মোদিনমিক্স: আশার চেয়ে আশঙ্কা বেশি

দেবাশিস মিথিয়া

 


অর্থনীতির গতিপ্রকৃতির বিচারে গত ৫ বছরে বিজেপি সরকার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির ধার দিয়েও যায়নি— পরিসংখ্যান তেমনই বলছে। মোদি তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হয়ে ক্যামেরার সামনে প্রথম যে ফাইলটিতে সই করলেন, সেটি পিএম কিষানে কৃষকদের জন্য বরাদ্দ ৬০০০ টাকার ষোলোতম কিস্তি। ৯ কোটি ৩০ লক্ষ কৃষকের জন্য মোট ২০ হাজার কোটি টাকা অনুমোদন করা হল। মজা হল, এই টাকাটা কৃষকদের নিজেদের। হিসেবের মারপ্যাঁচ ঘটিয়ে চাষিদের ফসলের এমএসপি কম দিয়ে যেটা সরকার বাঁচিয়েছিল তা-ই অনুদান হিসেবে ফেরত দেওয়া হল। মোদির সই করার ছবি যখন বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে তখন পঞ্জাব-হরিয়ানা সীমানার খনৌরিতে, জুনের ঠা ঠা রোদে অনশনরত কৃষকরা একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সামনে ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেন। কৃষকদের কল্যাণে মোদি দায়বদ্ধ হলে জয়ের পর, আন্দোলনরত অন্নদাতাদের কাছে দৌড়ে যেতেন বা সমাধানসূত্র বের করতে প্রতিনিধি দল পাঠাতেন। ক্যামেরার সামনে ফাইলে সই, সস্তা চমক ছাড়া কিছুই নয়

 

অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় অর্থনীতিতে নোবেল পাওয়ার পর কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধি টুইট করে বলেছিলেন, “অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গবেষণা ন্যায়ের ধারণা তৈরি করতে সাহায্য করেছে যা দারিদ্র্য দূর করে ভারতীয় অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার ক্ষমতা রাখে। অপরদিকে মোদিনমিক্স, ভারতীয় অর্থনীতিকে ধ্বংস করছে এবং দারিদ্র্যকে বাড়িয়ে তুলছে।”

তার ঠিক একমাস পর নভেম্বর ২০১৯-এ বললেন, “মোদিনমিক্স অত্যন্ত খারাপ।” কারণ, সরকারকে তার নিজস্ব তথ্যই লুকিয়ে রাখতে হচ্ছে। তথ্যটি হল ক্রেতাদের ভোগ-ব্যয় সংক্রান্ত ‘এনএসও’-র সমীক্ষার ফল। সেখানে দেখা গেছে গ্রামীণ চাহিদা হ্রাসের জন্য ভোগ-ব্যয় সর্বনিম্ন। এই রিপোর্টটি ২০১৯-এর ১৯ জুন, প্রকাশিত হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু ফলাফল সরকারের বিপক্ষে যাওয়ার কারণে সেটিকে আটকে রাখা হয়েছিল।

এখানে প্রশ্ন উঠতেই পারে, যিনি প্রশ্ন তুলছেন তিনি মোদি সরকার-বিরোধী দলের মুখ আর যখন প্রশ্ন তুলছেন তখন মোদি-২ সরকারের বয়স সবে মাত্র ৫/৬ মাস। তারপর আরও সাড়ে ৪ বছর মোদির নেতৃত্বে সরকার চলেছে। মেয়াদ শেষে ১৮তম লোকসভা নির্বাচন হয়েছে। ভোটে জিতে মোদি পুনরায় প্রধানমন্ত্রী পদে শপথ নিয়েছেন।

এখন দেখে নেওয়া যাক, মোদিনমিক্স কী। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে চলা সরকারের অর্থনৈতিক নীতিগুলিকে এক কথায় মোদিনমিক্স বলে। দেশের অগ্রগতি সর্বত্র ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিতে বিগত মোদি সরকার অর্থনৈতিক সংস্কারের বেশ কিছু প্রস্তাব দেয়। মূল লক্ষ্য, বিপুল সংখ্যক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে ভারতকে একটি বৈশ্বিক উৎপাদন কেন্দ্রে পরিণত করা। এই কাজে সফলতা পেতে, সরকার পরিকাঠামো উন্নয়ন, প্যান-ইন্ডিয়ান কানেক্টিভিটির জন্য ডিজিটাল ইন্ডিয়া ও দেশকে পরিষ্কার রাখতে স্বচ্ছ ভারতের পরিকল্পনা করে। একইভাবে দেশের সার্বিক বৃদ্ধিতে উপযুক্ত গতি আনতে এবং দক্ষতা বাড়াতে স্মার্ট সিটি এবং স্কিল ইন্ডিয়ার উদ্যোগও গ্রহণ করে। এই সমস্ত উদ্যোগগুলিকেই একসঙ্গে মোদিনমিক্স বলে। বিজেপির কথায় মোদিনমিক্স, মোদি সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন ভাবনার সমষ্টি।

