যবহার শুরু হয়ে গেল।” তবে, ফিখটের এই প্রস্তাবনা হেগেলে নেই, এবং মার্কসেও নেই। কোনও বিষয়ে থিসিস-অ্যান্টিথিসিসের দ্বন্দ্বসংঘাতের ফলে, কোনও একটি পক্ষ স্বাভাবিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে; পরিমাণগত পরিবর্তন বাড়তে বাড়তে একসময় গুণগত পরিবর্তন ঘটে। কখনও থিসিস-অ্যান্টিথিসিসের একটি প্রধান হয়ে ওঠে, আবার কখনও দুটোই অপসৃত হয়ে নতুন কোনও কিছু জন্মায়।
অতএব, হেগেলীয় দ্বন্দ্বসংঘাতের ব্যাখ্যায় “সিন্থেসিস” নামে কোনও ধারণা আদৌ নেই। কারণ, এই সিন্থেসিসের ধারণা আসলে একটি বদ্ধ (closed) পরিণতির (conclusion) কথা বলে। থিসিস-অ্যান্টিথিসিসের মেলামেশা হয়ে খানিক এর খানিক ওর থেকে নিয়ে একটা ফাইনাল আউটকাম যেন এই সিন্থেসিস, যা আসলে হেগেলের তৃতীয় নিয়ম, মোচনের মোচন (negation of negation)-কে অস্বীকার করে।
আসলে “হেগেল দেখাতে চেয়েছিলেন, দুনিয়ায় যা কিছু আছে, সংঘাত নিয়েই আছে।… তার অন্তর্লীন সত্তার গভীরে দুই বিপরীত শক্তির ঐক্য বা অভেদ রূপেই সে আছে। আবার এই দুই বিপরীত শক্তির মধ্যেকার চলমান নিরন্তর সংঘাতের ফলেই তার মধ্যে পরিবর্তনের প্রক্রিয়া কাজ করে চলে।” (লেখক)
লেখক দেখিয়েছেন যে সামাজিক ঐতিহাসিক ও প্রকৃতির বিষয়ে— দুই ক্ষেত্রেই দ্বন্দ্বসংঘাতের ধারণা প্রযোজ্য হলেও তা একই অর্থে নয়। মাও-এর On Contradiction থেকে antagonistic এবং non-antagonistic contradiction-এর ধারণা উদ্ধৃত করে তিনি বলেন যে, প্রকৃতির ক্ষেত্রে এই বৈরিমূলক সম্পর্কযুক্ত দ্বন্দ্বসংঘাতের আসলে কোনও অস্তিত্ব নেই। অনুষঙ্গে একাধিক সহজবোধ্য দৃষ্টান্ত দিয়ে তিনি এই মতের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যা দেন। এবং এ প্রসঙ্গে মাও সে-তুং-এরই লেখা উল্লেখ করেছেন, যেখানে দেখানো হয়েছে যে দ্বন্দ্বসংঘাতের অস্তিত্ব সর্বজনীন (universal) হলেও তার চরিত্র বিশেষ (particular)— প্রকৃতির ক্ষেত্রে একরকমভাবে, সমাজের ক্ষেত্রে অন্যরকমভাবে। লেনিনের উদ্ধৃতিও আসে:
Antagonism and contradiction are not at all one and the same. Under socialism the first will disappear but the second will remain.
লেখক আদিম সাম্যবাদী সমাজ থেকে শুরু করে শ্রেণিবিভক্ত সমাজ এবং আগামীর সাম্যবাদী সমাজের ক্ষেত্রে দ্বন্দ্বসংঘাতের ধারণার সঠিক প্রয়োগের বিশ্লেষণও দিয়েছেন। সরাসরি উদ্ধৃতি দিতে লোভ হয়:
আসলে আমাদের যেটা সমস্যা হয় সেটা হল, যা কিছু পরস্পরবিরোধী তাকেই আপাতদৃষ্টিতে শত্রুতামূলক বলে মনে হয়। আমরা যাকে প্রাকৃতিক দুর্ঘটনা বলি, তা আসলে বিশুদ্ধ প্রাকৃতিক ঘটনা। ঘূর্ণিঝড়, সুনামি, ভূমিকম্প, বজ্রপাত, বন্যা, নদীভাঙন ইত্যাদি কোনও কিছুই প্রকৃতির স্বাভাবিক ঘটনা ও নিয়মের বাইরে গিয়ে মানুষকে শত্রু হিসাবে ভেবে বিশেষ লক্ষ্য নিয়ে ঘটে না। পরিবেশ নিয়ে ভাবনা, চিন্তা এবং আন্দোলন করতে গিয়ে আমরা এখন বুঝতে পারছি— প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের দ্বন্দ্বের চরিত্র বৈরিমূলক নয়, মিলনাত্মক রূপে দেখতে এবং গড়ে তুলতে হবে। আবার পজিট্রন ইলেকট্রনকে শত্রু ভেবে আক্রমণ করে বসে না। এটা না বুঝলে, এরকম কিছু ঘটতে দেখলেই আমাদের মনে হয়, এটা হচ্ছে বিরোধাত্মক দ্বন্দ্বসংঘাত। এগুলোর মধ্যে একটা বিপরীত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া আছে। কিন্তু এগুলোর কোনওটাই দ্বন্দ্বতত্ত্বের মাও-কথিত ওই বিরোধাত্মক এবং মিলনাত্মক দ্বন্দ্বসংঘাতের আওতায় পড়ে না।
এক কথায়,
যেখানে কারও কোনও সচেতন ভূমিকা নেই, সেখানে কোনওভাবেই বিরোধাত্মক এবং মিলনাত্মক দ্বন্দ্বসংঘাতের বিভাজন দিয়ে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যাবে না।
এত পরিচ্ছন্ন, খুঁটিয়ে করা ব্যাখ্যা খুব কম পড়েছি আমি।
