লক্ষ কণ্ঠে গীতা পাঠ— উদ্দেশ্য, বিধেয়, প্রতিরোধ!

তাপস কুমার দাস

 


আজ যখন সারা ভারতবর্ষে দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্ববাদের জয়ধ্বনি উঠেছে, ভারতবর্ষের ইতিহাসের এই ক্রান্তিকালে শিক্ষিত, প্রগতিশীল বাংলার প্রকৃত অবস্থান অনেকটা ওই গলদের গ্রামের মতোই। সেই দুর্ভেদ্য বাংলা ছিনিয়ে নিতে সমস্তরকম দাঁত নখ বার করে ঝাঁপিয়েছে গেরুয়া ফ্যাসিজম। লক্ষ কণ্ঠের গীতাপাঠ সেই ফ্যাসিবাদী রাজনীতির এক চতুর চাল ছাড়া আর কিছুই নয়, এর সঙ্গে বাঙালির আত্মিক উন্নয়নের সামান্যতম সম্পর্ক নেই কোনও— না বৌদ্ধিক, না ধার্মিক, না মানবিক। সম্পূর্ণটাই এক ধুরন্ধর রাজনীতি

 

আগামীকাল অর্থাৎ চব্বিশে ডিসেম্বর কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে লক্ষ কণ্ঠে গীতা পাঠ করার আয়োজন করেছে দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দলগুলি। বাংলায়, খোদ কলকাতার বুকে, বাঙালিদের সার্বিক আত্মিক উন্নয়নের (আয়োজকদের দাবি অনুযায়ী) জন্য এই অনুষ্ঠান পরিচালনা করার জন্য নিয়ে আসা হচ্ছে এমন কিছু ধর্মীয় সংস্থাকে (অখিল ভারতীয় সংস্কৃত পরিষদ, মতিলাল ভারত তীর্থ সেবা মিশন প্রভৃতি) যারা সঙ্ঘ পরিবারের শাখা সংগঠন, এবং যাদের সঙ্গে বাংলার কোনও শিকড়ের যোগাযোগ নেই।  আনার চেষ্টা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, উত্তরপ্রদেশের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী, দ্বারকাপীঠের শঙ্করাচার্য সদানন্দ সরস্বতী এবং আরও অনেককে, যাঁরা বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের হোমরাচোমরা হলেও, বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং ধর্মদর্শনের সঙ্গে তাঁদের সেভাবে কোনও সম্পর্ক নেই। শুধু তাই নয়, প্রগতিশীল শিক্ষিত বাঙালি হিন্দু সমাজের সিংহভাগ তাঁদের নামই শোনেননি।

বাংলার বুকে বাঙালির গীতাচর্চার কোনও ঐতিহ্য কি তাহলে নেই? বাঙালির শিক্ষা ও মননের ইতিহাসে নেই গীতা নিয়ে সারস্বত সাধনার ইতিহাস? বাঙালিকে গীতা পড়িয়ে আত্মিক উন্নয়ন ঘটানোর জন্য বহির্বাংলা থেকে, প্রধানত নন-অ্যাকাডেমিক মানুষদের এনে সর্বাত্মক আত্মিক উন্নয়নের মাহাত্ম্য বাঙালির ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া কি একান্তই অপরিহার্য?

সংস্কৃত সাহিত্যের সঙ্গে সামান্যতম পরিচয় যাঁদের আছে, এবং বাংলার সারস্বত সাধনার উজ্জ্বল ইতিহাস সম্পর্কে যাঁরা ওয়াকিবহাল, সেইসব মানুষমাত্রই জানেন মধুসূদন সরস্বতী থেকে শুরু করে, হিতলাল মিশ্র, বিশ্বনাথ চক্রবর্তী, বলদেব বিদ্যাভূষণ, রামমোহন রায়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্যোপাধ্যায়, কেদারনাথ দত্ত, রমেশচন্দ্র দত্ত, ঋষি অরবিন্দ, ভূধরচন্দ্র চট্যোপাধ্যায়, সতীশচন্দ্র দাশগুপ্ত, স্বামী কৃষ্ণানন্দ, অনাথবন্ধু বসু প্রমুখ বহু বিদ্বান বাঙালি গীতা নিয়ে অতি গুরুত্বপূর্ণ এবং গভীর পাণ্ডিত্যপূর্ণ কাজ করে গেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গীতা নিয়ে সরাসরি কোনও প্রথাগত অ্যাকাডেমিক কাজ অথবা গীতার অনুবাদ না করলেও, তাঁর বিভিন্ন লেখায়— উদাহরণস্বরূপ, ‘ভারতবর্ষের ইতিহাসের ধারা’, ‘জাভাযাত্রীর পত্র’, এবং, বিশেষভাবে— ‘পারস্যে’ শীর্ষক ভ্রমণবৃত্তান্তে— এবং ১৯০৮ সালে অজিতকুমার চক্রবর্তীকে লেখা চিঠিতে (শেষ দুটি তথ্যনির্দেশের প্রসঙ্গে বিশদে উল্লেখ করা হবে অনতিবিলম্বে) গীতা নিয়ে বিভিন্ন বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা আছে।

