নাগরিকত্ব সংশোধনী বিধিমালা ২০২৪

অনুপ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়

 


উদ্বাস্তুদের জন্য "নিঃশর্ত নাগরিকত্ব"-এর চাহিদাপূরণ করা দূরে থাক, সিএআর ২০২৪ ভারতীয় নাগরিকত্বের জন্য করা প্রচুর সংখ্যক আবেদন প্রত্যাখ্যান করতে পারবে যার ফলে সেই প্রত্যাখ্যাত আবেদনকারীরা "অবৈধ অভিবাসী" হিসাবে চিহ্নিত হবেন। অসমের মতোই ডি-ভোটার হিসেবে তাঁদের স্থান হবে ডিটেনশন ক্যাম্পে। এটি এনআরসি প্রক্রিয়া প্রয়োগের সপক্ষে একটি পদক্ষেপ। সম্প্রতি আধার আইনে একটি নতুন ধারা (২৮এ) সেপ্টেম্বর ২০২৩-এ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সেই নতুন ধারার বলে আধার আইন ২০১৬ নাগরিকত্ব নির্ধারণের এবং নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতালাভ করেছে। সম্প্রতি এই নতুন ধারার বলে পশ্চিমবঙ্গের বিপুলসংখ্যক বাসিন্দার আধার নম্বর নিষ্ক্রিয় করাও এনআরসি প্রক্রিয়া প্রয়োগের প্রাথমিক প্রচেষ্টা বলে মনে হয়

 

ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক ১১ মার্চ, ২০২৪ তারিখে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিধিমালা, ২০২৪, (সিএআর ২০২৪) সংক্রান্ত যে বিবৃতি প্রকাশ করেছে সেটি ভারতীয় নাগরিক আইনের ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিকে বিনষ্ট করেছে। কেবলমাত্র নির্বাচনের স্বার্থে এই সাম্প্রদায়িক, সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি, পশ্চিমবঙ্গ, অসম, ত্রিপুরা এবং অন্যান্য ভারতীয় রাজ্যে বসবাসরত বাংলাদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ বাঙালি হিন্দু উদ্বাস্তুদের প্রতারিত করবার এবং আইনের চোখে তাদের “অবৈধ অভিবাসী” হিসাবে চিহ্নিত করবার একটি চক্রান্ত।

নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন, ২০১৯ (সিএএ ২০১৯) ডিসেম্বর, ২০১৯-এ সংসদে অনুমোদিত হয়েছিল। তারপর থেকেই এই আইনের সাংবিধানিক মান্যতাকে প্রশ্ন করে ভারতের শীর্ষ আদালতে দুই শতাধিক আবেদন দাখিল করা হয়েছে। কারণ এই আইনটি ভারতের প্রতিবেশী এলাকা থেকে নির্বিচারে নির্বাচিত তিনটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের অত্যাচারিত সংখ্যালঘু মানুষদের ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব মঞ্জুর করবার জন্য প্রবর্তিত হয়েছিল। বিচারাধীন থাকার কারণে কেন্দ্রীয় সরকার গত ৫ বছর নাগরিকত্ব সংশোধনী বিধিমালা প্রণয়নের ব্যাপারে কোনও উচ্চবাচ্য করেনি। লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে এখন এই সংশোধনী বিধিমালা সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ কেবলমাত্র নির্বাচনে সুবিধালাভের জন্যেই করা হয়েছে। একটি বিচারাধীন বিষয়ে অযথা হস্তক্ষেপ ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে খুব খারাপ নজির স্থাপন করল।

