কুমার সাহনি: এক অনন্য চলচ্চিত্রনির্মাতা

মানস ঘোষ

 


ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে কুমার সাহনিকে একজন অনন্য চলচ্চিত্রনির্মাতা হিসাবে স্মরণ করা হয় যিনি বিংশ শতাব্দীর ভারতীয় আধুনিকতাকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করে গেছেন। তিনি ছিলেন একজন রাজনীতিসচেতন চলচ্চিত্রনির্মাতা যিনি ভারতীয় আধুনিকতার কিছু কম আলোকিত এলাকায় তাঁর চলচ্চিত্র ও লেখার মাধ্যমে আলো ফেলেছেন


সমসাময়িক ভারতের অন্যতম বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালক ছিলেন কুমার সাহনি যিনি সফলভাবে ‘এপিক সিনেমা’ অনুশীলন করেছিলেন। সাহনি ১৯৭০-এর দশকের শুরুতে তাঁর চলচ্চিত্রজীবন শুরু করেন। ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তাঁর নাম মণি কউল, আদুর গোপালকৃষ্ণান, জন আব্রাহাম, এমএস স্যাথু, সঈদ মির্জা এবং জি অরবিন্দনের সঙ্গে ভারতের নব্য চলচ্চিত্র আন্দোলনের একজন সফল চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে উচ্চারিত হয়। ভারতে নব্য চলচ্চিত্র আন্দোলন (নবতরঙ্গ) শুরু হয়েছিল ১৯৬৯ সালের শেষের দিকে, মৃণাল সেন এবং অরুণ কউল দ্বারা প্রকাশিত একটি ইশতেহারের মাধ্যমে। এই দুই প্রতিষ্ঠিত চলচ্চিত্র পরিচালকের সঙ্গে, একদল তরুণ ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে এবং ১৯৭০-এর দশকের শুরুতে নতুন সিনেমা আন্দোলনে যোগ দেন। তাদের একজন ছিলেন কুমার সাহনি। সাহনি ১৯৭২ সালে তাঁর প্রথম গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র ‘মায়া দর্পণ’ তৈরি করেন এবং তরুণ পরিচালকের এই ছবিটি ভারতের নবতরঙ্গের যুগান্তকারী চলচ্চিত্র হয়ে ওঠে।

কুমার সাহনি ৭ ডিসেম্বর, ১৯৪০ সালে সিন্ধু প্রদেশের লারকানায় জন্মগ্রহণ করেন, যা এখন পাকিস্তানের অংশ। দেশভাগের সময় তাঁর পরিবার লারকানা থেকে স্বাধীন ভারতে চলে আসে। সাহনি বোম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাস অধ্যয়ন করেন। তিনি পুনে এফটিআইআই-এ চিত্রনাট্য বিভাগে অধ্যয়ন করেছিলেন এবং সেখানে তিনি ঋত্বিক ঘটকের ছাত্র ছিলেন। পরে তিনি ফরাসি সরকারের একটি ফেলোশিপ পান এবং আইডিএইচইসি-তে চলচ্চিত্র অধ্যয়নের জন্য প্যারিসে যান। তিনি সেখানে বিখ্যাত ফরাসি চলচ্চিত্রকার রবার্ট ব্রেসঁ-র কাছে অধ্যয়ন করেন। ইতিহাসবিদ ডিডি কোসাম্বির লেখাও সাহনিকে অনুপ্রাণিত করেছিল। সাহনির অনেক সাক্ষাৎকারে ও লেখায় আমরা দেখতে পাই যে তিনি ঘটক, ব্রেসঁ এবং কোসাম্বিকে তাঁর গুরু হিসেবে স্বীকার করেছেন। তিনি ঘটক ও কোসাম্বি উভয়ের কাছ থেকেই সমসাময়িক ভারতীয় জীবনের ব্যাখ্যায় পুরাণ ও মহাকাব্যের গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলেন।