প্রসঙ্গত, রবীন্দ্র-উত্তর যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবি শক্তি চট্ট্যোপাধ্যায় গীতার একাধিক অধ্যায়ের অনুবাদ করেছিলেন। অধুনালুপ্ত ‘সম্প্রতি’ পত্রিকায় ১৯৬৩ সালে গীতার একাদশ অধ্যায়, এবং সামসঙ্গীতের (অষ্টাদশ অংশ) অনুবাদ দিয়ে যার শুরু, আকস্মিক মৃত্যুতে তা শেষ করে যেতে পারেননি কবি। ১৯৮২ সালে ‘উলুখড়’ পত্রিকায় গীতার অষ্টম থেকে দশম অধ্যায়ের অনুবাদ প্রকাশ করেন শক্তি, এবং ১৯৮৪-তে তাঁর লেখার খাতায় প্রথম অধ্যায়ের অনুবাদ পাওয়া যায়। ‘ধর্ম নয়, গীতার কবিত্ব আমাকে টানে’— বলেছিলেন শক্তি। শক্তির করা অনুবাদই সম্ভবত গীতার সবচেয়ে সাবলীল এবং মধুর কাব্যানুবাদ। আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত ‘অনুবাদিত পদ্য’ (দ্বিতীয় মুদ্রণ প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালে, কবিপত্নী মীনাক্ষী চট্ট্যোপাধ্যায়ের সম্পাদনায়) শীর্ষক গ্রন্থে শক্তির যাবতীয় গীতা সংক্রান্ত অনুবাদ পাওয়া যাবে। ওই গ্রন্থেই মীনাক্ষীর লেখা অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় পাওয়া যাবে এই অনুবাদকীর্তির বর্ণানুক্রমিক এবং কালানুক্রমিক ইতিহাস।

বাঙালি সারস্বত সাধনা প্রকৃতই বহুমুখী— বামপন্থী মার্ক্সবাদী বাঙালি দর্শনিকরাও গীতা নিয়ে কাজ করেছেন। দিলীপ বসু এককভাবে ভগবত গীতা অ্যান্ড আওয়ার ন্যাশন্যাল মুভমেন্ট (পিপলস পাবলিশিং হাউজ থেকে ১৯৮১ সালে প্রকাশিত), এবং শ্রীনিবাস গণেশ সরদেশাই (প্রখ্যাত মারাঠি জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী এবং পরবর্তীকালে ভারতবর্ষে বামপন্থী আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা)-এর সঙ্গে যৌথভাবে মার্ক্সিজম অ্যান্ড ভগবত গীতা (পিপলস পাবলিশিং হাউজ থেকে ১৯৮২ সালে প্রকাশিত) শীর্ষক অতি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থদুটির প্রণেতা। আরেক বামপন্থী অ্যাকাডেমিশিয়ান আলোক মুখার্জীর বই ‘গীতারহস্যভেদ’ও এ-প্রসঙ্গে উল্লেখের দাবি রাখে (বইটি ভিরাসাত আর্ট পাবলিকেশন থেকে পুনর্মুদ্রিত হতে চলেছে)। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে বাংলার বাইরেও বামপন্থী লেখক, পণ্ডিত এবং দার্শনিকদের গীতাচর্চার গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস আছে, প্রখ্যাত সংস্কৃত বিশেষজ্ঞ, যোগাসন বিশেষজ্ঞ (আয়েঙ্গারের বন্ধু এবং একদা সহকর্মী), ইংরেজি সাহিত্যের জবরদস্ত অধ্যাপক জি রামকৃষ্ণের ‘আ গ্লিম্পস ইনটু দ্য ভগবত গীতা’ শীর্ষক গবেষণাপুস্তকে সেই ইতিহাস বিশদে পাওয়া যাবে।

