![srirupa 2](https://i2.wp.com/www.4numberplatform.com/wp-content/uploads/2024/04/srirupa-2.jpg?resize=678%2C381&ssl=1)
শ্রীরূপা বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রতিটি দুর্নীতি-কেলেঙ্কারিতেই লাভ হয়েছে রাজনৈতিক দল ও তাদের পৃষ্ঠপোষক বড় বড় শিল্পপতি-ব্যবসায়ীদের। আর তার মাশুল গুনতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে। তা সত্ত্বেও সাম্প্রতিক নির্বাচনী বন্ড দুর্নীতি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনে যতখানি প্রভাব ফেলেছে তা বোধহয় ইতিপূর্বে কখনও দেখা যায়নি
দেশের ভোটসর্বস্ব দলগুলোর রাজনীতি আর দুর্নীতি তো আজ প্রায় সমার্থক। স্বাধীনতার পর থেকে একের পর এক শাসকদল ও ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক দলগুলো যত দুর্নীতিতে জড়িয়েছে, তার সংখ্যা হয়তো হাতে গুনে শেষ করা যাবে না। প্রতিটি দুর্নীতি-কেলেঙ্কারিতেই লাভ হয়েছে ওইসব রাজনৈতিক দল ও তাদের পৃষ্ঠপোষক বড় বড় শিল্পপতি-ব্যবসায়ীদের। আর তার মাশুল গুনতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে। তা সত্ত্বেও সাম্প্রতিক নির্বাচনী বন্ড দুর্নীতি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনে যতখানি প্রভাব ফেলেছে তা বোধহয় ইতিপূর্বে কখনও দেখা যায়নি।
শাসকদল বিজেপি-সহ প্রায় সমস্ত ভোটকেন্দ্রিক দলগুলোই নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে পুঁজিপতি গোষ্ঠীগুলোর কাছ থেকে টাকা নিয়েছে। এখনও পর্যন্ত যেটুকু হিসেব পাওয়া গেছে তাতে দেখা যাচ্ছে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে বিভিন্ন পুঁজিমালিক ও তাদের গোষ্ঠীর কাছ থেকে মোট ১২,৭৬৯ কোটি টাকা এইসব দলের তহবিলে ঢুকেছে। পুরো হিসেব পাওয়া গেলে টাকার পরিমাণ বলাই বাহুল্য আরও অনেক বাড়বে। এতদিনে সকলেই জেনেছেন এই টাকার প্রায় অর্ধেক ৬০৬০ কোটি টাকা খুব স্বাভাবিকভাবে একাই পেয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারে আসীন বিজেপি। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস, তারপরেই রয়েছে কংগ্রেস। এবার দেখা যাক এই হাজার হাজার কোটি টাকার কেলেঙ্কারি শুধু ভোটবাজ দলগুলির বিষয় হয়ে না থেকে কীভাবে সাধারণ মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলেছে।
বিদ্যুতের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি
