ওদের ভোট ঘুরপাক খায় নদীর ঘোলা জলে

শুভ্র মৈত্র

 


ভোট আসে, ভোটের বাবুরা আসে। নদীর ধারে যে ঘরের বাসিন্দারা নিরাপদ দূরত্বে তুলে নিয়ে গেছে সংসার, সেখানে পড়ে থাকা বাঁশের খুটিতে উড়তে থাকে পতাকা। ভোট চাইতে এসে নেতারা শোনায় নানা কথা যার অধিকাংশই কানে ঢোকে না মানিরুদ্দিনদের। গ্রীষ্মের এই শান্ত নদীতেও ওদের কানে ধুপ ধুপ করে পাড়ের মাটি ভাঙার শব্দ

 

চমকে উঠতে হয় বৈকি। পারদের কাঁটা চল্লিশ ছুঁই ছুঁই, এমন দিনে সত্যাগ্ৰহ, ভাবলেই কেমন যেন দরদর করে ঘামতে হচ্ছে। কিন্তু এমনটাই আয়োজন হয়েছিল ৭ এপ্রিল কেশরপুর কলোনির বিরাট বটগাছের তলায়। ভোটপ্রার্থী বিজেপির শ্রীরূপা মিত্র ‘গঙ্গা ভাঙনে বিপর্যস্ত মানুষের স্বার্থে’ সত্যাগ্ৰহে বসেছিলেন। তিনি যখন সাদা তাকিয়ায় হেলান দিয়ে পূজা-পাঠ, যাগ-যজ্ঞ, খিচুড়ি ভোগ বিতরণের মধ্যে দিয়ে মানুষের স্বার্থরক্ষা করবেন বলে ভোটভিক্ষা চাইছেন, তখন অল্প দূরত্বে কালুটোনটোলার ঝুপড়িতে পা কোমড় ভেঙে শয্যাশায়ী ৬০ বছরের আকালি মাহাতো গঙ্গাপ্রাপ্তির দিন গুনছেন। সামসির ডাক্তার জবাব দিয়ে দিয়েছে, ‘আর কোমর ঠিক হবে না। হাঁটতে পারবে না আকালি।’ আকালির ছেলের বৌ লীলাবতী মাহাতো জানায়, ২০২২-এর ভাঙনে কালুটোনটোলার এই আমরা পালিয়ে আসার পরপরই পা কোমড় ভাঙল, এখন অদৃষ্টের কাছে সব সঁপে দিয়েছি, আমাদের দেখার কেউ নেই।’

সেদিক থেকে দেখলে এই ‘সত্যাগ্রহ’ প্রচারে খানিক অভিনবত্ব আনে, নইলে ভোটের বাজারে কে আর ভাঙনকে দূরে রাখতে চায়। আর সবারই অস্ত্র সেই দোষারোপ। তৃণমূল প্রার্থী দোষেন কেন্দ্রকে, কেন্দ্রের ফরাক্কা ব্যারেজকে আর সংসদের সদস্যদের, যেখানে তাদের এখনও পা না পড়ার অ্যাডভান্টেজ আছে। আর বিজেপির সাংসদের অস্ত্র রাজ্য সরকারের তরফে কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও বৈঠকেই যোগ না দেওয়া, কোনও সার্ভে রিপোর্ট না পাঠানো ইত্যাদি।

এই চাপানউতোরের অন্য পাড়ে শুয়ে থাকে ৭০ বছর বয়সী মানিরুদ্দিন ও তার স্ত্রী গিনি বিবি। এখনও গঙ্গার পাড়ে মাটি আঁকড়ে পড়ে আছেন। মানিরুদ্দিন তার বংশের এই ঈশ্বরটোলাতে ৪২ বিঘা সম্পত্তির শোক ভুলতে পারছেন না। সব গঙ্গায় চলে গেছে। রাত্রে ঘুম হয় না। একটা কালো ত্রিপলের তলায় কোনওরকমে দিন কাটছে। রাতের অন্ধকার যত বাড়ে, বাড়ে যত নদীর গর্জন, ধপাস ধপাস মাটি পড়ে যাওয়ার শব্দে ঘুম ভেঙে যায় মানিরুদ্দিনের‌।‌ ‘ভূত’-এর আনাগোনা দেখতে পায়। গিনি বিবি আক্ষেপ করে বলে, ‘লোকটার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আমরা কেউ বার্ধক্য ভাতা পাই না। ছেলে গেছে মুম্বাই। আমার লোকটা সম্পত্তির শোকে পাগলের মতো করে, কেউ খোঁজ নেয় না।’

