মরা বন্দরে আজ জোয়ার জাগানো ঢেউ

সমর্পিতা ঘটক

 


এখনও পথ বাকি অনেকটাই। দোষীরা ধরা পড়েনি। শাস্তি হয়নি একজনেরও। অনেকগুলো দিন কেটে গেছে। আন্দোলনের গতি হয়তো একইরকম থাকবে না। উৎসবের জোয়ার শুষে নেবে প্রতিবাদের আগুন। কিন্তু থামবে না স্পর্ধা

 

 

মেয়েদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খোপে আটকে রাখার ইতিহাস আমাদের। খোপ থেকে বেরোলেই মেয়ে ডানা মেলে, সমাজ জানে। তাই নানারকম শিকল আর খোপ তৈয়ার থাকে সেই অষ্টাদশ শতক থেকেই। তারপর থাকে খাপ। সালিশি সভায় যেভাবে মেয়েটার দোষ খুঁজে বের করা হয় চতুর হায়নার মতো। মেয়েদের স্বর, ইচ্ছে-অনিচ্ছে, প্রতিবাদ খতম করার এক কোটি উপায় জানে এই উপমহাদেশ। তার মধ্যেও নাবালিকা বিয়ে রুখে দেয় নিজের জীবন বাজি রেখে, সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয় হাজার নিষেধ-বারণ উপেক্ষা করে, মার খেতে খেতে একদিন তৈরি করে গুলাবি গ্যাং, তালিবানি হুমকি উপেক্ষা করে চালিয়ে যায় পড়াশোনা, পরিবেশ বাঁচানোর ব্রত নিয়ে কিশোরী মেয়ে লড়ে যায় মুনাফাখোরদের বিরুদ্ধে, আগুনে ছুড়ে দেয় হিজাব। শিকল ছেঁড়ার স্বপ্ন নিয়ে লড়াকু মেয়েরা সর্বক্ষেত্রে আলো হয়ে পথ দেখায়।

অন্ধকার ছুড়ে দেওয়া হয় তাদের দিকে। শরীর, মন, যাপনকে নামিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় সপ্তপাতালে। নারী কতখানি সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে তা নিয়ে কালে কালে সাবধানবাণী শুনিয়ে গেছে কুনাট্যের শাস্ত্রবাদীরা। লাখো বারণ-নিষেধ তাদের মানতে বাধ্য করা হয়েছে, এখনও হয়। বহুসংখ্যক মেয়ে এই গণ্ডির জীবনকেই সত্যি বলে মনে করে। নিজেও হয়ে ওঠে তার ধারক ও বাহক। নয় তো ভয়। সর্বনাশের ভয়। পুরুষেরা যখন পেরে ওঠে না যুক্তিতে, সংযমে, বুদ্ধি কিংবা মেধায় তখন ঝাঁপিয়ে পড়ে নারীর শরীরের ওপর। যুদ্ধে, দাঙ্গায়, সংগ্রামে, ইগো-হার্ট হলে ইত্যাদি অযুত ফিকিরে এই উপমহাদেশে বদলা নেওয়ার এই এক সুলভ পথ। তেমন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয় না আমাদের দেশে। এক-একটা জায়গা দ্বীপের মতো জেগে থাকে ওই নির্মম ঘটনার নামে। সেদিন হাথরাসের ওপর দিয়ে যখন ট্রেন যাচ্ছিল তখন আর কিচ্ছু মনে পড়েনি। চরম বিষণ্নতা গ্রাস করল। এত সহজ এইভাবে অত্যাচারিত হয়ে, চরম কষ্ট পেয়ে মরে যাওয়া? বানতলা, কামদুনি, উন্নাও, পার্ক স্ট্রিট, কাঠুয়া, আরজিকর… একের পর এক নাম জেগে থাকে। স্বস্তি নেই, অস্থিরতা আমাদের ছারখার করে দেয় ভেতরে ভেতরে। ছাড়া পেয়ে যায় ধর্ষক-খুনির দল বারবার। প্রমাণ লোপাট করে দেয় শাসক। টাকার টোপ, হুমকি, নির্যাতিতার চরিত্রহননের চেষ্টা, আইনের ফাঁক, শাসক বাঁচাতে চায় নিজের ভাবমূর্তি কিংবা তার মদতপুষ্ট ধর্ষকদের। আর নির্যাতিতার পরিবার তিলে তিলে মরে। কেবলই কি ধর্ষণ? আরজিকর-এর ঘটনা তো নাকি পরিকল্পিত হত্যা!

