সুব্রত ঘোষ

পাঁচটি কবিতা

 

উচ্চকিত হলফনামা

দেবদূতের মতো তিনি থাকেন ওপারে, বড়ে গোলামের মতো ভারী কন্ঠস্বর, জিজ্ঞাসা করেন—
বলুন, বলুন তাড়াতাড়ি বলুন— আপনার শেষ ইচ্ছা কী? সেতারের ঝালার মতো বলে যাই—
প্রভু আপনার সঙ্গে এখানেই যেন দেখা হয় আগামী হেমন্তের সকালে। জীবনের পড়ন্ত হেমন্তে—
বিয়ের কনের মতো পরিপাটি জীবনের সাথে প্রবঞ্চনা, ধর্মগ্রন্থ স্পর্শ করে আওড়াই— যাহা বলি
সত্য বলি। ধর্মাবতার— আমি বেঁচে আছি। দেখুন আমি বেঁচে আছি। উলটে পালটে দেখুন,
আমি বেঁচে আছি। আজকের হেমন্ত বেশ রোদ ঝলমলে— আমার স্বাক্ষরিত, উচ্চকিত হলফনামার
মতো। বিংশ শতকে তুমি তো কোনও দিন দরজায় কড়া নাড়োনি— অবনী বেঁচে আছ?
তোমার হঠাৎ জেগে ওঠা অনুরাগ কী মমতায় ভরপুর, কৈশোরের প্রেমিকার নিখুঁত কোমল
ঋষভ। আমার বাৎসরিক কাজ, আমার বাৎসরিক শ্রদ্ধা— আমায় অবনত করে।

সহমর্মীর আমার দিকে নির্মম অঙ্গুলিনির্দেশ— মিথ্যাবাদী, প্রবঞ্চক, কাপুরুষ।
মিথ্যা হলফনামায় তোমার অহঙ্কৃত অস্তিত্ব। মৃতের মিছিলে তুমিই একমাত্র জলজ্যান্ত পুরুষ?

বাঁচার অ্যাক্রোব্যাট আমায় আয়ত্তে। কীভাবে, কোন কৌশলে বেঁচে আছি— অর্থহীন এ বাক্যবাণ। বেঁচে আছি আমি বেঁচে আছি। হলফনামার উজ্জ্বল অক্ষরে আমি বেঁচে আছি।

 

বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি

মোক্ষলাভ মানেই কি অপসারিত ছায়া,
মোক্ষলাভ মানেই কি নিষ্প্রভ পূর্ণিমা—

তবে কেন আজ এ আকুতি

জল দাও— তৃষ্ণার্ত চণ্ডালতনয়ায়।

বোধিবৃক্ষ মানেই কি পাথরের চোখ,
বোধিবৃক্ষ মানেই কি জমাট হৃদয়—

তবে কেন আজ ভিক্ষার প্রার্থনা—

প্রাণ দাও আমায় প্রাণ দাও—

প্রাণ-ভিক্ষা কে করে দান, হস্তে যার অশান্তির শাণিত বাণ।

ত্রিপিটক মানেই কি ছিন্ন তুলট,
সূত্র, বিনয়, অভিধর্মের তীব্র ক্রন্দন—
ত্রিপিটক মানেই কি তিনশো কোটির হুতাশন,
তবে কেন আজ এ নিরন্নের কাকুতি—
দাও শুধু দাও সূর্যের কিরণে মাখা এক দিন।
কে দেবে সূর্যের কিরণ— আমরা যে আঁধারের কারিগর।

 

মধু ভট্টাচার্যের মুঠোফোন

হয় বন্ধ আছে, অথবা যোগাযোগসীমার বাইরে
হয় বন্ধ…..
হয় বন্ধ…..

