সেলিমের নেতৃত্বে বামপন্থীরা কি এবার খাতা খুলতে পারবে?

গৌতম রায়

 


গোটা বামপন্থী শিবির নির্বাচনী প্রচারে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দিচ্ছে রাজনৈতিক ইস্যুগুলির উপর। তাঁরা বারবার বলছেন সামগ্রিকভাবে দেশের অনগ্রসরতার কথা। তাঁরা বারবার বলেছেন দেশের ভয়াবহ বেকার সমস্যার কথা। খাদ্যসঙ্কটের কথা। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার আর রাজ্যের তৃণমূল সরকারের বল্গাহীন দুর্নীতির কথা। বামপন্থীরা বলছেন ইলেকটোরাল বন্ডের মধ্যে দিয়ে কীভাবে বিজেপি আর তৃণমূল পরস্পর প্রতিযোগিতা করে নিজেদের আর্থিক সম্পদ বৃদ্ধি করেছে সেই কথা

 

বামফ্রন্ট সরকার দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকবার পর ২০১১ সালে ক্ষমতাচ্যুত হয়। তারপর থেকেই সংসদীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে বামফ্রন্টের প্রায় সব কটি শরিকদল ক্রমশ পিছিয়ে পড়তে থাকে। যদিও সেই অবস্থাতেও ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার মাত্র তিন বছরের মাথায়, রায়গঞ্জ লোকসভা কেন্দ্র থেকে সিপিআই(এম) প্রার্থী হিসেবে জেতেন মহম্মদ সেলিম।

তারপরের পাঁচ বছর সংসদের ভেতরে ও বাইরে তাঁর ভূমিকার জন্য দেশে-বিদেশে তাঁর নামের আগে একটি বিশেষণ যুক্ত হয়— ‘অনলবর্ষী’। সত্যিই সাম্প্রতিক অতীতে সংসদে সেলিমের মতো যুক্তিনিষ্ঠ ঝাঁঝালো বক্তৃতায় শাসকশিবিরকে বিপর্যস্ত করবার ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ থেকে আর কোনও সাংসদকে দেখা যায়নি।

একটা সময় ছিল যখন হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, রেণু চক্রবর্তী, জ্যোতির্ময় বসু, ডাক্তার শরদীশ রায়, গীতা মুখোপাধ্যায়, ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত, ত্রিদিব চৌধুরী, চিত্ত বসু প্রমুখের মতো সাংসদেরা, কখন কোন ধরনের আক্রমণ বা সরকারের কেলেঙ্কারি সংসদে তুলে ধরবেন, তা নিয়ে পণ্ডিত নেহরু থেকে ইন্দিরা গান্ধি পর্যন্ত উদ্বিগ্ন থাকতেন।

বামফ্রন্ট ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর লোকসভায় আমরা দেখেছি যে প্রণম্য সাংসদদের কথা এখানে উল্লেখিত হল, প্রায় তাঁদের সকলের প্রতিনিধিত্ব এককভাবে লোকসভার ফ্লোরে দাঁড়িয়ে মহম্মদ সেলিম করে গিয়েছেন। তাঁর নিজের নির্বাচনকেন্দ্র রায়গঞ্জের অন্তর্গত ডালখোলার রাস্তা নির্মাণজনিত সমস্যা থেকে শুরু করে বিজেপি আর তৃণমূলের দুর্নীতি, নারদা কেলেঙ্কারি, সারদা কেলেঙ্কারি ইত্যাদি ঘিরে সেলিম যেভাবে লোকসভায় মুখর ছিলেন তা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে বামপন্থীদেরই কেবল নয়, গোটা ভারতীয় সংসদীয় ব্যবস্থার মর্যাদাকে একটা বিশেষ জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছিল।

সেলিম এইসময় লোকসভায় একজন তুখোড় বক্তা বা নিজের নির্বাচনীকেন্দ্রে একজন সফল সাংসদ হলেও সাংগঠনিকভাবে বামপন্থীরা তখন ক্রমশই পিছিয়ে পড়তে থাকেন। তৃণমূল এবং বিজেপির যৌথ আক্রমণের মোকাবিলা করবার ক্ষেত্রে রাজনীতির ময়দানে যে-ধরনের অবস্থান নেওয়া দরকার ছিল, নীতিগতভাবে সেই অবস্থানের পক্ষে বামপন্থীরা ছিলেন। কিন্তু অবস্থানের প্রয়োগের ক্ষেত্রে সবসময় যথোচিত ভূমিকা তাঁরা পালন করতে পারেননি।