মোদিনমিক্সের উৎপত্তি প্রধানমন্ত্রী মোদির কারণে হলেও এর একটি রাজনৈতিক ইতিহাস রয়েছে। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা ভারত ছেড়ে যাওয়ার পর ভারতের তৎকালীন নেতাদের জাতীয় অর্থনীতি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা ছিল না। তাঁরা সাম্যবাদের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত রাশিয়ার সমাজতন্ত্রের নীতিকে গ্রহণ করেন। স্বাধীনতার পর থেকে ভারতে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগে বাধা ছিল। সমাজতন্ত্র এবং জাতীয় পরিকল্পনা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে গিয়ে অর্থনীতিতে মিশ্র সাফল্য মিলেছে। ১৯৯১-এর সঙ্কট ভারতের চোখ খুলে দেয়। তৎকালীন সরকার বাজারচালিত অর্থনীতিকে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। এই নতুন আর্থিক নীতিতে দেশের নির্ভরতা ছিল অনেকদিন। মোদি জমানায় সেই ভাবনায় বদল আসে। এখন দেখার সেই বদল দেশের অর্থনীতিতে কতটা গতি দিল। মোদিনমিক্সের কয়েকটি প্রকল্পের দিকে চোখ বোলালে কিছুটা ধারণা হতে পারে। বোঝা যেতে পারে ভাবনার পরিবর্তন কতটা বাস্তবের কাছাকাছি।

 

প্রকল্প ১: মেক ইন ইন্ডিয়া

২০১৪ সালের স্বাধীনতা দিবসে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেওয়ার সময় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জনসমক্ষে মেক ইন ইন্ডিয়ার ঘোষণা করেন। তিনি দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক উভয় কোম্পানিকে ভারতে উৎপাদনের জন্য আমন্ত্রণ জানান। উল্লেখ করেন সরকার এ-ব্যাপারে সবরকম সাহায্য ও সহযোগিতা করবে। মেক ইন ইন্ডিয়ার মূল লক্ষ্য হল ভারতকে একটি বিশ্বমানের উৎপাদন কেন্দ্রে পরিণত করে বিপুল সংখ্যক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। একই সঙ্গে ভারতীয় অর্থনীতিকে বিশ্বের অন্যান্য উন্নত অর্থনীতির সঙ্গে সমানভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। মেক ইন ইন্ডিয়ার চারটি প্রধান স্তম্ভ—

  • ভারতে ব্যবসা-সংক্রান্ত জটিলতা কমিয়ে বাণিজ্যবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করতে নতুন উদ্যোগ গ্রহণ। একই সঙ্গে উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করা।
  • মেক ইন ইন্ডিয়ায়, দেশে নতুন বাণিজ্য পরিকাঠামো তৈরিতে সরকার অগ্রণী ভূমিকা নেবে। বেসরকারি উদ্যোগে বাণিজ্য পরিকাঠামো তৈরিতেও সরকার সাহায্য করবে।
  • নতুন প্রযুক্তি এবং ব্যবসায়িক ক্ষেত্র তৈরি করা মেক ইন ইন্ডিয়ার অন্যতম লক্ষ্য। এই কাজে, ২৫টি সেক্টরকে আলাদা করে চিহ্নিত করা হয়েছে।
  • ব্যবসা সম্বন্ধে গতানুগতিক মানসিকতার পরিবর্তনে সরকার উদ্যোগী হবে।

বাস্তবতা: দুর্বল পরিকাঠামো, শিল্পের জন্য বিদ্যুৎ ও দক্ষ শ্রমিকের অভাব, বিশৃঙ্খল সমাজ, দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থা এবং দুর্বল শাসন— ফলে কাম্য সাফল্য আসেনি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বর্তমান ভারতীয় রেলের পরিকাঠামো পড়ে আছে চিনের ১৯৮০ সালের রেল পরিকাঠামোতে। বেইজিং এবং সাংহাইতে সারা বছর কোনও লোডশেডিং হয় না অথচ ভারতের আইটি শহর ব্যাঙ্গালোরে দিনের লম্বা সময় বিদ্যুৎ থাকে না। মুম্বাই এবং নয়াদিল্লির মতো মেগা শহরগুলিতেও খুব ঘন ঘন লোডশেডিং হয়।

