নির্বাচনী বন্ড: আইনসিদ্ধ দুর্নীতির সাতকাহন

সুমন কল্যাণ মৌলিক

 


নির্বাচনী বন্ড নিষিদ্ধ হওয়ার রায়কে স্বাগত জানিয়েই একথাটা আরেকবার বলে নেওয়া প্রয়োজন যে বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতার কারণে ভয়ঙ্কর ক্ষতি ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে। প্রায় সাত হাজার কোটি টাকার অনুদান হাতে পেয়ে টাকার জোরে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বাকি প্রতিদ্বন্দ্বীদের থেকে বিজেপি কয়েকশো যোজন এগিয়ে গেছে। এটা এক পরিকল্পিত চক্রান্ত যা বিজেপির দেশকে হিন্দু রাষ্ট্র বানানোর নীল নকশার অংশ

 

কোনও মানদণ্ডেই সাতটা বছর কম সময় নয়। ভারতের নির্বাচনী বিধিব্যবস্থাকে স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্ত করার দাবি নিয়ে ২০১৭ সালে যে নির্বাচনী বন্ড (ইলেকটোরাল বন্ড) চালু করা হয় তা প্রথম দিন থেকেই ছিল বিতর্কের কেন্দ্রে। বিষয়টির সঙ্গে সম্পর্কিত দুটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান বহু আগেই এই বন্ড যে দুর্নীতি ও জালিয়াতির নতুন নতুন রাস্তা খুলে দেবে তা সম্পর্কে নিশ্চিত ছিল। একাধিক সংগঠন এই বিষয়টি নিয়ে মামলা দায়ের করে। বিভিন্ন আপাতগ্রাহ্য প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও এ-বিষয়ে কোনও স্থগিতাদেশ দেয়নি সর্বোচ্চ আদালত। এমনকি ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসেও নতুন বন্ড বিক্রির অনুমতি দেওয়া হয়। এই সাত বছরে ১৬,৫১৮.১১ কোটি টাকা ডোনেশন হিসাবে ভারতের নির্বাচনী ব্যবস্থায় ঢুকেছে যার সিংহভাগ পেয়েছে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। ৪৭-পরবর্তী ভারতবর্ষে অন্যতম বৃহত্তম আর্থিক দুর্নীতির এই কাহিনির বাস্তবায়নে আইনবিভাগের এই হতাশাজনক ভূমিকাও ইতিহাসে লিপিবদ্ধ থাকবে। তাই যাঁরা সর্বোচ্চ আদালতের এই রায়কে ‘ঐতিহাসিক’ বলে উচ্ছ্বসিত, তারা নেহাতই সত্যের অপলাপ করছেন। একই সঙ্গে এ-কথাটাও স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে ২০১৮ সালে তৎকালীন অর্থদপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী পি রাধাকৃষ্ণান এ বিষয়ে সংসদে প্রকাশ্যে মিথ্যাচার করেছিলেন এবং এই নির্বাচনী আইন শুধু অসাংবিধানিকই নয়, তা প্রথম মুহূর্ত থেকেই প্রিভেনশন অব মনি লন্ডারিং অ্যাক্টের (পিএমএলএ) বিরুদ্ধে।

মূল আলোচনায় প্রবেশ করার আগে নির্বাচনী বন্ড নিয়ে দুটো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের বিগত সময়ের বক্তব্য আরেকবার স্মরণ করে নেওয়া জরুরি। ২০১৭ সালে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তৎকালীন গভর্নর কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রককে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছিলেন:

Electoral bonds in physical form may exchange hands several times before reaching the political party, which would leave no trail of the transactions and in the process anonymity to the contributor and to the political party, anonymity will be provided to several others in the chain of transforms of the electoral bonds. This can render the scheme open to abuse by unscrupulous elements.

২০১৮ সালে কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রককে লেখা এক চিঠিতে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন জানিয়েছিল:

This (electoral bond) opens up the possibility of shell companies being set up for the sole purpose of making donations to the political parties with no other business of consequences having disbursable profits.