কুমার সাহনির ছবিতে ঘটক ও ব্রেসঁ-র প্রভাব ছিল অপরিসীম। কিন্তু তথাপি তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণে নিজের পথ তৈরি করতে পেরেছিলেন। বিশেষত, তাঁর ছবিগুলি একটি সূক্ষ্ম রাজনৈতিক পরিণতির দিকে চালিত হয়, যা সাহনির নিজের মতে, ভারতীয় চলচ্চিত্রের আঙ্গিক এবং বিষয়বস্তুর বি-উপনিবেশকরণের একটি সচেতন প্রক্রিয়া। সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, তিনি ঋত্বিক ঘটকের কাছ থেকে একটি শৈলী শিখেছিলেন, যা ‘মহাকাব্যিক শৈলী’ হিসাবে পরিচিত এবং ব্রেসঁ-র কাছ থেকে তিনি শিখেছিলেন কীভাবে আখ্যান ও বিষয়ীর সম্পর্ককে গভীরভবে পর্যবেক্ষণ করতে হয় নৈর্ব্যক্তিক বস্তুজগতের সাপেক্ষে। কুমার সাহনির প্রথম ছবি ‘মায়া দর্পণ’-এ এই বৈশিষ্ট্যগুলো প্রকাশ হয়। ‘মায়া দর্পণ’ তারন নামে একটি অল্পবয়সী মেয়ের গল্প বলে, যে একটি ছোট শহরের একটি উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্য। ছবিটি হিন্দি সাহিত্যের ‘নয়ি কাহানি’ আন্দোলনের অন্যতম বিখ্যাত লেখক নির্মল ভার্মার একটি ছোট গল্প অবলম্বনে নির্মিত। ভার্মার আখ্যানটি মূলত একটি আধা-সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় যুবতী তারণের একাকিত্বকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল।

কুমার সাহনির চলচ্চিত্র নির্মাণশৈলীতে, তাঁর সমসাময়িক মণি কউলের মতো, দেখা যায় যে তিনি একটি আখ্যানের গতিকে কিছুটা ধীর করে দেন। কুমার সাহনির চলচ্চিত্রে উন্মোচিত স্থান এবং সময় ধীরে বয়ে যায়, যেখানে কুমার সাহনি ধারাবাহিকতা সম্পাদনার পশ্চিমি শৈলীকে এড়িয়ে একটি বিকল্প আখ্যান-রীতি গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। কুমার সাহনি, প্রথম থেকেই, চলচ্চিত্র নির্মাণের ‘প্রচলিত’ শৈলী থেকে নিজেকে দূরে রাখার চেষ্টা করেছিলেন, এবং তিনি তাঁর চলচ্চিত্রে এক ধরনের ভারতীয় নান্দনিকতার সঙ্গে আমাদের পরিচয় করান। তাঁর চলচ্চিত্র কখনওই উপন্যাসের বর্ণনার সমতুল্য হওয়ার চেষ্টা করে না, বরং চলচ্চিত্র ছিল তাঁর কাছে মহাকাব্যিক শৈলীতে ভারতীয় সমাজকে প্রকাশ করার মাধ্যম।

‘খেয়াল গাথা’ নিয়ে আলোচনা করলে কুমার সাহনির চলচ্চিত্রনির্মাণের মহাকাব্যিক শৈলী সবচেয়ে ভালভাবে অন্বেষণ করা যেতে পারে। ‘খেয়াল গাথা’ ১৯৮৯ সালে তৈরি হয়েছিল। ছবিটি ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে খেয়ালের ইতিহাসকে টুকরো টুকরো আখ্যানের মাধ্যমে প্রকাশ করে। খেয়ালের উৎপত্তি ও বিবর্তন এবং ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের একটি রূপ হিসাবে খেয়ালের বিকাশ ও আধুনিকীকরণ এই ছবিতে কুমার সাহনি অন্বেষণ করেছেন। তাঁর শৈলী, দৃষ্টিভঙ্গি এবং চিন্তাভাবনা এই চলচ্চিত্রটি দিয়ে সবচেয়ে ভালভাবে বোঝা যায়। ‘খেয়াল গাথা’ প্লট-ভিত্তিক প্রচলিত-রীতির ছবি নয় বরং এমন একটি ছবি যা প্রতিপদে ভারতীয় আখ্যান রীতি, ভারতীয় দৃশ্য ও শব্দ ঐতিহ্যকে অন্বেষণ করে। নিসর্গ, মিথ, ধ্রুপদী নৃত্য ও নাট্যভঙ্গিমা, চলমান জীবজগতের সঙ্গে প্রাকৃতিক ও সাঙ্গীতিক শব্দ-সমূহের জটিল রসায়ন এই ছবির উপজীব্য। ভারতীয় নাট্যরূপ ও সঙ্গীতের ঐতিহ্য সম্পর্কে সাহনি বলেছেন, “আমাদের এপিক থিয়েটার শুধুমাত্র তার বর্ণনার অংশ হিসাবে সঙ্গীত ব্যবহার করেনি। বরং অঙ্গভঙ্গি এবং মুখাবয়ব ও মুখ-ভঙ্গিমার ব্যবহারে সঙ্গীতের সঙ্গে একটি আদানপ্রদান আমরা সেখানে স্পষ্টভাবে খুঁজে পাই।” তিনি সঙ্গীত ও শব্দের ক্যালাইডোস্কোপের মাধ্যমে চলচ্চিত্র নির্মাণের নিজস্ব মহাকাব্য-শৈলী এখানে সন্ধান করেন।

