ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য— সরকারের প্রতিশ্রুতিভঙ্গের আর এক নজির

দেবাশিস মিথিয়া

 


বিজেপি ক্ষমতায় আসার আগে স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ মেনে ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারণ করবে— এমনই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু ক্ষমতায় স্থায়ী হয়েই সরকার কৃষক-মারা ‘কৃষি আইন’ চালু করতে উদ্যোগী হয়। কৃষক আন্দোলনের চাপে সেই আইন প্রত্যাহার করা হয় এবং সেই সময়েও সরকার পুনরায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল স্বামীনাথন কমিটির সুপারিশ মেনে এমএসপি স্থির করবে এবং কৃষিপণ্যের সরকারি ক্রয় বাড়াবে। কিন্তু ২০২৩ সালের বাজেটে সরকার কৃষি সহায়তা প্রায় প্রত্যাহার করে নেয়। ২০২৪ সালের অন্তর্বর্তীকালীন বাজেটে তো দেখা গেল পিএম-আশা স্কিমে বরাদ্দের পরিমাণ গতবারের তুলনায় ২১ শতাংশ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে

 

ভারতে কৃষকের প্রকৃত সংখ্যা বিভিন্ন গবেষণাপত্রে বিভিন্ন। পরিসংখ্যানের এমন ফারাক সরকারি নথিতেও চোখে পড়ে। তবে ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশনের হিসেব অনুযায়ী ২০২২ সালের শেষে দেখা যাচ্ছে দেশের ৪৩ শতাংশ মানুষ চাষ-আবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। চমকপ্রদ বিষয় হল মোট মহিলাদের ৫৯ শতাংশ কৃষিতে যুক্ত। স্বাভাবিকভাবে নির্বাচনে এদের মন জয় করতে সবাই মরিয়া। কৃষকদের উন্নয়নে রাজনৈতিক দলগুলি তাদের নির্বাচনী ইস্তেহারে প্রতিশ্রুতিতে ভরিয়ে দিয়েছেন। তবে অতীত অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর নয়। কৃষকের আয় বাড়িয়ে তাঁর জীবনযাত্রার মানকে উন্নত করতে স্বাধীন ভারতে কত যে কমিটি হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। এক-একটা কমিটির এক-একরকমের সুপারিশ। কিন্তু কমিটি তো সুপারিশটুকুই করতে পারে। প্রয়োগের দায়িত্ব দেশের সরকারের। সেখানেই সবচেয়ে বড় ফাঁক রয়ে গেল। ফলে চাষিরা যে তিমিরে ছিলেন সেই তিমিরেই রয়ে গেলেন।

সময়টা ২০০৪ সাল। ততদিনে নয়া-অর্থনীতির কুফল চাষিদের গলায় ফাঁস হয়ে চেপে বসেছে। কৃষকদের আত্মহত্যা ক্রমশ বাড়ছে। সেই সময়ে দেশের ইউপিএ সরকার ক্ষমতায় ফিরে ‘ন্যূনতম সাধারণ কর্মসূচি’ ঘোষণা করল। তাতে গুরুত্ব পেল কৃষক, কৃষিশ্রমিক ও ক্ষেতমজুরদের অবস্থার উন্নতির প্রশ্নটি। এই লক্ষ্যে এমএস স্বামীনাথনের নেতৃত্বে গঠিত হল ‘ন্যাশনাল ফার্মার্স কমিশন’।

 

