![sanjay](https://i1.wp.com/www.4numberplatform.com/wp-content/uploads/2024/04/sanjay.jpg?resize=678%2C381&ssl=1)
সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়
কুমার সাহনি এমন একজন মানুষ যিনি মনীষাকে ষোড়শোপচারে অর্ঘ্য দিয়েছিলেন, তা তাঁর চলচ্চিত্র-সহ অন্যান্য সৃষ্টিসম্ভার দেখলেই বোঝা যায়৷ তাঁর বিদায়ে ভারতীয় চলচ্চিত্র শূন্য হয়ে যায়নি, কিন্তু আমাদের বুদ্ধিজীবিতার আকাশে একটি ম্লান ছায়া নেমে এসেছে। কতদিন বাদে দৃশ্যের রূপকথার মধ্যে কুমার সাহনিকে পুনরায় খুঁজে পাব, তা আমরা জানি না। কিন্তু আমাদের গর্ব হয়, এ মানুষটি যখন কোনও শিক্ষায়তনে আসতেন, তিনি তখন একটা অন্যরকম বাচনভঙ্গির আশ্রয় নিতেন, তখন তাঁকে দেখে বোঝা যেত না তিনি নানা দূরহ মেধার মধ্যে প্রবেশ করেন ও নানারকম গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা প্রবর্তন করেন
বিদায় নিলেন কুমার সাহনি। সমস্যা আপাতত এই যে তাঁকে কীভাবে, কোন অবস্থান থেকে আলোচনা করব তা আমরা এখনও সঠিক জানি না। কেননা কুমার চলচ্চিত্রকার ছিলেন অবশ্যই, কিন্তু চলচ্চিত্রের উঠোন ছাড়িয়ে তাঁর জানার স্তর ও জিজ্ঞাসার মাত্রাগুলি ছড়িয়ে পড়েছিল নানাদিকে। ব্রেশটের নাটক সম্পর্কে যেমন বলা হয় তাঁর মূল উপজীব্য থিয়েটার হলের বাইরে, কুমার সাহনিও তেমনি পর্দার বাইরে একজন সচেতন চিন্তকের পর্যটনব্রত। তিনি দামোদর কোসাম্বির কাছ থেকে কিংবদন্তি বৌদ্ধ পুরাণ ও নানা বিষয়ে শিক্ষা নিয়েছিলেন, আবার ঋত্বিক কুমার ঘটক ও রবের ব্রেঁস-র কাছ থেকে সিনেমা বিষয়ে পাঠ নিয়েছিলেন৷ কিন্তু এমনটি নয় যে বন্দিমুক্তি আন্দোলন বা পরিবেশ বা চেতনার সঙ্কট বা অন্যান্য বিষয়ে তাঁর কোনও উৎসাহ ছিল না। বরং দিল্লিতে ঋত্বিক মেমোরিয়াল ট্রাস্টে বা অন্যত্র তাঁকে সবসময়েই দেখা যেত যে তিনি এমন সব বিষয়ে কথা বলছেন যার সঙ্গে হয়তো চলচ্চিত্রের সরাসরি সম্পর্কই নেই। এই একটা বিষয়ই কুমারকে ভারতীয় চলচ্চিত্র থেকে আলাদা করে দেয় যে তিনি নেহাত চলচ্চিত্রকার নন। আমাদের একজন বন্ধু বলেছিলেন যে লোক কবিতা লেখে কবিতা তাকেই বেশি তাচ্ছিল্য করেছে। নিছক সিনেমার মানুষ হয়ে থেকে যাওয়া— এটা কুমার সাহনির নিয়তিতে ছিল না।
