সবুজ সন্ত্রাস

উন্মেষ মিত্র

 


আমাদের পৃথিবীর অসুখ হয়েছে। খুব জ্বর। শরীরের তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে। পৃথিবীর সেবা প্রয়োজন, পথ্য প্রয়োজন। অসুখ জটিল, তাই চিকিৎসাপদ্ধতিও সরল হওয়ার কথা নয়। জটিল অসুখের চিকিৎসায় অনেকগুলি পথ্যের মধ্যে একটি ‘বৃক্ষরোপণ’ হলেও, সেটিই একমাত্র পথ্য নয়। আবার এ-কথাও সত্য যে, একই পথ্যের মাত্রাধিক ব্যবহারে সেটি তখন আর পথ্য থাকে না, বিষে রূপান্তরিত হয়

 

বিশ্ব উষ্ণায়নের সমাধান কী?
—গাছ লাগান, প্রাণ বাঁচান।

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে কী করা উচিত?
—গাছ লাগান, প্রাণ বাঁচান।

পরিবেশ নিয়ে সেমিনার হবে, স্লোগান খুঁজে পাচ্ছি না। কী লিখব?
—গাছ লাগান, প্রাণ বাঁচান।

সব রোগের ওষুধ এক হয় না। আমাদের পৃথিবীর অসুখ হয়েছে। খুব জ্বর। শরীরের তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে। পৃথিবীর সেবা প্রয়োজন, পথ্য প্রয়োজন। অসুখ জটিল, তাই চিকিৎসাপদ্ধতিও সরল হওয়ার কথা নয়। জটিল অসুখের চিকিৎসায় অনেকগুলি পথ্যের মধ্যে একটি ‘বৃক্ষরোপণ’ হলেও, সেটিই একমাত্র পথ্য নয়। আবার একথাও সত্য যে, একই পথ্যের মাত্রাধিক ব্যবহারে সেটি তখন আর পথ্য থাকে না, বিষে রূপান্তরিত হয়।

ঘটনার পটভূমি পশ্চিম রাজস্থান। সাধারণ মানুষের কাছে যার পরিচয় মরুভূমি হিসেবে। রাজস্থান বললেই আমরা কল্পনা করি দিগন্তবিস্তৃত বালুকারাশি। চলেছে মরুজাহাজের ক্যারাভান। মাথায় একটির পর একটি মাটির পাত্র সাজিয়ে, তাতে জল ভরে ঘরে ফিরছেন রমণীরা। বাস্তব পরিস্থিতি অবশ্য খানিক আলাদা। পশ্চিম রাজস্থানে এরকম দিগন্তবিস্তৃত বালুপাহাড় বা ‘মরুস্থলী’ থাকলেও, সেটি অতি সামান্য এলাকা জুড়ে অবস্থিত। বাকি অংশে রয়েছে নানান প্রজাতির ঘাস-সমৃদ্ধ মনোমুগ্ধকর ঘাসভূমি (grassland)। অবশ্য স্বাধীনতার এত বছর পেরিয়েও সরকারি নথিতে এর নাম এখনও বন্ধ্যাভূমি (wasteland)। সরকারি যুক্তি বলে, জমিতে গাছ নেই মানে সেই জমি বন্ধ্যা, সেখানে জীবনের অস্তিত্ব নেই। অথচ বৈজ্ঞানিক তথ্য বলে এই ঘাসজমি ভারতের বিলুপ্তপ্রায় পাখি গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ডের বিচরণক্ষেত্র। ‘চিঙ্কারা’ হরিণদের বসতভূমি এই ঘাসজমি। এখানে থাকে কাঁটাচয়া (Hedgehog), মরু-শিয়াল, বিভিন্ন দুর্লভ প্রজাতির সরীসৃপরা। বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত এখানে দাপিয়ে বেরিয়েছে চিতা। কিন্তু তাও সরকারি যুক্তিতে এই জমি হল বন্ধ্যা জমি। অতএব লাগাও গাছ। তার জন্য আফ্রিকা থেকে বাবুল প্রজাতির গাছ নিয়ে এসে ‘সবুজায়ন’ করা হল বন্ধ্যা জমির। ওপরে যে সকল প্রাণীদের নাম লিখেছি তারা পড়ল মহা বিপদে। এত বছরের বিবর্তনের প্রাকৃতিক নিয়ম মেনে তারা ঘাসজমিতে চলাফেরা করতে, খাদ্যসংগ্রহ করতে অভ্যস্ত। উদাহরণ স্রূপ, গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ড, এরা পাখি হলেও, উচ্চতা প্রায় চার ফুট, ওজন প্রায় ১২-১৪ কিলোগ্রাম। এরা গাছে বসতে পারে না, কারণ বিবর্তনের নিয়মে এদের পায়ের পিছনের আঙুলটি নেই, আমাদের আশেপাশের পাখিদের পায়ে চারটি আঙুল থাকলেও, এদের থাকে তিনটি। তাই দিনের বেশিরভাগ সময় এরা পায়ে হেঁটে খাবার সংগ্রহ বা অনান্য নিত্য-নৈমিত্তিক কাজ করে। আজন্ম পরিচিত ঘাসজমি কয়েকবছরে বিদেশি বাবুলের বলে পরিণত হওয়ায় এরা এলাকাছাড়া হতে বাধ্য হয়েছে। ‘চিঙ্কারা’ হরিণ রা অবশ্য ডানা না-থাকায় এলাকা ছাড়তে পারেনি। তবে খোলা ঘাসজমিতে বিবর্তনের আশীর্বাদ হিসেবে প্রাপ্ত দুরন্ত গতিতে তারা যেরকম শিকারিদের থেকে পালিয়ে যেতে পারত, এই কৃত্রিম বনভূমি তাঁদের সেই স্বাভাবিক গতিকে রুদ্ধ করে শিকারিদের সহজ খাদ্যে পরিণত করছে। ব্যাহত হচ্ছে শিকার-শিকারির স্বাভাবিক সাম্যাবস্থা। বিঘ্নিত হচ্ছে বাস্তুতন্ত্র।

