মিছিলে কে আসতে পারে

স্বাতী ভট্টাচার্য

 


নাগরিক আন্দোলন একদিকে যেমন সব মানুষকে রাস্তায় নামতে আহ্বান করেছে, তেমনই এক-একটি অংশ অন্য অংশের থেকে দূরত্ব বজায় রাখতেও ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। যদিও আহ্বায়কেরা বারবার ঘোষণা করেছেন যে তাঁরা কোনও দলীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে আন্দোলন করছেন না, তবু বন্যাস্রোতের মধ্যে পাঁচিল তোলার চেষ্টার মতো, ‘ওই মিছিল আমার নয়’-গোছের কথা বলে দূরত্ব তৈরির চেষ্টা রয়েই যাচ্ছে

 

রাত সাড়ে বারোটা, সুকান্ত সেতু থেকে যাদবপুর এইট-বি বাসস্ট্যান্ডের দিকে যাওয়ার পথ দখল করেছে মানুষের মিছিল। তিলমাত্র জায়গা নেই, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ স্লোগান উঠছে ঘন ঘন, অন্যায়ের প্রতিবাদে রুখে দাঁড়ানোর উদ্দীপনা সবার চোখেমুখে স্পষ্ট। তারই মধ্যে মাইকে ঘন ঘন ঘোষণা শোনা গেল, “শাঁখ বাজাবেন না, শাঁখ আমাদের কর্মসূচির মধ্যে নেই।” তাতে শঙ্খধ্বনি থামেনি অবশ্য। ভিড়ের মধ্যে থেকে বারবার শাঁখ বেজে উঠছিল সজোরে। রাতদখল আন্দোলন সংগঠনে যাঁরা সক্রিয়, তাঁদের একাংশ আবার ২৭ আগস্ট আরজিকর-কাণ্ডের প্রতিবাদে ডাকা ছাত্র অভিযানকে সমর্থন করেননি। একটি বিবৃতি প্রকাশ করে জানিয়েছেন, ওই আন্দোলনের পিছনে থাকা বিজেপি-আরএসএস “ধর্ষক সংস্কৃতির ধারক বাহক।”

অর্থাৎ, নাগরিক আন্দোলন একদিকে যেমন সব মানুষকে রাস্তায় নামতে আহ্বান করেছে, তেমনই এক-একটি অংশ অন্য অংশের থেকে দূরত্ব বজায় রাখতেও ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। যদিও আহ্বায়কেরা বারবার ঘোষণা করেছেন যে তাঁরা কোনও দলীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে আন্দোলন করছেন না, তবু বন্যাস্রোতের মধ্যে পাঁচিল তোলার চেষ্টার মতো, ‘ওই মিছিল আমার নয়’-গোছের কথা বলে দূরত্ব তৈরির চেষ্টা রয়েই যাচ্ছে। নাগরিক আন্দোলনের নিরিখে দেখলে এটা অস্বস্তিকর— রাষ্ট্রশক্তির বিপরীতে নাগরিকের প্রধান অস্ত্র ঐক্যবদ্ধতা। সেখানে আন্দোলনে যোগদানের একটিই শর্ত— শাসকের কোনও একটি কাজের, বা পরিকল্পনার, বিরোধিতায় ঐকমত্য। নাগরিক সেখানে পরস্পরের জন্য শর্ত তৈরি করতে পারে কি? কোনও কোনও রাজনৈতিক মতাদর্শের সমর্থকদের, বিশেষত রাজনৈতিক দলের নানা (কু)কাজের ভিত্তিতে দলীয় সমর্থকদের যদি নাগরিক আন্দোলনের বাইরে রাখতে হয়, তা হলে নাগরিক আন্দোলন দানা বাঁধাই অসম্ভব। কারণ এমন কোনও রাজনৈতিক দল নেই, যা নাগরিকের অধিকার লঙ্ঘন করেনি। প্রশাসনে থেকে নাগরিকের জীবনের অধিকার, বাকস্বাধীনতা, সংগঠনের স্বাধীনতা লঙ্ঘন করেনি, এমন কোনও রাজনৈতিক দল ভারতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট শাসনকালে ধানতলা-বানতলা, তৃণমূল শাসনকালে কামদুনি-সন্দেশখালি, উত্তরপ্রদেশে বিজেপি সরকারের শাসনকালে উন্নাও-হাথরাস— কোন দলের সমর্থক দাবি করতে পারে, তার দল “ধর্ষক সংস্কৃতির ধারক বাহক” নয়? ভারতের প্রতিটি রাজনৈতিক দল পুরুষতন্ত্রের ধারক বাহক, ধর্ষণ সংস্কৃতি যার অপরিহার্য অঙ্গ। যে প্রতিবাদকে ‘নাগরিক আন্দোলন’ বলে অভিহিত করা হচ্ছে, তাতে নানা রাজনৈতিক দলের সমর্থকদের উপস্থিতি থাকলে মতাদর্শগত বিভাজনগুলিকে অস্বীকার করা হয়, নস্যাৎ করা হয়, এমন তো নয়। রাজনৈতিক সমর্থনের উপরে, পরিস্থিতির নিরিখে আরও জরুরি কোনও বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হয়।