এই মানিরুদ্দিনদের সংখ্যাটা কত লক্ষ, সে হিসেবে আজ আর যেতে চায় না কেউ। কারও কাছে সুনির্দিষ্ট হিসেবও নেই। তবে ভাঙনে মানিকচক, কালিয়াচক-১, ২, ৩ নং ব্লক, রতুয়া আর ইংলিশবাজার মিলে মোট ৭৬টি মৌজা নদীগর্ভে গেছে, জমির মোট পরিমাণ অন্তত ৮০০ বর্গ কিমি। গদাই মহারাজপুর অঞ্চলটাই গঙ্গায় কেটে গেছে প্রায় বছর ১৫ আগে।‌ এক সময়ে এই অঞ্চলের তিনটি গ্রাম জঞ্জালিটোলা, ত্রিলোচনটোলা এবং রসরাজটোলার মোট ৪৪৪টি পরিবারের জন্য দুটো মেম্বার ছিল। পুরুষ ভোটার ছিল ১৮০০ এবং ১৭০০ ছিল মেয়ে ভোটার। এখন সেই ভোটাররা ছড়িয়ে পড়েছে জেলার নানান প্রান্তে, কেউ বা ভিনরাজ্যে।

 

পড়ুন, ইলেকশন এক্সপ্রেস ২০২৪

 

আর গত পাঁচ বছরে যারা ভিটেমাটি হারিয়েছে তাদের মধ্যে অন্তত তিন হাজার পরিবার এখনও খোলা আকাশের নিচে বসে আছে। কালিয়াচক-৩ ব্লকে মেয়েদের একটা স্কুল প্রায় দুই বছর ধরে উদ্বাস্তুদের বাড়িঘর। আবার একদিকে ভাঙনের ফলে অন্যদিকে গঙ্গার বুকে জেগে ওঠা চরে এ জেলার প্রায় ছাব্বিশটি মৌজা, সেখানে বাস আড়াই লক্ষ মানুষের। তারা কোনও নাগরিক সুবিধা পায় না, উল্টে ঝাড়খণ্ড প্রশাসন নামমাত্র কিছু সুবিধা দিয়ে দখল করে রেখেছে ৩০০ বর্গ কিলোমিটার জমি।

***

 

যে জন আছে মাঝখানে। এভাবেই দেখা যেতে পারে মালদাকে। উত্তরবঙ্গ তাকে নেয়নি, নেয় না দক্ষিণবঙ্গও। খুব স্বাভাবিকভাবেই ভোটবাজারেও যে এই অঞ্চল উত্তর বা দক্ষিণ কোনও সমীকরণে পড়বে না, এটাই স্বাভাবিক।

সন্ধ্যায় হঠাৎ ভিড় হয় মালদা টাউন স্টেশনে। বাক্স-প্যাঁটরার পুরনো ছবি হয়তো নেই, তার জায়গায় পিঠে ব্যাগ, কানে ইয়ারফোন। ট্রেন প্ল্যাটফর্মে দাঁড়াতেই হুড়োহুড়ির পরিচিত দৃশ্য। কিন্তু আর পাঁচটা ট্রেন ধরার দৃশ্যের সঙ্গে এর ফারাক একটু নজর করলেই বোঝা যায়। যাত্রীরা অধিকাংশই পুরুষ, তাও একটা নির্দিষ্ট এজ গ্রুপে। কেউই তেমন বয়স্ক নয়। একটু উঁকি মারুন ট্রেনের ভেতরে, কথা বলুন ওদের সঙ্গে। জানতে পারবেন বিভিন্ন গ্রাম থেকে, এমনকি পাশের জেলা থেকেও এসে ট্রেন ধরেছে, গন্তব্য দিল্লি। না দিল্লি মানে শুধু দিল্লি নয়, দিল্লিতে নেমে ছড়িয়ে পড়বে বিভিন্ন রাজ্যে, কাজের খোঁজে। একজন দফাদার আছে যে ওদের নিয়ে যাচ্ছে, আবার কেউ কেউ কোনও গন্তব্য ছাড়াই। যদি কিছু কাজ মেলে।

