আমাদের নির্বাচন

বিশ্বনাথ উদিত

 

এত বড় বৈচিত্র্যময় দেশের বহুমুখী রাজনৈতিক স্রোতের জটিলতা থেকে ঘুরিয়ে আমরা পশ্চিমবাংলার নির্বাচনী পটচিত্রে দৃষ্টি নিবদ্ধ করব। নির্বাচন ঘোষিত হওয়ার আগেই তৃণমূল দলের বিরুদ্ধে ‘চোর চোর’ স্লোগানে পশ্চিমবাংলা মুখরিত হয়েছিল। চুরির অভিযোগ ভুরি ভুরি, যার অর্থ শাসকের নৈতিক মান আদৌ আস্থা রাখার যোগ্য নয়। তার সঙ্গে শিক্ষার মান নিম্নগামী। আমাদের উচ্চশিক্ষা আগেই কিছুটা বিকশিত হলেও শিক্ষক নিয়োগে চূড়ান্ত দুর্নীতি এনে আমরা সুবিধাটা মুছে ফেলতে চাইছি। এক সময় মনে হয়েছিল দুর্নীতিটা নির্বাচনে একটা প্রভাবক হবে, কিন্তু ধর্মীয় বিভাজন তা হতে দিল না। পছন্দটা হয়ে দাঁড়াল এক আধা-তালিবানি শক্তি আর এক হাড়ে-মজ্জায় দুর্নীতিগ্রস্ত ধূর্ত ক্ষমতালোভী শক্তির মধ্যে

 

পরাধীন ভারতবাসীর বিশ্বাস ছিল যে স্বাধীন হলে দেশ শীঘ্র উন্নতির পথে এগিয়ে যাবে। অশিক্ষিত, ভগ্নস্বাস্থ্য, হীনবল, বুভুক্ষু ভারতবাসীর মধ্যে উদ্যোগ সঞ্চারিত করার কোনও চেষ্টা বিদেশি শাসকের ছিল না। সবার জন্যে প্রাথমিক শিক্ষা প্রসারের গুরুত্ব সম্বন্ধে সাম্রাজ্যবাদী সরকার সামগ্রিকভাবে নির্বিকার থাকলেও দেশে উচ্চশিক্ষার কিছু উন্নতমানের প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়েছিল। দেশ যখন স্বাধীন হয় তখন শিক্ষিতের হার ছিল শতকরা ১৫ জনের কম। দেশভাগের পর এই হারের একটু হেরফের হয়েছে বেশিরভাগ শিক্ষিত মানুষ ভারতে থেকে যাওয়ায়। বস্তুত অশিক্ষার এই অন্ধকারে আলোকের আভার মতো বিরাজমান শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যে কিছু মানুষ ছিলেন উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের মতো। তাঁদের প্রভাব দারিদ্র্য-লাঞ্ছিত শতধা-দীর্ণ সদ্য-স্বাধীন ভারতবর্ষকে চিন্তায় এবং আদর্শে অগ্রণী রেখেছে।

ভারতবর্ষ নামক ভৌগোলিক এলাকাটাকে একটা অখণ্ড দেশ হিসাবে ভাবা সেইসময় অনেকের কাছেই যুক্তিযুক্ত মনে হয়নি। ইংরেজরা দেশের দুই-তৃতীয়াংশ সরাসরি শাসন করত। বাকিটা ছিল দেশীয় রাজাদের শাসনে। বহু ভাষা, ধর্ম ও জাতপাতে বিভক্ত ভারতবাসীর মধ্যে স্বাধীনতা আন্দোলন দেশীয় চেতনাকে শক্তিশালী করে। তবুও দেশভাগ সংশয়বাদীদের চিন্তার যৌক্তিকতা প্রমাণ করে। পাঁচ লক্ষ প্রাণহানি ও এক কোটি বাস্তুচ্যুতের ঘটনাকে পিছনে ফেলে সংশয়বাদীদের অগ্রাহ্য করে আদর্শবাদী নেতারা ভারতরাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসাবে ঘোষণা করেন এবং পৃথিবীর সর্ববৃহৎ লিখিত সংবিধান রচনা করেন। সারা পৃথিবী তাকিয়ে দেখে এক চরম দরিদ্র দেশের এই অভূতপূর্ব যাত্রা। একদিকে দেশজুড়ে চরম খাদ্যসঙ্কট, অপরদিকে সীমানায় শত্রু, এমনকি বিভিন্ন প্রান্তে বিচ্ছিন্নতাবাদ, দেশের নেতাদের ঘুম কেড়ে নেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট ছিল। এরই মধ্যে প্রবল উৎসাহে ও পরম নিষ্ঠায় সংবিধান রচনা এবং গণতন্ত্রের প্রতি দায়বদ্ধ থাকার প্রতিজ্ঞা! সারা পৃথিবীর ইতিহাসে এমন দৃষ্টান্ত আর নেই। সেইসময় রাজনীতি ছিল সমাজসেবায় আত্মনিবেদন, কোনও প্রতিদানের আশায় নয়, আদর্শের চরিতার্থতায়। আদর্শ, প্রতিজ্ঞা, ত্যাগ ও নিষ্ঠার অভাব ছিল না, কিন্তু কিছুর একটা অভাব ছিল।

