পরিবেশ-প্রহসন ও সাম্প্রতিক ভারতবর্ষ— একটি ‘বিকশিত’ দশক

অনির্বাণ ভট্টাচার্য

 


২০২২ সালে ১৮০টি দেশের মধ্যে সমীক্ষা করা ইয়েল ইউনিভার্সিটির এনভায়রনমেন্টাল পারফর্মেন্স ইন্ডেক্সে ভারতবর্ষ শেষ করেছে একেবারে তলানিতে, অর্থাৎ ১৮০ নম্বরে। স্কোর ১৮.৯। পাঁচ বছর আগে, অর্থাৎ বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার বছরে যা ছিল ১৫৫-য়। ক্লাইমেট অ্যাকশন, নেট জিরো এমিশন, মিশন লাইফ ইত্যাদি ঢক্কানিনাদের আড়ালে পরিবেশ-নিয়ন্ত্রণ, বলা ভাল, পরিবেশ-নিধনের তুমুল বন্যা বইছে বর্তমান ভারতবর্ষে

 

২০২২ সালে ১৮০টি দেশের মধ্যে সমীক্ষা করা ইয়েল ইউনিভার্সিটির এনভায়রনমেন্টাল পারফর্মেন্স ইন্ডেক্সে ভারতবর্ষ শেষ করেছে একেবারে তলানিতে, অর্থাৎ ১৮০ নম্বরে। স্কোর ১৮.৯। পাঁচ বছর আগে, অর্থাৎ বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার বছরে যা ছিল ১৫৫-য়। ক্লাইমেট অ্যাকশন, নেট জিরো এমিশন, মিশন লাইফ ইত্যাদি ঢক্কানিনাদের আড়ালে পরিবেশ-নিয়ন্ত্রণ, বলা ভাল, পরিবেশ-নিধনের যে তুমুল বন্যা বইছে বর্তমান ভারতবর্ষে, তার কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া আসলে টিপ অফ দ্য আইসবার্গ। তবু চেষ্টা থাকল।

 

প্রোজেক্ট ক্লিয়ারেন্স ও ইআইএ-র অস্তিত্বহীনতা

২০২০-র বিতর্কিত ড্রাফট ইআইএ নোটিফিকেশন এবং পাশাপাশি পরিবেশমন্ত্রক থেকে আলাদা করে বেরোনো কিছু অফিস মেমোরান্ডামে রিভার ভ্যালি প্রোজেক্ট, নিউক্লিয়ার প্রোজেক্ট এবং মাইনিং প্রোজেক্টের ক্লিয়ারেন্স রিনিউ করার সময়সীমা যথাক্রমে ১০ বছর, ১০ বছর এবং ৩০ বছর থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ১৩ বছর, ১৫ বছর ও ৫০ বছর। অর্থাৎ বাড়তি বেশ কয়েকটি বছরে চূড়ান্ত পরিবেশ স্বেচ্ছাচারের সার্টিফিকেট। ড্রাফট নোটিফিকেশনে বলা হয়েছে দেশের সীমান্ত অঞ্চলে থাকা হাইওয়ে প্রোজেক্টের ক্ষেত্রে স্ট্রাটেজিক কারণে নাকি কোনও পরিবেশ ক্লিয়ারেন্স লাগবে না। লাদাখে ইন্দোচিন সীমান্তের চ্যাংথাং অভয়ারণ্যে এভাবেই ১০টি হাইওয়ে তৈরির ছাড়পত্র দিয়েছে ন্যাশনাল ওয়াইল্ডলাইফ বোর্ড। কোথায় যাবে বিপন্ন টিবেটিয়ান অ্যাস, ব্ল্যাক ক্রেন! উত্তর নেই। স্ট্র্যাটেজিক ডেভেলপমেন্টের তত্ত্ব। তার সঙ্গে বলা হল, ১৫ মেগাওয়াট ক্ষমতা পর্যন্ত তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের কোনও ক্লিয়ারেন্স লাগবে না। উপরন্তু, ভয়ঙ্করতম এটিই যে পোস্ট-ফ্যক্টো ক্লিয়ারেন্সের একটি আশ্চর্য ক্লজ আনা হয়েছিল ড্রাফটে। অর্থাৎ কোম্পানি প্রোজেক্ট শুরু করে দেদার দূষণ ছড়িয়ে পরে ক্লিয়ারেন্স নিতে পারে। যদি এইটুকু সময়ে ক্লিয়ারেন্স বাতিল হয়, সেক্ষেত্রে পরিবেশের ওপর যে ইরিভারসিবল ক্ষতি হয়ে গেল, তার দায় কারও নয়। যদিও সুপ্রিম কোর্ট থেকে পোস্ট-ফ্যাক্টো ক্লিয়ারেন্সের ওপর স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়েছে গত জানুয়ারির একটি গুরুত্বপূর্ণ রায়ে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্থানীয় আদিবাসীদের থেকে পাবলিক কনসাল্টেশন নেওয়ার কোনও প্রয়োজন মনে করা হচ্ছে না। তার সঙ্গে সংশোধনের পর এই জন-মতামত নেওয়ার সময়সীমা ৪৫ দিন থেকে কমিয়ে করা হল ৩০ দিন। ১৯৯৪ নোটিফিকেশনের সময়ে লেগ্যাসি মাইনিং লিজ দেওয়া কনসেশনগুলির ক্ষেত্রে কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য কঠিনতম পাবলিক হিয়ারিং কমিয়ে পাবলিক কনসাল্টেশনে নামিয়ে দেওয়া হল মালিকের স্বার্থে। গত ১৭ জানুয়ারি পরিবেশ মন্ত্রকের একটি মেমোরেন্ডামে স্টেট এনভায়রনমেন্ট ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট অথরিটির ইআইএ করার সময়সীমার ওপরে দেওয়া হয়েছে স্টার রেটিং— যেখানে ১২০ দিনের বেশি সময় লাগলে পয়েন্ট জিরো, ৮০ দিনের কম সময় নিলে পয়েন্ট টু। তাড়াহুড়ো করে প্রোজেক্ট ক্লিয়ারেন্সের ওপর এত বেশি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে ‘ease of doing business’-এর দোহাই দিয়ে। প্রোজেক্টের মোট খরচের এক শতাংশ পেনাল্টি দিয়ে পরিবেশের তুমুল স্বেচ্ছাচার করে পার পেয়ে যাচ্ছে কোম্পানিগুলি। খোদ পরিবেশমন্ত্রকের হিসেব বলছে, ২০২২-এ দেশের রেকর্ড সংখ্যক ১২৪৯৬টি প্রোজেক্ট ক্লিয়ারেন্স পেয়েছে, যা ২০১৮-র ৫৭৭টি ক্লিয়ারেন্সের চেয়ে ২১ গুণ বেশি।