এরপর মাও-অনুসারে পরিবর্তনের মূল কারণ হিসেবে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বসংঘাত এবং পরিবর্তনের শর্ত হিসেবে এক বা একাধিক বাহ্যিক দ্বন্দ্বসংঘাতের ধারণা উল্লেখিত হয়। উদাহরণ হিসেবে মাও-এরই দেওয়া মুরগির ডিমে বাচ্চা ফোটানোর প্রক্রিয়া দ্বারা বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়। এর সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে এলবীজ থেকে গাছের উদ্ভবের দৃষ্টান্ত।
এরপর এই জ্ঞানের প্রয়োগে লোকপ্রিয় বিবৃতি “বিপ্লব রপ্তানি করা যায় না” সহজভাবে ব্যাখ্যা করা হয়। প্রায়োগিক ক্ষেত্রে দেখা যায় কিউবায় বিপ্লব এবং বলিভিয়ায় চে গেভারার মতো একজন সর্বস্ব পণ করা জ্ঞানী ও বুদ্ধিদীপ্ত বিপ্লবীর উপস্থিতিতেও বিপ্লব স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংগঠিত হয় না।
মার্কসের ক্যাপিটাল লেখার প্রেক্ষাপট এবং এঙ্গেলসের অ্যান্টিডুরিং ও প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা রচনার পরম্পরা বিশদে আলোচিত হয়েছে। এতে এসেছে নারদনিকদের বিপক্ষে প্লেখানভের মতাদর্শগত লড়াইয়ের কথাও, যার মাধ্যমে রাশিয়ার প্রেক্ষাপটে জমিদার ও চাষির মধ্যেকার দ্বন্দ্বসংঘাত, কুলাক বনাম গরিব চাষির শ্রেণিদ্বন্দ্বে পরিবর্তিত হওয়ার ক্ষেত্র নিখুঁতভাবে চিহ্নিত ও ব্যাখ্যাত হয়েছে।
ইতিহাসের আরেকটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ দৃষ্টান্ত উল্লেখ করেছেন লেখক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে, ১৯১৬ সালে, লেনিন সুইজারল্যান্ডে পাঁচটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজন করেছিলেন শুধুমাত্র এক জরুরি ও জায়মান দ্বন্দ্বসংঘাত চিহ্নিত করার উদ্দেশ্যে। তাঁর বক্তব্য ছিল, সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে এক দেশের বুর্জোয়ারা অন্য আর এক দেশের বুর্জোয়া, সেই দেশের শ্রমিক এবং নিজের দেশেরও শ্রমিক— এই তিন পক্ষের বিরুদ্ধে এক সঙ্গে লড়ছে। এই দ্বন্দ্বসংঘাতের প্রকৃতি বোঝা অত্যন্ত জরুরি।
এমন এক সম্ভাবনাময় পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে লেনিন বলেন, “আমাদের কাজ হচ্ছে আমাদের দেশের শ্রমিক-কৃষক শ্রেণির হাতের রাইফেলটা শাসকশ্রেণির দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া।” লক্ষণীয়, অন্য কোনও দেশের শ্রমিকদের জন্য লেনিনের এই বক্তব্য যথাযথ অর্থবোধে ধরা দেয়নি, এবং সেই কারণেই সেসব দেশে বিপ্লব সুষ্ঠুভাবে সংঘটিত হয়নি। কিন্তু রাশিয়ার মানুষ তাঁর বক্তব্য বুঝতে পেরেছিল, তাই সুযোগ আসা মাত্র বিপ্লব ঘটে যায়। রাশিয়ান সৈনিকেরা— কারখানার শ্রমিক বা গ্রামের চাষি— যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সশস্ত্র ফেরার পথে নিজের দেশের, অর্থাৎ রাশিয়ারই শাসকদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তোলেন। এর প্রতিক্রিয়ায় ফেব্রুয়ারিতে জারের পতন ঘটে এবং নভেম্বরে নতুন বুর্জোয়া সরকারের পতন ঘটে। লেখক মন্তব্য করেন: “অন্তত এখন আমরা বলতে পারি, তিনি আলোচ্য দ্বন্দ্বসংঘাতটিকে ঠিক মতো ধরতে পেরেছিলেন।”
যদিও, লেখক আর একদল বামপন্থী বুদ্ধিজীবীর কথাও উল্লেখ করেছেন, যাঁরা মনে করেন যে লেনিনের বিপ্লব তত্ত্বটি সম্পূর্ণ ঠিক নয়। তাঁদের যুক্তি অনুযায়ী, মার্কসের তত্ত্বানুসারে রাশিয়ায় তখন বিপ্লব হওয়ার কথা নয়। একইভাবে, চিনেও বিপ্লব হওয়ার কথা ছিল না; সেখানে স্রেফ রাশিয়ার অনুকরণ ঘটেছে। অন্যদিকে, লেনিন ও/বা স্তালিনের একনিষ্ঠ ‘ভক্ত’ মূল ধারার কমিউনিস্টরাও লেনিনের ‘সৃজনশীল’ মার্কসবাদের নিশ্চিত অভ্রান্ততা এবং সমালোচকদের প্রতিক্রিয়াশীল বা বুর্জোয়া প্রচারে প্রভাবিত বলে দায় সারেন, লেখকের ভাষায়।