রাজস্থানের ঘাসজমিতে গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ড

‘বহিরাগত’ বর্তমান বিশ্ব-রাজনীতির বহুল ব্যবহৃত শব্দ। সবাই সবাইকে বহিরাগত হিসেবে দেগে দেওয়ার পর দেখা যাচ্ছে আমরা সবাই বহিরাগত। পার্থক্য শুধু সময়ের কাঁটার। তবে এখন যে বহিরাগতর কথা বলব তারা মানুষ নয়, গাছ। এদেরকে ইংরেজিতে বলে ‘Invasive’ প্রজাতি। এরকমই দুটি প্রজাতির বৈজ্ঞানিক নাম হল Lantana camara এবং Prosopis juliflora, প্রথম প্রজাতির বাসভূমি মধ্য এবং দক্ষিণ আমেরিকা, দ্বিতীয় প্রজাতিটির মাতৃভূমি দক্ষিণ আমেরিকা। ল্যান্টানাকে আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর আগে ব্রিটিশেরা ভারতে আমদানি করে বাগানের ফুলের গাছ হিসেবে। তারপর একসময় এর বীজ বাগানের বাইরে প্রাকৃতিক বনভূমিতে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। বর্তমানে ভারতের বাঘের জন্য সংরক্ষিত বনভূমির ৪০ শতাংশে বিরাজ করছে এরা। এর কারণ কী? বিজ্ঞানের ভাষায় এর উত্তর ‘alleopathy’। অর্থাৎ, ল্যান্টানা যে অঞ্চলে জন্মাবে সেই অঞ্চলের মাটিতে তারা কিছু এমন বিষ রাসায়নিক মিশিয়ে দেবে যাতে দেশি গাছেরা সেখানে জন্মাতে না পারে। এই প্রাণঘাতী ক্ষমতাও বিবর্তনের ফসল। এরকমই আরেকটি প্রজাতির গাছ প্রোসোপিস, স্থানীয় ভাষায়, ‘বিদেশি বাবুল’। এদের আমদানি করা হয়েছিল ভারতের রুক্ষ, শুষ্ক গ্রামীণ অঞ্চলে জ্বালানি কাঠের সরবরাহ বজায় রাখার জন্য। ভয়ানক কাঁটাযুক্ত এই গাছ অতি কষ্টসহিষ্ণু, সামান্য জলের উপস্থিতিতে এরা অতি দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। মানুষের সুবিধের জন্য নিয়ে আসা এই গাছ এখন অনিয়ন্ত্রিতভাবে ছড়িয়ে পড়ছে ভারতের নানা অংশে। ১৯৭০-এর দশকে বনদপ্তরের উদ্যোগে ইজরায়েল থেকে আমদানি করা বিদেশি বাবুলের বীজ  হেলিকপ্টার থেকে এই ছড়ানো হয়েছিল আরাবল্লি-সংলগ্ন অঞ্চলে। বর্তমানে আরাবল্লি পর্বতের বেশিরভাগ অংশে স্থানীয় নানা প্রজাতির গাছেদের ‘খতম’ করে এখন একাই রাজ করছে এই বিদেশি বাবুল। ঐতিহাসিকভাবে অবশ্য এই গাছকে ভারতে আনার কৃতিত্ব ব্রিটিশদেরই দিতে হয়। ১৯১১ সাল নাগাদ ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরিত করার সময় ব্রিটিশদের মনে হয়েছিল ধূসর দিল্লি শহরকে সবুজ করার জন্য প্রয়োজন গাছ। সেই সবুজায়নের পরিকল্পনার অংশ হিসাবেই ভারতে প্রথম পা রেখেছিল ‘বিদেশি বাবুল’।