দক্ষিণ আফ্রিকা বর্ণবৈষম্যের অভিশাপ থেকে মুক্ত হয়ে পূর্ণ গণতন্ত্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা পায় ১৯৯৪ সালে। তখন থেকে পূর্ণ তিন দশক দেশে ক্ষমতাসীন থাকে নেলসন ম্যান্ডেলার দল ANC (African National Congress)। প্রথম ১৫ বছর দেশ থেকে বর্ণবৈষম্য দূর করে আর্থিক উন্নতির পথে ক্রমাগত এগিয়ে যায় সে দেশ। শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নতির প্রবল উৎসাহে দেশের সরকার জাতীয় আয়ের ছয় শতাংশের বেশি ব্যয় করে, যা সম্ভবত বিশ্বের আর কোনও দেশ কখনও করেনি। আমাদের দেশে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের মিলিত ব্যয়ের তুলনামূলক অঙ্কটা জাতীয় আয়ের তিন শতাংশের কিছুটা বেশি ছিল গত শতকের শেষে, বর্তমানে তা তিন শতাংশের কম। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার বিপুল ব্যয় চলে যায় ভুল পথে। সম্প্রতি দেখা গেছে সে দেশের সরকারি বিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষকদের নিয়োগে সমস্তরকম দুর্নীতির অবাধ প্রবেশ, যা পশ্চিমবাংলার সাম্প্রতিক দুর্নীতিকে মনে করিয়ে দেয়। একটি বিদেশি গবেষণায় মাধ্যমিকস্তরে ছাত্রদের জন্য নির্দিষ্ট অঙ্কের প্রশ্নে সেই স্তরের শিক্ষকদের পরীক্ষা নিয়ে দেখা গেছে সরকারি বিদ্যালয়ে প্রায় আশি শতাংশ শিক্ষকের মান তাঁদের ছাত্রদের থেকে ভাল নয়। আরেকটি গবেষণা দেখিয়েছে সে দেশে প্রাথমিক স্তরে অন্তত অর্ধেক সংখ্যক বিদ্যালয়ে কোনও পড়ুয়াই একটি সহজ পাঠ্য থেকে অর্থ উদ্ধার করতে পারে না। বিদ্যালয়শিক্ষার মান দক্ষিণ আফ্রিকায় সারা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে নিচে। শিক্ষক নিয়োগ করতে চাইলেই তো তা পাওয়া যায় না, উপযুক্ত শিক্ষক তৈরি করার নিষ্ঠা চাই আর চাই যত্ন ও ধৈর্য। সম্প্রতি দক্ষিণ আফ্রিকায় মাথাপিছু আয়ের বৃদ্ধিও থেমে গেছে। বর্তমানে শ্বেতাঙ্গ এবং এশীয়রা বিত্তবানের তালিকায় বহু এগিয়ে, যদিও এঁরা মিলিতভাবে জনসংখ্যার মাত্র এক-পঞ্চমাংশ। কিছু সংখ্যক কৃষ্ণাঙ্গরা বিত্তবান হলেও মোটের উপর তুলনা করলে ১৯৯৪-এর আগে যেমন, তিন দশক পরেও তেমনই পিছিয়ে আছে— শিক্ষায়, চাকরিতে ও বিত্ত অর্জনে। আর এই পিছিয়ে থাকাটাই কৃষ্ণাঙ্গের শাসনে কৃষ্ণাঙ্গেরই অন্ধ, বন্ধ হয়ে পিছিয়ে পড়ার দৃষ্টান্ত।