স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ

কৃষকের দুর্দশা বিচার করে কমিশন অনেকগুলি সুপারিশ করেছিল। যদিও সেই সময়ে তা কার্যকরী হয়নি। সেগুলির মধ্যে ফসলের লাভজনক দাম নিশ্চিত করতে ‘ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বা এমএসপি’-র সঠিক বাস্তবায়ন এবং গণবণ্টনব্যবস্থার মাধ্যমে জনগণের কাছে পুষ্টিকর খাদ্য পৌঁছে দিতে ধান ও গম ছাড়া অন্যান্য ফসল এমএসপিতে কেনার সুপারিশ— যা এই মুহূর্তে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। স্বামীনাথনের নেতৃত্বাধীন ‘ন্যাশানাল ফার্মার্স কমিশন’ উৎপাদন ব্যয়ের (দেশের সব রাজ্যের) ‘ওয়েটেড অ্যাভারেজ’-এর উপর অতিরিক্ত ৫০ শতাংশ ধরে এমএসপি নির্ধারণ করা উচিত বলে পরামর্শ দেয়। ‘ন্যাশানাল ফার্মার্স কমিশন’ চাষের মোট খরচ হিসাব করার ক্ষেত্রে সমস্ত খরচের সঙ্গে জমির খাজনা এবং কৃষি মূলধনের সুদকেও যুক্ত করার সুপারিশ করে। যাকে চাষের অর্থনৈতিক খরচ বলে। কেন্দ্রীয় সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন ‘কমিশন ফর এগ্রিকালচারাল কস্ট অ্যান্ড প্রাইস’ চাষের খরচের যে হিসেব দিল তাতে চাষের খরচের মধ্যে নগদ খরচ ও পারিবারিক শ্রমের মজুরিকে অন্তর্ভুক্ত করা হলেও বাদ পড়ল জমির খাজনা এবং কৃষি মূলধনের সুদ। ফলে চাষের খরচের সরকারি হিসাব ন্যাশানাল ফার্মার্স কমিশনের হিসেবের চেয়ে অনেকটাই কম হল। সরকারি হিসেব অনুযায়ী ২০২২-২৩ সালে ধানের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারিত হয় কুইন্টাল প্রতি ২০৪০ টাকা। কিন্তু ন্যাশনাল ফার্মার্স কমিশনের সুপারিশ মেনে নিলে তা কুইন্টাল প্রতি ২৭০৮ টাকায় গিয়ে দাঁড়াত।

 

ন্যূনতম সহায়ক মূল্য কী

ন্যূনতম সহায়ক মূল্য সরকার নির্ধারিত ফসলের দাম— যা সারা দেশে নির্দিষ্ট ফসলের জন্য একই। খাদ্যশস্যের মজুত ভাণ্ডার গড়ে তুলতে এই দামে সরকার কৃষকের কাছ থেকে ফসল কেনে। খাদ্যশস্যের এই মজুত ভাণ্ডার গণবণ্টনে এবং অন্যান্য কল্যাণমূলক প্রকল্পে ব্যবহৃত হয়। সংগৃহীত শস্যের একাংশ ভবিষ্যতের জন্য ‘বাফার স্টক’ হিসেবে রাখা হয়। এছাড়াও খোলা বাজারে ফসলের দাম খুব কমে গেলে সরকারের কাছে কৃষক তার ফসল ন্যায্য দামে বিক্রি করতে পারেন। তাই এমএসপি কৃষকের কাছে তাঁর ফসলের নিশ্চিত মূল্য। এতে কৃষক কিছুটা ক্ষতির হাত থেকে রেহাই পান। আবার ক্রেতাও সাধ্যানুযায়ী দামে কৃষিপণ্য কিনতে পারেন।

 

ইতিমধ্যে বিজেপি সরকার কী করল

বিজেপি ক্ষমতায় আসার আগে স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ মেনে কৃষকদের ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারণ করবে— এমনই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু ক্ষমতায় স্থায়ী হয়েই সরকার কৃষক-মারা ‘কৃষি আইন’ চালু করতে উদ্যোগী হয়। যদিও কৃষক আন্দোলনের চাপে সেই আইন প্রত্যাহার করা হয়। সেই সময়ে সরকার আন্দোলনকারীদের পুনরায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল স্বামীনাথন কমিটির সুপারিশ মেনে এমএসপি স্থির করবে এবং কৃষিপণ্যের সরকারি ক্রয় বাড়াবে। কিন্তু ২০২৩ সালের বাজেটে মার্কেট ইন্টারভেনশন স্কিম এবং প্রাইস সাপোর্ট স্কিমে বরাদ্দ কমিয়ে নামমাত্র করে, অর্থাৎ কৃষি সহায়তা প্রায় প্রত্যাহার করে নেয়। ২০২৪ সালের অন্তর্বর্তীকালীন বাজেটে দেখা গেল পিএম-আশা স্কিমে বরাদ্দের পরিমাণ গতবারের তুলনায় ২১ শতাংশ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ এই প্রকল্পগুলিই দেশের এমএসপি-ভিত্তিক কৃষিপণ্যের সরকারি ক্রয়ের নির্ণায়ক। তবে, সরকার এই পথে যে হাঁটবে তার ঈঙ্গিত সেদিন-ই পাওয়া গিয়েছিল যেদিন তারা সুপ্রিম কোর্টে একটা এফিডেভিট দাখিল করে বলেছিল, এমএসপি-র নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ করা অসম্ভব। সমস্যা আরও বাড়িয়ে তারা একটি নির্দেশ জারি করল, যে-সব রাজ্য কৃষকদের কেন্দ্রীয় সরকার নির্ধারিত এমএসপি-র অতিরিক্ত বোনাস দেবে, সেই সব রাজ্যে সংগ্রহ বন্ধ করে দেওয়া হবে। এইসব কৃষকবিরোধী কাজ করতে গিয়ে, সরকার এমএসপি-সংক্রান্ত প্রতিশ্রুতি বেমালুম এড়িয়ে গেল। বিগত ২ বছরে তা নিয়ে একবারও রা কাড়ল না, উল্টে কৃষিকে কর্পোরেট হাতে তুলে দেওয়ার সবরকম চেষ্টা চালাল।