চ্যাংথাং, লাদাখ

সাম্প্রতিক গ্রেট নিকোবরের ৭২,০০০ কোটি টাকার ইন্টারন্যাশনাল কন্টেইনার ট্রানশিপমেন্ট টার্মিনাল। এয়ারপোর্ট। টাউনশিপ। থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট। দেশের চারটি প্রধান বায়োডাইভার্সিটি হটস্পটের অন্যতম সুনডাল্যান্ড জোনের কিছুটা অংশ এই গ্রেট নিকোবরের গ্যালাথিয়া অঞ্চল পরিকল্পিত ট্রানশিপমেন্ট টার্মিনালের অন্যতম অংশ যা বিপন্ন লেদারব্যাক কচ্ছপের রেয়ার নেস্টিং গ্রাউন্ড। মেগাপোড পাখিদের চারণভূমি। ৮ লক্ষ ম্যানগ্রোভ-ঘেরা অঞ্চল। ফাইনাল ক্লিয়ারেন্স দেওয়া এক্সপার্ট অ্যাপ্রেইসাল কমিটি এইসব আসন্ন পরিবেশ সঙ্কটের কথা ভেবে কিছু প্রাথমিক রিপোর্ট চেয়েছিল নিচুতলা থেকে। রিপোর্ট এল। রিপোর্টে নতুন প্রোজেক্টের অয়েল স্পিল সংক্রান্ত ঝুঁকির কথা নেই, বিপন্ন প্রজাতির প্রাণীদের রিহ্যাবিলিটেশনের কথা নেই, সল্টওয়াটার ক্রোকোডাইল ম্যানেজমেন্ট প্ল্যানের উল্লেখ নেই। লেখা আছে, প্রোজেক্ট নাকি বিপন্ন প্রজাতিতের ছুঁয়েই দেখবে না। ১২-২০ হেক্টর এলাকা জুড়ে ৮ লক্ষ ম্যানগ্রোভ কাটতে গেলে সমপরিমাণ কমপেনশেটরি গাছ লাগানোর নির্দেশ আছে ২০১৬ সালের কমপেনশেটরি অ্যাফরেস্টেশন ম্যানেজমেন্ট ফান্ড অ্যাক্ট অনুযায়ী। রিপোর্টে সেসবও নেই। সম্প্রতি ইআইএ-র দায় থেকে উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে পাম্প স্টোরেজ প্রোজেক্ট বা পিএসপি-গুলিকেও। বলা হচ্ছে হাই ডিমান্ডে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা এই পিএসপিগুলি সাধারণ জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলির থেকে আলাদা এবং অফস্ট্রিম হওয়ায় এদের পরিবেশের উপর সরাসরি প্রভাব কম। ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে স্থানীয় বাসিন্দাদের ২৫০০ হেক্টর জমি কেড়ে নেওয়া অন্ধ্রপ্রদেশের পিন্নাপুরমের বা পুরুলিয়ার বাঘমুন্ডি ব্লকের ১০০০ মেগাওয়াটের পিএসপিগুলির টাটকা ক্ষত।

গ্যালাথিয়া, গ্রেট নিকোবর

২০২০-র ৬ মে। বিশাখাপত্তনমের এলজি পলিমার কোম্পানির কেমিকাল প্ল্যান্ট থেকে রাত তিনটেয় টক্সিক গ্যাস বেরোনো শুরু হল। ভূপাল দুর্ঘটনার ৩৬ বছর পর হাসপাতালে ভর্তি করতে হল ৫০০০ জনকে, নিহত ১৩ জন। শ্বাসকষ্ট, চোখ জ্বলা, বেশ কিছু ফেটালিটি। ওহো, যা বলা হয়নি, এলজি পলিমারের কোনও এনভায়রনমেন্টাল ক্লিয়ারেন্স ছিল না। ডেডলি স্টাইরিন নিয়ে কাজ করা রেডলিস্টেড এই কারখানাকে এলজি পলিমার অধিগ্রহণ করে ১৯৯৭ সালে। কুড়ি বছর পর ২০১৭-য় প্রথম ক্লিয়ারেন্সের জন্য আবেদন করে এলজি পলিমার। বিগত কুড়ি বছর রাজ্য বা কেন্দ্র কোনও জায়গা থেকেই কোনও চাপ দেওয়া হয়নি, যদিও কোম্পানি তার উৎপাদন বাড়িয়ে নিয়েছে দ্বিগুণ। এর বাইরেও ফাউল প্লে, মিথ্যের পরিচর্যা আরও আছে। অসমের দেহিং পাটকাই এলিফ্যান্ট রিজার্ভের মধ্যে অবৈধ মাইনিং-চোরাগোপ্তা স্মাগলিং চলছে। মেট্রো কারশেড তৈরির জন্য মহারাষ্ট্রের বিশাল ‘গ্রিন লাং’ আরে কলোনির অরণ্যের দিকে জ্বলজ্বলে নজর দিচ্ছে প্রশাসন। ৪০০০ হেক্টরের পান্না টাইগার রিজার্ভ কোর এরিয়াকে সঙ্কটে ফেলছে কেন-বেতোয়া রিভার লিঙ্কিং প্রোজেক্ট। এখনও টাটকা আট লক্ষ গাছ কাটার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে চলা আদানি গ্রুপের পারসা ইস্ট অ্যান্ড কান্তা বাসান মাইনিং প্রোজেক্টের বিরুদ্ধে ১১১ দিন ধরে ধর্নায় বসা ছত্তিশগড়ের হাঁসদেও আরান্দ আদিবাসীদের রেবেল, বা স্টিল প্ল্যান্ট না চেয়ে আন্দোলনরত ওডিশার জগৎসিংহপুরের আদিবাসী দলের ওপর পুলিশি ব্যাটন, গ্রামের মেয়েদের মুখে চাপ চাপ রক্ত। এবং এসবের সঙ্গেই সাম্প্রতিকতম তিস্তা দুর্ঘটনা এবং সিলকিয়ারার টানেল দুর্ঘটনা এবং মিশন রেসকিউ ফর্টি ওয়ান।