কুমার সাহনি বেশ কিছু স্বল্প-দৈর্ঘ্যের ছবি এবং তথ্যচিত্র তৈরি করেছেন, কিন্তু তাঁর পরিচালিত পূর্ণ-দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্রের সংখ্যা সীমিত। ‘মায়া দর্পণ’ (১৯৭২) ছাড়াও ১৯৮৪ সালে কুমার সাহনি ‘তরঙ্গ’ নামে আরেকটি ছবি নির্মাণ করেন; ১৯৮৯ সালে ‘খেয়াল গাথা’র জন্ম হয়; ১৯৯১ সালে সাহানি ‘কসবা’ নির্মাণ করেন যা ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অন্যতম সেরা সমান্তরাল ছবি; এবং ১৯৯৭ সালে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস ‘চার অধ্যায়’-এর একটি অত্যন্ত সুচিন্তিত রূপান্তর করেছিলেন।

‘তরঙ্গ’ আধুনিক ভারতের একটি ছোট শিল্পপতি পরিবারের গল্প। শেঠজি, তার ভাগ্নে এবং জামাইয়ের মধ্যে সম্পত্তির লোভ, আত্মীয়তার জটিলতা, তিক্ততা, ব্যক্তিগত অহং এবং আত্মকেন্দ্রিকতার এক অদ্ভুত মিথষ্ক্রিয়া ছবিটিতে রূপ পেয়েছে, যার শেষ হয় অপরাধবোধ, অবিশ্বাস এবং বিপর্যয়ের মধ্যে। সাহনি ‘তরঙ্গ’ ছবিতে প্রাথমিকভাবে একটি ভারতীয় বুর্জোয়া পরিবারের অভ্যন্তরের গল্প বলতে থাকেন কিন্তু ক্রমে সেই গল্প হয়ে ওঠে সেই বাড়ির গৃহ-সহায়ক জানকি-র গল্প। জানকি শেঠজির মেয়ে হন্সা ও জামাই রাহুলের বাড়িতে আসে শিশুর দেখাশোনার কাজ নিয়ে। সে এক মৃত শ্রমিক আন্দোলনের কর্মীর দরিদ্র স্ত্রী। শহরে কাজ নিয়ে চলে আসে নিজের  ছোট শহর ছেড়ে। হন্সা ক্রমে নিরাসক্ত হয়ে ওঠে রাহুলের জীবন ও সম্পত্তির টানাপোড়েনের জগৎ সম্পর্কে। কেবল তার বাবা, বৃদ্ধ শিল্পপতি শেঠজি তার ধ্যান-জ্ঞান। রাহুলের সঙ্গে জানকির একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। নির্বিকার ও নিরাসক্ত হন্সা আত্মহত্যা করে। বৃদ্ধ শেঠজি মারা যায়। অবশেষে জানকি ও রাহুলের সম্পর্ক শেষ হয় তিক্ততার মধ্যে দিয়ে। জানকি ফিরে যায় তার ছোট শহরে। ক্রমে ছবিটা হয়ে ওঠে জানকির আত্মানুসন্ধানের গল্প। জানকির ভাবনাগুলো সংলাপে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ‘অ্যাকশন’ ও ‘নাটকীয়তা’ ছাপিয়ে। ফ্রেমিং-এ পরিবর্তন দেখা যায়। ক্যামেরা অনেকটা কাছ থেকে অপরিসর বস্তির ঘরে জানকিকে গভীরভাবে লক্ষ করে চলে। সেই ছোট্ট ঘরের গেরস্থালি, বিশেষ করে দরজা আর জানালা, টাইট ফ্রেমে দৃশ্যগতভাবে অর্থবহ মনে হতে থাকে। তারপর জানকির সেই ছোট্ট ঘরের ভিতর কেউ একটা বিস্ফোরক ছুঁড়ে দেয়। লেলিহান লাল আগুন আর বিস্ফোরণকে পিছনে রেখে, আমরা দেখি, জানকি একটা ব্রিজের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে।