সেই বাঙালিকে গীতাপাঠ করাতে কেন বহির্বাংলা থেকে নিয়ে আসতে হচ্ছে এমন মানুষদের, যাঁরা প্রধানত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, এবং যাঁদের গীতা সংক্রান্ত, বা সাধারণভাবেই, সারস্বত এবং বৌদ্ধিক চর্চার গভীরতা সম্পর্কে প্রবল সন্দেহের অবকাশ আছে— এমনকি যাঁদের সংস্কৃত সাহিত্যজ্ঞান সম্পর্কেই প্রশ্ন ওঠে? বৌদ্ধিক জাতি হিসেবে বাঙালির এই অবনমন কবে থেকে হল, যেখানে দাঁড়িয়ে অল্পশিক্ষিত বা অশিক্ষিত রাজনৈতিক নেতারা এসে ছড়ি ঘুরিয়ে যাবেন বাঙালির কিসে কিসে আত্মিক, ধর্মগত, এবং সারস্বত উন্নয়ন হয় সেই বিষয় নির্ধারণ করতে?

এই প্রশ্নের উত্তর পেতে গেলে আমাদের তাকাতে হবে অ্যাস্টেরিক্স কমিক্সের প্রতিটি বইয়ের শুরুর পাতায়। যেখানে পঞ্চাশ খ্রিস্টপূর্বাব্দের গল দেশের মানচিত্রের একটি বিশেষ জায়গা নির্দেশ করে (আতস কাচের মাধ্যমে অদম্য অ্যাস্টেরিক্স ওবেলিক্সের গ্রামকে বড় করে দেখিয়ে) বলা হয়েছে—

Nous sommes en 50 avant jesus-christ. Toute la gaule est occupee par les Romanis… Toute? Non! Un village peupl d trreductibles Gaulois resiste encorte et Toujours a l’envahisseur.

মূল ফরাসি এই লেখার বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়—

যিশুর জন্মের পঞ্চাশ বছর আগে সমস্ত গলদেশ রোমের অধীনে… ঠিক সবটা নয়, এক ছোট্ট গ্রাম এখনও অদম্য। সেই গ্রামের বীর বাসিন্দারা এখনও ঠেকিয়ে রেখেছে বিদেশি আক্রমণকারীদের।

আজ যখন সারা ভারতবর্ষে দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্ববাদের জয়ধ্বনি উঠেছে, ভারতবর্ষের ইতিহাসের এই ক্রান্তিকালে শিক্ষিত, প্রগতিশীল বাংলার প্রকৃত অবস্থান অনেকটা ওই গলদের গ্রামের মতোই। সেই দুর্ভেদ্য বাংলা ছিনিয়ে নিতে সমস্তরকম দাঁত নখ বার করে ঝাঁপিয়েছে গেরুয়া ফ্যাসিজম। লক্ষ কণ্ঠের গীতাপাঠ সেই ফ্যাসিবাদী রাজনীতির এক চতুর চাল ছাড়া আর কিছুই নয়, এর সঙ্গে বাঙালির আত্মিক উন্নয়নের সামান্যতম সম্পর্ক নেই কোনও— না বৌদ্ধিক, না ধার্মিক, না মানবিক। সম্পূর্ণটাই এক ধুরন্ধর রাজনীতি। বাঙালির কালচারাল হেরিটেজের অহঙ্কারের জায়গা ভেঙে দিয়ে বহির্বাংলার, বিশেষত গোবলয়ের সংস্কৃতিকে ছলে-বলে-কৌশলে গায়ের জোরে বাংলার মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চতুর রাজনৈতিক চাল। বাঙালির নিজস্ব, অতি সমৃদ্ধ, বহুমুখী সংস্কৃতি নষ্ট করে দিয়ে বাঙালিকে গোবলয়ভিত্তিক দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির কব্জায় আনার প্রক্রিয়া।