ছত্তিশগড়ের হাঁসদেও আরান্দ অরণ্যে আদানি গ্রুপের কোল মাইনিং প্রজেক্টের জন্য অবাধে বৃক্ষচ্ছেদন

গত অক্টোবরে দুর্ঘটনাগ্রস্ত সিকিমের তিস্তা-থ্রি ১২০০ মেগাওয়াট প্রোজেক্টের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তিস্তা উর্জা লিমিটেডকে এমন এক সময়ে, যখন কোম্পানির বয়স চার মাসও হয়নি। এত কম অভিজ্ঞতায় এমন একটি টেন্ডার! আত্মঘাত? চারধাম মহামার্গ বিকাশ পরিযোজনা, যার অন্যতম একটি অংশ হিসেবে সিলকিয়ারার টানেলে ১৭ দিনের অন্ধকার নির্মিত হয়েছিল, একটু বৃহত্তর দিকে খেয়াল করলে দেখা যাবে টানেলের বাইরেটাও অন্ধকার। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কেবিনেট থেকে পাশ হয়ে আসে বরকোট-সিলকিয়ারা টানেলের নির্মাণপ্রকল্প। জুন মাসে উত্তরাখণ্ড সরকারের ন্যাশনাল হাইওয়েজ অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন থেকে টেন্ডার দেওয়া হয় হায়দ্রাবাদের নবযুগ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানিকে, এবং সে বছরই নবযুগ একটি অস্ট্রেলীয় কোম্পানি বার্নার্ড গ্রুপকে ডেকে আনে টানেল তৈরির নকশা করতে। পরিবেশমন্ত্রক থেকে বলা হল, টনকপুর-পিথোরাগড় এলাকায় পাঁচটি ন্যাশনাল হাইওয়ের উন্নয়নের জন্য মোট ৮৮৯ কিলোমিটার রাস্তাকে ৫৩টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে, যার অন্যতম এই সিলকিয়ারা। বলা হল, এই ৫৩টি ভাগের প্রত্যেকটিই ১০০ কিলোমিটারের কম দীর্ঘ। এই যুক্তিতে কোনও এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট হওয়ার প্রয়োজন নেই। অর্থাৎ ম্যাজিক ফিগার ১০০ না ছুঁলে পরিবেশে প্রভাব ফেলার সম্ভাবনা থাকছে না। এবং এই কারণ দর্শনের পেছনে ২০১৩ সালে ইআইএ অ্যাক্টের একটি সংশোধন এবং সেখান থেকে চলে আসা আর্টিকল 7(f)— ‘Expansion of National Highways greater than 100 km involving additional right of way or land aquisition greater than 40m on existing alignments and 60m on re-alignments or by-passes only require environmental clearance.’ ২০২১ সালে The National Highyways Authority of India তামিলনাডু ও পুডুচেরির মধ্যে ভিল্লুপুরম ও নাগাপাত্তিনমের মধ্যে সংযোগকারী ১৭৯.৫৫৫ কিলোমিটার বিস্তৃত ৪৫ নম্বর জাতীয় সড়কের এক্সপ্যানশনের স্ট্রাটেজি হিসেবে রাস্তাটিকে চারটি ভাগে ভাগ করেছিল। প্রতিটি ভাগ যথাক্রমে ২৯ কিমি, ৩৮ কিমি, ৫৬ কিমি ও ৫৫ কিমি দীর্ঘ ছিল। এই এক্সপ্যানশনে স্বভাবতই এসে গেছিল প্রাইভেট এজেন্সি এবং পুরো কাজটিতে অসংখ্য গাছ এবং জলা জমি শেষ হয়ে যাচ্ছিল অকাতরে। 7f-এর দোহাই দিয়ে কোনও গ্রিন ক্লিয়ারেন্স নেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করেনি ন্যাশনাল হাইওয়েজ অথরিটি। বহু মানুষ পিটিশন দিতে শুরু করেন এবং সরাসরি মামলা রুজু হয়, যার নাম The National Highway Authority of India vs Pandarinathan Govindarajulu। ন্যাশনাল হাইওয়েজ থেকে বলা হয়, একটি বিশাল বড় রাস্তাকে কোনওরকম সেগমেন্টে না ভেঙে একটি এজেন্সিকে দিয়ে করালে সময় লাগবে ছ-বছরেরও বেশি, বরং এভাবে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে প্রতিটিকে আলাদা আলাদা এজেন্সিকে দিয়ে করালে সময় লাগছে মাত্র তিরিশটি মাস। এবং এই প্রতিটি আলাদা আলাদা অংশ কোনওটাই ১০০ কিলোমিটার ছুঁচ্ছে না বলে ক্লিয়ারেন্স নেওয়ারও কোনও প্রয়োজন হয় না। মাদ্রাজ হাইকোর্ট এই যুক্তিকে নস্যাৎ করে বলে, দীর্ঘ প্রোজেক্টের কম্পার্টমেন্টালাইজেশন প্রশাসনিক কাজের সুবিধের জন্য চলতে পারে কিন্তু তা ইআইএ এড়িয়ে যাওয়ার কোনও অজুহাত হতে পারে না, এবং এই ধরনের ঘটনা ‘will only engineer statutory abuse and sound the death-knell of EIA.’ এই সুবিবেচক রায়ের বিরুদ্ধে ন্যাশনাল হাইওয়েজ সুপ্রিম কোর্টে গেলে উচ্চতর আদালত থেকে সেই সেভেন এফ-এর কথা তুলে নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে গিয়ে ন্যাশনাল হাইওয়েজের পক্ষেই রায় দেওয়া হয়। বলা হয়, প্রোজেক্ট সেপারেশন করলে প্রতিটি ভাগের ১০০ কিলোমিটার তত্ত্বই মানা হবে। অবশ্য মাদ্রাজ হাইকোর্টের সঙ্গে একটি ব্যাপারে একমত হয়ে একথাও স্বীকার করা হয় যে এই প্রক্রিয়া চললে অচিরেই ইআইএ একটি হাসির খোরাক হয়ে যাবে। এবং তাই, পরিবেশমন্ত্রক থেকে এই ধরনের এক্সপ্যানশনে প্রোজেক্ট কম্পার্টমেন্টালাইজেশনের প্রয়োজনীয়তা কতটা তা যাচাই করার জন্য একটি কমিটি বাছাই করতে বলা হয়, যে-কমিটি সমস্ত প্রোজেক্ট এক্সপ্যানশন হলে তার সরেজমিন তদন্ত করে বলবে আদৌ প্রোজেক্ট এক্সপ্যানশনে এলাকাটিকে ভাগ করার প্রয়োজন আছে কিনা। এবং যদি থাকে, সেক্ষেত্রে চলে আসবে সেই ১০০ কিলোমিটার তত্ত্ব। বলা বাহুল্য, সেই কমিটি এখনও হয়নি। মহামান্য আদালতের রায়কে কোনওভাবে ছোট না করেই এটুকু বলা যায়, অন্তত ইআইএ শব্দটাকেই মিথ্যে প্রমাণ করে দিতে ডেভেলপাররা রাষ্ট্রীয় মদতে চলা এই ধরনের সেগমেন্টেশনে উঠে পড়ে লেগেছে শুধুমাত্র সেভেন-এফ-এর ছুঁতোয়। প্রশাসনিক সুবিধের সেগমেন্টেশনকে সাধুবাদ জানালেও তা কোনওভাবেই ক্লিয়ারেন্স এড়িয়ে যাওয়ার অজুহাত হতে পারে না। কারণ জাতীয় সড়ক একটি বাধাহীন বড় অংশ, যার বিভিন্ন সেগমেন্টের মধ্যে কোনও লক্ষণীয় পার্থক্য থাকে না। এভাবে প্রতিটি সেগমেন্টে কোনওরকম ইআইএ বন্ধ হয়ে গেলে কাটা হবে অসংখ্য গাছ, ধ্বংস হবে ওয়েটল্যান্ড, তৈরি হবে আরও অনেক সিলকিয়ারা। আটক মানুষেরা সবক্ষেত্রে কিন্তু বেরিয়ে নাও আসতে পারেন। উপরন্তু থেকে যাচ্ছে গালভরা কমিটি গঠন। সেই কমিটি তৈরি করছে কারা? পরিবেশমন্ত্রক। সহজেই অনুমেয় কর্পোরেট-সরকার নেক্সাস, প্রো-কর্পোরেট কমিটি এবং প্রায় সমস্ত সেগমেন্টেশনে কমিটির চিরাচরিত ‘হ্যাঁ’— অর্থাৎ মাদ্রাজ হাইকোর্ট যা ভয় পাচ্ছিল তাই— ‘সাউন্ড দ্য ডেথ-নেল অফ ইআইএ’।