ব্যক্তিগত আলোচনায় তিনি আমাকে বলেছিলেন, যে তাঁর জীবনে, ঋত্বিক ঘটকের উপস্থিতিতে প্রথম দেখা ছবিটিই ছিল ‘কোমল গান্ধার’। আমার মনে হয় কোমল গান্ধার-এর যে নানা স্তর, যেমন ছবিটির লোকপ্রিয় নন্দনতত্ত্ব ও বিশুদ্ধ দার্শনিকতার সমন্বয়, এ দেখে কুমার বুঝেছিলেন যে বিশুদ্ধ ‘শিল্প’-সিনেমার সম্ভাবনা শেষ হয়ে গেছে। সত্তর দশকে কুমার যখন পুনে ফিল্ম ইন্সটিটিউটের সীমানা ছাড়াচ্ছেন, তখন তাঁর মনেই হয়েছিল যে তথাকথিত শিল্প, সিনেমায় এমন একটি পরিসর, যা বস্তুত রূপোপজীবিনীর সিঁথিতে সিঁদুর। সুতরাং কুমার কখনওই আর্ট-সিনেমায় উৎসাহী হননি। যেমন বোদলেয়ার তাঁর কোনও কবিতায় প্রেমিকাকে বিবসনা দেখে সরোষে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, তাকে গয়না পরাতে চেয়েছিলেন। তেমন কুমার সাহনি ব্রেঁস-র কাছে শিক্ষিত হয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর যে তপোক্লিষ্ট কার্পণ্য বা একধরনের ধার্মিক মিতব্যয়িতা— কুমার তাকে গ্রহণ করেননি। এল গ্রেকো-র কৃশকায় খ্রিস্টের তুলনায় অথবা কিয়ের্কেগার্দের কৃচ্ছযাপনকে মনে রেখেও তিনি হৃদয়ঙ্গম করেছিলেন অজন্তার হংসপদিকা বা কোনারকের মৃদঙ্গবাদিনীর সঙ্গে তাঁর নৈকট্য। কুমার জানতেন, ভারতবর্ষের বিরাট ইতিহাস এবং সংস্কৃতি সম্পূর্ণ অলঙ্কারবর্জন পছন্দ করবে না। কোমল গান্ধার ও সুবর্ণরেখা তাঁর রক্তে ঐতিহ্যের সংক্রমণ ঘটায়।
ফলে ককতো-র ‘অরফি’ বা ব্রেঁস-র ‘বালথাজার’-এর কথা মনে রেখেও কুমার প্রথম ছবি ‘মায়াদর্পণ’-এ রং এবং দেখা নিয়ে এমন কতকগুলো পরীক্ষা করেন, যা সিনেমাকে আখ্যানের বাইরে এক অন্য স্তরে নিয়ে যায়। দেখার একধরনের রকমফের বলা যায়। বস্তুত, ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে তাঁর যদি কোনও মিল থাকে, তাহলে তা এই যে কুমারও ঋত্বিকের মতোই গল্পকে বা আখ্যানকে চন্দ্রচূড় জটাজালে বেঁধে রাখতে চাননি। ঋত্বিকও যেমন বহুস্তরে গল্প বলেন, বাস্তব ও কিংবদন্তি সেখানে যেমন বিধৃত থাকে, কুমারের সিনেমাতেও আমরা একই জিনিস দেখতে পাই। এমনকি ভারতীয় চলচ্চিত্রে সত্যজিৎ রায় যে বাস্তবকে সনাক্তকরণের যোগ্য বলে মনে করেন, কুমার সেই বাস্তবকে নিজের ধর্তব্যের মধ্যেই আনেন না। পাঠক এখানে মনে রাখবেন, আমি কোনও সাফল্য বা অসাফল্যের কথা বলছি না৷ আমি বলতে চাইছি কুমার সাহনি যে আভিজাত্যের অন্তরালে চলে যেতে চান, তার কারণ তিনি মূলত এমন একটা মাধ্যম নিয়ে কাজ করেন যার জন্ম সার্কাসের তাঁবুতে এবং যাকে লঘু তামাশার অতিরিক্ত কেউ কখনও মনে করেনি। আর যখন তাকে উন্নত করার চেষ্টা করা হয়েছে, তখন তাকে কবিতা বা ভাস্কর্যের সমকক্ষ বলে দাবি করা হয়েছে। কুমার এটা জানতেন যে তিনি এমন এক সময়ে বাস করেন, যখন ‘সৌন্দর্য রাখিছে হাত ক্ষুধার বিবরে’, এবং তিনি আমাকেই একটি