দক্ষিণ আফ্রিকার ঠিক বিপরীত উদাহরণ সিঙ্গাপুর। ১৯৬৫ সালে মালয়েশিয়া থেকে সিঙ্গাপুর স্বাধীন হলে LKY (Lee Kuan Yew) প্রধানমন্ত্রী হয়ে এই ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্রকে গড়ে তুলতে সঙ্কল্পবদ্ধ হন। রাষ্ট্রের এক প্রাকৃতিক বন্দর ছাড়া কোনও উল্লেখযোগ্য সম্পদ নেই, আছে বহু মানুষ। LKY বুঝলেন মানুষই দেশের সম্পদ, তাকেই সযত্নে গড়ে তুলতে হবে। এই কাজ সার্থকভাবে করতে হলে মানুষকে শিক্ষা দিতে হবে, সৎ নাগরিক হিসাবে  তাদের চরিত্র গঠন করতে হবে। দুর্নীতি-মুক্ত শিক্ষিত মানুষই হবে দেশের সম্পদ। কোনও সময় নষ্ট না করে তিনি কাজে ব্রতী হলেন। বর্তমানে সিঙ্গাপুরের বিদ্যালয়শিক্ষা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে বিশ্বের সেরা বলে চিহ্নিত হয়। PISA (Programme for International Student Assessment) বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নিয়ে নানাভাবে দেখেছে। তাদের বিচারে সিঙ্গাপুরের পনেরো বছরের পড়ুয়ারা গড়ে আমেরিকার একই বয়সের পড়ুয়াদের থেকে গণিতশিক্ষায় তিন বছর এগিয়ে আছে। নিচের ক্লাসের পড়ুয়ারও একইভাবে এগিয়ে থাকছে এবং তারা আনন্দের সঙ্গে বিদ্যালয়ে শিক্ষা লাভ করে। এমনটা সম্ভব হয়েছে অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে শিক্ষক চয়ন করে, তাঁদের যথোচিত সম্মান দিয়ে, প্রতি বছর ১০০ ঘণ্টা প্রশিক্ষণ দিয়ে এবং কাজের মূল্যায়ন করে। তাঁরা মানবসম্পদ সৃষ্টির কারিগর। শুধু বিদ্যালয়স্তরেই নয়, উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার কাজেও দেশটি একইভাবে নিয়োজিত। আজ সিঙ্গাপুর বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত দেশগুলির অন্যতম এবং সারা বিশ্বের কাছে আদরণীয়। সিঙ্গাপুরের পাসপোর্ট প্রায় সারা বিশ্বে (১৯৫টি দেশে) সরাসরি গ্রহণযোগ্য, সে-দেশের নাগরিকদের বিদেশভ্রমণে ভিসা লাগে না, অথবা বিমানবন্দরেই ভিসা হয়ে যায়।

স্বাধীনতা পাওয়ার আগেই যে উন্নত মানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি গড়ে উঠেছিল, তা সীমিতসংখ্যক শিক্ষিত উচ্চ ও মধ্য বিত্তের মানুষের চাহিদা অনেকাংশে পূরণ করছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমাদের দেশের সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে যে ব্যয় করে তার সিংহভাগই যায় উচ্চশিক্ষার উন্নতিকল্পে। দ্রুত দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে উন্নতির বিকল্প নেই এ-কথা আমাদের উচ্চশিক্ষিত নেতারা বুঝেছিলেন, কিন্তু দেশের বিরাট সংখ্যক ক্ষুধার্ত প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের শিক্ষিত করে মূলস্রোতে আনার দুরূহ কাজটার গুরুত্ব সম্যক উপলব্ধি করে উঠতে পারেননি। তাঁদের তো জ্ঞান-বুদ্ধি বা দেশপ্রেমের কোনও অভাব ছিল না। প্রশ্ন থেকে যায় বহুবিভক্ত ভারতীয় সমাজকে সম্পূর্ণ এক করে বৃহত্তর ভারতীয় সমাজের ধারণা ভালভাবে দানা বেঁধেছিল কিনা সে বিষয়েই। যে নালা পরিষ্কার করবে বা জুতো সেলাই বা মাঠে লাঙল দেবে তার কতটা শিক্ষার দরকার আছে? তাঁর সন্তানসন্ততি পিতৃপুরুষের কাজ ছেড়ে অন্য কাজ নিতে পারে এই চিন্তা করতে গিয়ে বহু উদার মানুষও থমকে গেছেন। আর দুর্ভাগ্যজনক হল এদেশে থেকে যাওয়া মুসলমানেরা ভারতীয় নাগরিক হয়েও বহুলাংশেই আলাদা সম্প্রদায় হয়েই রয়ে গেছেন। তফসিলি জাতি, জনজাতি জনসংখ্যার সঙ্গে মুসলমান জনসংখ্যা ধরলে এই ভারতীয় নাগরিকেরা মোট জনসংখ্যার প্রায় শতকরা ৪০ জন। মোটের উপর শিক্ষায় ও আর্থিক সক্ষমতার বিচারে এঁরা বাকি ৬০ শতাংশ ভারতীয়ের তুলনায় অনেক পিছিয়ে। আর পিছিয়ে থাকার একটা নিজস্ব গতিপ্রকৃতি থাকে যা সব ক্ষেত্রে এক নয়, দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গদের ক্ষেত্রে আমরা একটা উদাহরণ দেখেছি। সমস্ত সম্প্রদায়কে সমাজের মূলস্রোতে মিলিয়ে দিতে শিক্ষার একটা বড় ভূমিকা থাকে। গণতন্ত্র এক বৃহৎ সম্প্রদায়ের পিছিয়ে পড়া আটকায় না কিন্তু তাদের ভোটাধিকার দেয়। এখানে একটা বিরোধ দানা বাধে যা রাজনীতির পক্ষে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