এই দুই পক্ষই আসলে এ দুই দেশে এই আমূল বদলের পেছনের রাজনীতি, দর্শনের সংযুক্ততা, এবং লেনিন ও মাও তাঁদের সময় অনুযায়ী কীভাবে প্রয়োগ করেছিলেন তা পর্যবেক্ষণ করেননি। লেনিনের নভেম্বর বিপ্লবের মতোই মাওয়ের নেতৃত্বে লং মার্চের পিছনে ছিল আন্তর্জাতিক রাজনীতির সক্রিয় দ্বন্দ্বসংঘাতের নিবিড় পাঠ। ফলে, চিন ও ভারতে একই বছরে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে ওঠা সত্ত্বেও, এবং দুই পার্টির কর্মীসংখ্যাও প্রায় সমান থাকা সত্ত্বেও, চিনে বিপ্লব ঘটে, আমাদের দেশে তেমন কিছুই হয় না। লেখকের মতে, এ-দেশের কর্মী ও নেতারা সংশ্লিষ্ট দ্বন্দ্বসংঘাতগুলো সঠিকভাবে বুঝতে পারেননি। অর্থাৎ, লেখকের ভাষায়: “দ্বন্দ্বতত্ত্ব, দ্বন্দ্বসংঘাত তত্ত্ব এবং শ্রেণিসংগ্রাম বিকাশের তত্ত্ব— এগুলো বোঝার সঙ্গে বিপ্লবের বাস্তব কাজকর্মের দিকটি একদম ওতপ্রোতভাবে যুক্ত রয়েছে।”
এ-প্রসঙ্গে লেনিনের একটি উদ্ধৃতিও আসে:
সমাজতন্ত্রে দ্বন্দ্বসংঘাত থাকবে, কিন্তু সংঘর্ষের সম্ভাবনা বিলীন হয়ে যাবে।
লেখক খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করে দেখান যে দ্বন্দ্বতত্ত্বের বিপরীতের ঐক্য সূত্রে, ঐক্যই স্থায়ী ও শর্তহীন, আর সংগ্রাম অস্থায়ী এবং শর্তাধীন।
এরপর আমরা জানতে পারি, দ্বন্দ্বতত্ত্বের দ্বিতীয় নিয়ম বা পরিমাণ থেকে গুণগত পরিবর্তন নাকি আধুনিক কেওস তত্ত্বের সাহায্যে গাণিতিকভাবে নির্ণয় করা সম্ভব। Non-linear thermodynamics-এর উদ্গাতা ইলিয়া রোমানোভিচ প্রিগোজিনের উদ্ধৃতিতেও মার্কস-এঙ্গেলসের প্রতি সসম্ভ্রম প্রকাশ পায়।
এরপর আসে বিজ্ঞানের আরেক উদীয়মান ক্ষেত্র স্ব-গঠন (self-organization)— নেবুলার মহাজাগতিক ধূলিকণা থেকে নক্ষত্র ও গ্রহের উৎপত্তি। এটি আসলে এক ধরনের বস্তু থেকে পরিমাণগত পরিবর্তনের মাধ্যমে অন্য জটিল ধরনের বস্তুতে স্বয়ংক্রিয় গুণগত পরিবর্তনের প্রক্রিয়া। এভাবে মোচনের মোচন নীতিকেও বারংবার যাচাই করা যায়, প্রাকৃতিক ও সমাজ-ঐতিহাসিক উদাহরণের মাধ্যমে।
লেখকের চূড়ান্ত মন্তব্য: “দ্বন্দ্বতত্ত্বের প্রবর্তিত তিনটি নীতির দ্বারা পরিবর্তন প্রক্রিয়ায় সূত্রপাত, অগ্রগতি ও পরিণতি— এই তিনটি ধাপকে দার্শনিক প্রেক্ষিতে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে।”
আর একটু খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়: “প্রথম নীতি দ্বারা গতি বা পরিবর্তনের কারণ বা উৎস নির্দেশিত হয়। বস্তু গতিশীল কেন? তার মধ্যে গতি ও স্থিতির দ্বন্দ্বসংঘাত চলছে। দ্বিতীয় সূত্রের সাহায্যে দেখানো হয় গতি বা পরিবর্তনের প্রক্রিয়াকে। কীভাবে পরিবর্তন হচ্ছে? প্রথমে অল্প অল্প করে, তারপর বেশি বেশি করে। এইভাবে এক সময়ে আগের বস্তুসত্তার আপন বৈশিষ্ট্যের মৌলিক পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। তৃতীয় নিয়মটির মধ্যে রয়েছে পরিবর্তনের অভিমুখ বা দিকনির্দেশ। যে কোনও যথার্থ পরিবর্তন একটি একমুখী (unidirectional) ও অপ্রত্যাবর্ত্য (irreversible) প্রক্রিয়া বা পরিঘটনা।… পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় পেছন দিকে ফিরে যাওয়ার উপায় থাকছে না।”
অতএব, বস্তুজগৎ বা সমাজ-ইতিহাসকে দার্শনিকভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য নির্মিত logical tools বা যুক্তিশাস্ত্রীয় হাতিয়ার হল দ্বন্দ্বতত্ত্বের এই তিন নীতি।