কুমার সাহনির ‘কসবা’ আরেকটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় ছবি যা তাঁর রাজনৈতিক আদর্শকে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত করে। একজন রাজনৈতিক চলচ্চিত্রনির্মাতা হিসেবে সাহনি উদার মার্কসবাদে বিশ্বাসী যার ভিত্তি অনেকটাই কোসাম্বির মার্কসবাদ দ্বারা প্রভাবিত। ‘কসবা’য়, কুমার সাহনি একটি পরিবার দেখান— মণিরাম নামে একজন ধনী ব্যবসায়ীর পরিবার— পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা হল, তার দুই ছেলে, তার স্ত্রী এবং তরুণী পুত্রবধূ তেজো। তেজোকে সর্বদা এমন একটি পরিবেশে রাখা হয় যেখানে স্থান, বিশেষ করে নিসর্গ, বাড়ি এবং তেজোর চারপাশ উদাসীন। এই উদাসীন নিসর্গ ছবির প্রথম থেকেই খুব আকর্ষণীয়ভাবে আমাদের চোখের সামনে প্রস্ফুটিত হয়। ফিল্মটি ধীরে ধীরে তেজোর মনের মধ্যে গড়ে ওঠা বিবিধ টানাপোড়েনকে উন্মোচন করে। মণিরামের হাভেলি আখ্যানের প্রধান কেন্দ্র, কিন্তু এর বাইরে, জীবনের অন্য স্রোত বয়ে চলেছে, তার কিছুটা দৃশ্যমান কিছুটা নয়।

সাহনি আসলে এই ছবিতে দুটি প্রান্তের মধ্যে একটি সমান্তরাল গড়ে তোলেন। এক প্রান্তে মণিরামের পরিবার ও হাভেলি, আর অন্য প্রান্তে রয়েছে আশপাশ ও গ্রামসমাজ। কুমার সাহনির চলচ্চিত্র আশেপাশের বস্তুর সঙ্গে তাদের সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়ীকে অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে গড়ে তোলে। বিষয়ী এবং বস্তুজগতের মধ্যে একটি মিথস্ক্রিয়া দেখা যায় তাঁর ছবিতে। মণি কউল এবং কুমার সাহনি দুজনেই চলচ্চিত্রে স্থানকে এমনভাবে উন্মোচন করেন যেন স্থান/নিসর্গ এবং বিষয়ী তাদের পরস্পরের সাপেক্ষে স্বাধীন এবং আখ্যান এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উভয়ের মধ্যে একটি জটিল সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়।

সাধারণত ভারতে রাজনৈতিক চলচ্চিত্রনির্মাতারা ধর্মঘট, শিল্পব্যবস্থা, কৃষকের শোষণ ইত্যাদির একটি কাঠামো অনুসরণ করেন, যা দিনের শেষে, সাহনির মতে, পশ্চিমি মার্কসবাদের অনুকরণে পরিণত হয়। কিন্তু কুমার সাহনির ছবিগুলিতে চলচ্চিত্র-নির্মাতা একটি পরিবারের উপর জোর দেন, ‘মায়া দর্পণ’, ‘তরঙ্গ’ ও ‘কসবা’র উদাহরণ দেওয়া যায়। ভারতে শেঠরা ও ছোট পুঁজিপতিরা পুঁজির অন্যতম প্রধান ও সাধারণ ধারক। সেই পুঁজি তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে সমাজিক পরিসরে বিস্তার লাভ করে। এরা পুঁজির ক্ষুদ্র ধারক, তবুও এরা ভারতীয় পুঁজিবাদী ব্যবস্থার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বিশেষ করে ভারতীয় সমাজে আধুনিক উৎপাদন পুঁজি ও সামন্ততান্ত্রিক গ্রামীণ পুঁজির মধ্যে যোগসূত্র এরাই তৈরি করে। ফলে এরকম কোনও গ্রামীণ বা মফস্বলি বণিক পরিবারের মধ্যের টানাপোড়েনকে কেন্দ্র করে সমাজকে লক্ষ করাটা কুমার সাহনির কাছে জরুরি মনে হয়েছিল। তিনি ভারতীয় সমাজে পরিবারের কাঠামো বিশ্লেষণ ও তার মধ্যেকার রসায়নের উপর বিশেষভাবে জোর দিয়েছিলেন। দৈনন্দিন দিনযাপনের পিতৃতান্ত্রিক পদ্ধতি, নৈতিকতার আধা-সামন্ততান্ত্রিক কাঠামো, অর্থ উপার্জনের মোহ, ক্ষমতা লিপ্সা এবং নারীদের বঞ্চনা এসব তাঁর ছবিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এসবই ‘কসবা’য় একটি জটিল উপায়ে আবর্তিত হতে থাকে। ‘কসবা’ একটি অত্যন্ত গভীরতা-সম্পন্ন ছবি যা সামাজিক-পারিবারিক পরিসরে পুঁজি এবং নৈতিকতার সম্পর্ককে প্রকাশ করে। পুঁজির ‘পলিটিক্যাল ইকনমি’ নয়, ভারতীয় চরিত্রের পুঁজিবাদী সমাজে ‘নৈতিকতার পলিটিক্যাল ইকনমি’ এবং পারিবারিক কাঠামো এই ছবিতে কুমার সাহনি বোঝার চেষ্টা করেছেন।