আলোচনায় বলেছিলেন, দুর্ভাগ্য হচ্ছে এই যে লোকেরা এমনকি অজন্তা-ইলোরাতেও নিজেদের নাম খোদাই করে! দামোদর কোসাম্বি হয়তো তাঁকে পুনের পেছনদিকের পাহাড়ে নানা ধরনের প্রাচীন লিপিচিত্র দেখিয়েছিলেন, সেই হস্তাবলেপন তাঁকে আধুনিক মানুষের মনোবিকারের দিকে আগ্রহী করে তোলেন। এক গভীর আত্মপীড়নকে তিনি সনাক্ত করেন। গ্যোটের ফাউস্ট যে শয়তান মেফিস্টোফিলিসের কাছে নিজের আত্মা সঁপে দিয়েছিলেন, তার অন্যতম কারণ সৌন্দর্যের একটি সাকার অভিজ্ঞানপ্রাপ্তির প্রলোভন। কুমার সাহনি জানতেন যে দৃশ্যের বলাৎকার সম্পন্ন হয়েছে। তাছাড়া দৃশ্যকে সুচারুভাবে সাজানো তাঁর কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত নয়। বরং দৃশ্যকে যদি তিনি একটি আধ্যাত্মিক মলাট দিতে পারেন, এবং দৃশ্যের গভীরে যদি প্রবেশ করতে পারেন, যদি এরকম প্রশ্ন করতে পারেন যে ‘জল কি আদৌ জলের নিকটবর্তী মানে?’, একমাত্র তাহলেই তাঁর ক্যামেরার পরীক্ষা সার্থক হবে।
আমরা একটু আগে ‘কোমল গান্ধার’-এর কথা বলছিলাম। ঋত্বিক ঘটক যখন তাঁদের ছবিটা দেখাচ্ছিলেন, তখন কুমারের সঙ্গে ছিলেন মনি কাউল ও পরিচালক রাম গাবালে। রাম গাবালেকে পুনের সাধারণ মানুষ চিনত নেতা হিসেবে। কলকাতায় দর্শকদের সামনে ছবিটা দেখিয়ে ঋত্বিক যখন সহমর্মিতার অভাবে অসহায় হয়ে পড়েছিলেন, তখন এই তিন অনুজই বলে উঠেছিলেন, “দাদা, এটা একটা মাস্টারপিস!” তাঁদের কথায় ঋত্বিক সান্ত্বনা পেয়েছিলেন। ঋত্বিক বাস্তবধৃত ও বহুবিষয় সমন্বিত চেতনার অভিঘাত তাঁর সিনেমার মধ্যে দিয়ে আনতে চেয়েছিলেন। পাশাপাশি, কুমার যখন ঋত্বিক ঘটককে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন, বলা বাহুল্য, তিনি ঋত্বিকের উপকরণগুলি নিয়ে কাজ করেন না, করার কথাই নয়। কারণ রাবীন্দ্রিক-রাই রবীন্দ্রনাথ থেকে সবচেয়ে দূরে সরে গিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের পরে বাংলা সাহিত্যে কেউ যদি রবীন্দ্রনাথকে প্রকৃত অর্থে চিনে থাকেন, তিনি জীবনানন্দ দাশ, যিনি রবীন্দ্রনাথের থেকে সবচেয়ে দূরে সরে গিয়ে কবিতা লিখতে পারেন। কাজেই কুমার সাহনির ছবিতে ঋত্বিক ঘটকের প্রভাব কোথায়, ঋত্বিকের প্রবল সমাজচৈতন্য কোথায়— এসব নিয়ে যাঁরা প্রশ্ন তোলেন, তাঁরা বুঝতে পারছেন না, অথবা বুঝতে চান না, কুমার আসলে ঋত্বিকের যে দার্শনিক অনুসন্ধান তাকেই এগিয়ে নিয়ে গেছেন। সেই অনুসন্ধানের একটাই মৌলিক প্রশ্ন— একটা কথাকে কতবার বলা যায়? আমাদের উপনিষদের কাহিনিতে দেবতারা যেমন ‘আত্মা’ শব্দের মানে