 

প্রকল্প-২: ডিজিটাল ইন্ডিয়া

মোদি ডিজিটাল ইন্ডিয়া প্রোগ্রাম চালু করেছিলেন। যার লক্ষ্য দেশবাসীর কাছে সরকারি পরিষেবাগুলিকে ইলেকট্রনিক্যালি পৌঁছে দেওয়া। সরকারি কাজে কাগজপত্রের পরিমাণ কমাতে গ্রামীণ এলাকা-সহ সর্বত্র উচ্চ-গতির ইন্টারনেট অ্যাক্সেস নিশ্চিত করতে ডিজিটাল পরিকাঠামো তৈরি করা। দেশের জনগণকে ডিজিটাল শিক্ষায় শিক্ষিত করতে প্রচার-সহ দেশের দরিদ্র মানুষদের ডিজিটাল সচেতনতা বাড়ানো। এই প্রকল্পটি ভারতকে ডিজিট্যালি ক্ষমতায়িত করার পাশাপাশি দেশকে জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতিতে রূপান্তরিত করবে।

বাস্তবতা: ডিজিটাল ইন্ডিয়ার প্রত্যাশা পূরণ বাস্তব থেকে বহু দূরে। সরকার সকলের জন্য ডিজিটাল ভারতের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে কিন্তু পানীয় জল এবং খাদ্যসামগ্রীর মতো মৌলিক প্রয়োজনীয়তাগুলির কী হবে? ডিজিটাল ইন্ডিয়াতে বায়ু এবং জলের চেয়ে ব্যান্ডউইডথ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ডিজিটাল ইন্ডিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বিগত সরকারের তুলনায় মোদির নেতৃত্বাধীন সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা বেশি— তার কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এই প্রকল্পের অধীনে প্রতিশ্রুতিগুলি অর্জন করা সত্যিই কঠিন বলে মনে হচ্ছে কারণ ভারতে প্রয়োজনীয় অপটিক্যাল পরিকাঠামো নেই এবং এমনকি জনসংখ্যার একটি বড় অংশের কাছে এখনও বিদুৎ সংযোগ পৌঁছায়নি।

 

প্রকল্প-৩: স্টার্ট-আপ ইন্ডিয়া

আবিষ্কারক, উদ্ভাবক ও নতুন নতুন ব্যবসায় বিনিয়োগে আগ্রহী ব্যক্তিদের জন্য গৃহীত প্রকল্প। মোদি সরকার নতুন স্টার্ট-আপের জন্য দশ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে। সরকার স্টার্ট-আপগুলিকে শুরুতে প্রাথমিক সুযোগসুবিধা দিয়ে সাহায্য করবে এবং প্রথম ৩ বছর তাদের ব্যবসার জন্য কোনওরকম কর দিতে হবে না। এই উদ্যোগটি অনেক নতুন উদ্যোক্তাকে বাজারে আনবে বলে আশা করা হয়েছিল।

বাস্তবতা: তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য স্টার্ট-আপ ইন্ডিয়া একটি ভাল প্রচেষ্টা। তবে, স্টার্ট আপের নামে পরিবেশ ও ইকোসিস্টেম ধ্বংস করা যায় না। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, এই ধরনের ধ্বংসকে ঠেকানোর কোনও ব্যবস্থা নেই।  পরিবেশের অবনতি, বনভূমি দখল এবং ব্যবসা ও শিল্পের কারণে তৈরি দূষণের মতো সমস্যাগুলি থেকে সরকার চোখ ঘুরিয়ে রেখেছে। তাছাড়াও, স্টার্ট-আপগুলিকে দেওয়া আর্থিক সহায়তা অনেক ক্ষেত্রেই ‘অকার্যকর সম্পদ’ বা ‘নন-পারফরমিং অ্যাসেটে’ পরিণত হয়েছে।

 

প্রকল্প৪: স্মার্ট সিটি

স্মার্ট সিটি উদ্যোগ হল প্রধানমন্ত্রী মোদির একটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী পরিকল্পনা। তিনি ভারতীয় শহরগুলিকে বিশ্বব্যাপী ব্যবসা এবং শিল্প কেন্দ্রে রূপান্তরিত করতে চেয়েছিলেন৷ এই শহরগুলিকে উদ্ভাবন এবং বৃদ্ধির নিরিখে মডেল করতে চেয়েছিলেন। মোদি ২৫ জুন ২০১৫-এ ১০০টি শহরকে ‘স্মার্ট শহর’ রূপে গড়ে তোলার জন্য একটি ফ্ল্যাগশিপ স্কিম চালু করেছিলেন৷ একই সঙ্গে ‘স্মার্ট গ্রাম’ তৈরির পরিকল্পনাও গৃহীত হয়। এই গ্রামগুলিতে ইন্টারনেট অ্যাক্সেস, বিশুদ্ধ পানীয় জল, স্যানিটেশনের সুযোগ থাকবে। সেই সময় স্থির হয় ২০১৯ সালের মধ্যে কমপক্ষে ২৫০০টি গ্রামকে স্মার্ট গ্রামে উন্নীত করা হবে। প্রত্যেক সাংসদ তাঁর লোকসভা এলাকায় গ্রাম নির্বাচন করে এই কর্মসূচির সফল রূপায়ণ ঘটাবেন।