গোটা আলোচনাতেই নজরে পড়ে এক অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য দৃষ্টিভঙ্গি। লেখক দ্বন্দ্বতত্ত্বের বিষয়ে লেনিনের বিভিন্ন সময়কার লেখার তুলনা করে সত্যিকারের লেনিনকে— বা তাঁর প্রকৃত অবস্থানকে— বিভিন্ন আপাত বিচ্যুতিকে পেরিয়ে তুলে ধরতে চান। একইভাবে, মাও-এরও— লেনিনের সেইসব আপাত বিপরীত কথাগুলো ধরে— খানিক ভুল বোঝার বিষয়টি লেখক বিশ্লেষণ-সহ ব্যাখ্যা করেছেন। অনুষঙ্গে তিনি মার্কস-এঙ্গেলসের বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক বক্তব্য, হেগেলের ব্যাখ্যা, জেবিএস হলডেনের বক্তৃতা ইত্যাদি থেকে গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ তুলে ধরেছেন। এবং শেষত দেখিয়েছেন যে হেগেলের দ্বন্দ্বতত্ত্বের তিন নিয়ম প্রকৃতপক্ষে তিনটি ন্যায়শাস্ত্রীয় হাতিয়ার, কোনও একটিকে প্রধান বা একমাত্র হিসেবে দেখা সঠিক নয়। তিনি আরও স্পষ্ট করেছেন যে এই তিন নিয়ম দর্শনের ক্ষেত্রে একমুখিতা (monism) নির্দেশ করে না, বরং ত্রিমুখিতা (triplism) জন্ম দেয়— যা ছিল মাওয়ের বীক্ষণ, লেখক সেটিকেও ভুল হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন।
এভাবে লেখক মূল তত্ত্বকে কেন্দ্রে রেখে ইতিহাসের বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে নিদর্শন সংগ্রহ করেছেন, এবং যাঁরা তত্ত্বের নির্মাণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন তাঁদের লেখাপত্র বিশ্লেষণ করেছেন। দেশ-কালের পরিবর্তন ও মানুষের জ্ঞানার্জনের ধারাবাহিকতার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে তিনি নিজেকে নির্ভুল প্রমাণ করেছেন, সকল বিবৃতি ও বিশ্লেষণকে তথ্য-যুক্তির নিকষে যাচাই করে। বস্তুবাদী ঝোঁক এবং মার্কসবাদী দ্বান্দ্বিকতায় আস্থা থাকলেও তা কোনও অন্ধনিষ্ঠার দিকে যায় না; ফলে পাঠকও নিজের জানাকে তথ্য ও যুক্তির আলোকে ক্রমাগত মূল্যায়ন করতে উদ্বুদ্ধ হন।
লেখক বিপরীতের ঐক্য সূত্রের ব্যাখ্যার প্রয়োজনে মার্কসীয় সাহিত্যে দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত কিছু উদাহরণ ও তাদের মধ্যেকার অসঙ্গতি এবং সম্ভাব্য সমাধানও তুলে এনেছেন। এর পর একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য আসে: “বস্তু বা ঘটনার বিবৃতি হচ্ছে ফরমাল লজিকের আওতাভুক্ত। সেখানে বৈপরীত্যের ঐক্য থাকার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। এমনকি একজন দ্বান্দ্বিক তর্কশাস্ত্রীর কাছেও নয়। কিন্তু যখনই আমরা প্রক্রিয়া বা সম্পর্কের মধ্যে ঢুকব, যেখানে গতি বা পরিবর্তনের প্রশ্ন আছে, সেখানে দ্বান্দ্বিক যুক্তিশাস্ত্রের প্রয়োগ শুরু করতে হবে।”
বইয়ের শেষের আগের অধ্যায়ে লেখক মার্কসবাদ সংক্রান্ত কিছু জনপ্রিয় অতি ও/অথবা ঊনকথা তুলে ধরেছেন এবং সেগুলোর সম্ভাব্য নিরসন প্রস্তাব করেছেন। তবে তিনি সঙ্গে সঙ্গেই প্রস্তাবনাগুলোকে নানান দিক থেকে প্রামাণ্যতা যাচাইয়ের মধ্যে নিয়েছেন। লেখকের কথায়:
মার্কসবাদ নিজেই একটি বিজ্ঞান নয়। মার্কসবাদ সকল বিজ্ঞানের বিজ্ঞানও নয়। … কিন্তু মার্কসবাদ অবশ্যই একটি বৈজ্ঞানিক দর্শন।
প্রসঙ্গত এসেছে মার্কসের উক্তি:
Natural science will, in time, subsume the science of man, just as the science of man will subsume natural science — there will be one science.
লেখক অত্যন্ত যৌক্তিক পদ্ধতিতে দেখিয়েছেন যে, মার্কসের এ-কথার আসল তাৎপর্য হল: প্রকৃতি বিজ্ঞানের মতোই মানুষের সামগ্রিক সামাজিক জীবন-নির্ভর সমাজবিজ্ঞানও একই বৈজ্ঞানিক বিচারপদ্ধতির ওপর দাঁড়াবে। বিষয়বস্তুতে আলাদা হলেও চিন্তা ও বিচারপদ্ধতির দিক থেকে এই দুই ক্ষেত্রের মধ্যে আর কোনও পার্থক্য থাকবে না। অর্থাৎ, “one science” বলতে গিয়ে মার্কস এখানে এক সঠিক বিজ্ঞানসম্মত দর্শনকেই বুঝিয়েছেন। এঙ্গেলসও বলেছেন:
That which still survives, independently, of all earlier philosophy is the science of thought and its laws — formal logic and dialectics. Everything else is subsumed in the positive science of nature and history.