সেলিম দলের রাজ্য সম্পাদকের দায়িত্ব নেওয়ার অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই বীরভূমের বগটুইতে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্বে এক ভয়াবহ গণহত্যা ঘটে। ঘটনার দিন সকালবেলায় হাওড়ার আমতা থানার অন্তর্গত প্রত্যন্ত এঈটি গ্রামে তৃণমূল সরকারের পুলিশের হাতে খুন হওয়া আনিস খানের বাড়িতে যাওয়ার কথা ছিল সেলিমের। সেই প্রস্তুতিপর্বের মধ্যেই তড়িঘড়ি দলের রাজ্য দপ্তরে বগটুই-গণহত্যা ঘিরে সাংবাদিক সম্মেলন করা— এই যে ক্ষিপ্রতা এবং গতিময়তা, এটাই কিন্তু আমরা বামফ্রন্ট এবং গোটা সিপিআই(এম) নেতৃত্বের ভেতরে বিগত প্রায় ২০-৩০ বছরে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। হ্যাঁ, বামফ্রন্ট যখন ক্ষমতাশীন ছিল সেই সময়কালকে ধরেই কিন্তু এই ২০-৩০ বছরের কাল নির্ণয় করা হচ্ছে এখানে।

সাংবাদিক সম্মেলন করে বাড়িতে ফিরেই সেলিম সিদ্ধান্ত নিলেন আনিস খানের বাড়ি হয়ে তিনি বগটুই যাবেন। এই ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে আমরা আগে দেখেছি, একটা অদ্ভুত ধরনের আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মধ্যে বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলি অনেকটা সময় কাটিয়ে দেয়। যার ফলে শাসক-শিবিরের পক্ষে নিজেদের অপরাধ আড়াল করবার বিষয়টি অনেক ক্ষেত্রেই সহজ হয়ে পড়ে। সেলিম কিন্তু সেই চিরাচরিত গড্ডলিকাপ্রবাহে গা ভাসালেন না।

সেদিন আনিস খানের বাড়িতে তাঁর পিতার সঙ্গে দেখা করে, তাঁদের সহমর্মিতা জানিয়ে বিকেলেই হাওড়া জেলার একটি জায়গায় রাজনৈতিক সভা করেন সেলিম। উঠে এল বগটুই প্রসঙ্গ। তখনও পর্যন্ত অন্য রাজনৈতিক দলগুলি সেভাবে রাজনৈতিক বক্তব্য রাখতে শুরু করেনি বগটুই ঘিরে। শুধু সভা করাই নয়। সভার পথে একটা বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে বিরাট মিছিলে নেতৃত্ব দিলেন সেলিম। সঙ্গে ছিলেন বিমান বসু।

সেখান থেকে সেলিম এবং বিমান বসু একটি আলাদা গাড়িতে করে বীরভূমের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন। তারপর সবটাই যেন কমিউনিস্টদের ঘুরে দাঁড়ানোর একটা প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতবাহী ঘটনা ঘটতে থাকলো। বিমান বসুকে আটকে দিল পুলিশ বড় গাড়ি করে অকুস্থলের দিকে রওনা হওয়ায়। কিন্তু সেলিম এক স্থানীয় পার্টি-কমরেডের মোটরসাইকেলের পিছনে বসে পৌছে যান অকুস্থলে। শুধু তাই নয়, পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে বগটুইতে যে-বাড়ির ভেতরে গণহত্যা চালিয়েছিল তৃণমূল, সেই বাড়িতেও প্রবেশ করেন সেদিন সেলিম। তারপর ওই গণহত্যার যে মূল ষড়যন্ত্রী তার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে যেভাবে সবার সামনে তিনি গর্জে উঠেছিলেন, সেই প্রেক্ষিত কিন্তু সাধারণ কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে লড়াইয়ের ময়দানে সামিল হওয়ার ক্ষেত্রে একটা বড় ধরনের অ্যান্টিবায়োটিকের কাজ করেছিল।