বাস্তবতা: শহরের প্রতিটি অংশে ২৪ ঘন্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ, অতি উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা, দক্ষ পুলিশ প্রশাসন, উপযুক্ত স্বাস্থ্য পরিষেবা, সকলের জন্য শিক্ষার সুযোগ ইত্যাদি মৌলিক সুযোগ সুবিধাগুলি স্মার্ট সিটিতে থাকা উচিত। এখনও পর্যন্ত, স্মার্ট সিটি শুধুই প্রচার, তাকে পরখ করা যায়নি। ভারতের অনেক অঞ্চলেই এখনও ন্যূনতম সুযোগসুবিধাগুলি পৌঁছায়নি। শহরগুলোতে খাদ্যনিরাপত্তার অভাব রয়েছে। ভারতীয় শহরগুলিকে দেখলে শোষণের কেন্দ্রবিন্দু মনে হয়। একটি শহরকে তখনই স্মার্ট বলা যায় যখন তার অধিকাংশ বাসিন্দা স্মার্ট হয়ে ওঠে। অর্থাৎ স্মার্ট সিটি তৈরিতে জনসচেতনতা এবং পাবলিক এথিকস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ থেকে পরিষ্কার, সত্যিকারের স্মার্ট শহর পেতে এখনও অনেক সময় লাগবে।

 

প্রকল্প-৫: স্বচ্ছ ভারত

এই প্রকল্পটি ভারতের সমস্ত নাগরিকদের জন্য। সরকারের সব পরিকল্পনার মধ্যে সম্ভবত এটাই সবচেয়ে সহজ এবং কঠিন। স্বচ্ছ ভারত প্রকল্পের লক্ষ্য বিভিন্ন সচেতনতামূলক কর্মসূচির মাধম্যে নাগরিকদের সচেতন করে তোলা। সেই সচেতন নাগরিক দেশকে স্বচ্ছ করবে অর্থাৎ পরিষ্কার রাখবে। স্বচ্ছ ভারত কর্মসূচিতে ভাল অবদানের জন্য সরকার স্বেচ্ছাসেবকদের পুরস্কৃত করার কথা ঘোষণা করে।

বাস্তবতা: এই প্রকল্পের অধীনে পরিচ্ছন্নতার বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে পৃথিবীতে ভারতীয় শহরগুলো সবচেয়ে নোংরা ও দূষিত। এমনকি গ্রামীণ এলাকাও সমান অপরিচ্ছন্ন। শৌচালয়ের অভাব ভারতের অন্যতম বড় সমস্যা। স্বচ্ছ ভারত স্কিমটি নাগরিকদের চোখ খুলে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট হলেও বেশিরভাগটাই মানুষের বিবেকের ওপর ছেড়ে দেওয়া আছে। একটি সঠিক রূপরেখা ছাড়া এই প্রকল্পে সাফল্য পাওয়া সম্ভব নয়।

 

মোদি, অন্তত ঘোষিতভাবে, নতুন এবং সম্ভাবনাময় এক ভারতকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে এই ধরনের বেশ কিছু উদ্যোগ নেন। হয়তো ভাবনায় কিছু ভুল ছিল না। তবে, বাস্তবতা অনেকটাই ভিন্ন। মোদিনমিক্সে যা প্রোজেক্ট করা হয়েছিল ভারত তার থেকে অনেক দূরে। ভারতকে বিশ্বব্যাপী উৎপাদন কেন্দ্র রূপে গড়ে তুলতে গিয়ে বেশ কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। একইভাবে, ডিজিটাল ইন্ডিয়ার উদ্যোগও আশানুরূপ সাফল্য দেয়নি। স্টার্টআপগুলি ভারতের জন্য ভাল হলেও মারাত্মক পরিবেশগত অবনতির ঘটনা ঘটেছে। নাগরিকদের দ্বারা সমর্থিত সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের সঠিক কাঠামো ছাড়া কখনওই সফল স্বচ্ছ ভারত সম্ভব নয়।