এই দুটো পর্যবেক্ষণকে কোনও গুরুত্ব না দিয়ে মোদি সরকার এই নির্বাচনী বন্ড চালু রেখেছিল।

 

নির্বাচনী বন্ডের কথা

‘নির্বাচনী বন্ড’ এক ধরনের কারেন্সি নোট যা ১,০০০/১০,০০০/১,০০০০০/১০,০০০০০/১,০০০০০০০ মূল্যমানে বিক্রি হয়। এগুলো কিনতে পারে ব্যক্তিমানুষ, গোষ্ঠী বা কর্পোরেট সংস্থা। কেনার পর ক্রেতারা তাদের পছন্দমতো রাজনৈতিক দলগুলিকে সেগুলো দান করে। রাজনৈতিক দল ১৫ দিনের মধ্যে এই বন্ডগুলোকে ভাঙিয়ে নেয়। নগদ অনুদান নেওয়ার সময় ২০,০০০ টাকার বেশি হলে দাতাদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করতে রাজনৈতিক দলগুলি বাধ্য থাকে, কিন্তু নির্বাচনী বন্ডের ক্ষেত্রে টাকার অঙ্ক যাই হোক না কেন দাতাদের নাম প্রকাশের কোনও প্রশ্ন থাকে না। এই বন্ড চালু হওয়ার পর রাজনৈতিক দলগুলোর ফান্ডিং-এর ৫৬ শতাংশ এই বন্ডের মাধ্যমেই আসছে। এই বন্ড কার্যকরী হওয়ার পর কর্পোরেট সংস্থাগুলোকে রাজনৈতিক দলগুলিকে চাঁদা দেওয়ার যে সিলিং ছিল তা অবলুপ্ত করা হয়। এতদিন বিদেশি সংস্থাগুলো রাজনৈতিক দলগুলোকে অনুদান দিতে পারত না। কিন্তু বন্ড চালু হওয়ার পর বিদেশি কর্পোরেট সংস্থাগুলো তাদের সাবসিডিয়ারি কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে যথেচ্ছ অনুদান দিতে পারে।

 

নির্বাচনী বন্ডের বিরোধিতা

এই নির্বাচনী বন্ডে দাতার নাম গোপন রাখা হল কালো টাকা চালানের প্রথম ধাপ। বিভিন্ন শেল কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে কালো টাকা আইনসিদ্ধ করার সম্ভাবনা রয়েছে এই বন্ডে। অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্মের (এডিআর) প্রধান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল অনিল ভার্মা সঠিকভাবে মন্তব্য করেছেন:

It could be bigtime Corporation or it could be players funnelling illicit money through shell companies — we don’t know who is donating. This has become what many call legalised and institutionalised corruption.

এই বন্ডগুলো একমাত্র বিক্রি করার অধিকারী হল দেশের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া। ফলত কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন শাসকদল অলিখিতভাবে নির্বাচনী বন্ড সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য জানার অধিকারী। কর্পোরেট সংস্থাগুলো স্বাভাবিকভাবেই তাদের অনুদানের সিংহভাগ শাসক দলকেই দেবে। বিরোধী দলগুলিকে এই বন্ডের মাধ্যমে বড় অঙ্কের অনুদান দিলে সে খবর সহজেই শাসক দলের কাছে পৌঁছে যাবে। সেই কর্পোরেট সংস্থাকে কেন্দ্রীয় এজেন্সি দিয়ে বিব্রত করার উপায় শাসক দলের হাতে থাকবে। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও রিজার্ভ ব্যাঙ্কের পূর্বতন গভর্নর রঘুরাম রাজন নির্বাচনী বন্ডের বিরোধিতা করতে গিয়ে বলেছিলেন:

Given the carrots and sticks at the governments disposal, few individuals or Corporations would chance donating large sums to the opposition through these bonds.