তখন বেশ ছিল-যখন ছিল না মুঠোফোন।
না থাকত বন্ধ, না যোগাযোগসীমার বাইরে,
এ-জোন, বি-জোন, সি-জোনের নির্জন মাঠ পেরিয়ে
চণ্ডীদাস, বেনাচিতি—
আমার বাতাস, আমার আমার একান্তই আমার।
সে বাতাস কবে অতীত হয়ে অন্য বাতাসের সঙ্গে মিশে একাকার।

বাতাসের ধর্মই ধর্মান্তরিত হওয়া
এ খেলাতেই সে সিদ্ধহস্ত।
হঠাৎ উত্তুরে হাওয়া এসে কানে কানে বলে—
এসো আমার ঘরে এসো।
বললেই কি আসা হয়? কত কাঠ, কত খড় অঙ্গার হয়ে যায়—
তবু ….

কথা না রাখার কথাই ওঠে না—
কেউ কাউকে কথা দিইনি,
এ খেলার না আছে কোনও ফলা, না কোনও ফল।

বাতাস ফিসফিস করে— কানের একেবারে কাছে আসে—

বাতাসের এ এক ধূসর পোশাক—
নিমপাতা চাপা দেওয়া আমার বইয়ের জীর্ণ পাতা…
পরিচিত এক গন্ধ হালকা হয়ে আকাশে উড়ে উড়ে যায়,
বিধার্মিক বাতাস হঠাৎ উচ্চৈস্বন,
নির্মম উচ্চারণ—
“ফোন বন্ধ আছে—
মুঠোফোন মুঠোয় ধরে— যোগাযোগসীমার বাইরে।”
ঘটনাটা গত ফেব্রুয়ারির এক নিরাভরণ সন্ধ্যায়।

 

নিরঙা স্বপ্ন

আমার স্বপ্ন না জানে কোনও সিঁড়িভাঙ্গা অঙ্ক,
তার না আছে কোনও বন্ধনীর মাত্রাজ্ঞান,
নির্মম দিগ্বিদিক শূন্য। ছন্দহীন ছোটাছুটি।
যা ছিল ভূতপূর্ব— সূর্যের আলতো ছোঁয়ায় সেই হয়ে ওঠে ভবিষ্যের প্রার্থনা।

স্বপ্ন এক বর্ণহীন, গন্ধহীন, স্বাদহীন মৌলিক পদার্থ।
পাশবালিশের মতো জড়িয়ে থাকে।
বোতলের প্যাঁচ আলগা হলেই হরিৎ আভার তরল বাষ্পের রূপ নেয়।
মালসায় নিজের আতপ্ত চাল নিজে ফোটাবার এই কি সময়?

স্বপ্নই আমার ফেসবুক— চৌকো বাক্সের ফাঁকে চোখ রাখি,
পরীরা সব আমাকে ঘিরে ধরে— কতদিন দেখিনি তোমায়।
সেই প্রেমিকা যার নীল স্কার্ট বারান্দায় ঝোলানো দেখেই আকাশে রামধনু ওঠে।

এ স্বপ্ন না দেখলেই ভাল ছিল,
এ কবিতা না লিখলেই আরও ভাল হত,
এই বুলুদিকে এতদিন পর না দেখলেই অনেক ভাল লাগত।

 

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত

ওরকম করেই রাখো, যেরকম রোজ থাকে
জুতোজোড়া ওখানে, জামাটা এখানে
সূক্ষকোণে খুলে রাখো জানলাটা
দরজাটা আধখানা।
আর—
এই আমাদের বাংলা দেশ আমাদেরই বাংলা রে।

নটা আটান্নোর ট্রেন লেট হলে
একটু স্টেশনে বসে থেকো,
বেশি দেরি হলে বেশি ভাল
কম হলে কম,
আর—
এই আমাদের বাংলা দেশ আমাদেরই বাংলা রে।

বৃক্ষের মতো সহিষ্ণু হও,
সময়মতো পাতা ঝরাও
সময়মতো গর্ভবতী
পবিত্র আগুনের কাছে অস্পৃশ্য হও,
ঝরুক তোমার শিল্প, তোমার সুষমা,
আর—
এই আমাদের বাংলা দেশ আমাদেরই বাংলা রে।

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4664 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...