এই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে ২o২৪ লোকসভা নির্বাচনের আগে ‘মোদির গ্যারেন্টি’ নামে বিজেপি নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করেছিল। সেখানে ১৪টি বিষয়ে তারা জোর দিয়েছে। বিকশিত ভারতের চারটি স্তম্ভ— নারীশক্তি, যুবশক্তি, কৃষক ও দরিদ্রদের উন্নতির লক্ষ্যে বিজেপি আগামীতে কাজ করবে বলে ঘোষণা করেছে। মানুষের আত্মমর্যাদা ও জীবনযাত্রার গুণগত মান বাড়াতে সরকার সব বাড়িতে পাইপযুক্ত গ্যাস এবং সৌরবিদ্যুৎ বিনামূল্যে পৌঁছে দেবে। ইশতেহারে আর্থিক সুবিধার যে বিষয়গুলি গুরুত্ব পেয়েছে তা হল:

  • ৩ কোটি গ্রামীণ মহিলাদের লাখপতি দিদি বানানো হবে।
  • স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলিকে সার্ভিস সেক্টরের সঙ্গে যুক্ত করে নতুন আয়ের সুযোগ বৃদ্ধি করা হবে।
  • মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস এবং ভারতের অর্থনৈতিক দক্ষতা বৃদ্ধি।
  • কর্মসংস্থান, স্ব-রোজগার এবং নাগরিকদের জন্য জীবিকার সুযোগ বৃদ্ধি।
  • করদাতারা অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তাই তাদের বাড়তি সম্মান।
  • ক্ষতিগ্রস্ত চাষির কাছে পিএম ফসল বিমার সুযোগ দ্রুত পৌঁছে দিতে এই বিমাকে আরও বেশি প্রযুক্তিনির্ভর করে তোলা হবে।
  • সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এমএসপি-র বৃদ্ধি ঘটানো হবে।
  • কৃষি উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত কীটনাশক ব্যবহার, সেচ ব্যবহার, মাটি পরীক্ষা ও আবহাওয়ার পূর্বাভাসে ‘ভারত কৃষি স্যাটেলাইট’ নামের দেশীয় প্রযুক্তির প্রয়োগ করা হবে।
  • ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও এমএসএমই-রা যাতে ব্যবসাকে প্রসারিত করতে পারে তার উদ্যোগ নেওয়া হবে।
  • ভারতকে বিশ্বমানের উৎপাদন কেন্দ্রে পরিণত করার পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদন ক্ষেত্রগুলিতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির কাজ চালিয়ে যাওয়া হবে।
  • স্ব-রোজগার প্রকল্পকে উৎসাহ দিতে ‘মুদ্রা যোজনা’-র অধীনে ঋণের পরিমাণ দ্বিগুণ করে ২০ লক্ষ টাকা করা হবে।
  • ভারতীয় অর্থনীতিকে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত করা হবে।

এ তো গেল আর্থিক প্রতিশ্রুতির দীর্ঘ তালিকা। মোদি-৩ জমানায় তা কতটা পূরণ হবে সেই কাটা-ছেঁড়া ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। ফাইনাল ব্যালেন্সশিট পেতে সময় লাগবে। তবে মোদির নেতৃত্বে বিজেপি ২০১৪ সাল থেকে এ-পর্যন্ত দেশের সরকার চালিয়েছে। অভিজ্ঞতা বলছে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির গুরুত্ব বিজেপির কাছে কখনওই তেমনভাবে ছিল না, যা স্পষ্ট হয়েছিল গত নির্বাচনের আগে। ২০১৯ সালে ভারতীয় জনতা পার্টি তাদের ইশতেহার প্রকাশ করেছিল প্রথম পর্বের নির্বাচনের মাত্র ৩ দিন আগে। এবারেও তাই করেছে। বিজেপির কাছে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির গুরুত্ব ঠিক কতখানি তা খুঁজতে ফিরে যেতে হবে ২০১৯ সালে। ওই বছর ১৭তম লোকসভা নির্বাচনের আগে তারা কী কী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল এবং তার কতটুকু রাখতে পেরেছে সেটা দেখা যাক।

 

২০১৯ সালের নির্বাচনে বিজেপি-র আর্থিক প্রতিশ্রুতি

২০১৯ সালে বিজেপির ইশতেহারের নাম ছিল ‘সঙ্কল্পিত ভারত সশক্ত ভারত’। স্বাধীনতার ৭৫ বছরে (২০২২ সাল) বিশেষ ৭৫টি মাইলফলক ছোঁয়ার প্রতিশ্রুতি ইশতেহারে আলাদা করে বলা থাকলেও বিজেপি প্রধানত জাতীয় নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিয়েছিল। তাদের ইশতেহারে অর্থনীতির যে বিষয়গুলি গুরুত্ব পেয়েছিল:

