নরেন্দ্র মোদি: জয়ী হয়েও যিনি পরাজিত

শুভাশিস মৈত্র

 


রামমন্দিরে প্রাণপ্রতিষ্ঠার কিছু আগে থেকেই মোদি বলতে শুরু করেছিলেন তিনি ঈশ্বরের নির্দেশ পালন করছেন। তাঁর মনে বাসনা ছিল রাজনীতিতে একজন ধর্মগুরু-নেতা হয়ে ওঠার। যিনি সারা দেশ ঘুরে গ্যারান্টি দিয়ে বেড়াবেন। যাঁর মুখের কথাই হবে সংবিধান। কিন্তু ভারতের এক বিরাট সংখ্যক জনতা ইভিএম হাতে পেতেই বোতাম টিপে জানিয়ে দিলেন, তাঁরা মোদির গ্যারান্টিতে বিশ্বাস করছেন না। তাঁরা সংবিধান মানা নেতা চান, সাম্প্রদায়িক ধর্মগুরু নয়

 

ভোটের এমন ফল হতে পারে আগাম আন্দাজ করতে পারেননি অনেকেই। ভোটের এই ফলে, সাম্প্রদায়িকতা-নির্ভর স্বৈরতান্ত্রিক রাজনীতি থমকে দাঁড়িয়েছে। গণতন্ত্রের উপর তার আঘাত হানার ক্ষমতা অনেকটাই কমে গিয়েছে। তবে তা দীর্ঘস্থায়ী হবে কি না, এখনই বলা কঠিন।

এবারে ভোটের বৈশিষ্ট্য হল, নরেন্দ্র মোদি জয়ী হয়েছেন কিন্তু তাঁর ভয়ানক সব আকাঙ্ক্ষাগুলো আপাতত বোতলবন্দি হয়ে গিয়েছে। সে কারণেই জয়ী হয়েও পরাজিতের মতো মনে হচ্ছে নরেন্দ্র মোদিকে।

১৯৫০ সালে দুটি সংগঠন ভিন্ন ভিন্ন কারণে ভারতের সংবিধানের বিরোধিতা করেছিল। তারা হল কমিউনিস্ট পার্টি এবং আরএসএস। কমিউনিস্ট পার্টি পরে অবস্থান বদলায়। গোলওয়ালকারের পার্টি এখনও আগের অবস্থানেই আছে। এবারের ভোট আমাদের দেখাল, সংবিধানের মতো ধারা-উপধারায় ঠাসা নীরস একটি বই কীভাবে মানুষকে একজোট করে তুলতে পারে। আন্দোলনের ইতিহাসে এ এক নতুন পথ।

আমরা প্রথম ২০১৯-২০-তে দেখেছিলাম সিএএ-র বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সংখ্যালঘু মুসলিমরা সংবিধান হাতে পথে নামলেন। শাহিনবাগ হল। তার পর ফের দেখা গেল ২০২৪-এর নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে সংবিধান নিয়ে সরব হলেন দলিত এবং ওবিসি সম্প্রদায়। এই যে সংখ্যালঘু, দলিত এবং ওবিসি সম্প্রদায়ের কোটি কোটি মানুষ সংবিধান রক্ষায়, নিজেদের অধিকার রক্ষায়, ইভিএমকে ব্যবহার করে সাফল্যে পৌঁছলেন, এর মধ্যে দিয়ে আমরা এক নতুন ভারতকে দেখতে পেলাম। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ব্যবহার করেই নরেন্দ্র মোদি উদ্যোগী হয়েছিলেন গণতন্ত্রকে সীমিত করতে। নির্বাচনকে ব্যবহার করে গণতান্ত্রিক পথেই সাধারণ জনতা তা রুখে দিয়েছে। এমন যে ঘটতে পারে, মোদিতন্ত্রের পরিকল্পনাকারেরা তা কল্পনাও করতে পারেনি!