আরাবল্লির বিদেশি বাবুল

বনভূমি দখলের সঙ্গে সঙ্গে রয়েছে অনান্য বিপদ। দিল্লির নিকটস্থ গাইরাটপুর বাস গ্রামে বিগত ২০-৩০ বছর ধরে সাম্রাজ্য বিস্তার করেছে বিদেশি বাবুল। গ্রামবাসীদের কথা অনুসারে ২০ বছর আগে এই গ্রামের ভূগর্ভস্থ জলস্তর ছিল ৫০ ফুট নিচে, তবে বিদেশি বাবুলের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই জলস্তর নেমে গিয়েছে ২৮০ ফুট গভীরতায়। একই সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন চম্বল অঞ্চলের মানুষেরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই গাছের শিকড় মাটির গভীরে ২০ থেকে ২৫ মিটার পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারে। শুষে নেয় সেই অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ জল।

শুধু স্থানীয় গাছেরাই নয়, বাস্তুতন্ত্রের স্বাভাবিক নিয়মে হারিয়ে যাচ্ছে পশু-পাখিরা। একেই বোধ হয় বন্ধ্যাভূমি বলা সমীচিন হবে। Centre for Environmental Management of Degraded Ecosystem-এর তথ্য অনুসারে যে অঞ্চলে আগে প্রায় ৪৮০ প্রজাতির পাখি দেখা যেত, বিদেশি বাবুলের বিস্তৃতির পর সেই অঞ্চলে পাখির প্রজাতির সংখ্যা কমে এসেছে ৩৫টিতে। অবস্থা এতটাই হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে যে সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে এই বিদেশি গাছ উচ্ছেদের জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করে প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে। ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে স্থানীয়ভাবে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া ঘাস এবং বৃক্ষের স্থানীয় প্রজাতিদের।

সমস্যা শুধু এটুকুতেই সীমাবদ্ধ নয়। দেশীয় বৃক্ষের বদলে বিদেশি গাছের প্রভাব বিস্তারের ফলে ভারতের বনভূমি খাদ্যহীন হয়ে পড়েছে। বিদেশি বাবুল, ল্যান্টানা, মিমোসার মতো বহিরাগত গাছগুলি ভারতের বন্য জীবেদের জন্য কোনও খাদ্যের ব্যবস্থা করে না। বনভূমির প্রাকৃতিক খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে যাওয়ার ফলে বন্য পশুরা পেটের টানে হানা দিচ্ছে নিকটবর্তী জনবসতি অঞ্চলে, চাষের জমিতে। বন্যপ্রাণী-মানুষের সংঘাতের ঘটনা ক্রমশই বেড়ে চলেছে কর্নাটক, তামিলনাড়ু, কেরলের মতো দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে। একই সমস্যায় জর্জরিত অসম-সহ বাকি উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলি। এখানে অবশ্য খলনায়ক বিদেশি গাছের নাম মিমোসা, সিয়াম ইত্যাদি।