 

কৃষকের দাবি ও আন্দোলন

অধৈর্য কৃষকরা স্বামীনাথন কমিশনের ফর্মুলা মেনে সমস্ত ফসলের এমএসপি নির্ধারণ ও তার আইনি নিশ্চয়তার দাবিতে নতুন করে আন্দোলন শুরু করেছেন। সংযুক্ত কিষান মোর্চা এবং কিষান মজদুর মোর্চার নেতৃত্বে পঞ্জাব, হরিয়ানা এবং উত্তরপ্রদেশ থেকে ২০০টিরও বেশি কৃষক সংগঠনের প্রায় দশ হাজার কৃষক শম্ভু সীমান্তে জড়ো হয়েছেন। প্রশাসন আন্দোলনকারীদের শহরে ঢোকা বন্ধ করতে সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া থেকে শুরু করে গুলি চালানো, যা যা করার সব করেছে। পুলিশের গুলিতে ৫ জন চাষি মারা গেছেন। যার মধ্যে শুভকরন সিং নামের ২১ বছরের এক তরুণও রয়েছেন— যিনি তাঁর সংসারের একমাত্র রোজগেরে। সরকারের কর্মকাণ্ড দেখে মনে হচ্ছে অনুপ্রবেশকারীদের ঠেকাচ্ছেন। অর্থনীতিবিদ মধুরা স্বামীনাথন বলেছেন ‘সরকার কি ভুলে গেল, এঁরা কেউ সমাজবিরোধী নন? এঁরা আমাদের অন্নদাতা।’ আন্দোলনের সমর্থনে ইতিমধ্যে একদিন গ্রামীণ ভারতে বনধ পালিত হয়েছে। ৪ ঘন্টা রেলের চাকা বন্ধ থেকেছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের সঙ্গে কৃষক নেতারা একাধিকবার আলোচনায় বসেছেন কিন্তু গ্রহণযোগ্য কোনও সমাধানসূত্র বেরিয়ে আসেনি।

 

কৃষকের আয় বৃদ্ধির রাস্তা

ফসলের সঠিক ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারণ এবং সেই দামে সরকারি ক্রয় সুনিশ্চিত হলে কৃষকের আয় বাড়বে— বিষয়টি সরকারের কাছে গুরুত্ব পেলে আজকের কৃষক আন্দোলন হয়ত ঠেকানো যেত। তবে বর্তমান কৃষক আন্দোলন আমাদের অনেকগুলি প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়েছে। বর্তমান সরকার ২০১৬ সালে সিদ্ধান্ত নেয়, ২০২২ সালের মধ্যে চাষির আয় দ্বিগুণ করবেন। সেই সময়ে আয় বাড়ানোর হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেওয়া হয় ‘ক্রপ ডাইভার্সিফিকেশন’ বা ‘শস্য বৈচিত্র্যকরণ’-কে। ঠিক হয় খাদ্যশস্যের পরিবর্তে উচ্চ-মূল্যযুক্ত শস্য উৎপাদনে জোর দেওয়া হবে। কিন্তু উৎপাদন করলেই তো আর আয় বাড়ে না। লাভজনক দামে তাকে বিক্রির ব্যবস্থা করতে হয়। ২০১৬ সালে কৃষকদের গড়  মাসিক আয় যা ছিল ২০২২-২৩ সালে তা খুব একটা বাড়েনি। চাষি প্রায় একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন। যদিও সরকারের দাবি কৃষকের আয় দ্বিগুণ হয়েছে। তবে এটা ঠিক, লাভজনক দামে ফসল বিক্রির খামতি মেটাতে পারলে কৃষকের আয় বাস্তবিকই বাড়ত।

 