ভেতরে তখনও শ্রমিকের আটকে, সিলিকিয়ারা-বরকোট টানেলের প্রবেশপথ (নভেম্বর, ২০২৩)

পাশাপাশি প্রাসঙ্গিক পরিবেশ-পোর্টাল ওয়ান থেকে পরিবেশ-পোর্টাল টু-র রূপায়ণ। পোর্টাল ওয়ানে প্রোজেক্টের ইআইএ রিপোর্ট থাকলেও গত সেপ্টেম্বরের মন্ত্রকের কথায় ‘রিভ্যাম্প’ হওয়া পোর্টালে রিপোর্ট আর পাবলিক করা হচ্ছে না। থাকছে না ২০২৩-এর ২২ সেপ্টেম্বরের পরের প্রোজেক্টগুলির ডিটেল পাবলিক হিয়ারিং ডকুমেন্ট বা প্রি-ফিজিবিলিটি রিপোর্টগুলিও। কারণ হিসেবে পোর্টালকে ‘ইউজার-ফ্রেন্ডলি’ ও ‘মোর এফেক্টিভ’ করার জন্য সেই ‘রিভ্যাম্প’ তত্ত্ব। আসলে দিস্তে দিস্তে আরটিআই আটকাতে স্ট্র্যাটেজি মাত্র।

 

অরণ্য সংরক্ষণরদবদল ও সঙ্কট

২০২৩-এর ২৬ জুলাই ভারতীয় পরিবেশ আইনি ব্যবস্থার অন্যতম একটি পিলার আইনের রদবদল বা অ্যামেন্ডমেন্ট হল। ১৯৮০ সালের Forest (Conservation) Act-এর সংশোধন হয়ে Forest Conservation (Amendment) Bill 2023 পাশ হল লোকসভায়। বলা হল ২০৩০ সালের মধ্যে ভারতের ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড কন্ট্রিবিউশন টার্গেট বাড়ানো হবে ২.৫ থেকে ৩ বিলিয়ন টন, এবং পাশাপাশি দেশের মোট স্থলভাগের এক-তৃতীয়াংশকে বনভূমির আওতায় আনার এক সর্বান্তকরণ চেষ্টা হবে। এবং এই লক্ষ্যমাত্রা আসলে ২০৭০ সালের মধ্যে নেট জিরো এমিশন টার্গেটের সামগ্রিক লক্ষ্যমাত্রার একটি অংশ হিসেবে গণ্য করা হবে। অথচ, কী কী হল এই সংশোধনে? বলা হল, দেশের সীমান্তরেখার একশো কিলোমিটারের আশেপাশের সমস্ত এলাকার অরণ্য stratetic linear projects of national importance and concerning national security-র কারণে ১৯৮০ সালের অরণ্য সংরক্ষণ আইনের পর্যায়ে পড়বে না, অর্থাৎ এই সমস্ত সীমান্তবর্তী অঞ্চলের অরণ্যকে কোনওরকম আইন ব্যতিরেকেই কেন্দ্রীয় সরকার ইচ্ছেমতো ব্যবহার করতে পারবে। আরেকটু বিস্তৃত ব্যাখ্যা করলে দাঁড়ায়, কন্সট্রাকশন এবং নিরাপত্তাজনিত কারণে বিভিন্ন পরিকাঠামো নির্মাণে ব্যবহৃত দশ হেক্টর অবধি বনভূমি এবং লেফট উইং এক্সট্রিমিজম তালিকাভুক্ত অঞ্চলে জনসেবাকাজে, প্যারামিলিটারি ফোর্সের জন্য অথবা প্রতিরক্ষা-বিষয়ক কাজে পরিকাঠামো তৈরিতে ব্যবহৃত অন্তত ৫ হেক্টর পর্যন্ত বনভূমি অঞ্চল অরণ্য সংরক্ষণ আইনের আওতার ভেতর পড়বে না। এছাড়াও বলা হল, রেলট্র্যাক বা সরকার নিয়োজিত কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন রাস্তার আশেপাশের ০.১ হেক্টর পর্যন্ত অরণ্যকে পার্শ্ববর্তী হ্যাবিটেশন এবং রোডসাইড অ্যামেনিটিজের দোহাই দিয়ে ১৯৮০-র আইনের বাইরে রাখা হবে, এবং এখানেও সরকারের নিরঙ্কুশ স্বেচ্ছাচার। এতেও শেষ নয়। ১৯৮০-র আইনের section 2 অর্থাৎ exemption-এর তালিকাকে দীর্ঘ করে বলা হল, চেকপোস্ট, ফেন্সিং, ব্রিজ, চিড়িয়াখানা, সাফারি, ইকো-টুরিজম ইত্যাদি কাজে বনভূমিকে ব্যবহার করা হলে সেখানেও কেন্দ্র সরকার থেকে কোনওরকম অনুমতি লাগবে না। Strategic linear projects of national importance and concerning national security’— এই কারণের আওতায় পড়া সীমান্তবর্তী ১০০ কিলোমিটার অঞ্চলের ভেতরে থাকা কোনও অরণ্যই আর সেভাবে বনভূমির পর্যায়ভুক্ত নয়। গৃহমন্ত্রকের ডেটা বলছে, দেশের সীমান্ত অঞ্চলের পরিসীমা ১৫১০৬.৭ কিলোমিটার। এবং এই সীমান্তবর্তী একশো কিলোমিটারের ক্লজ ধরলে গোটা উত্তর-পূর্ব ভারত চলে যাচ্ছে স্ট্র্যাটেজিক লিনিয়ার প্রোজেক্ট ইত্যাদি গালভরা গ্লসারির ভেতরে, সঙ্কট এমনই। এবং এই উত্তর-পূর্ব ভারতেই দেশের মোট dense এবং moderately dense ফরেস্ট-কভারের প্রায় ২১.৬৮ শতাংশ অবস্থিত।

