গুরুস্থানীয় এক চলচ্চিত্রকার চিরবিদায় নিলেন

উদয়ন বাজপেয়ি

 


এমন একটা সমাজে আমরা দ্রুত পর্যবসিত হচ্ছি, যা সৃজনশীল প্রতিভাদের প্রতি যত কম শ্রদ্ধাশীল, ততটাই কম সম্ভ্রমশীল গুরুস্থানীয়দের প্রতি। আমরা ওঁদের দমবন্ধ করে দিই, ওঁদের টিটকিরি করি, ওঁদের শিল্পকর্ম জারি রাখাটাই আমরা অসম্ভব বানিয়ে দিই। দুর্ভাগ্যবশত, কুমার ঠিক এই অবিচারের সম্মুখীন হয়েছেন সারা জীবন, এবং তবুও আমাদের যা দিয়ে গেছেন তা বিশ্বসিনেমায় সম্ভাব্য উৎকৃষ্টতম

 

চলচ্চিত্র-সম্বন্ধীয় ভাবনায় নিজের সময়ের চেয়ে অনেকটা এগিয়ে ছিলেন কুমার সাহনি। একই সঙ্গে প্রযুক্তিগত দিক থেকেও বোধ অর্জন করেছিলেন যা ওনার ভাবনাগুলিকে বাস্তবায়িত করতে সহায়ক হবে। অথচ, উনি যে চলচ্চিত্রগুলি বানিয়েছেন, তা আধুনিক যুগে ঐতিহ্য ও পরম্পরার উৎকৃষ্টতম প্রতীতি।

ভারতীয় সিনেমার এক দিকপাল গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন কলকাতায়— যে-শহর শুধু ওঁকে ভালইবাসত না, ভালবাসত ওঁকে এবং ওঁর সিনেমাগুলি নিয়ে প্রশ্ন করতে। বিশেষ করে, ১৯৯৭ সালে নির্মিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘চার অধ্যায়’ (১৯২৯) উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়ন নিয়ে, যা রাষ্ট্রবাদ, হিংসা, স্বধর্ম (ব্যক্তির নিজস্ব নৈতিক মূল্যবোধ এবং বৃত্তি) এবং স্বভাব (ব্যক্তির অন্তঃচরিত্র) বিষয়ে গভীর বিশ্লেষণের অঙ্গ হিসেবে প্রশ্ন করে।

বিশ্ব-সিনেমায় ওঁর সমসাময়িক চলচ্চিত্রকারদের মধ্যে সম্ভবত একলা ওঁর সিনেমাতেই প্রতিটি শট ও শব্দ আর সঙ্গীতের অংশগুলিতে এমন এক একাত্মতা খুঁজে পাওয়া যায় যা শুধু ওঁর আত্মনিষ্ঠাকেই প্রতিফলিত করে না, আমাদের দর্শকদের অন্তঃস্থ স্বর্গীয় ভাবের কম্পনকেও জাগিয়ে তুলতে সক্ষম।

আমি বলবার চেষ্টা করছি যে, ওঁর ছবিতে দেখানো একটি নুড়িপাথরও যে আত্মনিষ্ঠার নিদর্শন পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছে, তাকে কোনও ধরনের সাধারণত্বের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। গুরুস্থানীয় এই চলচ্চিত্রকার এইভাবেই আমাদের মনের গহনে একাত্মতার অনুভব জাগিয়ে তুলে পারতেন যা সময়ের সঙ্গে হ্রাস ঘটবে না। এইভাবেই উনি আমাদের স্বতন্ত্রতা এবং নিস্তরণের মুক্তিদ্বার খুলে দিয়েছেন। শুধু আমাদের স্বতন্ত্রতারই নয়, আমাদের একাত্ম হয়ে ওঠবার সম্ভাবনারও।

পুনের ফিল্ম ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়া (অধুনা ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়া)-য় ১৯৬০-এর মধ্যভাগে অধ্যয়ন করেছিলেন কুমার সাহনি। ওঁর সঙ্গে অধ্যয়ন করতেন মণি কাউল। দুই সতীর্থ নিজেদের উৎকৃষ্ট শিল্পকর্ম উপহার দিয়েছেন দর্শকদের। দুজনেই ছিলেন ইন্সটিটিউটের সহ-অধ্যক্ষ ঋত্বিক ঘটকের ছাত্র— যিনি চলচ্চিত্রকারদের চলচ্চিত্রকার হিসেবে সুপরিচিত।