কালচারাল হেজেমনি প্রতিষ্ঠা করার এই চেষ্টা আমরা সম্প্রতি অতি সুস্পষ্টভাবে দেখতে শুরু করেছি। এবারের দুর্গাপুজোয় রামমন্দিরের আদলে মণ্ডপ গড়ে জয় শ্রীরাম ধ্বনি তুলে বাঙালির সর্বজনীন উৎসবকে গোবলায়িত করার চেষ্টা আমাদের নজর এড়ায়নি। তারও আগে বর্তমান প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং অন্যান্য বিজেপি নেতারা বাংলায় এসে বাঙালিকে শিখিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন দুর্গাপুজো কীভাবে করা উচিত। কালীপুজোর সময় ধনতেরাসে বিপুলহারে ঝাঁটা কেনানোর পরোক্ষ সামাজিক চাপ সৃষ্টি করে আঘাত করার চেষ্টা করা হয়েছে সুপ্রাচীন বাঙালি সংস্কৃতি এবং লোকাচার পদ্ধতিকে। ব্রিগেডের গীতাপাঠ এই সাংস্কৃতিক সন্ত্রাস কায়েমের প্রচেষ্টায় নবতম সংযোজন।

গীতা, কাব্যগুণে এক মহৎ সৃষ্টি। তবে মহাভারতে প্রক্ষিপ্ত এই সাহিত্যকর্মের মধ্যে মানবতাবাদের প্রকৃত রূপ কতটা প্রকাশ পেয়েছে, তা হয়তো তর্কযোগ্য। স্বয়ং রবিঠাকুর এই বিষয়ে সন্দিহান ছিলেন— অন্য পরে কা কথা। পরবাস পত্রিকায় প্রকাশিত আশীষ লাহিড়ীর যুক্তিপূর্ণ প্রবন্ধ থেকে আমরা জানতে পারি, আপাতদৃষ্টিতে গীতার যা মূলমন্ত্র— সেই আত্মার অবিনশ্বরত্ব সম্পর্কিত তাত্ত্বিক জ্ঞানের মহত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। শ্রী লাহিড়ী লিখছেন, রবিঠাকুরের মতে, গীতায় আত্মার অনশ্বরত্ব নিয়ে যে উপদেশ কৃষ্ণ দিচ্ছেন, তা সম্ভবত কার্যসিদ্ধির কৌশল মাত্র। ১৯০৮ সালের ৩১ মে বিশিষ্ট কাব্যবিশারদ অজিতকুমার চক্রবর্তীকে লেখা একটি চিঠিতে রবিঠাকুর লেখেন—

…অর্জুনকে যুদ্ধে প্রবৃত্ত করবার জন্য আত্মার অনশ্বরত্ব সম্বন্ধে যে উপদেশ আছে তার মধ্যেও বিশুদ্ধ সত্যের সরলতা নেই।

পরবর্তীকালে, ১৯৩২-এ ‘পারস্যে’ শীর্ষক প্রবন্ধে রবিঠাকুর গীতার দার্শনিক মহত্ব এবং মানবিকতাবাদ সংক্রান্ত তাঁর সংশয় আরও তীব্রভাষায় প্রকাশ করেছেন। তারও বহু আগে মনীষী অক্ষয়কুমার দত্ত ১৮৮৩ সালে গীতার যা তথাকথিত ‘ট্রেডমার্ক’, সেই ‘ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে’ শ্লোক সম্পর্কে একই সংশয় আরও সাদামাটা ভাষায় শ্লেষাত্মক সুরে ব্যক্ত করে গেছেন।[1] তথাকথিত সনাতনী ভারতীয় ধর্মের যুক্তিপূর্ণ সমালোচনা করার যে ‘পাপ’ শুধুমাত্র বামপন্থী দর্শনের এবং বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদের ওপর ইদানিং এসে পড়ে, তা যে অসত্য এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত— এই রেফারেন্সগুলি তা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে।

গীতাপাঠ, অতএব, বাঙালির সার্বিক আত্মিক উন্নয়ন আদৌ ঘটাতে পারে কিনা, তা সে লক্ষ কণ্ঠে পাঠ করলে বা এককভাবে— সে-সম্পর্কে তত্ত্বগতভাবে খানিক বৌদ্ধিক সংশয় সম্ভবত থেকেই যায়। বর্তমান নিবন্ধে অবশ্য সেই বিতর্কের বিশদে যাওয়া হবে না, আলোচনা আপাতত হবে ধর্মের নাম করে চতুর এবং বিভাজনমূলক দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রেক্ষিতে। যে রাজনীতি বাংলা দখলের জন্য সুচতুরভাবে বহির্বাংলার সংস্কৃতিকে বলপূর্বক চাপিয়ে দেওয়ার নিরন্তর চেষ্টা করে চলেছে।