আন্দাজ হয়, নাগরিক আন্দোলনের ভিতরে এক ধরনের উদ্বেগ কাজ করছে— কোনও এক দলের সমর্থকরা মিছিল-সমাবেশকে ‘হাইজ্যাক’ করে নিল কিনা, নাগরিক সেজে রাজনৈতিক উদ্দেশে সকলকে কাজে লাগাল কি না। এমন কি হয় না? অবশ্যই হয়। সঙ্কীর্ণ দৃষ্টি, চটজলদি সুবিধার সন্ধান যারা করে, তারা বরাবরই নাগরিক শক্তিকে দলীয় কাজে লাগাতে চেয়েছে, চাইবেও। কিন্তু সেই উদ্বেগকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়ার অর্থ দাঁড়ায়, যে বিভাজন রাজনৈতিক দলের বিশেষত্ব, তাকে নাগরিক সমাজে টেনে নিয়ে আসা। নাগরিক সমাজ অ-রাজনৈতিক নয়, কিন্তু তার রাজনীতি অন্যরকম। নাগরিক সমাজের ধারণার বিবর্তন ব্যাখ্যা করতে গিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাসের গবেষক-অধ্যাপক সুনীল খিলনানি লিখছেন, নাগরিক সমাজের নিরিখে রাজনীতি হল সেই জমি যেখানে ব্যক্তির ও গোষ্ঠীর নানা স্বার্থের প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলে, কিন্তু কী উদ্দেশে সকলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে, সে বিষয়ে সকলের মধ্যে একটা সাধারণ ধারণা কাজ করে। রাজনীতিতে যোগদান কেবল নির্বাচনী রাজনীতিতে সামিল হওয়া বোঝায় না, আরও নানাভাবে যোগদান হতে পারে। প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার বাইরে, ছোট-বড় নানা পরিসরে যোগদান চলতে থাকে নাগরিক সমাজে। এই অর্থে, বহু বৈচিত্র্য এবং বৈষম্যের মধ্যেও রাজনীতি কেবল সংঘাত তৈরি করে না, সংহতিও তৈরি করে।