কুমার সাহনি ও মণি কাউল

ইন্সটিটিউটে অধ্যয়নের সময়ে কুমার সাহনির সঙ্গে পরিচয় হয় আরেক দিকপালের। ইনি হলেন ডিডি কোসাম্বি, যিনি একাধারে গণিতজ্ঞ, ইতিহাসবিদ এবং বহুবিদ্যাজ্ঞ— জেনেটিক্স বিষয় একটি অগ্রণী গবেষণাপত্রের রচয়িতা।

ডিডি কোসাম্বি

ডিপ্লোমা অর্জনের পড়ে কুমার সাহনি চলচ্চিত্র-বিষয়ে নিজের বোধকে আরও সমৃদ্ধ এবং শানিত করবার লক্ষ্য নিয়ে চলে যান প্যারিসে। এখানে ওঁর সঙ্গে পরিচয় হয় অনন্য এক চলচ্চিত্রকারের, যাঁর সঙ্গে উনি পরবর্তীকালে কাজও করেন। এই চলচ্চিত্রকার হলেন রবার্ট ব্রেঁস।

তখন ১৯৬৮। প্যারিসে ছাত্রবিপ্লব চলছে। সেই বছরে লেখক ও দার্শনিক জঁ পল সার্ত্রে জনসমক্ষে এক তরুণ ছাত্রনেতার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। সেই বছরেই— কুমার আমাকে যেমনটা বলেছিলেন— প্রত্যেক চিন্তাবিদ, লেখক ও শিল্পী অন্য সব ধরনের চিন্তাজীবীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় রত হয়েছিলেন।

আমার বিশ্বাস, ১৯৬৮-এ প্যারিসের বাতাবরণ কুমার সাহনির ভাবনাচিন্তা এবং জীবনচর্যায় গভীরভাবে রেখাপাত করে। দিকপাল শিক্ষকদের পেয়েছেন উনি, ভাবনার আদানপ্রদানও করেছেন, প্রেরণাও পেয়েছেন তাঁদের থেকে। তবে ওঁদের অনুকরণ করেননি। স্বল্প-জানা সমালোচকরা বারবার বলেন বটে, তবে দেখা যাবে উনি যেভাবে নিজের ছবিগুলি বানিয়েছিলেন, তা ঋত্বিক ঘটক বা রবার্ট ব্রেঁস-র পথের অনুসারী নয়।

কুমার সাহনির সিনেমা প্রতিটি পরম্পরা নিয়ে কিছু না কিছু বলতে চেয়েছে— সে বৌদ্ধ পরম্পরাই হোক, অদ্বৈত বেদান্তের হোক বা মার্কসীয় চিন্তনের পরম্পরা— এবং এই নিযুক্তির থেকে কিছু না কিছু অভিনবত্ব সৃষ্টি করেছে।

ব্রেঁস-র সিনেমা কৃচ্ছতার সিনেমা। আমাদের মতন যারা বিশ্বাস করে না যে আমরাও নতুন এবং অর্থপূর্ণ কিছু বানাতে পারি, তারাও কুমার সাহনির সিনেমার সঙ্গে রবার্ট ব্রেঁসর সিনেমার তুলনা করে। অথচ এরা ভুলে যায় যে কুমার সাহনির সিনেমা কৃচ্ছতার নয়, অলঙ্কারময়তার সিনেমা।

যদি কেউ তাতে কৃচ্ছতার চিহ্ন খুঁজে পান, তা এইজন্যে যে, ওঁর নির্মাণের পথটি কৃচ্ছতার। কৃচ্ছতার এই পথ ধরে এগিয়ে কুমার সাহনির সিনেমা বিষয়গত দিক থেকে বা বস্তুগত দিক থেকে অলঙ্করণের পথটি আবিষ্কার করে।

অস্তিত্বময়তার অলঙ্করণের এক পথের সন্ধানী কুমার সাহনির সিনেমা। সেই অর্থে, কৃচ্ছতা এবং অলঙ্কারময়তার গতিময় এক দ্বান্দ্বিকতাই হয়ে ওঠে ওঁর সিনেমা।

ওঁর একটি সিনেমার সঙ্গে আরেকটি সিনেমার কোনও মিল নেই। তরঙ্গ (১৯৮৪) একেবারেই কসবা (১৯৯১)-র থেকে আলাদা। আবার এই দুটি ছবির থেকে খেয়াল গাথা (১৯৮৯) সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। এই তিনটি ছবির সঙ্গে ভাবনাতারানা (১৯৯১), চার অধ্যায় (১৯৯৭) অথবা ব্যাম্বু ফ্লুট (২০০০) ছবিগুলির বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই।