রাজ্যে আরপিজি সঞ্জীব গোয়েঙ্কার সিইএসসি বিদ্যুতের একচেটিয়া ব্যবসা করে চলেছে। পূর্বতন বামফ্রন্ট সরকার সিইএসসিকে এই গোষ্ঠীর হাতে তুলে দিয়েছিল। এখন দেখা যাচ্ছে গোয়েঙ্কা গোষ্ঠী ও তার সহযোগী নানা কোম্পানি এ-রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসকে দিয়েছে ৪৪৪ কোটি টাকা। এদেরই বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানি হলদিয়া এনার্জি দিয়েছে ২৮১ কোটি টাকা। ধারিওয়াল ইনফ্রাস্ট্রাকচার যা এদেরই এক শাখা-কোম্পানি সে দিয়েছে ৯০ কোটি। পিসিবিএল দিয়েছে ৪০ কোটি, ক্রিসেন্ট পাওয়ার দিয়েছে ৩৩ কোটি টাকা। ফল কী হয়েছে? গোয়েঙ্কা কোম্পানির এই উপঢৌকনের দায় মেটাতে হচ্ছে রাজ্যের সাধারণ মানুষকে। তৃণমূল কংগ্রেস সরকারে বসার পর গ্রাহকদের বিলের অঙ্ক নানা কৌশলে ১৪ বার বাড়ানো হয়েছে। এমনকি যখন কয়লার দাম অর্ধেক হয়ে গেছে, জিএসটি কমে ৫ শতাংশ হয়েছে, তখনও বিদ্যুতের সামান্য দামও কমায়নি সিইএসসি। অর্থাৎ শাসকদলকে কোটি কোটি টাকা ঘুষ দিয়ে তা তুলে নেওয়া হয়েছে সাধারণ মানুষেরই ঘাড় ভেঙে।
ওষুধের নেমে যাওয়া মান ও চড়া দাম
নির্বাচনী বন্ডের প্রভাব বোধহয় সবচেয়ে বেশি পড়েছে ওষুধের মান ও তার দামের উপর। প্রকাশিত তথ্যে দেখা যাচ্ছে ৩৫টি ওষুধ কোম্পানি নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে ১০০০ কোটি টাকারও বেশি চাঁদা দিয়েছে তাদের পছন্দসই রাজনৈতিক দলগুলোকে। স্বাভাবিক কারণেই এই টাকার সবচেয়ে বড় অংশ পেয়েছে বিজেপি। বিনিময়ে ওষুধের দাম যেমন খুশি বাড়ানোর সুযোগ পেয়ে গেছে কোম্পানিগুলো। অতি সম্প্রতি ৮০০টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও দরকারি ওষুধের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হল। আরও ভয়ঙ্কর হল, রাজনৈতিক দলগুলোকে চাঁদা দিয়ে সাতটা বড় ওষুধ কোম্পানি ওষুধের গুণমান-পরীক্ষায় ফেল করার পরেও বাজারে সেগুলো চালানোর ছাড়পত্র পেয়েছে। ফলে একদিকে সাধারণ মানুষ চড়া দামের জন্য ওষুধ কিনতে পারছেন না। যাঁরা কিনছেন, খারাপ মানের জন্য তাঁদের রোগ সারছে না, অথবা সারতে অনেক সময় লেগে যাচ্ছে। অর্থাৎ ঘুষের বিনিময়ে সাধারণ মানুষের প্রাণ নিয়ে খেলা করছে এইসব ভোটবাজ রাজনৈতিক দল।
লটারিতে সর্বস্ব খোয়াচ্ছেন সাধারণ মানুষ
নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোকে সবচেয়ে বেশি টাকা দিয়েছে লটারি-ব্যবসার রাজা ফিউচার গেমিং বলে একটা সংস্থা। এরা তৃণমূলকে দিয়েছে মোট টাকার প্রায় অর্ধেক। সকলেই জানেন পশ্চিমবঙ্গে এই সংস্থার লটারি চুটিয়ে ব্যবসা করছে। অন্যান্য রাজ্যে যেখানে এদের ব্যবসা আছে সেখানেও শাসকদলের ঝুলিতে এরা বিপুল টাকা ঢেলেছে। লটারির দোকানগুলোতে কাদের ভিড় সেদিকে একটু খেয়াল করলেই দেখা যায়, লাচার শ্রমজীবী গরিব মানুষ একটু ভালভাবে জীবন কাটানোর আশায় তাদের আয়ের একটা বড় অংশ লটারির পিছনে খরচ করছে। জনস্বার্থ নিয়ে বিন্দুমাত্র উদ্বেগ থাকলে যেখানে সরকারের উচিত এই লটারি-ব্যবসাগুলোকে বন্ধ করা, সেখানে দেখা যাচ্ছে কোটি কোটি টাকা ঘুষের বিনিময়ে গরিব মানুষকে এই লটারির ভুলভুলাইয়াতে ঠেলে দিচ্ছে তারা।