আমাদের দেশে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে যেমন চরম বিভিন্নতা রয়েছে তেমনি দেশের বিভিন্ন অংশ বা রাজ্যের পরিস্থিতিরও বিভিন্নতা রয়েছে। তাই সারা দেশের নির্বাচনের ফল বিচার করতে গেলে অনেক পরস্পর-বিমুখ গতিপ্রকৃতির বিচার করতে হয়। যেমন সদ্যোসমাপ্ত নির্বাচনে ভাজপা অনেক শক্তি হারালেও বৃহত্তম দলের স্বীকৃতি ধরে রেখেছে, আবার কংগ্রেস আগের থেকে দ্বিগুণ শক্তিশালী হলেও ভাজপার অর্ধেক সংখ্যক আসনও পায়নি। ভাজপা মধ্যপ্রদেশে সব আসন পেয়েছে কিন্তু তামিলনাড়ুতে কোনও আসন পায়নি। বিহারে নীতিশ কুমার কোনও নীতির তোয়াক্কা না করে বারবার জোট পাল্টালেও মানুষের সমর্থন পেয়েছেন অথচ পশ্চিমবাংলায় কংগ্রেস-সিপিএম জোট যথেষ্ট উদ্যম নিয়ে নীতিনিষ্ঠ লড়াই করেও কোনওমতে একটা আসন জিতেছে। স্পষ্টতই এলোমেলো হাওয়ার ইঙ্গিত। কিন্তু তার মধ্যেও একটা গতিমুখ স্পষ্ট: মোদির আত্মপ্রতারণামূলক ঐশ্বরিক আশীর্বাদপ্রাপ্তির প্রচার মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছে এবং তাঁর বিষাক্ত সাম্প্রদায়িক প্রচার মানুষের মধ্যে ভয় ও বিরক্তির সৃষ্টি করেছে। এই বিরক্তিরই একটা ঝটকা ভাজপার আসনসংখ্যা কমিয়েছে অনেক জায়গায়, বিশেষত উত্তরপ্রদেশে, আসন কমেছে কর্নাটক ও পশ্চিমবঙ্গেও। কিন্তু ভাজপার সারা দেশে প্রাপ্ত ভোটের শতাংশ কমেছে কতটা? ৩৭.৪ থেকে ৩৬.৬ শতাংশ, এক শতাংশেরও কম। ভাজপা পাখা মেলেছে দক্ষিণ দিকে, অন্ধ্র, তেলেঙ্গানা, এমনকি কেরলেও।