ফরেস্ট (কনজারভেশন) অ্যামেন্ডমেন্ট বিলের বিরুদ্ধে উত্তর-পূর্ব ভারতে লাগাতার প্রতিবাদ-আন্দোলন চলছে

পাশাপাশি, সংশোধন আইনে বলা হয়েছে, বন সংরক্ষণ আইন সেইসব বনভূমির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে, যে-সমস্ত বনভূমি সরকারের রেকর্ডেড এলাকার মধ্যে পড়ছে, অর্থাৎ সরকারি নথিতে ১৯৮০ সালের ২৫ অক্টোবর বা তারপর থেকে যেগুলি ফরেস্ট বলে চিহ্নিত আছে। অর্থাৎ, মানে দাঁড়াল, রেকর্ডেড নয়, এমন যে-কোনও অঞ্চল, তা যদি ঘন কোনও স্ট্যান্ডিং ফরেস্ট এরিয়াও হয়, নির্দ্বিধাও সেগুলো কমার্শিয়াল এক্সপ্লয়েটেশনের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে, এবং তার জন্য কোনও অনুমতিও লাগবে না। এবং এই প্রসঙ্গে ১৯৯৬ সালে সুপ্রিম কোর্টে ‘টিএন গোদাবর্মণ বনাম ইউনিয়ন অফ ইন্ডিয়া অ্যান্ড আদার্স’ নামের ল্যান্ডমার্ক মামলার শুনানির বিচারটি উল্লেখযোগ্য। এই মামলা অনুযায়ী, সরকারি রেকর্ড ইত্যাদির তোয়াক্কা না করে অভিধানে ‘ফরেস্ট’ বলে পরিচিত যে-কোনও অঞ্চলই বন সংরক্ষণের আওতাভুক্ত হবে এবং এইসব অঞ্চল ব্যবহার করতে গেলে সরকারের বনদপ্তর থেকে লিখিত অনুমতির প্রয়োজন। অর্থাৎ, ২০২৩ সংশোধন বিলের ফলে এই মামলার রায়ের আর কোনও বৈধতা থাকল না। সরকারি রেকর্ডেড ফরেস্ট নয়, এমন যে-কোনও অঞ্চলেই চলবে নির্দ্বিধায় বৃক্ষচ্ছেদন।

 

ইলেক্টোরাল বন্ড ও পরিবেশ-ঘাতক চক্র

২০২৪-এর ১৪ মার্চ সুপ্রিম কোর্টের আদেশে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার থেকে দেশের নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী বন্ডের হিসেব প্রকাশ করে, যাতে স্পষ্ট, দেশের বর্তমান শাসক ২০১৯ থেকে অনুদান পেয়েছে ৬,০০০ কোটি। এই অনুদানের ভেতর অন্যতম চারটি গুরুত্বপূর্ণ কোম্পানির সবুজায়ন ধ্বংস করার পেছনে কুখ্যাতি নতুন কিছু না। দেখা যাচ্ছে এই তালিকায় নিয়মগিরি বা লাঞ্জিগড় প্রোজেক্টের সঙ্গে যুক্ত কুখ্যাত বেদান্ত দিয়েছে ৪০০.৬৫ কোটি, ওড়িশার বাগরিঝোলা গ্রামের বিতর্কিত রিফাইনারির সঙ্গে জড়িত উৎকল অ্যালুমিনা দিয়েছে ১৪৫ কোটি, ছত্তিশগড়ের রায়গড় বা বারমেরের ভদ্রা গ্রামে জমি অধিগ্রহণ ও মাইনিং নিয়ে বিতর্কিত জিন্দাল গ্রুপ দিয়েছে ১৫৩ কোটি, এবং সুপ্রিম কোর্ট থেকে স্থগিতাদেশ দেওয়া তেলেঙ্গানার গোদাবরী নদীর ওপরে বিতর্কিত কলেশ্বরম লিফট ইরিগেশন প্রোজেক্টের সঙ্গে জড়িত হায়দ্রাবাদের মেঘা ইঞ্জিনিয়ারিং দিয়েছে প্রায় ৯৬৬ কোটি। অন্য একভাবে হিসেব করলে দেখা যাচ্ছে বেদান্ত, রুংটা সন্স, ইএমআইএল, জেএসপিএল ও ডেম্পো মিলে দিয়েছে মোট ৮২৫ কোটি, এবং এই পাঁচটি মাইনিং ও ইস্পাত জায়ান্টের বিভিন্ন প্রোজেক্ট গ্রিন ক্লিয়ারেন্সের জন্য আটকে আছে মন্ত্রকে। পরিণতি কী হবে, সহজেই অনুমেয়।