খুঁজতে গিয়ে বারংবার সলিলস্থ বস্তুচ্ছায়াকে মানুষের সত্তা বা essence ভাবতে অস্বীকার করছেন, কুমারও তেমনি বস্তু, বহির্বিশ্ব, আপাতভাবে মানুষের প্রতিকৃতি, তাকে গ্রহণ করতে অস্বীকার করছেন৷ কারণ তিনি জানেন, শিল্প একধরনের মায়াবী আড়াল। এবং সেই মায়াবী আড়ালের অন্তরালে জলস্রোতের মতো নানারকম কথা ও ঐতিহ্যের সমুদ্র বয়ে যায়। যখন কুমার সাহনি পুরাণকথা বলেন, তখন বুঝতে হবে দামোদর কোসাম্বি যেমন তাঁর মধ্যে সক্রিয়, ঠিক একইভাবে সক্রিয় ঋত্বিক ঘটক৷ ঋত্বিক ঘটকের কাছ থেকে কুমার যদি কোনও মূল শিক্ষা পেয়ে থাকেন, তা হল এই যে, চলচ্চিত্র শুধুমাত্র বিবরণ বা আখ্যান-বিস্তৃতি নয়, তাও এক ধরনের দার্শনিক অনুধ্যান৷ শিল্পীর এই জীবন জিজ্ঞাসা যদি না থাকে, তাহলে তাঁর সিনেমা করার কোনও অধিকার নেই।
![](https://i1.wp.com/www.4numberplatform.com/wp-content/uploads/2024/04/sanjayin@4.jpg?resize=640%2C496&ssl=1)
আজ কুমার চলে গেছেন৷ তিনি এমন একজন মানুষ যিনি মনীষাকে ষোড়শোপচারে অর্ঘ্য দিয়েছিলেন, তা তাঁর চলচ্চিত্র-সহ অন্যান্য সৃষ্টিসম্ভার দেখলেই বোঝা যায়৷ তাঁর বিদায়ে ভারতীয় চলচ্চিত্র শূন্য হয়ে যায়নি, কিন্তু আমাদের বুদ্ধিজীবিতার আকাশে একটি ম্লান ছায়া নেমে এসেছে। আমরা কতদিন বাদে দৃশ্যের রূপকথার মধ্যে কুমার সাহনিকে পুনরায় খুঁজে পাব, তা আমরা জানি না। কিন্তু আমাদের গর্ব হয়, এ মানুষটি যখন কোনও শিক্ষায়তনে আসতেন, পুনেতে, সত্যজিৎ রায় ফিল্ম ইন্সটিটিউটে, রূপকলা কেন্দ্রে বা অন্যত্র, তিনি তখন একটা অন্যরকম বাচনভঙ্গির আশ্রয় নিতেন, তখন তাঁকে দেখে বোঝা যেত না তিনি নানা দূরহ মেধার মধ্যে প্রবেশ করেন ও নানারকম গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা প্রবর্তন করেন। আমি নিজে দেখেছি তিনি ছাত্রদের কী পরিমাণ উৎসাহ দিতেন, এবং কীভাবে উদ্দীপিত করতেন। তিনি নিজে আমাকে বলেছেন, যে ঋত্বিক ঘটক একটা সূর্যোদয়ের দৃশ্য শেখাবেন বলে রাত বারোটা থেকে যেরকম হৈ-হুল্লোড় শুরু করেছিলেন পুনেতে, সূর্যোদয়ের দৃশ্যটির চেয়ে তার আগেকার সেই হৈ-হুল্লোড় কুমারের কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিল। আসলে ঋত্বিক ঘটকের কাছ থেকে তিনি শিখেছিলেন যে মানুষের যৌথ নির্মাণের মধ্যে যে সৌন্দর্য, তা-ই শ্রেষ্ঠতম, চূড়ান্ত। আজ কুমার সাহনিকে স্মরণ করতে গিয়ে ব্যক্তির নিজস্ব সত্য আর সামাজিক সত্য কীভাবে জুড়তে পারে তাই-ই ভাবতে থাকা কুমারের বলিরেখাগ্রস্ত ললাট আমার মনে পড়ে যায়।