টাকা ঢেলে কাজ পেয়েছে অযোগ্য সংস্থা
প্রকাশিত তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে নির্বাচনী বন্ডে ঘুষ দিয়ে কাজের বরাত জোগাড় করেছে বড় বড় সব কোম্পানি। দেখা যাচ্ছে ৩৮টি কর্পোরেট গোষ্ঠী নির্বাচনী বন্ডে বিজেপিকে ঘুষ দিয়ে ১৭৯টি কাজের অর্ডার পেয়েছে। এই পথেই বহু অযোগ্য কোম্পানি কাজ করার অনুমতি পেয়েছে। অনেকেরই মনে আছে কিছুদিন আগে উত্তরাখণ্ডের সিল্কিয়ারায় একটি নির্মীয়মান সেতুতে ধস নেমে ৪১ জন শ্রমিক ১৬ দিন ধরে কী ভয়াবহ অবস্থায় আটকে ছিলেন। পরে তদন্তে বেরিয়ে এসেছিল ওই কাজের দায়িত্ব ছিল যে নবযুগ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির উপর। তারা নিরাপত্তার নানা নিয়মকানুন অগ্রাহ্য করেই কাজ চালাচ্ছিল। অভিযোগ দায়ের করা সত্ত্বেও ওই কোম্পানির বিরুদ্ধে সরকার কিন্তু কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। এখন দেখা যাচ্ছে ২০১৯ থেকে ২০২২-এর মধ্যে ওই নবযুগ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি নির্বাচনী বন্ডে ৫৫ কোটি টাকা দিয়েছে বিজেপিকে।
সবশেষে যে কথাটি না বললেই নয় সেটি হল, এই সমস্ত ভোটবাজ দলগুলো ভোটের সময় প্রার্থীর প্রচারে যে দেদার টাকা খরচ করে, ব্যানারে ফ্লেক্সে বড় বড় হোর্ডিং-কাট আউটে অলিগলি ভরিয়ে দেয়, ভোটারদের হাতে তুলে দেয় কম দামি-বেশি দামি উপঢোকন, সেই সব টাকা আসে এইসব বড় বড় কোম্পানির মালিকদের কাছ থেকেই। বুঝতে অসুবিধা হয় না নির্বাচনী বন্ডের এই বিপুল টাকাও খরচ হবে এভাবে ব্যাপক প্রচারকে কাজে লাগিয়ে জনমতকে প্রভাবিত করতে। এছাড়া ভোটের দিন জাল ভোট করাতে, বুথ জ্যাম করতে, এলাকায় সন্ত্রাসের পরিবেশ তৈরি করতে, দেদার মদ-মাংস ঢেলে যুবসমাজের একাংশকে দিয়ে নানা বেআইনি কাজ করিয়ে নিতে যে টাকা লাগে তার একটা বড় অংশও আসবে নির্বাচনী বন্ড থেকে। এইসব দলের প্রচারের জৌলুসে চাপা পড়ে যাচ্ছে সেই দলগুলি যারা নীতির ভিত্তিতে সাধারণ মানুষের দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্তরিকভাবে লাগাতার লড়াই-আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। বিপুল প্রচারের ঝলমলে আলোয় জনস্বার্থের বিরোধী দুর্নীতিবাজ দলগুলি চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সহজ সরল খেটে খাওয়া মানুষের। ফলে এ দেশের নির্বাচনগুলিতে সত্যিকারের জনমত প্রতিফলিত হতে পারছে না। এই অবস্থায় একের পর এক কেলেঙ্কারিতে কলঙ্কিত এদেশের ভোটবাজ রাজনৈতিক দলগুলির সাম্প্রতিক নির্বাচনী বন্ড কেলেঙ্কারি গভীর উদ্বেগের বিষয়। এইসব দলকে আসন্ন নির্বাচনে পরাজিত না করতে পারলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে আমাদের মতো সাধারণ মানুষেরই।
*মতামত ব্যক্তিগত