অর্থাৎ, জ্ঞানের রাজ্যে একটাই দৃষ্টিভঙ্গি থাকবে, এবং চর্চিত হবে তারই দর্শন।
কিন্তু মার্কস-কথিত এই one science-ই কি তাহলে মার্কসবাদ? লেখক অত্যন্ত সুকৌশলে স্পষ্ট করেছেন যে, এর উত্তর একাধারে হ্যাঁ এবং না। যে কোনও তত্ত্ব, মতবাদ, পরিঘটনা ইত্যাদির বিশ্লেষণের একটি সামগ্রিক তত্ত্বকাঠামো-স্বরূপ বিজ্ঞান হল মার্কসীয় দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ। কিন্তু, তিনি যোগ করেন, মার্কসবাদ শুধুই চিন্তাপদ্ধতির বিজ্ঞান বা জ্ঞানতত্ত্বই নয়। মার্কসবাদের আরেকটি বড় অংশ হল ঐতিহাসিক বস্তুবাদ, যার আবার অন্তত তিনটি উপবিভাগ— ইতিহাস; রাষ্ট্রিক অর্থনীতি; এবং সমাজতত্ত্ব।
এই তিনটি ক্ষেত্র মূলত মার্কসীয় চিন্তাপদ্ধতির বিশেষ বিশেষ প্রয়োগের উদাহরণ। লেখক বলেন, দর্শন, অর্থনীতি, ইতিহাস ও সমাজতত্ত্ব— প্রত্যেক ক্ষেত্রেই মার্কসবাদের তাত্ত্বিক সিদ্ধান্তগুলো সুনির্দিষ্ট তথ্যসাপেক্ষে বিবেচনাযোগ্য, এবং অসঙ্গতি থাকলে বাতিলযোগ্য, অর্থাৎ পপারের criterion of falsifiability মার্কসবাদের ক্ষেত্রে নির্ভুলভাবে প্রযোজ্য। একটা চমকপ্রদ বিবৃতি দিয়ে এই আলোচনা শেষ হয়:
মার্কসবাদকে বিজ্ঞান বললে তার যতটা সম্মান হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি মর্যাদায় তাকে ভূষিত করা যায় তাকে একটি বৈজ্ঞানিক দর্শন বললে।
এভাবে সমস্ত বিষয়গুলো সহজগম্য ও বুদ্ধিগ্রাহ্য হয়ে ওঠে।
এরপর কর্নফোর্থকে উদ্ধৃত করে বিজ্ঞানের ভিত্তিভূমি পর্যবেক্ষণ (observation) না পরীক্ষণ (experimentation)— এই বিষয়টি বিশদে আলোচিত হয়। প্রসঙ্গটিকে লাইসেঙ্কো এবং তাঁর ওপর অন্ধ সমর্থন জুগিয়ে চলা স্তালিন পর্যন্ত টানা হয়েছে, যে বিভ্রান্তি কর্নফোর্থকেও সংক্রামিত করে। এই অনুষঙ্গেই আসে মার্কসের এক বহুপ্রচলিত ও প্রতাপশালী মন্তব্য:
এত দিন দার্শনিকরা দুনিয়ার ব্যাখ্যা বদল করেছেন, এবার দুনিয়াকেই বদল করতে হবে।
তবে লেখক বলেন, মার্কসের এই সঠিক বক্তব্যকেও চূড়ান্ত বাড়াবাড়ির জায়গায় নিয়ে গিয়ে তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের গুরুত্বকে খর্ব করার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। এই প্রসঙ্গে লেনিন, প্লেখানভ, স্তালিন ও হলডেনকে উদ্ধৃত করে বিশ্লেষণ এগোয় এবং স্বচ্ছ সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে:
Marxism is an integral world outlook. (প্লেখানভ)
এখানে বোঝাতে চাওয়া হয় যে, যথোপযুক্ত সঠিক তত্ত্ব এবং প্রয়োজনীয় কার্যকর ও উদ্দেশ্যপূর্ণ অনুশীলনে সঠিক সাযুজ্যই মার্কসবাদের শক্তি। “Theory of everything”-এর Marxist analogue নির্মাণ মার্কসবাদীদের কর্তব্য হতে পারে না। কোনও “দর্শনের আলো যতই উজ্জ্বল হোক, তা দিয়ে বিজ্ঞানের শাখাগুলির সমস্যা সম্পূর্ণ সমাধান করা সম্ভব নয়; তার জন্য বিজ্ঞানের সেই সব শাখাকেই লাগবে।” এঙ্গেলসের কথায়—
Philosophy is therefore ‘sublated’ here, that is, ‘both overcome and preserved’; overcome as regards its form, and preserved as regards its real content.[4]
একে পরবর্তীতে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির নেতা আন্দ্রেই ঝদানভ এক ভিন্ন দিক থেকে ব্যাখ্যা করেছেন, লেখক উদ্ধৃত করেন:
Marxist philosophy, as distinguished from preceding philosophical systems, is not a science above other sciences, rather, it is an instrument of scientific investigation, a method penetrating all natural and social sciences, enriching itself with their attainments in the course of their development.