বেদান্তর সঙ্গে অসম লড়াইয়ে জিতে যাওয়া নিয়মগিরি পাহাড়ে ডোংরিয়া কোন্ধদের একটি গ্রাম

এখানেই উল্লেখ্য Organized Crime and Corruption Reporting Project বা OCCRP-র একটি তদন্ত রিপোর্ট। বেদান্ত কোম্পানির চেয়ারম্যান অনিল আগরওয়ালের দেশের তৎকালীন পরিবেশমন্ত্রীকে লেখা একটি চিঠিতে ইআইএ লঘু করে বেশি করে ক্লিয়ারেন্স দিয়ে আর্থিক অগ্রগতির টোপ দেখানোর পরিষ্কার উল্লেখ আছে। এর ঠিক পরপর, খোদ দেশের প্রধানমন্ত্রীকে বেদান্তর চিফ এক্সিকিউটিভের আর একটি চিঠিতে প্রায় একইরকম ‘উদ্বেগ’-এর কথা জানানো হয়। বলা বাহুল্য, দুটি চিঠিই ‘অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ’ বলে চিহ্নিত করে পরিবেশমন্ত্রকের সেক্রেটারির কাছে পাঠানো হয়, যা বেশ কিছু খনিবিশেষজ্ঞ ও মন্ত্রকের এক্সপার্ট কমিটির কাছে অত্যন্ত ভয়ঙ্কর এবং উদ্বেগজনক বলে শুরুতে আপত্তি আসে। বলা হয় সিরিয়াস পাবলিক কনসাল্টেশন ছাড়া এই ধরনের শিথিলতা পরিবেশের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকারক। বলা বাহুল্য ধোপে টেকেনি। প্রোজেক্ট ক্লিয়ারেন্সের বহুগুণ বৃদ্ধির পেছনে বেদান্তর প্রত্যক্ষ হাত অস্বীকার করা যায়!

 

গ্রিন ক্রেডিট, কমপেনশেটরি অ্যাফরেস্টেশন ও অন্যান্য গ্রিনওয়াশ

দুবাইতে গত ‘কপ ২৮’-এ ‘গ্রিন ক্রেডিট প্রোগ্রাম’ ভাবনার কথা বলা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে। বলা হচ্ছে, কোনও ব্যক্তি, বা সংস্থা বৃক্ষরোপণ ও জল সংরক্ষণ মূলত এই দুটি পরিবেশভাবনা থেকে কোনও সদর্থক কাজ করলে তা প্রধান নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ ফরেস্ট্রি রিসার্চ অ্যান্ড এডুকেশনের রেজিস্ট্রি পোর্টালে আবেদন করলে একটি এজেন্সিকে দিয়ে যাচাই করে তারপর সেই সংস্থাকে দেওয়া হবে গ্রিন ক্রেডিট। এবং এই গ্রিন ক্রেডিট খুব সহজেই কার্বন ট্রেডিং-এর মতো কেনাবেচা চলতে পারে কোম্পানিগুলির মধ্যে। তাহলে কি অবাধ বৃক্ষচ্ছেদনের ছাড়পত্র? প্রাকৃতিক পূর্ণবয়স্ক অরণ্য লোপাট করে চারাগাছ রোপণ এমনিতেই পরিবেশবাদীদের কাছে অপরাধ। তার সঙ্গে গ্রিন ক্রেডিট যোগ হলে কোম্পানিগুলির তো এতে পোয়াবারো। ১৯৮০ সালের অরণ্য সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী প্রোজেক্টের জন্য বৃক্ষচ্ছেদন করলে অন্য কোনও জমিতে সমপরিমাণ চারাগাছ লাগাতে হবে সেই কোম্পানির দায়িত্বে, যাকে কমপেনশেটরি অ্যাফরেস্টেশন বলা হয়। দেশের বৃক্ষচ্ছেদনের হিসেবটা এখানে প্রাসঙ্গিক। গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচের সমীক্ষা বলছে ২০০২ থেকে ২০২২ পর্যন্ত দেশে মোট ৩৯৩ কিলোহেক্টর হিউমিড প্রাইমারি ফরেস্ট ধ্বংস হয়েছে, যা মোট ট্রি কভার লসের অর্থাৎ ২.১৯ মেগাহেক্টরের ১৮ শতাংশ। ২০১৬ থেকে ২০২১-এ ধ্বংস হয়েছে মোট ৮৩,০০০ হেক্টর অরণ্য। ২০২১-এর স্টেট অফ ফরেস্ট রিপোর্টে আগের দুবছরে ২,২৬১ বর্গ কিলোমিটার অরণ্য বৃদ্ধির যে হিসেব দেওয়া হয়েছে, তাতে প্রাকৃতিক অরণ্যের সঙ্গে মনোকালচার বা কফি-রবার প্ল্যান্টেশনকে সমগোত্রীয় ধরে হিসেবের মতো ধোঁয়াশাও রয়ে গেছে। এবং এর সঙ্গেই রয়েছে স্ক্রল পত্রিকার গবেষণায় ধরা পড়া ভূতুড়ে কমপেনশেটরি অ্যাফরেস্টেশনের একটি চাঞ্চল্যকর রিপোর্ট।

রাজস্থানের লাদখান নয়াগাঁও অঞ্চলের ৪ হেক্টরের সেই ফাঁকা জায়গা যা সরকারি নথিতে অরণ্যাকীর্ণ