‘কসবা’ ছবিতে আমরা দেখি শেঠ মণিরাম তার মানসিকভাবে অপরিণত পুত্রের সঙ্গে বিয়ে দেয় শহরের দরিদ্র পরিবার থেকে নিয়ে আসা তেজোর। তেজো ক্রমে মণিরামের ব্যবসার প্রধান সহকারী হয়ে ওঠে। ব্যবসা ও পরিবারের দায়িত্ব সে-ই সামলাতে থাকে। কিন্তু তার কোনও স্বাভাবিক দাম্পত্যজীবন নেই, তার স্বামী অর্ধোন্মাদ, অপরিণত। মণিরামের স্বচ্ছল সংসারে সে যুগপত বঞ্চিত ও দায়িত্বশীল সদস্য। ক্রমে মণিরামের সঙ্গে কাজ করতে করতে তোজোকেও যেন অর্থের মোহে পেয়ে বসে। শোওয়ার ঘরে একা তেজোকে নিবিড়ভাবে লক্ষ করতে থাকে সাহনির ক্যামেরা। ক্রমে তেজোর মধ্যে ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা প্রবলতর হতে থাকে। সবকিছুকে সে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। মাঝেমধ্যেই আমরা দেখি সাহানি ছবিতে কিছু সাবলাইম মুহূর্ত তৈরি করতে থাকেন। তেজোর মানসিকভাবে অপরিণত স্বামীকে দেখা যায় পায়রার সঙ্গে, খরগোশের সঙ্গে শিশুর মতো ব্যবহার করতে। সে তেজোর কাছে নিজেকে একটা শিশুর মতো সমর্পণ করেছে। তেজো ক্রমে এই সমর্পণ ও নির্ভরতা উপভোগ করতে থাকে। কারণ তার একছত্র ক্ষমতার পথ তাতে বাধাহীন হচ্ছে। তেজোকে মণিরামের পরিবার ব্যবহার করে, উল্টোদিকে তেজোও তাদের ব্যবহার করতে থাকে। ছবিতে প্রত্যেকটা চরিত্র ক্ষমতা ও অর্থলালসার পথে নিজেদের মতো করে এগোতে থাকে। অবশেষে পরিণতিতে বিপর্যয় নেমে আসে মণিরামের পরিবারে।

কুমার সাহনির আরেকটি প্রধান কাজ হল ‘চার অধ্যায়’। তিনি রবীন্দ্রনাথের এই উপন্যাসে আগ্রহী হন কারণ উপন্যাসটি শুধুমাত্র কয়েকটি চরিত্রের আখ্যান নয়, উপন্যাসটি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের দিনগুলির একটি সমালোচনামূলক সন্দর্ভ। এই ছবিতে কুমার সাহনি তাঁর মহাকাব্যিক শৈলী অনুসরণ করে দুটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র, অন্তু এবং এলার পরিণতি লক্ষ করতে থাকেন। অন্তু এবং এলা ধীরে ধীরে দেশপ্রেমের নামে ‘নিঃশর্ত আনুগত্য’ এবং ‘গোঁড়া রেজিমেন্টেশন’-এর সমস্যা বুঝতে পারে। তারা গুপ্ত সংগঠন থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করে। গুপ্ত সংগঠন তাদের ‘রেনিগেড’ ঘোষণা করে এবং তাদের ধ্বংস করতে চায়। ক্ষমতার মোহ সে দলের নেতা ইন্দ্রনাথকে কীভাবে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ফেলে, আর সেই ক্ষমতার জটীল আবর্ত কিভাবে অন্তু আর এলাকে টেনে নিয়ে যায় ধংসের দিকে তা সাহনির উপজীব্য এই ছবিতে।