লেখকের ভাষায় ছবিটা পরিষ্কার হয়ে আসে— “মার্কস-কথিত এক-বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি এখন জ্ঞানের জগতের অপরিহার্য হাতিয়ার। আধুনিক জ্ঞানের চর্চায় ‘হয় এটা, নইলে ওটা’ এখন আর সুবিধাজনক মন্ত্র নয়; এখনকার কার্যকর মন্ত্র হচ্ছে ‘এটাও এবং ওটাও’। পরিমাণগত থেকে গুণগত পরিবর্তন। যা রয়েছে তাকে ভেঙে ফেলেই আগামী নতুনের উদ্গম ঘটছে। ভালো করে সঠিকভাবে বুঝতে গেলেই অনেক জিনিসকে মিলিয়ে যুক্ত করে বুঝতে হচ্ছে।”
শেষ অধ্যায়ে আসে মার্কসবাদীদের মধ্যে প্রয়োজনীয় বৈজ্ঞানিক মনোভাব সম্পর্কিত আলোচনা। লেখক স্তালিনকে উদ্ধৃত করে, তবে তাঁকে অতিক্রম বা একভাবে অস্বীকার করেই বলেন যে, মতান্ধ (dogmatic) মার্কসিজম বলে কিছুর অস্তিত্ব থাকাই অসম্ভব। ফলে আলাদা করে সৃজনশীল (creative) মার্কসবাদ বলে কোনও উল্লেখও অযৌক্তিক।
এই অনুষঙ্গে উঠে আসে তিন ধরনের বিচ্যুতির কথা: মতান্ধতা (dogmatism); শোধনবাদ (revisionism); এবং সে দুই দিক বাঁচিয়ে অতিসরলীকরণ বা তরলতার বিচ্যুতি। লেখক এখানে মার্কসবাদী মহলে প্রায় ভুলে যাওয়া মানবেন্দ্রনাথ রায়ের মূল্যবান কাজের উল্লেখও করেছেন। এখান থেকেই তিনি পৌঁছান আজকের সময়ে, অর্থাৎ পৃথিবীব্যাপী বাম শিবিরের পশ্চাদপসরণের ক্রান্তিকালে, এবং তুলে ধরেন অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিপাদ্য। তিনি বলেন: “আমাদের অনেকের সঙ্গেই অনেকের সব ব্যাপারে মিল নাও থাকতে পারে। আমাদের একটা বৃহত্তর ক্যাম্প আছে। যে ক্যাম্পে আমরা সবাই মিলে আছি। ফ্যাসিবাদের সামনে পড়ে আমরা যাদের সঙ্গে ঐক্য চাইছি, এক সঙ্গে কাজ করতে চাইছি। সত্যিই এটা চাইলে আগে আমাদের পুরনো ভাবনার ধরন এবং অভ্যাস পাল্টাতে হবে।… সত্যি করেই একটা মৌলিক বা বিশুদ্ধ চিন্তাধারা আছে, সেটা যেটাই হোক। কারণ, একটা মতাদর্শ আছে, একটা চিন্তাধারা আছে মানেই তার একটি সত্য-মিথ্যার প্রশ্ন আছে। সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকে কেন্দ্র করে একটা বিশুদ্ধতা রক্ষারও প্রশ্ন আছে। কিন্তু এখন যেটা আমাদের ভাবা উচিত বা যেভাবে জিনিসটা দেখা উচিত, তা হল, আমারটাই বিশুদ্ধ নাও হতে পারে, অন্যদেরটাও হতে পারে। আবার যেটাই শুদ্ধ মার্কসবাদ হোক, তার বাইরেও নানা কারণে নানারকম ঝোঁক থাকে। কোথাও ডগম্যাটিক হওয়ার ঝোঁক থাকবে, কোথাও শোধনবাদের দিকে ঝোঁক থাকবে। এটা আমাদের ধরে নিতে হবে। এখানে আমি সচেতনভাবেই ‘বিচ্যুতি’ না বলে ‘ঝোঁক’ কথাটি ব্যবহার করছি।… এটা যদি আমরা ধরে নিতে পারি, তাহলে আমাদের শিবির অনেক বড় হবে। এবং বড় হলেই একমাত্র এ শিবিরটা বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রতিক্রিয়ার ঝড়ঝাপটা সামলে টিকতে পারবে।”
এ আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে একটি অত্যন্ত জরুরি— প্রায় অপরিহার্য— চিন্তাসূত্র।
এর পর তিনি বলেন: “ঠিক এই জায়গাতেই বিজ্ঞান আমাদের সাহায্য করতে পারে। একেবারে হুবহু না হলেও বিজ্ঞানে সত্য-মিথ্যার প্রশ্ন যেভাবে মীমাংসা হয়, তা থেকে আমরা কিছু শিক্ষা নিতে পারি। বিশেষ করে আমরা যেহেতু সকলেই মার্কসবাদকেও একটা বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা হিসাবে গণ্য করি, এই শিক্ষাটা নেওয়া আরও বেশি স্বাভাবিক এবং জরুরি।”
পরমাণু বিজ্ঞান, কোয়ান্টাম তত্ত্ব, জিনতত্ত্ব ইত্যাদি বিবিধ ক্ষেত্রে প্রভূত মতপার্থক্য নিয়ে “বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন সম্মেলনে মিলিত হন, আলোচনা করে মতভেদ কমিয়ে আনার বা মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা করেন। সেই চেষ্টা কখনও সফল হয়, অনেক সময়ই হয় না। মুলতুবি হয়ে পড়ে থাকে। কিন্তু তার জন্য বিজ্ঞানের মধ্যে দুই লাইনের সংগ্রাম শুরু হয়ে যায় না। খুব দুর্লভ দু-একটা ঘটনা বাদ দিলে, এই বিবদমান বিজ্ঞানীরা কেউ একে অপরকে বিরোধীপক্ষ বা শত্রুপক্ষ বলে ভাবেন না। মার্কসবাদকে যদি সত্যিই একটা বৈজ্ঞানিক দর্শন হয়ে উঠতে হয়, তাহলে মার্কসবাদীদেরও এই বৈজ্ঞানিকসুলভ মানসিকতা অর্জন করতে হবে।”