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল কর্পোরেট চাঁদার ক্ষেত্রে যে ৭.৫ শতাংশের সিলিং ছিল তা তুলে দেওয়ার ফলে কর্পোরেট গোষ্ঠী ও রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে যে স্বার্থের রাজনীতি তৈরি হবে তা সবসময় শাসক দলকে সাহায্য করবে। এখানে একটা বড় সম্ভাবনা হল অনুদানের মাধ্যমে সরকারের নীতিকে প্রভাবিত করা। নির্বাচনী বন্ডে যেহেতু দাতার নাম গোপন থাকবে তাই কোনও কোম্পানি নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে শাসক দলকে সাহায্য করে সরকারি পলিসিকে নিজের অনুকূলে নিয়ে আসতে পারে। এই অনুদানকে নির্বাচনী বন্ড বলা হলেও কোথাও লেখা নেই যে এই টাকা শুধু নির্বাচনেই ব্যয় করা যাবে। এই বন্ডের মাধ্যমে প্রাপ্ত টাকা মিডিয়া ও বিজ্ঞাপনে সারা বছর ব্যয় করা যাবে। এক্ষেত্রে যারা বেশি টাকা পাবে তারা ক্ষমতা দখলের লড়াইতে অন্য দলের থেকে অনেক বেশি এগিয়ে থাকবে। নির্বাচনী সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত অবসরপ্রাপ্ত ভারতীয় নৌবাহিনীর কমোডার লোকেশ বাত্রা মন্তব্য করেছেন:

So, Whoever gets more money can be used to buy up media space, boost advertising. Once you have the money, you can use it anywhere.

নির্বাচনী বন্ড মুখে স্বচ্ছতার কথা বললেও আদতে তা নাগরিকদের অধিকার ভুলুন্ঠিত করে। এখানে গোপনীয়তার নামে নাগরিকদের তথ্য জানার অধিকারকে অস্বীকার করা হয়। একজন নাগরিকের অধিকার নেই এটা জানার যে কোন্ রাজনৈতিক দল কাদের থেকে চাঁদা নিচ্ছে,তাদের অর্থের উৎস কী! এটা একটা গণতান্ত্রিক দেশের চরম লজ্জা।

 

সাত বছরের স্কোরশিট

সাত বছরে এখনও পর্যন্ত ১৬,৫১৮.১১ কোটি টাকার নির্বাচনী বন্ড (জানুয়ারি ২০২৪) বিক্রি হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৭-১৮ থেকে ২০২২-২৩ মধ্যে বিক্রি হয়েছে ১২,০০৮ কোটি টাকার বন্ড। এই হিসেবের মধ্যে ৬,৫৬৪ কোটি টাকা (৫৫ শতাংশ) একাই পেয়েছে বিজেপি। দেশের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় কংগ্রেস পেয়েছে মাত্র ১,১৩৫ কোটি টাকা (৯.৫ শতাংশ)। আঞ্চলিক দল তৃণমূল কংগ্রেস পেয়েছে ১,০৯৩ কোটি টাকা। এবার আসা যাক ২০২২-২৩ আর্থিক বর্ষের হিসাবে। এ-বছর বিজেপি পেয়েছে ২,১২০.০৬ কোটি টাকা যা এ-বছর বিজেপির মোট আয়ের ৫৪ শতাংশ। আর কংগ্রেস পেয়েছে মাত্র ১৭১ কোটি টাকা। আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যে প্রথম স্থানে আছে ভারত রাষ্ট্র সমিতি (পূর্ববর্তী নাম তেলেঙ্গানা রাষ্ট্রীয় সমিতি), আয় ৫২৯ কোটি টাকা। বিজু জনতা দল ১৫২ কোটি টাকা। ওয়াইএসআর কংগ্রেস ৫২ কোটি টাকা। একই সঙ্গে এটাও মনে রাখা দরকার যে বন্ড বিক্রির সময়টা নির্ধারণ করার ক্ষমতাও আছে শাসক দলের হাতে (এক্ষেত্রে বিজেপি)। সাধারণ নিয়মটি হল প্রতি বছর জানুয়ারি, এপ্রিল, জুলাই ও অক্টোবর মাসে প্রথম দশদিন এই বন্ড বিক্রি হবে। কিন্তু এই নিয়ম ইচ্ছেমতো বদল করা যেতে পারে। ২০১৮ সালে মে ও নভেম্বর মাসে দুটো গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনের আগে বিজেপি নির্বাচনী বন্ড বিক্রি চালু করে। এই টাকার প্রবাহ নির্বাচনী ব্যবস্থাটাকে কীভাবে কিছু গোষ্ঠীর কুক্ষিগত করে তুলছে তার প্রমাণ ক্রমবর্ধমান নির্বাচনী খরচ। ব্লুমবার্গের রিপোর্ট অনুসারে ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে ব্যয় হয়েছে ৮.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যা ২০১৪ সালের নির্বাচনী খরচের দ্বিগুণ।