এমএসপি র আইনি স্বীকৃতি কেন

শুধু এমএসপি নির্ধারণ কৃষকের আয় নিশ্চিত করে না। ওই বাড়তি দামে কৃষক তাঁর বিক্রয়যোগ্য উদ্বৃত্ত বিক্রি করতে পারছেন কিনা সেটা নিশ্চিত হওয়া জরুরি। তাই এমএসপি-তে প্রকৃত সরকারি ক্রয় নিশ্চিত হলেই চাষি এমএসপির সুবিধা পাবেন, নচেৎ নয়। এখন দেখা যাক মোট উৎপাদনের কতটা সরকার কেনে, কতটা খোলা বাজারে চাষি বিক্রি করেন। গণবণ্টনব্যবস্থার মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তাকে সুনিশ্চিত করতে সরকার এমএসপিতে প্রধানত ধান আর গম কেনে। পরিসংখ্যান বলছে সরকার যে পরিমাণ গম কেনে তা মোট উৎপাদনের ৪০ শতাংশ। ধানের ক্ষেত্রে এই পরিমাণ ৩৫-৩৭ শতাংশ। গমের বেশিরভাগটাই কেনে পঞ্জাব, হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশ থেকে এবং ধানের সিংহভাগ কেনে পঞ্জাব-সহ ৬টি রাজ্য থেকে। অভিজ্ঞতা বলছে এই রাজ্যগুলিতে ধান, গম বিক্রি নিশ্চিত জানার ফলে এখানকার চাষিরা ধান ও গম চাষেই বেশি উৎসাহী। এমএসপিতে ডাল, তৈলবীজ এবং মোটাদানা শস্যের সরকারি ক্রয় নেই বললেই চলে। ফলে এই ফসল চাষে তাঁদের আগ্রহও নেই। সেইজন্য ফসলগুলির উৎপাদন দারুণভাবে হ্রাস পেয়েছে। সমস্ত চাষি এবং সমস্ত ফসলকে এমএসপির সুবিধা দিতে হলে সবার আগে প্রয়োজন এমএসপির আইনি স্বীকৃতি।

 

এমএসপি ও শস্য বৈচিত্র্যকরণ

মজার বিষয় হল এমএসপি কৃষকের আয় বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ হলেও আজ অবধি কোনও কৃষি আইনে এমএসপি বাধ্যতামূলক— এটা বলা নেই। দেশের সরকার কোনও বছর এমএসপির ঘোষণা না করলে তাকে আইনি উপায়ে বাধ্য করা যাবে না। খোলা বাজারে ক্রেতাকে এমএসপিতে ফসল কেনায় জোর করারও সুযোগ নেই। বর্তমানে কোন ফসল এমএসপির আওতায় আসবে, সেই দামে সরকারি ক্রয় কতটা হবে, সবটাই সরকারের মর্জিমাফিক। বর্তমান কৃষক-আন্দোলনের দাবি স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ মেনে এমএসপি দিতে হবে এবং এমএসপির আইনি স্বীকৃতি চাই। এমএসপি আইনি বৈধতা পেলে চাষি এমএসপিতে যেকোনও ফসল বিক্রির নিশ্চিত প্রতিশ্রুতি পাবেন। অন্যান্য ফসল চাষে চাষির আগ্রহ বাড়বে। চাষিরা ধান এবং গম বাদে তৃতীয় কোনও ফসল, যেমন তৈলবীজ, ডাল, ভুট্টা কিংবা অন্য ফসল ফলাবেন। শস্যচাষে বৈচিত্র্য আসবে। যার উপর নির্ভর করে কৃষকের আয় বাড়ানোর লক্ষ্য সফল হবে। ঠেকিয়ে দেওয়া যাবে ভোজ্যতেল এবং ডালের আমদানি। সাশ্রয় ঘটবে বৈদেশিক মুদ্রারও। তবে সচেতন থাকতে হবে, বাণিজ্যশস্যের উৎপাদন বাড়াতে গিয়ে খাদ্যশস্যের উৎপাদন তলানিতে না ঠেকে। তাহলে খাদ্যের জোগানে বাড়তি চাপ পড়বে।

 

পড়ুন, ইলেকশন এক্সপ্রেস ২০২৪

 

এমএসপি ও পরিবেশ

এমএসপিতে মূলত ধান ও গমের সংগ্রহ হয় বলেই এই দুই শস্য চাষে চাষিদের ঝোঁক বেশি। কিন্তু ধান উৎপাদনে জলের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। সেটা পুরোটাই সেচনির্ভর। গম চাষে জলের ব্যবহার ধানের তুলনায় কম হলেও যা লাগে তা সেচের জল। এমএসপির লোভে কৃষকদের ধান ও গম চাষের এই ঝোঁক ভূগর্ভস্থ জলস্তরকে অনেকখানি কমিয়ে দিচ্ছে। এছাড়া ধান-গম চাষে অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে জমির উর্বরতা কমছে। এতে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। সরকার এমএসপিতে ২৩টি ফসল-ই সংগ্রহ করবে, সেটা আইনি স্বীকৃতি পেলে ধান গমের চাষ কমবে। বন্ধ হবে অতিরিক্ত জলের খরচ, কমবে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার। এর ফলে ভারসাম্য ফিরবে পরিবেশে।