চমকে উঠে লক্ষ করি— বৈজ্ঞানিক বিচারপদ্ধতি বা scientific approach–এর এর চাইতে প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা আর কিছুই হতে পারে না।
এরই অবিচ্ছিন্নতায় ১৯৩৯-এ পার্টির অষ্টাদশ কংগ্রেসে স্তালিনের মূল্যায়নের কথা আসে, যেখানে তিনি বলেন:
…the remnants of the exploiting classes have been completely eliminated…
এই পথ ধরে এগিয়ে ঝদানভ ১৯৪৭-এর ভাষণে উল্লেখ করেন যে, সোভিয়েত সমাজে এখন আর কোনও শত্রুতামূলক শ্রেণিদ্বন্দ্ব নেই; তাঁরা শ্রেণির অস্তিত্ব নিঃশেষ করে ফেলেছেন। অতঃপর স্তালিনের মৃত্যু, খ্রুশ্চভের নেতৃত্বলাভ ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে পর পর সোভিয়েত পার্টি ও রাষ্ট্রের রং বদলের লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে, এবং স্তালিন–ঝদানভের থিসিস ভুল প্রমাণিত হয়। এই বিষয়ে আমরা মাও সেতুং-এর ১৯৪৮ সালে দেওয়া স্তালিন-নীতির সমালোচনার মধ্যেও জানতে পারি।
এভাবে বিভিন্ন উল্লেখ, যাচাই, খণ্ডন, পুনরুদ্ধার ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে গিয়ে লেখক সিদ্ধান্তে পৌঁছন: “বিষয়টি এভাবেই ভাবা ভালো যে মার্কসবাদী নেতাদের সামাজিক-রাজনৈতিক জটিল বিষয়গুলো বুঝতে বারবার ভুল হবে। ভুল হতে পারে। ভুলটা যখনই ধরতে পারব, শুধরে নেব। এবং ভুল যে হয়েছিল, তা স্বীকার করে নেব। আড়াল করব না। বিজ্ঞানের মতো করে, বিজ্ঞানীদের কায়দায়। আসলে আমাদের সব সময়ই বিভিন্ন থিসিসকে নানা পরিস্থিতির মুখে দাঁড়িয়ে নানা দিক থেকে বিচার বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে। পরিস্থিতির পরিমাণগত পরিবর্তন হচ্ছে না গুণগত পরিবর্তন হয়ে গেছে, সেটাও বোঝার চেষ্টা করতে থাকব। এই করতে করতে কখনও আমরা ঠিক সিদ্ধান্ত করতে পারব। যতটা ঠিক হবে সেই অনুযায়ী ঠিকভাবে এগোতে পারব। আবার ধরেই নিতে হবে, অনেক ক্ষেত্রে পরিস্থিতির বিচারে ভুল হয়ে যাবে।”
মার্কসবাদীর বিজ্ঞানসম্মত বিচারপদ্ধতির এই অসামান্য ব্যাখ্যার পর লেখক আসেন যাচাইয়ের প্রশ্নে।
তাঁর কথায়: “তার মানে কি এরকম যে কখন কোথায় সংশোধনবাদ মাথা তুলছে বোঝাই যাবে না? বলাও যাবে না? সেটাও নয়। ভুল আর শোধনবাদ এক নয়। একই সঙ্গে আমাদের মনে রাখতে হবে যে শোধনবাদের… কিছু স্পষ্ট নির্দিষ্ট লক্ষণ আছে। সেই সব জেনে বুঝে নিলেই আমরা ভুল থেকে বিচ্যুতিকে ধীরে ধীরে আলাদা করতে শিখতে পারি।…
“এখানেও আমরা আবার বিজ্ঞানের সাহায্য নিতে পারি।… ভাবা যাক সেই সমস্ত ঘটনা, যেখানে কারও তরফে বিজ্ঞানকেই সরাসরি অস্বীকার করে বসা হচ্ছে। সেখানেও কি অটুট সম্মিলন বজায় থাকবে? থাকে?…
“ভারতে এখন বিজেপি সরকারের আমলে গত এক দশক ধরে যে সমস্ত অপবিজ্ঞানের ভূসিমাল বিজ্ঞানের বড় বড় কেন্দ্র এবং মঞ্চগুলিতে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, দিচ্ছেন শুধু গৈরিক রাজনীতিবিদরাই নন, অনেক নামকরা বিজ্ঞানীও, সেখানেও কি কোনও যথার্থ বিজ্ঞানী সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবেন? বন্ধুত্বের মন নিয়ে চুপ করে থাকবেন? সেগুলোকে কি বিজ্ঞানের সৃজনশীল প্রয়োগ বা ভাবনা হিসাবে দেখবেন? নাকি, কঠোর সমালোচনা এবং বিরোধিতা করবেন? পালটা বিজ্ঞানের যথাযথ বার্তা তুলে ধরবেন আমজনতার কাছে?”
এই মোক্ষম দৃষ্টান্তে এসে তিনি বলেন যে, বিজ্ঞানে কিছু মূল বুনিয়াদি নিয়ম বা সূত্র আছে, যেগুলো নতুন পর্যবেক্ষণ বা পরীক্ষার ফলাফলে দিনের দিন পালটে যায় না— যেতে পারে না— গেলে বিজ্ঞানের গোটা স্থাপত্য ভেঙে পড়বে। যেমন, নিউটনের সূত্র: বল = ভর × ত্বরণ; ম্যাক্সওয়েল, প্লাঙ্ক, আইনস্টাইনের আবিষ্কারসমূহ। একইরকম পাকা আসন নিলস বোহর ও ভার্নার হাইজেনবার্গের কোয়ান্টাম আবিষ্কারের। রসায়নের পর্যায় সারণি এবং জীববিজ্ঞানে ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বেরও। এই মৌল সত্যগুলোতে যদি ফাটল ধরা পড়ে, তবে আধুনিক বিজ্ঞানের সমগ্র কাঠামোকেই নতুন করে লিখতে হবে।