  • ২০২২ সালের মধ্যে কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করা।
  • প্রান্তিক ও দরিদ্র কৃষকদের (২ হেক্টর পর্যন্ত জমির মালিক) আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত করতে পিএম-কিসানের পরিধি বাড়ানো।
  • ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের জন্য পেনশন প্রকল্প চালু করা।
  • ১০০০০টি নতুন ‘এফপিও’ তৈরি ।
  • আগামী পাঁচ বছরে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী পরিবারের শতাংশকে এক অঙ্কে নামিয়ে আনা।
  • কয়েকটি বিশেষ ক্ষেত্র যেখানে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে সেগুলিকে অতিরিক্ত আর্থিক সহায়তা দেওয়া। প্রতিরক্ষা এবং ফার্মাসিউটিক্যালস-এর মতো ক্ষেত্রগুলিকে কর্মসংস্থান-সৃষ্টিতে ব্যবহার করা।
  • মহিলাদের নেতৃত্বে উন্নয়ন, মহিলাদের জন্য সমান অধিকার সুনিশ্চিত করা, ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’ এবং সৌভাগ্যের মতো কর্মসূচির উন্নতিতে জোর দেওয়া হয়েছিল। পাঁচ বছরে মহিলাদের জন্য নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির পাশাপাশি গ্রামীণ ও আধা-গ্রামীণ এলাকায় মহিলাদের আর্থিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি ছিল। মহিলা উদ্যোক্তাদের জন্য দেওয়া ঋণের ৫০ শতাংশ গ্যারান্টির দায়িত্ব সরকার নেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
  • উৎপাদন বাড়ানো এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধির লক্ষ্যে ইশতেহারে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’-র উপর জোর দেওয়া হয়েছিল। কোম্পানি আইনকে শক্তিশালী করে একটি নতুন শিল্প নীতির প্রতিশ্রুতিও সেখানে ছিল– যার লক্ষ্য ছিল ‘ইজ অফ ডুয়িং’ বিজনেস সূচকে ভারতের স্থানকে উন্নত করা।
  • দেশের অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা এনে আগের তুলনায় জিডিপি-র বৃদ্ধি। ২০২৫ সালের মধ্যে ভারতকে ৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের অর্থনীতিতে পরিণত করা এবং ২০৩০ সালের মধ্যে দেশকে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তিতে রূপান্তরিত করা।