 

একটি মামলার কথা

প্রথম থেকেই নির্বাচনী বন্ডের বিরুদ্ধে সংবিধান লঙ্ঘন করার এবং দুর্নীতিকে আইনসিদ্ধ করার অভিযোগ ওঠে। ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে এই নির্বাচনী বন্ডের বিরুদ্ধে দুটি মামলা দায়ের হয়। মামলা করে দুটো অসরকারি সংস্থা এডিআর এবং কমন কজ এবং রাজনৈতিক দল সিপিআই(এম)। এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার গতি ছিল অস্বাভাবিক রকমের মন্থর, বিশেষ করে পূর্বতন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ (ইনি পরবর্তী সময়ে বিজেপির সৌজন্যে সাংসদ হন)-এর সময়ে মামলার কোন অগ্রগতি হয়নি বললেই চলে। অবশেষে বর্তমান প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ চূড়ান্ত রায় দেন। এই রায়ের প্রধান অংশগুলো আরেকবার দেখে নেওয়া যেতে পারে:

  • নির্বাচনী বন্ড প্রকল্প তথ্য জানার অধিকার ও মত প্রকাশের অধিকার (সংবিধানের ১৯-১-ক) ধারাকে উলঙ্ঘন করেছে এবং এই প্রকল্প অসাংবিধানিক।
  • স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়াকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যাতে অবিলম্বে এই বন্ড বিক্রি বন্ধ করা হয়। নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যাতে ১৩ মার্চ (২০২৪)-এর মধ্যে বন্ড সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।
  • সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে এটাও বলা হয়েছে ৬ মার্চ (২০২৪)-এর মধ্যে সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলি কে কত টাকার চাঁদা পেয়েছে, কারা সেগুলো কিনেছে এবং কোন দলকে তা দেওয়া হয়েছে, সম্পূর্ণভাবে তা প্রকাশ করতে।
  • এখনও পর্যন্ত যে সমস্ত বন্ডগুলো রাজনৈতিক দলগুলো ভাঙায়নি তা ফেরত দিতে হবে এবং যারা এগুলো কিনেছিলেন তাদের ফিরিয়ে দিতে হবে।

এই রায়ের ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতির লিখিত পর্যবেক্ষণের একটি অংশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ:

This is violative of the principle of free and fair elections and political equality captured in a value of ‘one person, one vote’.

 

শেষের কথা

এই মামলায় রায়কে স্বাগত জানিয়েই একথাটা আরেকবার বলে নেওয়া প্রয়োজন যে বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতার কারণে ভয়ঙ্কর ক্ষতি ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে। প্রায় সাত হাজার কোটি টাকার অনুদান হাতে পেয়ে টাকার জোরে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বাকি প্রতিদ্বন্দ্বীদের থেকে বিজেপি কয়েকশো যোজন এগিয়ে গেছে। এটা এক পরিকল্পিত চক্রান্ত যা বিজেপির দেশকে হিন্দু রাষ্ট্র বানানোর নীল নকশার অংশ। এর আগে নোটবন্দির মতো সিদ্ধান্ত দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিয়েছিল। নির্বাচনী বন্ড আদতে ভারতের নির্বাচনী ব্যবস্থা ও কর্পোরেট স্বার্থকে এক সূত্রে গ্রথিত করার এক ঘৃণ্য প্রয়াস হিসাবে ইতিহাসে থেকে যাবে।

 

তথ্যসূত্র:


*মতামত ব্যক্তিগত

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4664 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

আপনার মতামত...