সেলিম এই যে রণকৌশল সেদিন নিয়েছিলেন, সেই ধারাটি কিন্তু বিগত প্রায় দু-বছর ধরে তিনি সমানভাবে বজায় রেখেছেন। তাঁর দলের যে-কোনও নেতা, কর্মী, সমর্থক তৃণমূল বা বিজেপির হাতে আক্রান্ত হলে, সেলিম যেভাবে সেই আক্রান্ত মানুষদের পাশে ছুটে গিয়েছেন রোদ-জল-ঝড়-বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে, তাঁদের পাশে থেকেছেন, হাসপাতালে ছুটে গেছেন, শহিদ কমরেডদের হত্যার বিচারের দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন, অপরাধীদের গ্রেফতারের দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন, ঠিক তেমনি শহিদ পরিবারের অর্থনৈতিক পুনর্বাসনের বিষয়টিও কিন্তু সেলিমের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। বহু ক্ষেত্রে শহিদ কমরেডদের সন্তানদের পড়াশুনোর দায়িত্ব ঘনিষ্ঠ মানুষদের মধ্যে বণ্টন করে দিয়েছেন এবং সেই দায়িত্ব ঠিকমতো তাঁরা পালন করছেন কিনা সে-বিষয়ে সেলিম সদাসতর্ক থাকেন।

নেতৃত্বের সামনে থেকে লড়াই দেওয়ার যে-জায়গাটা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর গোটা বামপন্থী শিবিরের মধ্যেই খানিকটা ঝিমিয়ে পড়েছিল, সেদিন সিপিআই(এম) দলের সম্পাদকের দায়িত্ব নেওয়ার পর নিজের দলের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে এমন একটা পরিবেশ তিনি তৈরি করতে পারলেন, যাতে প্রায় অবলুপ্ত হয়ে যাওয়া বামফ্রন্টের শরিক দলগুলিও একটা নতুন উদ্যমে নিজেদেরকে নিজেদের সাধ্যমতো মাঠে নামতে কার্যত বাধ্য হল।

সেলিমের নিজের দলে তিনি রাজ্য সম্পাদক হওয়ার পর সবচেয়ে বেশি মর্যাদা পেল কিন্তু নবীন প্রজন্মের মানুষজনেরা। তাই বলে প্রবীণ নেতৃত্বকে একেবারে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিলেন— এমন হঠকারী সিদ্ধান্ত কিন্তু তিনি নেননি। অভিজ্ঞ প্রবীণ নেতৃত্ব, তাঁদের বুদ্ধি, মেধা, অভিজ্ঞতা— সমস্ত কিছুকে কাজে লাগিয়ে নবীন নেতৃত্বকে এমন একটা জায়গায় ধীরে ধীরে সেলিম তুলে আনছেন যেখান থেকে বামফ্রন্টের সমর্থক বা বিরোধী সমস্ত ধরনের মানুষের কাছেই মনে হচ্ছে রাজনীতির ক্ষেত্রে একটা বড় ধরনের অদলবদল আনবার জন্যে একটা চেষ্টা শুরু হয়েছে।

সংবাদমাধ্যম একটা সময় বামপন্থীদের পক্বকেশ বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সাম্রাজ্য বলে ব্যঙ্গ করত। সেলিম নবীন প্রজন্মকে নেতৃত্বে তুলে আনলেন। শহুরে মধ্যবিত্ত সমাজের বাইরেও একেবারে গ্রাম-মফস্বলের অর্থনৈতিক এবং সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষদের ভেতর থেকে, সংখ্যালঘু সমাজের ভেতর থেকে, তফসিলি জাতিভুক্ত, জনজাতিদের মধ্যে থেকে, এমনকি সময়ের সঙ্গে পাল্লা রেখে ট্রান্সজেন্ডারদেরও যেভাবে আলাদা করে দলের মূল কর্মধারার সঙ্গে তিনি সংযুক্ত করলেন, সাধারণ মানুষের কাছে মনে হল রাজনীতির প্রচলিত গড্ডলিকা প্রবাহের মধ্যে আবদ্ধ থেকে সেলিম তাঁর রাজনৈতিক ভাবনাকে প্রসারিত করছেন না।

একটা সময় যখন কেবলমাত্র বিপক্ষ দলের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বই নয়, নিজের দলের ভিন্ন গোষ্ঠীর রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে কথা বললেও কোনও-না-কোনও সমস্যার উদয় হত, সেখানে রাজনীতির একটা নতুন পরিভাষা সেলিম তৈরি করলেন। যে-পরিভাষার মধ্যে প্রথম এবং প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে যেটি তিনি উপস্থাপিত করবার চেষ্টা করলেন সেটি হল ‘কমরেডশিপ’। সেলিমের এই যে সমন্বয়-চিন্তা, দলের প্রবীণ নেতৃত্বের মেধা-অভিজ্ঞতার সঙ্গে তরুণ প্রজন্মের কর্মীদের সংযুক্ত করে, তাঁদেরকে ধীরে ধীরে নেতৃত্বে নিয়ে আসা— এই পদ্ধতিটার অভাবেই কিন্তু কেবলমাত্র ভারতেই নয়, বিশ্বের অনেক দেশে অনেক শক্তিশালী রাজনৈতিক দল পরবর্তী সময়ে নিজেদের শক্তির ধারাকে অক্ষুণ্ণ রাখতে পারেনি।