স্তূপীকৃত বেদন ও সীমাহীন নৃশংসতা দেখতে দেখতে দেওয়ালে ঠেকে যাওয়া পিঠ রাত দখলের আহ্বান নিয়ে গর্জে ওঠে। রাস্তার একেকটা মোড় তখন পীঠস্থান। মেয়েদের রাতদখল হারিয়ে দেয় পুজো-পার্বণের ভিড়কে। নিকষ জমাট আঁধারের গায়ে আলোর ফুলকি! একটি লড়াকু, স্বাধীন, জ্বলজ্বলে মেয়ে্কে পাহাড়প্রমাণ যন্ত্রণা নিয়ে চলে যেতে হল, এক করে গেল সমস্ত মেয়েদের। ১৪ তারিখ রচিত হল ইতিহাস। গলি থেকে রাজপথ মেয়েদের মিছিল, রাস্তা দখল। কিছু নির্ভীক মেয়েদের পরিকল্পনায় গভীর শোকের মাঝেও দ্রোহের মন্ত্র ছড়িয়ে পড়ল। হাঁটল নারী-পুরুষ নির্বিশেষে। শিশু কোলে বাবা-মা, অশীতিপর বৃদ্ধা। শহর, মফস্বল, গ্রাম, গঞ্জে ছড়িয়ে পড়ল জমায়েত। এমনকি সারা দেশে মেয়েরা নামল পথে। দেশের বাইরেও উঠল ঢেউ। পোড়খাওয়া রাজনীতি করা মানুষও বলে উঠলেন, এমন রাত তিনি দেখেননি আগে। দল, পতাকা, নেতার মুখ সরিয়ে রেখে মানুষ সেদিন কান্নাভেজা চোখে পথে নেমেছিল নিজের তাগিদে। অনেক ক্ষোভ জমা হয়ে আছে তাদের। পরবর্তী প্রজন্মকে মেয়েরা দিয়ে যেতে চায় সুরক্ষিত রাত। নিজেদের হাতে মানুষ বেঁধে ফেলল স্লোগান, নির্মাণ করল পোস্টার। এতদিন এইভাবে মঙ্গলযাত্রা করেছে মানুষ উৎসবের দিনে। কিন্তু দিন বদল করতে রাতদখলের কর্মসূচি আগে হয়নি এই রাজ্যে। কোনও বিখ্যাত বড় মুখ দেয়নি ডাক, কোনও সাহিত্যিক আদেশ করেননি যোগ দেওয়ার। কোণঠাসা মানুষ, দলাদলি দেখে ক্লান্ত মানুষ, বিচারের নামে একের পর এক প্রহসন দেখে ক্ষুব্ধ মানুষ অপেক্ষায় থাকে, গণমঞ্চ তারা নিজেরাই তৈরি করে নেয়। হয়তো ভুলচুক হয়, মতবিরোধ হয়, কিন্তু বিরাট উদ্যোগে, জনপ্লাবনে ত্রুটি, বিরোধ ভেসে যায়।