এত বড় বৈচিত্র্যময় দেশের বহুমুখী রাজনৈতিক স্রোতের জটিলতা থেকে ঘুরিয়ে আমরা পশ্চিমবাংলার নির্বাচনী পটচিত্রে দৃষ্টি নিবদ্ধ করব। নির্বাচন ঘোষিত হওয়ার আগেই তৃণমূল দলের বিরুদ্ধে ‘চোর চোর’ স্লোগানে পশ্চিমবাংলা মুখরিত হয়েছিল। চুরির অভিযোগ ভুরি ভুরি, যার অর্থ শাসকের নৈতিক মান আদৌ আস্থা রাখার যোগ্য নয়। তার সঙ্গে শিক্ষার মান নিম্নগামী। বিদ্যালয়শিক্ষার মানের সূচক (২০১৬-১৭) অনুযায়ী কেরল এবং তামিলনাড়ু দেশের এক এবং দুই নম্বর স্থানে আছে, তারপর একের পর এক রাজ্যের মান নির্দিষ্ট করা আছে, শুধু পশ্চিমবাংলার কোনও তথ্য নেই। তবে তথ্য আছে বিদ্যালয়শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে ছেলে-মেয়েরা কতটা অংশগ্রহণ করছে তার। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সহজেই সবাই উঠে যায়, কিন্ত যদি কিছু না শেখে তাহলে মাধ্যমিক (নবম-দশম শ্রেণি) ও উচ্চমাধ্যমিক (একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি) স্তরে তারা এগোবে না। কাজেই প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার মান যেখানে ভাল সেখানে প্রায় সকলেই উপরের স্তরে যেতে পারে; ঘটনাও তাই। কেরল ও তামিলনাডুতে শতকরা ৯৫ ভাগের বেশি ছেলে-মেয়ে মাধ্যমিক স্তরে উন্নীত হয় কিন্তু, দুর্ভাগ্য, পশ্চিমবাংলায় এই সংখ্যাটা ছেলেদের ক্ষেত্রে ৮৩ শতাংশ, মেয়েদের ক্ষেত্রে যদিও দশ শতাংশ বেশি। এই ছেলে-মেয়েরা নবম-দশম শ্রেণিতে নাম লেখালেও মাধ্যমিক স্তর অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে পারে এমন পড়ুয়া পশ্চিমবাংলায় উপযুক্ত বয়সের ছেলেদের মধ্যে মাত্র ৫৪ শতাংশ আর মেয়েদের মধ্যে ৭১ শতাংশ। এতটা ফারাক কেরল বা তামিলনাড়ুতে হয় না— কেরলে গড় ৮৫ আর তামিলনাড়ুতে ৮২, ছেলেদের একটু কম মেয়েদের থেকে। এই সংখ্যাগুলো নির্দেশ করে যে পশ্চিমবাংলায় প্রাথমিক শিক্ষার মান যথেষ্ট নিচু, প্রধানত সেই কারণেই পড়ুয়ারা অনেকেই আর এগোতে পারে না; কোনও কাজ পায় কিনা সেদিকে মন দেয়। মেয়েদের স্বাধীনতা কম, তাই তাদের বিদ্যালয়েই লেগে থাকতে হয়। এসব তথ্য থেকে পরিষ্কার যে দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ায় বা শিক্ষার মানের বিচারে পশ্চিমবাংলা সিঙ্গাপুরের ধারে-কাছেও নেই। তবে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে সুবিধাজনক অবস্থায় আছে, আমাদের শিক্ষক হওয়ার যোগ্য শিক্ষিত তরুণ বা তরুণী আছে, কারণ আমাদের উচ্চশিক্ষা আগেই কিছুটা বিকশিত হয়েছিল। তবুও শিক্ষক নিয়োগে চূড়ান্ত দুর্নীতি এনে আমরা সুবিধাটা মুছে ফেলতে চাইছি। এক সময় মনে হয়েছিল দুর্নীতিটা নির্বাচনে একটা প্রভাবক হবে, কিন্তু ধর্মীয় বিভাজন তা হতে দিল না। পছন্দটা হয়ে দাঁড়াল এক আধা-তালিবানি শক্তি আর এক হাড়ে-মজ্জায় দুর্নীতিগ্রস্ত ধূর্ত ক্ষমতালোভী শক্তির মধ্যে।