সেলিম এই যে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের দলের নেতৃত্বে তুলে আনছেন সেখানেও কিন্তু মফস্বলের পিছিয়ে পড়া অংশের মানুষদের ভেতর থেকে একটা বড় অংশকে তুলে আনার যে প্রবণতা, এটা কিন্তু ভারতে সাম্প্রতিক অতীতে কি বাম কি ডান, কোনও রাজনৈতিক দলের মধ্যেই আমরা সেভাবে দেখতে পাই না।

আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে (২০২৪) আমরা দেখতে পাচ্ছি, কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন ধর্মান্ধ হিন্দু সম্প্রদায়িক দল বিজেপি এবং রাজ্যে ক্ষমতাসীন প্রতিযোগিতামূলক সম্প্রদায়িক দল তৃণমূল কংগ্রেস উভয়ই এই ভোটটাকে সাম্প্রদায়িক এবং সামাজিক মেরুকরণের পথে পরিচালিত করতে চাইছে।

আমাদের মনে রাখা দরকার নয়ের দশকের শেষের দিকে যখন এনডিএ তৈরি করে নীতিবিহীন সুবিধাবাদী জোটের মধ্যে দিয়ে বিজেপি ক্ষমতায় আসতে চেষ্টা শুরু করেছিল, তখন কিন্তু তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী অটলবিহারী বাজপেয়ি নিজে মন্দির ইস্যুতে খুব একটা সোচ্চার ছিলেন না। এই কাজটি বিজেপির হয়ে তখন অটলবিহারীর পরিবর্তে লালকৃষ্ণ আদবানিকে দিয়ে করাত আরএসএস।

কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আরএসএস তাদের সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনের পদ্ধতির যে পরিবর্তণ এনেছে, সেখানে এখন আর সাম্প্রদায়িক বিভাজনের প্রশ্নে কোনও রাখঢাক তারা রাখতে চাইছে না। ইতিমধ্যেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আসন্ন রামনবমীকে ঘিরে সরাসরি নানা ধরনের প্ররোচনামূলক কথা বলতে শুরু করেছেন।

অপরপক্ষে সেই প্ররোচনাকে আরও উসকে দিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর স্বভাবসুলভ ভূমিকা নিতে শুরু করেছেন। উত্তরপ্রদেশের সাহারানপুর, রাজস্থানের আজমীর শরীফে প্রধানমন্ত্রী মোদি বলছেন রামনবমী আসছে। দেখি কত লোক বিরোধিতা করতে পারে।

আর তার ঠিক ২৪ ঘন্টার ভেতরেই মমতা বলছেন দাঙ্গার কথা। মমতা সতর্ক করে দিচ্ছেন দাঙ্গা করবে বিজেপি। কিন্তু মমতা একবারও বলছেন না দাঙ্গা করার চেষ্টা বিজেপি করলেও আমি সেই দাঙ্গা রুখব।

১৯৭৯ সালে এই আরএসএস যখন অবিভক্ত বিহারের জামশেদপুরে রামনবমীকে ঘিরে দাঙ্গা বাধিয়েছিল, তখন সেখানে আক্রান্ত মানুষদের ত্রাণ-পুনর্বাসনের জন্য যুবকর্মী হিসেবে ছুটে গিয়েছিলেন সেলিম। রামনবমীকে ঘিরে হিন্দুত্ববাদী শক্তি কী ধরনের ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে, সে-সম্পর্কে নিজের রাজনৈতিক জীবনের প্রথম পর্ব থেকেই সেলিমের একটা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আছে।

সাতের দশকের শেষপর্বে, তখন জনতা পার্টির সরকারের আমলে, আরএসএসের সঙ্গে সেই সরকারের যে ঘনিষ্ঠতা, তার ভিত্তিতে বিহারে ধর্ম আর জাতপাতের রাজনীতিকে ব্যবহার করে, হিন্দুত্ববাদীরা নিজেদের শক্তি বাড়াবার চেষ্টা করেছিল। সেখানে কিন্তু আর যাই হোক আজকের মতো প্রতিযোগিতামূলক সম্প্রদায়িকতা, যেটা মমতা ব্যানার্জি করে যাচ্ছেন, এই বিষয়টা এভাবে উঠে আসেনি সেদিন।