সারারাত ফুটুক তারা নব নব… তারপরেও কি বিচার আসবে? আমরা নিশ্চিত নই। আন্দোলনও তাই ওইরাতেই থেমে নেই। নিজের নিজের অঞ্চলে মানুষ বাঁধছে জোট। মানুষ আর অপেক্ষা করে না কবে ডাক দেবে তার প্রিয় লেখক, অভিনেতা, গায়ক, নাট্যকার। মানুষ বুঝে গেছে বুদ্ধিজীবীদের বোবায় ধরেছে। শাসকের কথায় তারা ওঠে বসে। হাজারো অন্যায় দেখেও তারা স্থবির। কেবল শাসকের মিছিলে তারাই প্রথম সারিতে। মঞ্চে জ্বলজ্বল তাদের পুতুল-উপস্থিতি। মানুষ আজ আর পরোয়া করে না বরং তারা ধিক্কার জানায় ঝুঁকে যাওয়া শিরদাঁড়াকে। একটি আন্দোলন কত ঐতিহাসিক দিনের জন্ম দেয় সেসব আমরা জানি যারা পড়েছি ইতিহাস নিয়ে। তেমনি আর একটি দিন হল ১৮ আগস্ট। নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে পুলিশ-প্রশাসন ডার্বি ম্যাচ বাতিল করার পর তিনটি ক্লাবের সমর্থক এক হয়ে পথে নামল যাবতীয় শত্রুতা জয় করে। সুবিচারের দাবিতে মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল আর মহামেডান তিন ক্লাব কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পথ হাঁটল, মার খেল পুলিশের, তাও মাঠ ছেড়ে পালায়নি সৎ খেলায় বিশ্বাসী সমর্থক। একটি অন্ধকার রাত, একটি মেয়ের প্রাণ কত প্রাণকে গেঁথে দিল সহমর্মিতায়। ম্যাচ চলাকালীন আরজিকরের ঘটনা নিয়ে যতটুকু প্রতিবাদ হত, তার থেকে অনেক বেশি হল ম্যাচ বাতিল হওয়ার পর। এ যদি দ্রোহকাল না হয় তাহলে কবে আসবে সেই সময়?

কিছু নেতা, মন্ত্রী, পারিষদ শহরের মেয়েদের উদ্দেশ্যে অসম্মানজনক কথা বললেন, বলার সঙ্গে সঙ্গে হাততালিও পড়ল। কথাগুলো শুনে ভাবলাম, এ আর নতুন কী? রাতদখলের কর্মসূচির এই সাফল্যের পরেও তো দেখছি মেয়েদের রাতে কাজ করা নিয়ে দ্বিধা রয়েছে প্রশাসনের। তখন আর পোশাক, কেশসজ্জা নিয়ে কুকথা বিষণ্ণ করে না, হাসি পায়। আর হাসি ছড়িয়ে পড়ে নিউ দিল্লি থেকে নিউ ব্যারাকপুরে। সিরিয়ালে যেমন ভিলেন করা হয় শহরের মেয়েদের। ঠিক তেমনই সুর মন্ত্রীসান্ত্রীদের গলায়। হাত কিংবা আঙুল ভেঙে দেওয়ার হুমকিও দিয়েছেন স্থূল, নির্বোধ নেতার দল। জনতার জাগরণে হয়তো ভয় পেয়েছেন।

এখনও পথ বাকি অনেকটাই। দোষীরা ধরা পড়েনি। শাস্তি হয়নি একজনেরও। দশ দিন কেটে গেছে। আন্দোলনের গতি হয়তো একইরকম থাকবে না। উৎসবের জোয়ার শুষে নেবে প্রতিবাদের আগুন। কিন্তু থামবে না স্পর্ধা। যিনি থাকলে লিখতেন ঠিক, অশক্ত শরীরে আসতেন মিছিলে, তাঁর অভাব রোজ অনুভব করছি আমি। তিনি কবি শঙ্খ ঘোষ এবং তাঁর অক্ষর।

স্পর্ধা

শঙ্খ ঘোষ

তার কোনও খ্যাতি নেই তার জন্মপরিচয় নেই
তার কোনও মুক্তি নেই লোকে যাকে মুক্তি বলে থাকে
যতদূর দেখা যায় সারি সারি কম্বল, পশম
আর কোনও ঢেউ নেই ঢেউয়ের সংঘর্ষে দ্যুতি নেই।
জীবন এত যে ভাল, সে-জীবনে অধিকার নেই
লজ্জাহীন সুন্দরের মুখে কোনও ম্লান আভা নেই
সারি সারি উট আর উটের চোখের নিচে জল
দু-হাত বাড়িয়ে দেখে আর কোনও জলচিহ্ন নেই—
তবু সে এমনভাবে কোন্‌ স্পর্ধা করে বলে যায়
‘আমার দুঃখের কাছে তোমাদের নত হতে হবে!’

তিনি ঠিক লিখে গেছেন মেয়েটির কথা… আমাদের কথা।


*মতামত ব্যক্তিগত

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4888 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...