‘চার অধ্যায়’ চলচ্চিত্রটির অনেকটাই মূলত অন্তু এবং এলার মধ্যেকার কথোপকথনের উপর ভিত্তি করে তৈরি, যেখানে কুমার সাহনি রবীন্দ্রনাথের লাইনগুলি যত্নসহকারে অনুসরণ করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তাঁর ক্যামেরা যেভাবে স্থান নির্মাণ করে তা খুবই আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে এবং এটি আখ্যানে নাটকীয়তার প্রাধান্যকে কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে। কুমার সাহনি বস্তুনিষ্ঠ জগৎ এবং চরিত্রের মধ্যে একটি সম্পর্ক স্থাপন করেন যাতে আখ্যানের বাইরের খোলস ভেদ করা যায় এবং শেষ পর্যন্ত সন্দর্ভের মধ্যে প্রবেশ করা যায়।

সাহনির চলচ্চিত্রের আরেকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক হল তাঁর সাউন্ড ডিজাইন করার পদ্ধতি। কুমার সাহনি কখনওই কেবল আখ্যানের দাবি মেনে শব্দের নকশা করেন না। তাঁর ছবিতে, শব্দ দৃশ্যের সঙ্গে সমান্তরালভাবে বিকশিত হয়। কখনও কখনও নীরবতা তার শব্দ-পরিকল্পনায় একটি ভূমিকা পালন করে। সাহনি বরাবর ভারতীয় সংস্কৃতিতে শব্দের ভূমিকার কথা মনে রেখেছেন। তিনি এই সত্যটির উপর জোর দেন যে ‘দেখা মানে বিশ্বাস করা’ ভারতীয় জীবনের কেন্দ্রীয় যুক্তি নয়। ভারতীয় চলচ্চিত্রের বি-উপনিবেশিকরণের প্রক্রিয়া হিসাবে, সাহনি প্রায়শই দর্শকের বোধকে ভিজ্যুয়াল থেকে শ্রবণ-উপলব্ধিতে স্থানান্তরিত করেন, যা দর্শককে যুক্তির একটি নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করতে সাহায্য করে। ‘চার অধ্যায়’, ‘খেয়াল গাথা’, ‘মায়া দর্পণ’, ‘কসবা’ এবং ‘তরঙ্গ’ ছবিতে শব্দের ভূমিকা সম্পর্কে সাহনির অনন্য উপলব্ধি দেখা যায়।

সাহনির সাউন্ডট্র্যাকগুলিতে সঙ্গীত একটি কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে। তিনি বলেন, “সঙ্গীত সম্ভবত মানুষের মেধার সবচেয়ে উন্নত সংবেদনশীল কাজ। কেউ কেবল শব্দের নান্দনিকতার কথা বলতে শুরু করতে পারে সঙ্গীতের মাধ্যমে, কারণ সঙ্গীত হল মানুষের অস্ত্বিত্বের মূলগত অভিব্যক্তি।” কুমার সাহনি ভারতের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ঐতিহ্যকে লোকসঙ্গীতের ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছেন এমন বেশ কয়েকটি উদাহরণ রয়েছে। বিশেষ করে, আমরা আবার ‘কসবা’র প্রসঙ্গে ফিরে যেতে পারি, যেখানে ছবির শেষদিকে কুমার সাহনির ক্যামেরা একটি ল্যান্ডস্কেপ দেখায়; এবং তারপর একটি (লোক)গান আসে। সঙ্গীত এখানে মুভমেন্টের অনুভূতি তৈরি করে, যেখানে ক্যামেরা একটি নিশ্চল নিসর্গ দেখায়। সাউন্ড ডিজাইনিং সাহনির চলচ্চিত্র নির্মাণশৈলীর একটি লক্ষণীয় অংশ হয়ে ওঠে।

ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে কুমার সাহনিকে একজন অনন্য চলচ্চিত্রনির্মাতা হিসাবে স্মরণ করা হয় যিনি বিংশ শতাব্দীর ভারতীয় আধুনিকতাকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করে গেছেন। তিনি ছিলেন একজন রাজনীতিসচেতন চলচ্চিত্রনির্মাতা যিনি ভারতীয় আধুনিকতার কিছু কম আলোকিত এলাকায় তাঁর চলচ্চিত্র ও লেখার মাধ্যমে আলো ফেলেছেন।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4664 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...