বাস্তবে কী ঘটেছে

এখন দেখা যাক ২০১৯ সালের বিজেপি-র এই প্রতিশ্রুতি কতটা পূরণ হয়েছিল।

  • ২০১৮-১৯ সালে, কৃষকের গড় মাসিক আয় ছিল ১০,২১৮ টাকা। ২০২২ সালে তা দ্বিগুণ হলে সেই  পরিমাণ অন্ততপক্ষে কুড়ি হাজার হওয়ার কথা। তা হয়নি। যেটুকু আয় হয়েছে তার সিংহভাগ এসেছে মজুরি থেকে। এর অর্থ হল, কৃষকদের একটা ভাল অংশ দিনমজুরে পরিণত হয়েছেন। ২০২৩-২৪ সালের বাজেটে কৃষির বরাদ্দ আগের তুলনায় কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম কমার ফলে এই আর্থিক বছরে সারের উপর ভর্তুকিও ২২.২ শতাংশ কমানো হয়। মার্কেট ইন্টারভেনশন স্কিম এবং প্রাইস সাপোর্ট স্কিমে বরাদ্দ নামমাত্র করা হয়েছে। এই সব কটি প্রকল্পই কৃষিপণ্যের সরকারি ক্রয় কর্মসূচির নির্ণায়ক— যা কৃষকের আয় বাড়াতে সাহায্য করে। অর্থাৎ, সামগ্রিক কৃষকের আয় দ্বিগুণ করার লক্ষ্যটি সরকারের ভাবনা থেকে বেরিয়ে গেছে।
  • ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে নরেন্দ্র মোদি কৃষকদের এই বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে তাঁরা সরকার গঠন করতে পারলে ন্যাশানাল ফার্মার্স কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য স্থির করবেন। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি রাখা হয়নি।
  • স্বামীনাথন কমিটির সুপারিশ কার্যকরী না হওয়ায় ২০১৫-১৬ থেকে ২০২২-২৩ পর্যন্ত সরকার শুধুমাত্র ধানের ক্ষেত্রেই কৃষকদের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বাবদ ২৩৭ হাজার কোটি টাকা কম দিয়েছে। একইভাবে, গমের ক্ষেত্রে কৃষকদের কম দিয়েছে ৫৮,৪৬০ কোটি টাকা। শুধু ধান ও গমেই কৃষকরা ২৯৬ হাজার কোটি টাকা কম পেয়েছেন। সরকার কৃষককে ফাঁকি দিয়ে যে তহবিল গড়েছে সেই টাকায় কৃষকদের অনুদান দিয়েছে। এ থেকেই পরিষ্কার গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজো করছে সরকার।
  • ২০১৯-২০ সালের কেন্দ্রীয় বাজেটে কৃষকের আয় বাড়াতে নতুন ১০০০০টি এফপিও গঠন ও উন্নয়নের কথা ঘোষণা করা হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত নতুন ২২৫৭টি এফপিও গঠিত হলেও তা এখনও পুরোদমে কাজ শুরু করেনি। বর্তমানে দেশে নথিভুক্ত এফপিও-র সংখ্যা নতুন পুরনো মিলিয়ে মোট ৭০৫৯টি।
  • ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের পেনশনের বিষয়টিও বিশ বাঁও জলে। এমএসপি-র আইনি স্বীকৃতির দাবিতে শম্ভু সীমান্তে চাষিরা আন্দোলন করছেন। অন্যান্য দাবির সঙ্গে তাঁদের পেনশনের দাবিটিও আছে।
  • কৃষক কল্যাণে ইশতেহারের প্রতিশ্রুতি না রাখলেও সংস্কারের নামে কৃষিকে কর্পোরেট হাতে তুলে দিতে সরকার কৃষি আইন চালু করেছিল। যদিও কৃষকদের আন্দোলনের চাপে তা প্রত্যাহার করে নিতে সরকার বাধ্য হয়।
  • দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী পরিবারের শতাংশকে এক ডিজিটে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতিও বাস্তবায়িত হয়নি। ২০২৩ সালের শেষে এই হার ১১.২৮ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। মোট সংখ্যার হিসেবে ভারতে এখনও ২৩ কোটি মানুষ দরিদ্র।
  • ইশতেহারে কয়েকটি বিশেষ ক্ষেত্রকে আলাদা করে চিহ্নিত করা হয়েছিল যার হাত ধরে অর্থনীতির অগ্রগতি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। কিন্তু ২০১৯ সালে বেকারত্বের হার যেখানে ৫.২৭ শতাংশ ছিল ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে তা বেড়ে হল ৮.১১ শতাংশ। এর মধ্যে ২০-২৪ বছর বয়সীদের বেকারত্বের হার ৪৪.৪৯ শতাংশ এবং ২৫-২৯ বছর বয়সীদের ক্ষেত্রে এই হার ১৪.৩৩ শতাংশ। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে বলা হয়েছিল ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলির প্রসার ঘটিয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হবে। আজ জলের মতো পরিষ্কার কর্মসংস্থান নয়, ইলেকটোরাল বন্ডে টাকা আদায়ের জন্যই এদের বাড়তি সুবিধা দেওয়া হয়েছিল।
  • মেক ইন ইন্ডিয়া-প্রকল্পের মাধ্যমে দেশে কর্মসংস্থান, বিদেশি বিনিয়োগ বাড়িয়ে দেশের অর্থনীতিকে রপ্তানিনির্ভর করে তোলার প্রতিশ্রুতি ছিল নির্বাচনী ইশতেহারে। কিন্তু দুঃখের কথা এই যে ‘ইজ অফ ডুয়িং’ বিজনেসের ক্ষেত্রে যেখানে ২০১৯ সালে ভারতের স্থান ছিল ৬৩ নম্বরে, ২০২৩ সালে তার বড় একটা হেরফের হয়নি।
  • ২০২৫ সালের মধ্যে ভারতকে ৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের অর্থনীতিতে পরিণত করার স্বপ্ন পূরণ হবে বলে মনে হয় না। কারণ ২০২৩ সালের শেষে ভারতীয় অর্থনীতির আয়তন ছিল মাত্র ৩.৭৩২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার।