২০০৯ থেকে ২০১২— এই সময়সীমায় কমপেনশেটরি অ্যাফরেস্টেশনে বরাদ্দ ২,৯০০ কোটি টাকা বেড়ে ২০১৯ থেকে ২০২২ সময়সীমায় দাঁড়িয়েছে ৫১,০০০ কোটি টাকায়। অথচ সরকারের ই-গ্রিন ওয়াচ ওয়েবসাইট থেকে ছটি রাজ্য ও একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মোট ২০০০টি জায়গায় চালানো গবেষণায় দেখা গেছে কমপেনশেটরি অ্যাফরেস্টেশন শূন্য, উপরন্তু সরকারি হিসেবের অক্ষাংশ দ্রাঘিমাংশ হিসেব করলে কোনও কোনও জায়গার অবস্থান আরব সাগরের মধ্যে। রাজস্থানের বিকানিরের লাদখান নয়াগাঁও গ্রামের ১৫ নম্বর জাতীয় সড়কের কাছে একটি জায়গায় ইলেক্ট্রিসিটি ট্রান্সমিশন লাইনের জন্য বৃক্ষচ্ছেদনের ক্ষতিপূরণ হিসেবে ই-গ্রিনওয়াচে ৪ হেক্টর জমিতে ৫.২৩ লাখ টাকা দিয়ে কমপেনশেটরি অ্যাফরেস্টেশন হয়েছে বলে চিহ্নিত করা আছে। আদপে স্ক্রলের স্পট রিপোর্টে দেখা গেছে ৪ হেক্টরের সেই জমি ধু ধু করছে বালিতে, সবুজের চিহ্নমাত্র নেই। খাতায়কলমে কমপেনশেটরি অ্যাফরেস্টেশনের এই অবস্থার সঙ্গে গ্রিন ক্রেডিট যোগ হলে খুব সহজেই এই ন্যূনতম বৃক্ষরোপণ থেকেও সরে আসতে চলেছে কোম্পানিগুলি এবং গ্রিন ক্রেডিট কেনাবেচা করে কমপেনশেটরি অ্যাফরেস্টেশন থেকে বেঁচে যেতে পারে সহজেই— ২০২২-এ কমপেনশেটরি অ্যাফরেস্টেশনের এই বদলের গালভরা টেকনিকাল নাম অ্যাক্রেডিটেড কমপেনশেটরি অ্যাফরেস্টেশন।

 

চিতা প্রোজেক্ট— হঠকারিতা, চিতামৃত্যু ইত্যাদি

২০২২-এ প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিনে মধ্যপ্রদেশের কুনো ন্যাশনাল পার্কে নামিবিয়া থেকে আটটি চিতা এবং পরের বছর ফেব্রুয়ারিতে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আরও বারোটি চিতা আনার ঢক্কানিনাদে চাপা থাকছে না খুব তাড়াতাড়ি ঘনঘন বেশ কয়েকটি চিতার মৃত্যুসংবাদ। ২০২৩-এর মে মাসে দক্ষ নামের একটি স্ত্রী চিতাকে একটি খাঁচার মধ্যে দুটি পুরুষ চিতার সঙ্গে সঙ্গমের পরীক্ষানিরীক্ষা করানোয় মারা পড়ল দক্ষ স্বয়ং। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খাঁচার মধ্যে মেটিং-এর অবিবেচক সিদ্ধান্তে এই ফলাফল। মেটিং বাইরে হলে চিতার সারভাইভাল রেট বাড়ে, যা আদৌ মানা হয়নি প্রোজেক্ট চিতায়। পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য ২০২২-এর সেপ্টেম্বরে নামিবিয়া থেকে কিডনির অসুখ নিয়ে আসা সাশা নামের একটি চিতার মৃত্যু। প্রাথমিক স্বাস্থ্যপরীক্ষা ছাড়াই তাহলে চিতা সংগ্রহ চলছে? দেশের পরিবর্তিত জলবায়ুতে একাধিক চিতাশাবকের মৃত্যুতে প্রশ্ন আসাও অস্বাভাবিক নয়। যেমন অস্বাভাবিক নয়, পূর্ণবয়স্ক একটি চিতাকে খাঁচার মধ্যে বাধ্যতামূলক সঙ্গমে লিপ্ত করিয়ে প্রায় চিতানিধনের হাস্যকর যজ্ঞের ওপরেও। এবং তাই কুনো ন্যাশনাল পার্কের পর গান্ধিসাগর অভয়ারণ্যকে দেশের পরবর্তী এশিয়াটিক চিতা রি-ইন্ট্রোডাকশনের জায়গা বলে চিহ্নিত করলেও অসুখ না সারালে এইসব হাওয়াবদলেও চিতাভাগ্য খুলবে না। মৃত্যু বাড়বেই।

সিভিলস ডেইলি পত্রিকার তরফে চিতা-মৃত্যুর একটি হিসেব

 

বাদবাকি? ২০১৫ সালে প্যারিস এগ্রিমেন্টে ভারত থেকে ২০২২-এর মধ্যে ১৭৫ গিগাওয়াট রিনিউয়েবল এনার্জির লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছিল, অথচ বাস্তবে হয়েছে মাত্র ১১৯ গিগাওয়াট, গ্লোবাল মনিটরিং এজেন্সি ‘ক্লাইমেট অ্যাকশন ট্র্যাকার’-এর ভাষায় যা ‘Highly insufficient’। ২০০৯ সালে প্ল্যানিং কমিশনের পক্ষ থেকে হিমালয়ের ১১টি রাজ্যের জন্য ১,০০০ কোটি টাকার ‘গ্রিন বোনাস’ দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। ২০১৯-এ দেশের বর্তমান শাসকদলের ম্যানিফেস্টোতে দেখা গেল উত্তরাখণ্ড-সহ সমস্ত হিমালয়ান স্টেটের জন্য আবার সেই গ্রিন বোনাসের কথা, যদিও গত পাঁচ বছরে তা ফলপ্রসূ হয়নি। হিমালয়-সংক্রান্ত গবেষণার জন্য ২০১৫ সালে তৈরি হয় ন্যাশনাল মিশন অন হিমালয়ান স্টাডিজ। বাজেটে ২০১৫-১৬ সালে এই মিশনের জন্য দেওয়া ৬৪ কোটি ২০২০-২৩ সময়সীমায় কমে দাঁড়িয়েছে ৪৮ কোটিতে। ২০১৪-তে প্রধানমন্ত্রীর ফ্ল্যাগশিপ ‘নমামি গঙ্গে’ প্রোজেক্টে ঢালা হয়েছিল ২০,০০০ কোটি, অথচ রূপায়ণে তাড়া নেই এতটুকুও। উত্তরাখণ্ড ও উত্তরপ্রদেশ— দুটি রাজ্যই ২০২২-২৩-এ নমামি গঙ্গের বাজেটের ৭ শতাংশও খরচ করে উঠতে পারেনি কোনও এক অজ্ঞাত কারণে। এবং, যেটুকু যা হয়েছে তার সামগ্রিক পরিণাম? মনিটরিং স্টেশনগুলির ৭১ শতাংশ ক্ষেত্রেই ফিকাল কলিফর্ম ব্যাক্টেরিয়া অস্বাভাবিক মাত্রায় পাওয়া গেছে, যা রীতিমতো উদ্বেগজনক। ২০১৯-এ কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে ‘ন্যাশনাল ক্লিন এয়ার কোয়ালিটি প্রোগ্রাম’ চালু করা হয়, যা দেশের ১৩১টি বায়ু দূষণযুক্ত শহরের দূষণমাত্রা কমানোর লক্ষ্য নিয়েছিল। ২০২২-এ সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের একটি রিপোর্টে দেখা গেছে ১৩১টি শহরের মধ্যে মাত্র ৬৯টিতে রিয়েল টাইম এয়ার কোয়ালিটি মনিটরিং হচ্ছে। ২০১৯ থেকে ২০২১-এর মধ্যে মাত্র ১৪টি শহরে পার্টিকুলেট ম্যাটার শতকরা ১০ ভাগ বা তার বেশিমাত্রায় কমেছে, অথচ ১৬টি শহরে বেড়েছে হু হু করে।