বাঙালির ধর্মাচরণের ক্ষেত্রে, দক্ষিণপন্থী রাজনীতির এই অশুভ প্রচেষ্টা সর্বাত্মক ভূমিকা নিচ্ছে। বাঙালি হিন্দুর কাছে দেবদেবী ঘরের লোক, আদরের বস্তু, আপনজন। মহাসাধক রামপ্রসাদের বেড়া বেঁধে দিয়ে যান মা কালী, রামকৃষ্ণদেব আদরে সোহাগে রাগে ধমকে কথা বলেন কালীর সঙ্গে, বাঙালির শিব ভুঁড়ো নিরীহ, ঘরের জামাই, রাম, সীতা, হনুমান বাঙালির আত্মার আত্মীয়। ঈশ্বরের সঙ্গে এই একাত্মবোধ বাঙালির অন্তর্নিহিত, আবহমান প্রগতিশীল এবং সংবেদনশীল মননশীলতার প্রতিভাস। অ্যাংরি হনুমান, হিংস্র রাম বা সিক্স প্যাকওয়ালা শিবের সূত্রে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিজমের যে প্রক্ষেপ, বাঙালির ঈশ্বরবাদ তার ধারকাছ  দিয়ে যায় না, বরং তাকে বর্জন করে। বহির্বাংলার এই আগ্রাসী ধৰ্মদর্শন গায়ের জোরে বাঙালির ওপর চাপিয়ে দেওয়ার এই প্রচেষ্টার মধ্যে প্রগতিশীল হিন্দু বাঙালির নিজস্ব সাংস্কৃতিক মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়ার চক্রান্ত রয়েছে। বর্তমানে, সুদূর দাক্ষিণাত্যের কিছু বিচ্ছিন্ন অঞ্চল ছাড়া, বাংলাই একমাত্র জায়গা যেখানকার মানুষ রুখে দিতে পারে গেরুয়া ফ্যাসিজমের জয়যাত্রা, কারণ বাংলার মানুষ প্রগতিশীল ভাবনায় বলীয়ান— সঙ্ঘ পরিবারের রাজনীতির হর্তাকর্তারা সেটা বুঝতে পেরেছেন, তাই বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতি তছনছ করে দিয়ে, বহির্বাংলার সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ঢুকিয়ে বাঙালির সেই মাজার জোর ভেঙে দেওয়াটা খুবই জরুরি। লক্ষ কণ্ঠে গীতাপাঠ সেই চক্রান্তের একটা সুপরিকল্পিত ধাপমাত্র, এ কিছুতেই কোনও ধর্মাচরণ নয়। ধর্মাচরণ একটি ব্যক্তিগত অনুভূতি। বাঙালি হিন্দুর ঘরে যে ব্যক্তিগত ধর্মাচরণ হয়, তা একান্তই আত্ম-অনুভূতিভিত্তিক, তা লোক দেখিয়ে করা হয়নি কোনওদিন। এমনিতেই, সঙ্ঘবদ্ধভাবে ধর্মাচরণ করা আব্রাহামিক রিলিজিয়নের বৈশিষ্ট্য, হিন্দু ধর্মের না। গীতাপাঠের এই রাজনৈতিক বয়ান তাই হিন্দুধর্মের প্রচলিত ধ্যানধারণারও বিরুদ্ধে।

চব্বিশে ডিসেম্বরের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড তাই প্রগতিশীল শিক্ষিত হিন্দু বাঙালিদের নিজভূমে পরবাসী করার দীর্ঘ্যমেয়াদি চক্রান্তের এক গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। বহির্বাংলার আগ্রাসী হিন্দুত্ববাদ বলপূর্বক ঢুকিয়ে কালচারাল হেজেমনির যে প্রয়াস, তা শুধু হিন্দু বনাম মুসলমান, বা ধার্মিক বনাম নাস্তিক বামপন্থী— এই বাইনারিতে আবদ্ধ রাখবে না ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে— তা আরেকটি নতুন কনফ্লিক্টের জন্ম দেবে। সেই সংঘাত, প্রগতিশীল শিক্ষিত হিন্দু বনাম আগ্রাসী অসংবেদনশীল হিন্দুত্ববাদীর সংঘাত। এই সংঘাতের পরিণাম হিসেবে, শিক্ষিত বাঙালি প্রগতিশীল হিন্দুরা নিজভূমে পরবাসী হয়ে যেতে পারেন— এই আশঙ্কা মোটেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয়, যে, এই বাংলারই কিছু মানুষ, অর্থের লোভে, ক্ষমতার লোভে, বিজেপি এবং সঙ্ঘ পরিবারের হয়ে কাজ করছেন বাংলার মাটিতে বিভেদমূলক হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রবেশ ঘটিয়ে বাঙালি হিন্দুর আইডেন্টিটি ক্রাইসিস তৈরি করার উদ্দেশ্যে। এইসব মীরজাফরদের ভূমিকা স্বাধীনতাপূর্ব বাংলাদেশের রাজাকারদের মতোই ঘৃণ্য।