অর্থনীতির গতিপ্রকৃতির বিচারে গত ৫ বছরে বিজেপি সরকার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির ধার দিয়েও যায়নি— পরিসংখ্যান তেমনই বলছে। মোদি তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হয়ে ক্যামেরার সামনে প্রথম যে ফাইলটিতে সই করলেন, সেটি পিএম কিষানে কৃষকদের জন্য বরাদ্দ ৬০০০ টাকার ষোলোতম কিস্তি। ৯ কোটি ৩০ লক্ষ কৃষকের জন্য মোট ২০ হাজার কোটি টাকা অনুমোদন করা হল। মজা হল, এই টাকাটা কৃষকদের নিজেদের। হিসেবের মারপ্যাঁচ ঘটিয়ে চাষিদের ফসলের এমএসপি কম দিয়ে যেটা সরকার বাঁচিয়েছিল তা-ই অনুদান হিসেবে ফেরত দেওয়া হল। যাই হোক, ফাইলে সই করার পর মোদি বললেন, “আমাদের সরকার কৃষকদের কল্যাণে দায়বদ্ধ। দায়িত্ব নিয়েই কৃষকদের কল্যাণের সঙ্গে সম্পর্কিত ফাইলে স্বাক্ষর করলাম। আগামীদিনে আমি কৃষক এবং দেশের কৃষিক্ষেত্রের জন্য আরও বেশি কাজ করে যেতে চাই।” কিন্তু মোদির সই করার ছবি যখন বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে তখন পঞ্জাব-হরিয়ানা সীমানার খনৌরিতে, জুনের ঠা ঠা রোদে অনশনরত কৃষকরা একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সামনে ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেন। কৃষকদের কল্যাণে মোদি দায়বদ্ধ হলে জয়ের পর, আন্দোলনরত অন্নদাতাদের কাছে দৌড়ে যেতেন বা সমাধানসূত্র বের করতে প্রতিনিধি দল পাঠাতেন। ক্যামেরার সামনে ফাইলে সই, সস্তা চমক ছাড়া কিছুই নয়।

 

জিডিপি-র বৃদ্ধি অতীতের তুলনায় মোদিনমিক্স-এ অনেক বেড়েছে বলে ফলাও প্রচার চলে। জিডিপি-র বৃদ্ধি অর্থনৈতিক বিকাশের সূচক হলেও উন্নয়নের নির্দেশক নয়। অর্থনৈতিক উন্নয়ন আরও কিছু দাবি করে। তার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল আয়ের সুষম বণ্টন। ২০২৩ সালের শেষে দেখা গেছে বর্তমান ভারতে ১ শতাংশ ধনী লোকের হাতে রয়েছে দেশের মোট সম্পদের ৪০.১ শতাংশ। সেখানে দেশের ৫০ শতাংশ জনগণ মাত্র ৩ শতাংশ সম্পদের মালিক। মোদিজমানায় আয়ের এই বৈষম্য ক্রমশ বেড়েছে। উন্নয়নের অপর দুটি উপাংশ দারিদ্র্য দূরীকরণ ও কাজের সুযোগ তৈরি করা। বিগত ১০ বছরে এই দুটি ক্ষেত্রে মোদি সরকারের সাফল্যের চেয়ে ব্যর্থতাই বেশি। খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির হার কম-বেশি ৮.৭০ শতাংশ। দামস্তর বৃদ্ধি পেলে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের দুর্দশা সবচেয়ে বেশি। তাদের খাদ্যের সংস্থান করতে নাভিশ্বাস ওঠে। যা অর্থনৈতিক উন্নয়নে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। অতীত অভিজ্ঞতা বলছে মোদিনমিক্স দেশের আর্থিক উন্নয়নে সে অর্থে কোনও আলোড়ন তুলতে পারেনি।

মোদির অর্থনীতি অনেকটাই কর্পোরেটদের পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা। সেখানে সাধারণ জনগণের ভাল থাকার বার্তা নেই। মোদি-৩ সরকার, এই সব ত্রুটি দূর করার জন্য অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাহসী পদক্ষেপ নেবে— এ নিতান্তই অলীক কল্পনা। এর কারণ মোদি সরকারের টিকে থাকা নির্ভর করছে দুটি আঞ্চলিক দলের চাওয়াপাওয়ার ওপরে। শুরুতেই এরা নিজেদের রাজ্যের জন্য যেভাবে আর্থিক প্যাকেজের দাবি তুলেছে তাতে মনে হচ্ছে এদের চাহিদা ক্রমাগত বেড়েই চলবে। সরকার বাঁচাতে প্রধানমন্ত্রী যদি তাদের দাবি মেনে নেন তাহলে সরকারি মদতে রাজ্যগুলির মধ্যে আর্থিক বৈষম্যকে প্রশয় দেওয়া হবে সে-বিষয়ে কোনও দ্বিমত নেই। ফলে মোদি-৩ সরকারের কাছে জনমুখী আর্থিক সংস্কারের প্রত্যাশা করে খুব একটা লাভ নেই।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4888 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...