 

সরকারের কী করণীয়

তথ্য অনুযায়ী দেশের মাত্র ৬-১০ শতাংশ কৃষক এমএসপির দ্বারা উপকৃত হন। এমএসপি আইনি স্বীকৃতি পেলে তার সুযোগ সর্বজনীন হবে। দেশের মোট কৃষিপণ্য উৎপাদনের সবটাই বিক্রয়যোগ্য নয়। চাষির ব্যক্তিগত ভোগ, বীজ হিসেবে সংরক্ষণ, ইঁদুরের খাওয়া এবং ফসল স্থানান্তরের অপচয় বাদ দিয়ে যে অবশিষ্ট ফসল রইল তার ৫০ শতাংশ যদি সরকার এমএসপিতে কেনেন সেক্ষেত্রে সরকারি কোষাগার থেকে ব্যয় হবে প্রায় ৫ লাখ কোটি টাকা। যা ২০২২-২৩ বাজেট-বরাদ্দের মাত্র ১১ শতাংশ। সরকার অনুগামীরা বলছেন এই টাকা শস্য কেনায় ব্যয় করলে দেশের অন্য উন্নয়ন বাধা পাবে। তাঁরা মনে হয় ভুলে গেছেন দেশের প্রায় অর্ধেক মানুষ কৃষিক্ষেত্রে যুক্ত। কৃষকদের আয় বৃদ্ধিতে এই অর্থ সামান্যই। শুধু তাই নয়, কৃষকের আয় বাড়লে অর্থনীতির গুণক তত্ত্ব মেনে কৃষিবহির্ভূত ক্ষেত্রেও কার্যকরী চাহিদা সৃষ্টি হবে। ফলে অর্থনীতি গতি পাবে। অন্য যে কথাটা খুব গুরত্বপূর্ণ, তা হল বাজেটে কর্পোরেট ট্যাক্স ছাড় দেওয়া হয়েছে প্রায় ১.৫ লাখ কোটি টাকা। তাহলে কৃষকদের জন্য ব্যয়বরাদ্দে এত কার্পণ্য কেন? অনেকে আবার বলছেন এত শস্য মজুত রাখার পরিকাঠামো সরকারের নেই। কৃষকনেতারাই এই সমস্যার সমাধান দিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন সবটা সরকারকে কিনতে হবে না। খোলা বাজারে ফসল বিক্রি করবেন চাষি। এতে চাষি এমএসপি র কম যতটুকু পাবেন সেই ফারাকটুকু তাঁর অ্যাকাউন্টে সরকার দিয়ে দিলেই সমস্যা মিটে যাবে।

 

পরিণতি কী হতে পারে

সরকার কৃষক আন্দোলনকে শুধু পঞ্জাবের আন্দোলন ভাবছে। তাই চতুর্থবারের বৈঠকে প্রস্তাব দিয়েছে ধান, গম ছাড়া ডাল, ভুট্টা ও তুলা মিলিয়ে মোট পাঁচটি ফসল এমএসপিতে সংগ্রহ করা হবে তাও পাঁচ বছরের জন্য। কৃষকনেতারা এই প্রস্তাবে সায় দেননি। তাঁদের দাবি সরকার যে ২৩টি ফসলের এমএসপি ঘোষণা করেছে সেই ২৩টি ফসলেরই সরকারি ক্রয়ের আইনি নিশ্চয়তা দিতে হবে এবং সেই এমএসপি হতে হবে স্বামীনাথন কমিটির সুপারিশ মেনেই। এখনও পর্যন্ত চাষিরা নিজেদের দাবিতে অনড়। দেখার বিষয় শেষ হাসি কে হাসে!

 

পড়ুন, গুজরাত গণহত্যার বিচার হয়নি

 

স্বাধীনতার এত বছর পরেও ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য চাইলে কৃষকদের পুলিশের গুলিতে মরতে হচ্ছে! ‘অন্নদাতাদের’ এইরকম চরম দুর্দশার মধ্যে রেখে দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি কি সম্ভব? সরকার আন্দোলনকারীদের দাবি মেনে নিলে চাষে বৈচিত্র্য আসবে। কৃষকের আয় বাড়বে, বাঁচবে পরিবেশও। কৃষির হাত ধরে দেশের অর্থনীতি এক ধাপ এগিয়ে যাবে। সফল হবে জিডিপি বৃদ্ধির হারে রেকর্ড গড়ে ‘উন্নত’ ভারত তৈরির স্বপ্ন।


*মতামত ব্যক্তিগত

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4667 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...