কাজিরাঙ্গায় মিমোসা-র আগ্রাসন নিয়ে ওয়াইল্ডলাইফ ট্রাস্ট-এর রিপোর্ট

ইদানীং একটা খুব প্রচলিত শব্দবন্ধনী ‘গ্রিন ওয়াশিং’। বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থা নিজদের পরিবেশবান্ধব প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে অসৎ প্রচারে নেমেছে। যুক্তি-কুযুক্তি, সত্য-অর্ধসত্যের আড়ালে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে তাদের পণ্য কতটা পরিবেশবান্ধব। একশো টাকার ক্ষতি করে এক টাকা পরিবেশবান্ধব প্রকল্পে দান করে তারা নিজেদের সবুজ মোড়কে ঢেকে রাখছে। তেমনই ‘গাছ লাগান, প্রাণ বাঁচান’ মন্ত্রের আড়ালে না বলা হয়ে থেকে যাচ্ছে অনেক কথা। বাস্তব সমস্যার কথা। ২০১৮ সালে Wildlife Institute of India দ্বারা প্রকাশিত তথ্য অনুসারে ভারতের বনভূমি থেকে এই বহিরাগত গাছেদের সম্পূর্ণভাবে উৎখাত করতে প্রয়োজন প্রায় ১৩.৫ বিলিয়ন আমেরিকান ডলারের, ভারতীয় মুদ্রায় অঙ্কটা প্রায় এক লক্ষ কোটি টাকার কাছাকাছি।

নেতিবাচক অনেক কথার পর শেষ করা যাক ইতিবাচক কথা বলে। বিদেশি গাছেদের এই ভয়াবহ সন্ত্রাসের মধ্যে বনভূমিকে বাঁচানোর জন্য প্রথম উদ্যোগী হয়েছে তামিলনাড়ু রাজ্য সরকার। ২০২২ সালের জুন মাসে সরকারি উদ্যোগে প্রকাশিত হয়েছে Tamil Nadu Policy on Invasive Plants and Ecological Restoration, শুরু হয়েছে গবেষণা। জানা গেছে তামিলনাড়ুতে বর্তমানে ১৯৬ প্রজাতির বিদেশি সন্ত্রাসী গাছ উপস্থিত রয়েছে, এদের মধ্যে ২৩টি প্রজাতি অতি মারাত্মক। সরকারি উদ্যোগে প্রায় ৩৭০ হেক্টর বনভূমিকে বিদেশি গাছ-মুক্ত করা হয়েছে। তার পরিবর্তে সেখানে রোপণ করা হয়েছে দেশীয় গাছ এবং ঘাস। যা ওই অঞ্চলের বন্যজীবের বেঁচে থাকার জন্য একান্ত প্রয়োজন। ভারতের প্রাচীনতম প্রকৃতি বিষয়ক সংস্থা বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটির উদ্যোগে রাজস্থানের জয়সলমির এবং যোধপুর জেলায় চলছে এই সন্ত্রাসী গাছেদের নির্মূলন প্রক্রিয়া। দিল্লি সরকার এক কোটি টাকার প্রকল্প ঘোষণা করেছে সন্ত্রাসী গাছেদের সরিয়ে নষ্ট করে দেওয়ার জন্য। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কাজ চলছে নানান ব্যক্তিগত উদ্যোগে। তবে এইটুকুই যথেষ্ট নয়। সমস্যার বিপুলতার বিরুদ্ধে আমাদের চেষ্টা অতি সামান্য। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া এই সমস্যার সমাধান অসম্ভব। সচেতন হন, সচেতন করুন, সোচ্চার হোন। পানীয় জল, শিক্ষা, চাকরির মতো পরিবেশ সঙ্কটকেও নিয়ে আসুন রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। রাজনৈতিক ইস্তেহারের ভিতরের কোণায় অবহেলিত হিসেবে নয়, পরিবেশ সমস্যা উঠে আসুক আরও পাঁচটি প্রধান সমস্যার সঙ্গে প্রথম সারিতে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4664 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...