অটলবিহারী বাজপেয়ি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ২০০৩ সালে নাগরিকত্ব আইন, ১৯৫৫-কে সংশোধন করা হয় (সিএএ ২০০৩)। এই সংশোধিত আইনে, বিশেষ করে যারা ১৯৭১ সালের পরে বাংলাদেশ থেকে এসেছেন, এইরকম সকল উদ্বাস্তুকে “অবৈধ অভিবাসী” হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। বিভাজন-পরবর্তী পশ্চিমবঙ্গ, অসম, ত্রিপুরা এবং অন্যান্য ভারতীয় রাজ্যের বাঙালি শরণার্থীরা, তখন থেকেই “নিঃশর্ত নাগরিকত্ব” দাবি করে আসছিলেন। নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে এই শরণার্থী-বিরোধী, বাঙালি-বিরোধী সংশোধনী, অর্থাৎ সিএএ ২০০৩ বাতিল করে, সিএএ ২০১৯–এর মাধ্যমে তাদের নিঃশর্তভাবে ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রদান করবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। এই প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে ২০১৯ সালে অনেক বাঙালি উদ্বাস্তু বিশেষ করে মতুয়া সম্প্রদায়ের উদ্বাস্তুরা (নমশূদ্র বর্ণের অন্তর্গত যা পশ্চিমবঙ্গের একটি তফসিলি জাতি), যারা বনগাঁ, বারাসত, রানাঘাট ও কৃষ্ণনগর লোকসভা কেন্দ্রের ভোটার ছিলেন, তাঁরা বিজেপিকে ভোট দিয়েছিলেন। মনে আছে ২০২১ সালে বিধানসভা নির্বাচনের আগে আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একটি জনসভায় মতুয়া সম্প্রদায়ের কাছে বিজেপিকে ভোট দেওয়ার পরিবর্তে তাদের নাগরিকত্ব নিশ্চিত করবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একজন নাগরিক নয় এমন মানুষকে ভোট দিতে বলছেন! অদ্ভুত প্রস্তাব! ভারতীয় সংবিধানে গোটা গোটা করে লেখা আছে দেশের সকল প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক নির্বাচনের মাধ্যমে তাঁদের প্রতিনিধি বেছে নেবেন এবং এই নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই দেশ শাসন করবেন। তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখেছি সংবিধানের আর কোনও ধারাতেই আর কাউকে ভোট দেওয়ার অধিকার দেওয়া হয়নি। তাই এ-কথা বলাই যায় যাঁদের ভোট দেওয়ার অধিকার আছে তাঁরা দেশের নাগরিক। সেই একই যুক্তিতে যিনি নির্বাচিত হচ্ছেন তিনিও দেশের নাগরিক। আমরা জানি মতুয়ারা আগেও ভোট দিয়েছেন এবং তাঁদের মধ্যে থেকে একজন সাংসদ হয়ে বর্তমানে কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রীও বটে। তার মানে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁর একজন সহকর্মী প্রতিমন্ত্রী এবং তাঁর নির্বাচকদের নিশ্চিত নাগরিকত্বের আশ্বাস দিলেন। তাঁর মন্তব্য অনুযায়ী মতুয়া সম্প্রদায় নাগরিক নয় এ-কথা জানা থাকা সত্ত্বেও তিনি তাঁদের ভোট দিতে বলেছেন।