পশ্চিমবাংলার জনবিন্যাস কেমন? ২০১১ সালের জনগণনা থেকে আমরা জানি মুসলমান নাগরিকের সংখ্যা এক-চতুর্থাংশের কিছু বেশি, আর তফসিলি জাতি ও জনজাতির সংখ্যা তার অর্ধেক; অর্থাৎ এই বিশেষ সম্প্রদায়গুলি মিলে জনসংখ্যার পাঁচ ভাগের দুই ভাগ। এঁদের কেন প্রথমেই আলাদা করছি? নির্বাচনে এঁদের প্রধান বিবেচ্য বিষয়গুলিও অনেকাংশে আলাদা কারণ এঁরা বৃহত্তর সমাজের সঙ্গে ভালভাবে মিলে যাননি। মুসলমানদের কথা প্রথমে ধরা যাক। এঁরা মূলত হতদরিদ্র। ‘The Wire’ ওয়েব ম্যাগাজিনের একটি প্রতিবেদনে উল্লিখিত একটি সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে পশ্চিমবাংলার গ্রামাঞ্চলের প্রায় শতকরা আশিজন মুসলমান পরিবারের মাসিক আয় ৫০০০ টাকার নিচে, যা পাঁচজনের একটি পরিবারের জন্য প্রায় দারিদ্র্যসীমা। অবশ্য আমরা সংখ্যাটাকে একটা চটজলদি আন্দাজ হিসাবেই ধরব কারণ গ্রামাঞ্চলে আয়ের অনুমান করা অভিজ্ঞ সমীক্ষকের কাজ, নাহলে নিম্নমুখী ভুল হওয়ার সম্ভাবনা। যাই হোক, এঁরা সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় থাকেন তিনটি জেলায়— মুর্শিদাবাদ, মালদা ও উত্তর দিনাজপুরে। এগুলি মুসলমান-প্রধান জেলা। এর বাইরেও বীরভূম ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় এক-তৃতীয়াংশের বেশি মুসলমানের বসতি। শিক্ষার মানও এঁদের মধ্যে খুবই নিচু— রাজ্যের জনসংখ্যার শতকরা সাতাশ জন হলেও বিদ্যালয়-পরবর্তী শিক্ষায় উপস্থিতি সে অনুপাতের অর্ধেকেরও কম। পশ্চিমবাংলায় শিক্ষার হতাশাজনক চিত্র কিছুটা নিশ্চয় এই সম্প্রদায়ের পিছিয়ে থাকার প্রতিফলন। স্বাভাবিকভাবেই চাকরি-বাকরির ক্ষেত্রে এঁরা প্রতিযোগিতায় পেরে ওঠেন না, কায়িক পরিশ্রম করেই জীবিকা অর্জন করতে হয়। এঁরাই বাঙালি অভিবাসী শ্রমিকদের মূল অংশ। আমার বাড়িতে রাজমিস্ত্রিরা কাজ করতে এলে তাঁদের জিজ্ঞেস করেছিলাম এত কম পয়সায় তোমরা কাজ করো কেন? তাঁরা বলেন মুর্শিদাবাদ থেকে এত শ্রমিক এসে গেছে যে আমরা বেশি মজুরি চাইতে পরি না। সমাজবিরোধী কাজকর্ম থেকে নির্বাচনী জুলুম, সবেতেই মুসলমান যুবক সহজলভ্য ও সবচেয়ে বেশি হানাহানির শিকার। ভোট করাতে এঁদের লাগে, পশ্চিমবাংলায় পুলিশ এঁদের সহজে ঘাঁটায় না, হতভাগ্যদের ভাগ্যের কী তামাশা!

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সংখ্যা সম্প্রতি বেশ বেড়ে গেছে। ২০১১ সালে এর সংখ্যা ছিল পনেরো, ২০১৭-তে তা বেড়ে হয়েছিল ৫৮। স্বাভাবিকভাবেই দাঙ্গার খবরগুলো ছড়াতে দেওয়া হয় না, তবুও কিছু জায়গার নাম আমরা শুনতে পাই। যেমন হাজিনগর, বসিরহাট, ধূলাগড়, প্রভৃতি। RTI করে জানা গেছে ২০২১ থেকে ২০২২ সালের ১৮ মাসে শুধু হাওড়া জেলাতেই দাঙ্গার সংখ্যা ছিল ৫৯। ‘The Wire’-এর প্রতিবেদন জানাচ্ছে এইসব দাঙ্গায় অভিযুক্তদের অনেককেই ঘটনার কয়েক মাসের মধ্যে তৃণমূল নিজেদের দলে টেনে নিয়েছে। চরম দৈন্যের সঙ্গে বিপন্নতা ও রাজনৈতিক দুরাচার কিন্তু সারা ভারতের ছবি নয়, বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতের তো নয়ই। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কেরল রাজ্য। সেখানে মুসলমান জনসংখ্যার অনুপাত পশ্চিমবাংলার মতোই, কিন্তু শিক্ষার হার, এমনকি উচ্চশিক্ষায় অংশগ্রহণের অনুপাত মুসলমান নাগরিকদের যেমন হিন্দুদেরও প্রায় তেমনই। কেরলে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক যে-কোনও দুই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সম্পর্কের বিচারে আদর্শস্থানীয়। এটা শুধু রাজ্য সরকারের কৃতিত্ব নয়, একাধিক ইসলামিক সমাজসংস্কারক ব্যক্তি ও শিক্ষাসংস্থা সেখানে মুসলমান নারী ও পুরুষের শিক্ষার কাজে এগিয়ে এসেছে, তাঁদেরও কৃতিত্ব।