নাগরিক সমাজ সম্পর্কে এই কথাগুলি যে কেবল তত্ত্ব নয়, তা আমরা দেখতে পাচ্ছি পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রতিক ঘটনায়। সুপ্রশাসন, নিরাপত্তা, রাজনৈতিক প্রশ্রয়প্রাপ্ত দুর্বৃত্তের কবল থেকে মুক্তি, এই চাহিদাগুলি চিকিৎসক থেকে আশাকর্মী, অধ্যাপক থেকে গৃহপরিচারিকা, সকলকে একই আন্দোলনের জমিতে এনেছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান, বাজার, ভাটা-খাদানের মতো অংগঠিত ক্ষেত্রে উৎপাদন, পরিবহণ-সহ নানা গণপরিষেবা ব্যবস্থা, সর্বত্র রাজনৈতিক প্রশ্রয়প্রাপ্ত দুর্বৃত্তের ছড়ি ঘোরানো কর্মক্ষেত্রকে কলুষিত করছে। মেয়েরা বিশেষভাবে তার শিকার। তার প্রতিবাদের জমিতে তারা একত্র হয়েছে। যদিও এই গোষ্ঠীগুলির মধ্যে যথেষ্ট স্বার্থ-সংঘাত রয়েছে। রাজনীতির এই সংহতি তৈরির সম্ভাবনাকে ছোট করে দলীয় সংঘাতকে বড় করে দেখা কি সতর্কতা, নাকি অপরিণামদর্শিতা?

বিষয়টি আরও সমস্যা-সঙ্কুল লাগে নারীবাদের নিরিখে দেখলে। যেহেতু সুরক্ষা এবং সম্মানের সঙ্গে মেয়েদের কাজ করার দাবি এই আন্দোলনের কেন্দ্রে, এবং তা শ্রেণি-নির্বিশেষে সমস্ত মহিলা ও পুরুষের দাবি, তাই প্রশ্ন ওঠে, ঠিক কীসের ভিত্তিতে কিছু মেয়েকে এই আন্দোলনের বাইরে থাকার দাবি তোলা যায়?

বিজেপি-আরএসএস ‘হিন্দুত্ববাদী’ এবং মেয়েদের প্রতি বৈষম্য ও দমন-পীড়নের ব্যবস্থায় বিশ্বাসী, তা মেনে নিলেও (আরএসএস অবশ্য নানা যুক্তি ও কর্মসূচি দেখিয়ে দাবি করে, তারা মহিলাদের সমানতা ও সক্ষমতায় বিশ্বাসী) কথা থেকে যায়। প্রায় যে কোনও প্রচলিত ধর্মে পুরুষের আধিপত্যকে ‘স্বাভাবিক’ করে দেখানোর চেষ্টা রয়েছে। তা বলে সেই সব ধর্ম পালনকারী মানুষদের একমাত্র নিয়ন্তা প্রাচীন ধর্মগ্রন্থের কিছু নির্দেশ, এমন তো নয়। যে হিন্দু মেয়েরা শিবরাত্রির উপোস করেন, সন্ধ্যায় প্রদীপ জ্বেলে শাঁখ বাজান, ধর্মের নানা আচরণ পালন করেন, তাঁদেরও অনেকে সংসারে, সমাজে, মেয়েদের জন্য সাম্য ও সক্ষমতা তৈরির লড়াই চালাচ্ছেন, নিজের ও অন্যের জীবনে পরিবর্তন এনেছেন। আরও মনে রাখতে হবে, এই মেয়েদের অধিকাংশ দরিদ্র, নিম্নবর্ণ, সংখ্যালঘু, আদিবাসী। তাঁদের সংস্কৃতির বলয় তাঁদের নিজস্ব, সেখানে ধর্মীয় আচার-আচরণ সামাজিক ভুবনের প্রধান আধার। সমান মজুরি, সমান মর্যাদার জন্য তাঁদের চেষ্টাকে কিছুতেই সেই ভুবন থেকে বিচ্যুত করে, বিচ্ছিন্ন করে দেখা চলে না। কোথায় উদার, সহনশীল হিন্দু ধর্মের শেষ আর কোথায় ‘হিন্দুত্ববাদ’-এর শুরু, বাইরে থেকে তার বিচার করে কিছু মেয়েকে নারীবাদী আন্দোলন থেকে দূরে রাখার চেষ্টা দেখলে তাই প্রবল অস্বস্তি জাগে।