এবারে হয়তো “ভক্ত”জন বলবেন সেই কারণেই তো সিএআর ২০২৪ প্রণয়ন করা হল। কী আছে সেই আইনে? বলা আছে যে এই বাঙালি উদ্বাস্তুকে ভারতের সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের ধারা ৬বি-এর অধীনে ভারতীয় নাগরিকত্ব সুরক্ষিত করতে তাঁদের এবং তাঁদের পিতামাতার জন্মস্থান, ভারতে প্রবেশের তারিখের বিবরণ যুক্ত করে নির্ধারিত ফর্মে আবেদন করতে হবে। এই আবেদনের সঙ্গে আবেদনকারী যে আফগানিস্তান বা বাংলাদেশ বা পাকিস্তানের নাগরিক তা প্রমাণ করার জন্য একটি তালিকায় (Schedule IA) থাকা ৯টি নথির মধ্যে অন্তত একটি নথি জমা দিতে হবে। তেমনই ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৪ তারিখে বা তার আগে যে আবেদনকারী ভারতে প্রবেশ করেছেন তা প্রমাণ করবার জন্যে প্রদত্ত একটি নথির তালিকা (Schedule IB) থেকে যে-কোনও একটি নথি জমা দিতে হবে। এছাড়াও আরও বেশ কিছু নথি জমা দেওয়ার কথা বলা আছে। মনে রাখতে হবে যিনি এই আবেদন করছেন তিনি প্রতিবেশী দেশ থেকে ধর্মীয় সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে অত্যাচারিত হয়ে ভারতে চলে এসেছিলেন। তাই তাঁর পক্ষে এই সমস্ত নথি জোগাড় করা সম্ভব নাও হতে পারে। সিএআর ২০২৪ অনুসারে, একটি “ক্ষমতাপ্রাপ্ত কমিটি” নাগরিকত্বের জন্য জমা দেওয়া এই আবেদনগুলি যাচাই করবে এবং শুধুমাত্র যদি আবেদনকারীকে “নিবন্ধিত বা স্বাভাবিকীকরণের জন্য উপযুক্ত মনে হয় কেবলমাত্র তাহলেই তাঁকে ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রদান করবে।” আর নথিগুলি না দিতে পারলে অথবা “ক্ষমতাপ্রাপ্ত কমিটি” যদি সেগুলির ব্যাপারে সন্তুষ্ট না হয় তাহলে কী হবে? আবেদনকারী এতদিন যে যে সুবিধা পেয়ে আসছিলেন তা বন্ধ হয়ে যাবে। অসমের ডি-ভোটার এবং এনআরসি-র অভিজ্ঞতা ইতিমধ্যেই দেখিয়েছে যে কীভাবে “অবৈধ অভিবাসী” বলে সন্দেহ করা লোকেরা সমস্ত সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অধিকার হারিয়েছে।

উদ্বাস্তুদের জন্য “নিঃশর্ত নাগরিকত্ব”-এর চাহিদাপূরণ করা দূরে থাক, সিএআর ২০২৪ এইভাবে ভারতীয় নাগরিকত্বের জন্য করা প্রচুর সংখ্যক আবেদন প্রত্যাখ্যান করতে পারবে যার ফলে কলমের এক খোঁচায় তাঁরা অর্থাৎ প্রত্যাখ্যাত আবেদনকারীরা “অবৈধ অভিবাসী” হিসাবে চিহ্নিত হবেন। অসমের মতোই ডি-ভোটার হিসেবে তাঁদের স্থান হবে ডিটেনশন ক্যাম্পে। এটি এনআরসি প্রক্রিয়া প্রয়োগের সপক্ষে একটি পদক্ষেপ। সম্প্রতি আধার আইনে একটি নতুন ধারা (২৮এ) সেপ্টেম্বর ২০২৩-এ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মনে রাখা প্রয়োজন যে এই আইন তৈরি হয়েছিল কেবলমাত্র আর্থিক এবং অন্যান্য ভর্তুকি, সুবিধা এবং পরিষেবাগুলির সঠিক পরিচালনার জন্যে। এই নতুন ধারার বলে আধার আইন ২০১৬, তার প্রচলিত বিধানগুলির বাইরে গিয়ে ভারতীয় নাগরিকত্ব নির্ধারণের এবং নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতালাভ করেছে। সম্প্রতি আধার আইনে অন্তর্ভুক্ত এই নতুন ধারার বলে পশ্চিমবঙ্গের বিপুলসংখ্যক বাসিন্দার আধার নম্বর নিষ্ক্রিয় করাও এনআরসি প্রক্রিয়া প্রয়োগের প্রাথমিক প্রচেষ্টা বলে মনে হয়।

আমরা এনআরসি, এনপিআর, সিএএ ২০০৩, সিএএ ২০১৯, এবং আধার বিধিতে অন্তর্ভুক্ত নতুন ২৮এ ধারাটির ক্ষমতার মাধ্যমে ব্যাপক আকারে ভারতীয় বাসিন্দাদের নাগরিকত্ব এবং অন্যান্য মৌলিক অধিকারহরণ করার সমস্ত প্রচেষ্টার নিন্দা করি।


*মতামত ব্যক্তিগত

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4662 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...