একইভাবে, মার্কসবাদেও কিছু বুনিয়াদি কথা আছে, যেগুলো ধ্রুব, যা পরিস্থিতির সঙ্গে প্রতিদিন বদলায় না। যেমন— “তার বস্তুবাদী ভিত্তি, দ্বন্দ্বতত্ত্ব,… শ্রেণিসংগ্রাম ও তার পরিণতির তত্ত্ব। পুঁজিবাদ তো বটেই, এমনকি সমাজতন্ত্রেরও একটা বড় পর্যায় জুড়ে শ্রেণিসংগ্রামের বিষয়টা টিকে থাকে।… ফলে আজকে যদি এটাকে কেউ বাতিল করতে চায় বা বলে সর্বহারার একনায়কত্ব স্থাপিত হওয়াটাই ভুল ছিল, তাকে মেনে নেওয়া যাবে না।” এবং এই অনুসিদ্ধান্তের সপক্ষে তিনি ইতিহাস থেকে সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া ও চিনের ধারাবাহিক উত্থান-পতনের চর্চিত অথচ অবিশ্লেষিত বাস্তব, ডিক্টেটরশিপ অব দ্য প্রলেতারিয়েত-এর অভ্রান্ততার বিপক্ষে আর্ল ব্রাউডার, নিকিতা খ্রুশ্চভ, তোগলিয়াত্তি প্রমুখের অবস্থান; তাঁদের সংশোধনবাদী বিচ্যুতি যে মূলত বুর্জোয়া সংসদীয় পথের ভরসা, তা অনস্বীকার্যভাবে সামনে নিয়ে আসেন। লেখকের কড়া মন্তব্য: “বুর্জোয়াদের তৈরি রাজনৈতিক সভায় ঢুকে বুর্জোয়া ব্যবস্থাকে উচ্ছেদ করতে তারা দেবে না।”
বই শেষ হয়, “মার্কসবাদ বৈজ্ঞানিক মতাদর্শ কিনা— এটা নিশ্চয়ই খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, কিন্তু আমরা মার্কসবাদীরা বৈজ্ঞানিক মনোভাবাপন্ন হয়ে উঠতে পারছি কিনা— তার চাইতে অনেক বেশি জরুরি প্রশ্ন”— বাক্যটা দিয়ে।
পরিশেষে ফিরে আসি গোড়ার কথায়। বস্তুবাদ কী, এবং যান্ত্রিক থেকে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদে উত্তরণের তাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক বিবরণ গোটা বইজুড়ে অত্যন্ত খুঁটিনাটিভাবে পাওয়া যায়। পাওয়া যায় মার্কস-এঙ্গেলসের প্রস্তুতি ও পরবর্তী চিন্তাভাবনার মূল্যবান সংক্ষিপ্তসার। লেনিনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণ, স্তালিনের ঠিক-ভুল, সে প্রসঙ্গে মাওয়ের মন্তব্য, এমনকি মাওয়ের লেনিনকে খানিকটা ভুলভাবে ব্যাখ্যা করার আলোচনাও আমরা এখানে পাই। কর্নফোর্থ, হলডেন, বার্নাল প্রমুখ উল্লেখযোগ্য মার্কসবাদী তাত্ত্বিকদের বক্তব্যকে ধরে অশোকদা বিষয়টির স্বার্থেই খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ করেছেন, দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির অনুষঙ্গ মেনেই। আর এভাবে চলতে চলতে হঠাৎই যেন ধরা দেয়— চিন্তাপদ্ধতির মধ্যে দ্বান্দ্বিকতার সংক্রামক চরিত্রটিকেই অলক্ষ্যে তুলে ধরেছেন লেখক। ডগমাটিক অন্ধত্ব থেকে এতটাই দূরে নিয়ে গেছেন যে পদ্ধতির প্রয়োজনে আগামীদিনে আমি বা অন্য কেউ অনায়াসেই এইসব আলাপ-আলোচনাকে পুনর্বিবেচনা করতে পারব; কোথাও হয়তো খানিকটা লঙ্ঘন বা অস্বীকার করে নতুন অনুসিদ্ধান্তের জন্মও দিতে পারব। একই সঙ্গে, রিভিশনিস্ট ঝোঁক বলতে সঠিকভাবে কোন কোন প্রবণতাকে বোঝা উচিত, সে দিকেও আমরা অনেকটা এগিয়ে যাই অজান্তেই— যাতে ভবিষ্যতের মার্কসবাদীরা শোধনবাদের ফাঁদ পেরিয়ে স্বচ্ছন্দে এগিয়ে চলার দিশা পেতে পারে।
প্রসঙ্গত, এই বইতে মার্কস, এঙ্গেল্স, লেনিন, স্তালিন, মাও প্রমুখ মনীষী ও নেতাদের কিছু কিছু বক্তব্য বা সিদ্ধান্তের ভালো-মন্দ বিচার ও সমালোচনা আছে। কিন্তু তা কখনওই নিন্দাবাদ নয়, কাউকে সম্পূর্ণ বাতিল করার আয়োজনও নয়। সত্য জানা ও প্রতিষ্ঠার খাতিরেই— যেমন আগে উল্লেখ করেছি— বহুমুখী তথ্য ও যুক্তির কষ্টিপাথর নির্মাণের প্রয়াসে এগিয়েছে এই বিশ্লেষণ। একই সঙ্গে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে, যত বড় নেতা-চিন্তকই হোন, কেউই ভুলের ঊর্ধ্বে নন; আবার তাঁরা এক কথায় আগাগোড়া বাতিলযোগ্যও নন। ফলে এই সমালোচনা পাঠককে কারও প্রতি বিরূপ করে তোলে না, আবার অন্ধ অনুসরণেও প্রলুব্ধ করে না।
এই বই অশোকদার এক ধারাবাহিক মার্কসবাদী চর্চার ক্লাসের একটি উজ্জ্বল ফল। সেই চর্চা বর্তমানে আরও এগিয়েছে, এগিয়ে চলেছে। ভবিষ্যতে আমাদের সামনে থেকে আরও অনেক ঝাপসা পর্দা টেনে ছিঁড়ে দেওয়ার জন্য আমরা অশোকদার সুস্থতা ও দীর্ঘায়ু কামনা করি।
এত সুন্দর একটি গ্রন্থ পাঠকের হাতে চমৎকারভাবে ছাপিয়ে তুলে দেওয়ার জন্য প্রকাশকেরও অসংখ্য সাধুবাদ প্রাপ্য।
[1] Marx and Engels 1976, 83.
[2] German Ideology, Marx-Engels.
[3] Marx-Engels.
[4] Anti-Dühring.