সংখ্যায় মুসলমানদের অর্ধেক হলেও নির্বাচনের ফলাফল প্রাভাবিত করার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তফসিলি জাতি ও জনজাতি সম্প্রদায়গুলি। এঁরাও শিক্ষাদীক্ষায় ও সামাজিক অবস্থানে কিছুটা পিছিয়ে। কিন্তু পশ্চিমবাংলায় এঁদের সঙ্গে সাধারণ হিন্দুদের কোনও শত্রুতামূলক ধর্মীয় বিভেদ নেই। কাজেই এঁদের বিপন্নতা বোধ মুসলমানদের থেকে অনেক কম। সমাজের মূলস্রোত থেকে অনেকটা আলাদা হওয়ায় এঁদের কিছু বিশেষ দাবি থাকে। এই সম্প্রদায়গুলির মধ্যে ভাজপার প্রভাব অনেকটাই, ভাজপার ধর্মীয় বিভেদনীতি এঁদের ভীত করে না যেভাবে মুসলমানদের করে। এ-বছর ধর্মীয় বিভেদের রাজনীতিকে প্রধানমন্ত্রী নিজে নির্বাচনের প্রাক্কালে যে চরম মাত্রায় নিয়ে গেছিলেন তাতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সন্ত্রস্ত হওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল। বিভিন্ন স্থানীয় দ্বন্দ্বের কারণে সংখ্যালঘুদের কোনও একটা ছোট অংশ বিভিন্ন জায়গায় অতীতে ভাজপার সঙ্গে থেকেছে, হিন্দুত্ববাদী হুঙ্কার এবার সেই সুযোগটা সঙ্কুচিত করে দিয়েছে। লোকনীতির (CSDS-Lokneeti) সমীক্ষায় দেখা গেছে সাধারণত মুসলমান সম্প্রদায়ের কম-বেশি তিন-চতুর্থাংশ ভোট বিভিন্ন রাজ্যে একসঙ্গে কোনও ভাজপা-বিরোধী দলের পক্ষে পড়েছে। কিছুদিন আগে প্রণয় রায় (NDTV-র প্রতিষ্ঠাতা) একটি ভিডিও প্রকাশ করেন। সেখানে একজন বয়স্ক মুসলমান ভদ্রলোককে বলতে দেখা যায়: আমাদের শতকরা ৮০ ভাগ ভোট তৃণমূল পায়, কংগ্রেস শক্তিশালী হলে ১০০ ভাগ ভোটই তারা পেত, কিন্তু পশ্চিমবাংলায় তাদের শক্তি কোথায়? কথাটা মুসলমান মনের প্রতিফলন বলেই মনে হয়। কে কাকে ভোট দিয়েছে সঠিকভাবে বোঝার কোনও উপায় নেই, তবু সামগ্রিক ছবি থেকে একটা অনুমান করা যেতে পারে।

বহরমপুরের ঘরের ছেলে, পাঁচবারের সাংসদ অধীর চৌধুরী এবার হেরে গিয়ে মন্তব্য করলেন: আমি হিন্দুও হতে পারলাম না, মুসলমানও না। নির্বাচনের ফলের এর চেয়ে সরল এবং সঠিক ব্যাখ্যা, বোধহয়, হয় না। এ-বছর অধীরের ভোট ২০১৯ সালের ৪৫ শতাংশ থেকে একেবারে ১৩ শতাংশ কমে গেল (হল ৩২ শতাংশ), গুজরাত থেকে উড়িয়ে এনে আবাঙালি ইউসুফ পাঠানকে দাঁড় করিয়েও তৃণমূল পেল ৩৮ শতাংশ (২০১৯-এর তুলনায় এক শতাংশ কম), আর ভাজপা একেবারে ১৬ শতাংশ ভোট বাড়িয়ে পেল ২৭ শতাংশ। মনে রাখতে হবে এই কেন্দ্রে হিন্দু ভোট সম্ভবত ৩৫ শতাংশের কম, যার অর্থ অধীর স্থানীয় মানুষের কাছে যতই পরিচিত হোন তৃণমূলের থেকে মুসলমান ভোট টানতে পারেননি, বরং অনেক হিন্দু ভোট হারিয়েছেন ভাজপার কাছে। এই ভোটের চিত্রটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এর মধ্যে হিন্দু ভোট সংহত হওয়ার প্রবণতা রয়েছে। আরও কিছু কেন্দ্রে, এতটা প্রকট না হলেও, এই প্রবণতা লক্ষ করা যায়।