এত দিন সংবিধান অনেকটাই ছিল এলিটদের আলোচনার, চিন্তা করার, চর্চার বিষয়। ২০২৪-এর ভোট দেখাল, সংবিধান কী করে সাধারণ মানুষের এক বড় অংশের কাছে একটা রাজনৈতিক আদর্শ হয়ে উঠতে পারে, পতাকার বিকল্প হয়ে উঠতে পারে। এই অভূতপূর্ব পরিবর্তন ভারতবাসী দেখল এবারের নির্বাচনের ফলাফলের মধ্যে দিয়ে। ভারতের রাজনীতিতে যেন একটা নতুন আইডিওলজির জন্ম হল। যার নাম সংবিধান। সংবিধানের একটা আদর্শ তো অবশ্যই রয়েছে। সেটা হল, অধিকারের সাম্য, ব্যক্তিস্বাধীনতা, ধর্মনিরপেক্ষতা। যা অনেক মূল্যের বিনিময়ে ভারতবাসী অর্জন করেছে। যে অর্জন-প্রক্রিয়ায় হিন্দুত্ববাদীদের কোনও ভূমিকা ছিল না।

সংবিধান যে বিপন্ন হতে পারে ভারতে, সে ভয় বাবাসাহেব আম্বেদকারেরও ছিল। কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেমব্লির শেষ দিনে তাই আম্বেদকার আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছিলেন, যেদিন ভারতের রাজনৈতিক দলগুলি তাদের নিজেদের দলীয় আদর্শকে সংবিধানের উপরে স্থান দেবে, যেদিন রাজনীতিতে ব্যক্তিপুজো গুরুত্ব পাবে, সেদিন এই সংবিধান হেরে যাবে। আজ আম্বেদকার বেঁচে থাকলে দেখতেন, তাঁর নেতৃত্বে তৈরি হওয়া এই সংবিধানকে কীভাবে রক্ষা করলেন সমাজের সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা মানুষেরা।

এবারের ভোটে কোনও সন্দেহ নেই যুগ্ম ম্যান অফ দ্য ম্যাচ রাহুল গান্ধি এবং অখিলেশ যাদব। আর সবচেয়ে খারাপ যে সব ঘটনা ঘটেছে গত দশ বছরে, তার মধ্যে অন্যতম হল সংবাদমাধ্যমের নতজানু ম্লান চেহারা। একই সঙ্গে এবারের ভোটেই নতুন এক ঝাঁক সাংবাদিককে আমরা পেয়েছি বিভিন্ন ধরনের ডিজিট্যাল মাধ্যমে। আত্মপ্রকাশেই যারা প্রায় প্রায় সমানে সমানে পাল্লা দিয়েছে প্রবল শক্তিশালী গোদি মিডিয়ার সঙ্গে। ইতিমধ্যেই এই নতুন ধারার সংবাদমাধ্যম ক্ষমতায় না হলেও, বিশ্বাসযোগ্যতায় এগিয়ে গিয়েছে গোদি মিডিয়ার চেয়ে অনেকটাই। এটাকে ধরে রাখা যাবে কিনা, সময় বলবে। এই মিডিয়ার উপর বিধি-নিষেধ চাপাতে উদ্যোগী হয়েছিল নরেন্দ্র মোদি সরকার। ভোটের ফল বলে দিচ্ছে, এই কাজে আপাতত আর এগোতে সাহস পাবে না নতুন মোদি সরকার। বন্দি সাংবাদিক, লেখক, অধ্যাপক, সমাজকর্মীরা আশা করা যায় দ্রুত মুক্তি পাবেন।

অষ্টাদশ লোকসভা ভোটের ফলকে ভবিষ্যতে মানুষ ১৯৭৭-এর লোকসভা ভোটের ফলের সঙ্গেই তুলনা করবে। ৭৭-এ অবশ্য ইন্দিরা পরাজিত হয়েছিলেন। জরুরি অবস্থা জারির জন্য ভারতীয় জনতা শাস্তি দিয়েছিল তাঁকে। আর তার ৪৭ বছর পরে, ২০২৪-এ ভারতের জনতা নরেন্দ্র মোদিকে সিংহাসনচ্যুত করেনি ঠিকই তবে তাঁর ক্ষমতায় লাগাম পরিয়ে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, দেখা গেল, বারাণসী কেন্দ্রে ২০১৪ ও ২০১৯-এর অনুপাতে এবার নরেন্দ্র মোদির ভোটে জেতার মার্জিন বিপুল পরিমাণে কমে গেছে।

তৃণমূল কংগ্রেসের একদল মন্ত্রী ও নেতা, চুরি, ঘুষ, চাকরি বিক্রির অভিযোগে জেলে। রাজ্যে চাকরি-বাকরি প্রায় নেই বললেই চলে। তা সত্ত্বেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যেয়ের দলের ভোট, আসন বেড়েছে এবারের ভোটে। এর প্রধান কারণ, যারা নরেন্দ্র মোদিকে হারাতে চান তারা চোখ বন্ধ করে তৃণমূল কংগ্রেসকে ভোট দিয়েছেন।