একদিকে ক্রমশ কমে যাওয়া জমির পরিমাণ, যার ফলে বাড়ছে জনঘনত্ব, অন্যদিকে জেলায় কাজের অভাব— এই দুইয়ে মিলে সারিফুল, ভিক্টর, লিটনদের ঠেলে তোলে ভিনরাজ্যের ট্রেনে।

 

পড়ুন, গুজরাত গণহত্যার বিচার হয়নি

 

পাওয়া যায় কাজ?— ‘অবশ্যই যায়। দ্যাখেন না দেশের যেই প্রান্তেই যান দেখবেন মালদার লেবার। হয় বড় বিল্ডিং তৈরি করছে নয়তো রাস্তা। আর টাওয়ারের কাজে তো মালদা ছাড়া কথাই নেই।’ বলেন নিয়ামতপুরের হাসিরুল শেখ। গর্ব করে জানান, এখন ওঁর ৮০ জন রাজস্থানে, ৩৫ জন সিকিমে খাটছে। বলাই বাহুল্য, মজুরি থেকে একটা ভাগ দিতে হয় লেবার কন্ট্রাকটরকেও। কিন্তু যখন দুর্ঘটনা ঘটে?— হাসিরুল জানান ওঁর যে কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি তারা দুর্ঘটনার জন্য ক্ষতিপূরণ দেয়, ইন্সিউরেন্স আর কি! ‘তবে সবাই তো আর দেয় না, তখন আদায় করতে হয়, গ্রাম থেকে তুলতে হয়।‘ তবুও যেতেই হয় বাইরে। কোথাও জোটে একটা ঘুপচি ঘর, কোথাও তাঁবুতে খোলা মাঠে রাত কাটাতে হয়। বলা বাহুল্য স্থানীয়দের কাছ থেকে কোনও উষ্ণ অভ্যর্থনা আশা করে না ওরা। গত বছরে মিজোরামের রেলসেতু ভেঙে যেদিন ২৩টি কফিন এল একটি গাঁয়েই, নিয়ে এসেছিল ওদের যে সঙ্গীরা, ঠিক তার পরদিনই তারা আবার ট্রেন ধরল মিজোরামের উদ্দেশ্যে। হাজার মনোহারি প্রকল্পের নাম শুনিয়েও আটকে রাখা যায়নি তাদের।

***

 

ফরাক্কা ব্যারেজের আলোগুলি ঠাট্টার মতো দেখায় বীরনগরের ভাঙাপাড়ার মানুষদের কাছে। এই ধু ধু বালির চরে পুনর্বাসন আর এক পরিহাস। ওরা জানে সামনের বর্ষায় এই ত্রিপল ছাউনিও ছাড়তে হবে। যেমন জানে ভুতনির মানুষ। আগামী বর্ষায় ফুলহারের সঙ্গে গঙ্গা মিশে যাওয়ার পরিণতি ভাবতে শিউরে উঠছে ওরা। নদী রাজনীতির নেতা নয়, প্রতিশ্রুতি দেয় না, অবশ্যম্ভাবীর বার্তা আনে শুধু।

এরপরেও ভোট আসে, ভোটের বাবুরা আসে। নদীর ধারে যে ঘরের বাসিন্দারা নিরাপদ দূরত্বে তুলে নিয়ে গেছে সংসার, সেখানে পড়ে থাকা বাঁশের খুটিতে উড়তে থাকে পতাকা। ভোট চাইতে এসে নেতারা শোনায় নানা কথা যার অধিকাংশই কানে ঢোকে না মানিরুদ্দিনদের। গ্রীষ্মের এই শান্ত নদীতেও ওদের কানে ধুপ ধুপ করে পাড়ের মাটি ভাঙার শব্দ।

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4667 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. যে বৃত্তান্ত শেষ হ‌ওয়ার নয়… সুন্দর।

আপনার মতামত...