বাঙালিকে এই চক্রান্তের প্রকৃত রূপ সম্যকভাবে বুঝতে হবে। রুখে দিতে হবে বাঙালি সংস্কৃতি ধ্বংসের এই চক্রান্ত। হিন্দু বনাম হিন্দুত্ববাদীদের সংঘাত এই বাংলা যেন ভবিষ্যতে না দেখে, শিক্ষিত প্রগতিশীল বাঙালি হিন্দুকে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। বৌদ্ধিক, মানবিক, এবং রাজনৈতিক— সমস্তরকম লড়াই জারি থাকুক এই চক্রান্তের বিরুদ্ধে।


[1] অক্ষয়কুমার দত্ত, ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়, দ্বিতীয় খণ্ড (করুণা প্রকাশনী, কলকাতা, ১৯৯৯)। আশীষবাবুর প্রবন্ধের সূত্রে প্রাপ্ত।


*মতামত ব্যক্তিগত

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4664 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

3 Comments

  1. গীতা/শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা -র অনুবাদক হিশেবে রাজশেখর বসুর নাম চোখে পড়ল না।ঐ বই,যেটি রাজশেখর বসু প্রথমে প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক ছিলেন, তার ভূমিকাটি শিক্ষিত বাঙালির অবশ্যপাঠ্য।
    সরদেশাই ও দিলীপ বসু (এই দুই মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক, সিপিআইএর বিশিষ্ট নেতা)- সম্পাদনায় প্রকাশিত সংকলন গ্রন্থ The riddles of Bhagavadgita [PPH],যাঁদের লেখার কথা উল্লেখ করেছেন,ও সাম্প্রতিক কালের বিশিষ্ট মার্ক্সবাদী চিন্তাবিদ ও দার্শনিক রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যর একটি অসাধারণ প্রবন্ধ এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে।

    • হ্যাঁ, রাজশেখর বসুর নাম দুর্ভাগ্যবশত বাদ পড়ে গেছে l আসলে ওঁর বইটি তো একটু অন্য ঘরানার l রাজশেখর বসু ১৯৪২ এ (সম্ভবত, কারণ হরপ্রসাদ মিত্র সম্পাদিত রাজশেখর রচনাবলীর ভূমিকায় সেরকমই উল্লেখ আছে) এ গীতার অনুবাদ করেন l তাঁর মৃত্যুর পরে ১৯৬০ সালে ডি এম লাইব্রেরির তৎকালীন কর্নধার সুপ্রিয় সরকারের উৎসাহে সেটি প্রথম ছাপা হয় l পরিবর্ধিত ফর্মে এখন পাবেন, শ আড়াই তিন মত দাম বোধহয় l রাজশেখরের গীতা নিয়ে বিশ্লেষণমূলক আলোচনা আপনি আশীষ লাহিড়ী এবং কুমার রাণার একাধিক লেখায় পাবেন l

  2. আপনার লেখাটি পড়ে আমার মনে হয়েছে এটিকে আরও বিস্তৃত ভাবে লেখা প্রয়োজন। আপনি লেখার কয়েকটি জায়গায় অনেক বিদগ্ধজনের নাম উল্লেখ করেছেন, অনেকেরটা করা হয়নি, তাই আমি মনে করি তারা কিভাবে গীতাকে ব্যাখ্যা করেছেন তারও একটা সারাংশের উল্লেখ এই লেখার সাথে থাকা দরকার। এটা ঠিক অনলাইনে শব্দের একটা বাধ্যবাধকতা রাখতে হয়, এই পরিসরে সেটা হয়ত সম্ভব নয়। আপনার সাথে যোগাযোগের নম্বর আমার কাছে নেই, তাই অনুরোধ করব আপনি যদি অনুগ্রহ করে আমাকে 7908372970 নম্বরে একটা ফোন করেন, তাহলে এই বিষয়ে আপনার সাথে আলোচনার জন্য একটা তারিখ ঠিক করে বসে নেওয়া যায়।

আপনার মতামত...