পারিবারিক সূত্রে রাজনীতিতে আসা অভিষেকের ডায়মন্ড হারবারে জয়ের বেলুন আর ঢাকের আওয়াজ একদা আরামবাগের সিপিএম নেতা অনিল বসুর ‘চমকপ্রদ’ ফলের কথা মনে করিয়ে দিল।

নরেন্দ্র মোদির এটা ছিল তৃতীয়বারের লোকসভা ভোট। ২০১৯-এর থেকে তাঁর ভোট অনেকটাই কমে হয়েছে ৫৪.২০ শতাংশ।

তৃতীয়বারের নির্বাচনে, অর্থাৎ ১৯৬২-তে কংগ্রেস পেয়েছিল ৩৬১টি আসন, জওহরলাল জিতেছিলেন উত্তরপ্রদেশের ফুলপুর থেকে রামমনোহর লোহিয়াকে পরাজিত করে। জওহরলালের ভোট ছিল ৬১.৬২ শতাংশ, লোহিয়া পেয়েছিলেন ২৮.১৭ শতাংশ।

কংগ্রেস ১৯৫২ থেকে শুরু করে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত ছ-বার ৩৫০-এর বেশি আসন পেয়েছে।

১৯৮৪-র পর থেকে কোনও রাজনৈতিক দলই আর সাড়ে তিনশো আসন সংখ্যা ছুঁতে পারেনি। বিজেপি ৩০০ অতিক্রম করে ৩০৩ আসন একবারই মাত্র পেয়েছিল, ২০১৯ সালে।

এবারে নরেন্দ্র মোদির ডাক ছিল ৩৭০-এর। কিন্তু বিজেপি আটকে গেল ২৪০-এ।

১৯৮৪-র পরে কংগ্রেসও আর কখনও সাড়ে তিনশো আসন ছুঁতে পারেনি। ১৯৮৪-র পর কংগ্রেস মাত্র দুবার ২০০ আসন সংখ্যা অতিক্রম করতে পেরেছে, ১৯৯১ এবং ২০০৯-এর লোকসভা ভোটে। ফলে কংগ্রেসকে ভোটে যেতে হয়েছে কখনও ইউপিএ বা এখন যেমন, ইন্ডিয়া জোটের দল হিসেবে। তাহলে কি বিজেপিও সেই কোয়ালিশন যুগে ঢুকে পড়ল এবার? তার সম্ভাবনা প্রবল, তবে তা নিয়ে শেষ কথা এখনই বলা সম্ভব নয়।

নরেন্দ্র মোদির ক্ষমতা মানুষ কমিয়ে দিয়েছে ভোট দিয়ে। মোদির বিকল্প যাকে ভাবা হচ্ছিল, সেই যোগীর ক্ষমতাকেও প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে এবারের ভোট। উত্তরপ্রদেশে অর্ধেকের বেশি আসন বিজেপির হাতছাড়া হওয়া মানে যোগীর আসনও যে টলমল করে উঠতে পারে তা বলাই বাহুল্য।

মায়াবতীর বিএসপি সমাজবাদী পার্টির ভোট কাটায় বিজেপি বহু আসনে লাভবান হয়েছে। এই ভোট কাটা না পড়লে, ‘দ্য টেলিগ্রাফ’-এর সাংবাদিক পীযূষ শ্রীবাস্তব হিসেব কষে দেখিয়েছেন, বিজেপির আরও ১৪টি আসন কমত উত্তরপ্রদেশে।

রামমন্দিরে প্রাণপ্রতিষ্ঠার কিছু আগে থেকেই মোদি বলতে শুরু করেছিলেন তিনি ঈশ্বরের নির্দেশ পালন করছেন। ইদানিং প্রতিটি জনসভায় তিনি আগের চেয়ে অনেক বেশি নিজের নাম নিজেই উচ্চারণ করছিলেন, নিজের গুণগান নিজেই করে চলেছিলেন। তাঁর মনে বাসনা ছিল রাজনীতিতে একজন ধর্মগুরু-নেতা হয়ে ওঠার। যিনি সারা দেশ ঘুরে গ্যারান্টি দিয়ে বেড়াবেন। যাঁর মুখের কথাই হবে সংবিধান।

কিন্তু ভারতের এক বিরাট সংখ্যক জনতা ইভিএম হাতে পেতেই বোতাম টিপে জানিয়ে দিলেন, তাঁরা মোদির গ্যারান্টিতে বিশ্বাস করছেন না। তাঁরা সংবিধান মানা নেতা চান, সাম্প্রদায়িক ধর্মগুরু নয়।


*মতামত ব্যক্তিগত

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4877 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

আপনার মতামত...