এই ছোট লেখায় লোকসভা কেন্দ্রগুলির বিস্তারিত পর্যালোচনায় যাব না। শুধু কতগুলো লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য ও সামগ্রিক চিত্রটাই আমাদের আলোচনার লক্ষ্য। আমাদের প্রথম মন্তব্য: মুসলমান ভোট সাধারণভাবে সংহত হয়ে কোনও দলের পক্ষে পড়ে, যদিও স্থানীয় প্রভাব অনেক ক্ষেত্রে ভোট ভাগ করে দেয়। এ-বছর মূল লক্ষ্য ছিল কেন্দ্রে অতি দাম্ভিক ধর্মান্ধ শক্তির বিরোধিতা করা। এ-কাজে যথাসম্ভব ভোট সংহত করাকেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায় গুরুত্ব দিয়েছে। এই বাধ্যবাধকতায় অন্য কোনও বিচার— যেমন লক্ষ্মীর ভাণ্ডার বা অতলান্ত দুর্নীতি— প্রাধান্য পায়নি।

দ্বিতীয় মন্তব্য: মুসলমান ভোট সংহত হওয়া ছাড়াও কিছু উদারপন্থী মানুষ মোদির বিরোধিতায় তৃণমূলকে ভোট দিয়েছেন, পাছে ভাজপা জিতে যায়। আবার হিন্দু ভোট সংহত হওয়ার একটা প্রবণতাও আছে যার ফলে ভাজপার ভোট ভাগ হয়ে কংগ্রেস-বাম জোটের দিকে আসেনি বরং বিপরীতটাই ঘটেছে। কংগ্রেস-বাম মিলিতভাবে ১১.৯ শতাংশ থেকে কমে ১০.৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ভাজপা আর তৃণমূল মিলে আগের লোকসভা নির্বাচনে পেয়েছিল ৮৩.৫ শতাংশ ভোট, যা এবার বেড়ে হয়েছে ৮৪.৫ শতাংশ। অর্থাৎ এই দুই দলের বাইরে বিশেষ একটা পরিসর থাকছে না। এটা বিপজ্জনক মেরুকরণ, এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতি।

তৃতীয় মন্তব্য: মেরুকরণ দুর্বল না হলে কোনও তৃতীয় শক্তির উত্থান সম্ভব নয়। ভাজপার আসনসংখ্যা অনেক কমলেও ভোটের শতাংশ কমেছে মাত্র দেড় শতাংশ (৪০.২ থেকে নেমে ৩৮.৭ শতাংশ) আর তৃণমূলের বেড়েছে আড়াই শতাংশ (৪৩.৩ থেকে ৪৫.৮ শতাংশ)। পাল্লাটা উল্টে যাওয়া আদৌ কঠিন নয়। মানুষ বিদ্যালয়ে নিয়োগ কেলেঙ্কারি এবং তা ঢাকতে সরকারের সমস্ত প্রচেষ্টা, রেশনদুর্নীতি, সন্দেশখলি, কিছুই ভুলে যায়নি। বিধানসভা নির্বাচনের আগে এসব আবার প্রকাশিত হবে তদন্তে ও আদালতের রায়ে। যা-কিছু চাপা পড়ে, তা-ই হারিয়ে যায় না। এই পরিপ্রেক্ষিতে মনে হয় ভাজপা যদি ঘৃণা-বক্তৃতা বন্ধ করে বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি কিছুমাত্র শ্রদ্ধাশীল হতে পারে, আর অতীতে নিজেদের পক্ষে থাকা মুসলমান ভোট আবার টেনে নিতে পারে, যা বিরাট অসম্ভব কাজ নয়, তাহলে তাদের ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা উজ্জ্বল। অতএব বাঙালির দক্ষিণমুখী যাত্রা বেগবান হওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট, লোকসভা ও বিধানসভা ভোটের গতিপ্রকৃতি আলাদা হলেও।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4874 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...