নারীবাদ যেহেতু কেবল লিঙ্গসাম্য নয়, সার্বিকভাবে সমাজে সাম্যের সমর্থক, তাই যে নৈতিক বা অর্থনৈতিক ব্যবস্থাগুলি আধিপত্য ও অসাম্যের ভিত্তিতে গঠিত হয়েছে, তার সঙ্গে নারীবাদের খাপ খায় না। পুঁজিবাদ, নয়া উদারবাদ, ফ্যাসিবাদের মতো ব্যবস্থার প্রবক্তাদের সঙ্গে নারীবাদীদের সংঘাত বাধবেই। সহভাগী গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, বা পরিবেশবাদের সঙ্গে তাঁদের মতাদর্শের মিল স্বাভাবিক। তত্ত্বের দিক থেকে তাতে কোনও ভুল নেই। কিন্তু বাস্তব এই যে, সমাজবাদী দেশ থেকে পুঁজিবাদী দেশ, ধর্মনিরপেক্ষ দেশ থেকে ধর্মের অনুশাসন পালনকারী দেশ, প্রতিটি ব্যবস্থাতেই মেয়েরা লড়াই করে চলেছে বৈষম্যের সঙ্গে। অনেক মেয়ে যেমন অসম ব্যবস্থাটাকেই বর্জন করছেন, তেমনই অনেকে ব্যবস্থার ভিতরে থেকে তার সংশোধন চাইছেন। ভারতে মুসলিম মেয়েরা যেমন মুসলিম পার্সোনাল ল-এর সংস্কার এবং কোডিফিকেশনের জন্য আন্দোলন চালাচ্ছেন। অর্থাৎ তাঁরা ধর্মীয় আইন বাতিল করতে চান না, তার সংস্কার চান, যাতে মেয়েরা সাম্য এবং সম্মান পায়। ক্যাথলিক মেয়েরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করেছেন, যাতে ভ্যাটিকান জন্মনিয়ন্ত্রণের ব্যবহারকে ধর্মবিরোধী আখ্যা দেওয়া বন্ধ করে। শাঁখ বাজানো, বা হিজাব পরার মতো আচরণ দেখে তার আড়ালের মানুষটি সম্পর্কে কোনও ধারণায় পৌঁছনো চলে না। উলটোদিকে, যে মেয়েরা নারী-আন্দোলনের সপক্ষে লেকচার দিয়ে বেড়ান, তাদেরও অনেকের অভ্যন্তরে পুরুষতন্ত্রের ভূত ঢুকে বসে নেই কি? ধর্ষণবিরোধী মিছিলে যাঁরা হাঁটছেন, তাঁরা সবাই সমান নারীবাদী নন, সে আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

অমর্ত্য সেন লিখেছেন, অমুক দেশ গণতন্ত্রের যোগ্য কি না, সে প্রশ্ন করা অর্থহীন। গণতন্ত্রের মধ্যে দিয়েই দেশ যোগ্য হয়ে ওঠে। নারীবাদও তাই— নারীবাদী আন্দোলনে যোগ দিয়েই নিজের শক্তি, মর্যাদা অনুভব করে মেয়েরা, অন্যায়ের প্রতিবাদের সাহস পায়, নিজের হীনতা, ন্যূনতাকে ‘স্বাভাবিক’ বলে মেনে নেওয়ার অভ্যাস কাটিয়ে ওঠে। তাই ‘অমুক যেন আমার মিছিলে না আসে’ এমন বার্তা দেওয়া সতর্কতা নয়, শুচিবাই।


*মতামত ব্যক্তিগত

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4887 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. বাহ্! এই যুক্তিতে পাশের বাড়িতে যদি কোনো পরিচিত নারী নির্যাতনকারীও নারী ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী নাগরিক মিছিলের ডাক দেয় তাতেও সামিল হওয়া যাবে।

আপনার মতামত...