অথচ এক ধরনের নিরবচ্ছিন্নতা নিশ্চিতভাবে বয়ে যাচ্ছে এই সিনেমাগুলি থেকে।

আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর পৃথিবীতে মানুষের মনে পারম্পরিক শিল্পকলাগুলি কোন ধরনের সম্ভাবনার জন্ম দেয়, উনি এইভাবেই তার অন্বেষণের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন। মনুষ্যজাতি, পারম্পরিক শিল্পকলা এবং চিন্তার ধরনে আধুনিকতা যে স্থানচ্যুতি ঘটিয়েছে, ওঁর সিনেমায় সেই সচেতনতার ছাপ রয়েছে।

কুমার সাহনির সিন্ধ প্রদেশের লারকানায়, এখন যা পাকিস্তানে অবস্থিত। দেশভাগের পরে উনি ভারতে উৎপাটিত হন, আর ওঁর শৈশব কাটে বোম্বেতে। প্রায় ১০ বছর বয়স অবধি উনি স্কুলে ভর্তি হননি।

উনি আমাকে প্রায়ই বলতেন, ভাগ্যের ফের এমনই যে ওঁর পরিবারকে উৎপাটিত হতে হল মুসলমান নয় এই কারণে, অথচ বোম্বেতে আসবার পর ওঁদের সঙ্গে এমন ব্যবহার করা হল যেন ওঁরা পাকিস্তানি।

ওঁর প্রতিবেশীরা যে-ভাষায় কথা বলতেন, তা ওঁদের ভাষা নয়। ছোটবেলায় চারপাশের পরিবেশটিও অদ্ভুত মনে হয়েছিল। ভাষাগত এবং সংস্কৃতিগত এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ার ফলে সব ভাষাকে নিজের ভাষা বলে মেনে নিতে শুরু করেছিলেন (একেবারেই এই কারণে শেষ দিনগুলিতে কলকাতায় এসে উনি বাংলা ভাষা শিখছিলেন); গাছপালা, জন্তুজানোয়ার এবং পাখিদেরকে নিজের পরিবার হিসেবে ধরে নিয়েছিলেন।

ভাষাগুলির সম্পূর্ণতা এবং বিশ্বকে একান্ত আপন মেনে নেওয়ার সাক্ষ্য ওঁর সব ছবিতেই রয়েছে।

সিনেমা তৈরির জন্যে প্রয়োজনীয় টাকা জোগাড় করাটা কখনওই কুমারের পক্ষে সহজ হয়নি।

এমন একটা সমাজে আমরা দ্রুত পর্যবসিত হচ্ছি, যা সৃজনশীল প্রতিভাদের প্রতি যত কম শ্রদ্ধাশীল, ততটাই কম সম্ভ্রমশীল গুরুস্থানীয়দের প্রতি। আমরা ওঁদের দমবন্ধ করে দিই, ওঁদের টিটকিরি করি, ওঁদের শিল্পকর্ম জারি রাখাটাই আমরা অসম্ভব বানিয়ে দিই।

দার্শনিক নভজোত সিং প্রায়ই বলতেন সেই সমাজে এর চেয়ে বড় অবিচার আর হতে পারে না যে সমাজ মহৎ শিল্পীদের স্বীকৃতি দেয় না, পরিপোষণ করে না। দুর্ভাগ্যবশত, কুমার ঠিক এই অবিচারের সম্মুখীন হয়েছেন সারা জীবন, এবং তবুও আমাদের যা দিয়ে গেছেন তা বিশ্বসিনেমায় সম্ভাব্য উৎকৃষ্টতম।

বিদায় কুমার।

আমাদের দুজনের দীর্ঘ আলাপচারিতাগুলিতে যে আলোচনা জারি ছিল, তার অভাব বোধ করব— যেমনটি আপনি করেছেন আপনার সিনেমায়— যার মাধ্যমে আপনি বিভিন্ন ধরনের ভাবনা ও আবেগের বিস্তার ঘটিয়েছেন।

তবে আপনাকে আপনার ফিল্মগুলিতে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা থামাব না। আমি জানি আপনি আপনার সৃষ্ট ক্লাসিক ছবিগুলিতে চিরদিন রয়ে যাবেন।


*বিশিষ্ট হিন্দি কবি, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক এবং চিত্রনাট্যকার উদয়ন বাজপেয়ির এই নিবন্ধটি গত ১ মার্চ ইংরেজিতে ন্যাশনাল হেরাল্ড পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। বাংলা অনুবাদ করেছেন সত্যব্রত ঘোষ

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4664 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...