এবং শেষ করার আগে একটু মিষ্টিমুখ চলুক। গত ২০২৩-এর নভেম্বর মাসে হাইড্রোপাওয়ার ও রিভার ভ্যালি প্রোজেক্টগুলির ইআইএ করার জন্য এক্সপার্ট অ্যাপ্রেইসাল কমিটিতে এসেছেন জনার্দন চৌধুরী, যিনি আদানি গ্রিন এনার্জি লিমিটেডের অন্যতম পরামর্শদাতা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, অন্ধ্রপ্রদেশের ৮৫০ মেগাওয়াটের রায়ওয়াদা ও ১,৮০০ মেগাওয়াটের পেদাকোটা প্রোজেক্ট অথবা মহারাষ্ট্রের ২,১০০ মেগাওয়াটের পাটগাঁও, ২,৪৫০ মেগাওয়াটের কোয়না-নিবাকানে, ১৫০০ মেগাওয়াটের মালসেজ ঘাট ভোরান্দে ও ১,৫০০ মেগাওয়াটের তারালি প্রোজেক্টগুলি গ্রিন ক্লিয়ারেন্সের জন্য অপেক্ষা করছে। কাদের প্রোজেক্ট এগুলি? আদানি গ্রুপ। ক্লিয়ারেন্স দেবে কে? আদানি গ্রুপের পরামর্শদাতা।

দেশের পরিবেশ-প্রহসন অক্ষত থাকুক!

 

ঋণস্বীকার

  1. Aggarwal, Mayank. India’s proposed overhaul of environmental clearance rules could dilute existing regulations. Mongabay. March 18, 2020.
  2. Aggarwal, Mayank. Modi Government is pursuing ‘ease of business’ at the cost of the environment. Scroll.in. February 10, 2022.
  3. Banerjee, Preetha. Electoral bonds: At least 4 companies that gave over Rs. 100 Cr have history of violating green norms, tribal rights. Down to Earth. March 15, 2024.
  4. Ghanekar, Nikhil & Mazoomdaar, Jay. Electoral bonds data: Mining, steel majors spend Rs. 825 Crore, among them firms awaiting green nod. Indian Express. March 15, 2024.
  5. Jayashree, N. 12.5k projects given green clearance in 2022, Lok Sabha told. Hindustan Times. March 28, 2023.
  6. Kapoor, Meenakshi & Dinesh, Krithika A. Throughout the pandemic, environmental clearance law has been under the chopping block. The Wire. May 23, 2021.
  7. Kulkarni, Chiranjeevi. Remnants of Green India under concerted attack. Deccan Herald. July 23, 2023.
  8. Kukreti, Ishan. India’s ghost plantations in which millions of rupees have been sunk. Scroll.in. June 12, 2022.
  9. Mazoomdaar, Jay. Ignoring green commitments: Weak political will, lack of a monitoring system. Indian Express. February 5, 2022.
  10. Nitnaware, Himanshu. Are cheetahs at home? Down to Earth. March 1, 2024.
  11. Nitnaware, Himanshu. Government admits to have bypassed environmental impact assessments for Chardham project. Down to Earth. December 8, 2023.
  12. Pandey, Kiran. India’s forest cover goes up by nearly 3% in this decade; but all is not well. Down to Earth. December 30, 2019.
  13. Parvaiz, Athar. For Indian tree lovers, plantations are a poor substitute for lost forests. Science, The Wire. April 2, 2022.
  14. Paul, Madhumita. Failed Net Zero pledges: Just 0.3% renewable energy produced by 12 European Big Oil companies in 2022. Down to Earth. August 31, 2023.
  15. Rathore, Vaishnavi. A decade under Modi: Environmental protections diluted, Cheetah project falters. Scroll.in. February 12, 2024.
  16. Rathore, Vaishnavi. The dark clouds over India’s cheetah project. Scroll.in. July 12, 2023.
  17. Rathee, Dhruv. Environment is the most under-reported disaster of Narendra Modi government. The Print. April 19, 2019.
  18. Rawat, Vaishali. Greenlight for destruction: Controversial forest act opens door to unfettered deforestation. Frontline. January 10, 2024.
  19. Talukdar, Sandipan. Modi’s Namami Gange a failure, says report. Newsclick. April 16, 2019.
  20. Tripathi, Bhaskar. India bets on green credits, but could they reward deforestation? Context. February 29, 2024.
  21. Sharma, Ashutosh. Chhattishgarh’s new BJP government restarts controversial coal mining in Adivasi areas. Frontline. December 29, 2023.
  22. Vedanta successfully lobbied Indian Govt to weaken environmental regulations: Report. The Wire. September 1, 2023.
  23. Vibhaw, Nawneet. What is the Forest (Conservation) Amendment Bill, 2023 and why it matters. ET Energy World. July 31, 2023.
  24. Yadav, Nivit Kumar & Aggarwal, Anubha. Centre made over 100 changes in environment impact assessment notification in past 5 years. Down to Earth. April 10, 2023.

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4664 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...