জাতপাতের রাজনীতি বিহারে সেদিন যে-সক্রিয়তা দেখিয়েছিল তার পেছনে উচ্চবর্ণের অত্যাচারের একটা বড় ভূমিকা ছিল। কিন্তু আজ, বিশেষ করে ২০১৮ সাল থেকে, অর্থাৎ গত লোকসভা নির্বাচনের ঠিক এক বছর আগে থেকে একদিকে তাদের হাজার রকমের সহযোগী সংগঠনগুলিকে নিয়ে রামনবমী উপলক্ষে একটা ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক প্ররোচনা তৈরি করে বিজেপি। তার পাশাপাশি প্রতিযোগিতামূলক সম্প্রদায়িকতার স্মারক হিসেবে মমতা বা তার দল শুরু করেছে হনুমান জয়ন্তী।

এই উভয়ের প্রতিযোগিতার ফলে সবচেয়ে বিপন্ন অবস্থায় এসে পড়েন গরিব মুসলমান সমাজের লোকেরা। অত্যন্ত উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হিন্দুত্ববাদী শক্তি, মুসলমান জনবসতি এলাকাগুলির মধ্যে দিয়ে রামনবমীর মিছিলকে নিয়ে যায়। নিয়ে যাওয়ার সময় পবিত্র মসজিদ ইত্যাদির সামনে অহেতুক বাজনা বাজানো, অকথ্য গালাগালি দেওয়া, তাদের রাজনৈতিক স্লোগান ‘জয় শ্রীরাম’ একেবারেই শিবাকীর্তনের মতন আউড়ে যাওয়া— এইসব অরাজকতামূলক অবস্থার ভেতর দিয়ে একটা ভয়াবহ সম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি করে।

আমরা গত বছরেও দেখেছি কীভাবে হাওড়া শিল্পাঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় যেখানে মুসলমান জনবসতি বেশি রয়েছে বা হুগলিতে চটকল-অধ্যুষিত এলাকা যেখানে মিশ্র জনবসতি রয়েছে, সেইসব এলাকাগুলিতে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি কীভাবে রামনবমীর মিছিল নিয়ে গিয়ে আক্রান্ত করছে গরিব মুসলমানদের। সেখানে মমতার পুলিশ পালন করছে দর্শকের ভূমিকা। যে-সব মিশ্র জনবসতি, মিশ্র ভাষাভাষীদের অঞ্চলগুলি দিয়ে এই ধরনের সাম্প্রদায়িক প্ররোচনামূলক মিছিল যাওয়ার কথা নয় আইনশৃঙ্খলার কারণে, সেই অঞ্চলগুলি দিয়ে হিন্দুত্ববাদীরা মিছিল নিয়ে যাচ্ছে, পুলিশ দেখেও কিছু দেখছে না। মিছিলকারীরা যখন মসজিদের সামনে নানা ধরনের প্ররোচনামূলক আচরণ করছে, গরিব মুসলমানদের বাড়িঘর ধরে ধরে আক্রমণ করছে, তখনও পুলিশ কোনও অবস্থাতেই কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না।

এই যে পরিবেশ, এই যে পরিস্থিতি, তার ভেতর দিয়েই কিন্তু বিজেপি আর তৃণমূল ভোটের রাজনীতিকে পরিচালিত করতে চায়। কোনও অবস্থাতেই তারা মন্দির-মসজিদ, হিন্দু-মুসলমানের বাইরে আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে কোনও রাজনৈতিক ইস্যু তুলে ধরতে চাইছে না। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের ভয়াবহ দুর্নীতি— এই সমস্ত বিষয়গুলিকে বিজেপি রাজনৈতিক প্রচারের আড়ালে ঠেলে দিতে চাইছে। আর এইগুলি যাতে করতে পারে তৃণমূল, তার জন্যই বিজেপি তার হাজাররকমের সঙ্গীসাথীদের নিয়ে মন্দির-মসজিদ, হিন্দু-মুসলমানের রাজনীতি করে যাচ্ছে। একটিবারও তারা সাধারণ মানুষের রুটিরুজির প্রশ্ন আনছে না। দেশের ভয়াবহ বেকারত্বের কথা আনছে না। দেশের ভেঙে পড়া শিক্ষাব্যবস্থার কথা আনছে না।

মুখে তৃণমূল কংগ্রেস নিজেদের অনেক বড় বিজেপি-বিরোধী বলে দেখাবার চেষ্টা করলেও, গুজরাতের আহমেদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে পবিত্র রমজান মাসে বিদেশি ছাত্রদের নামাজ পড়ার সময় হিন্দুত্ববাদীরা যে ভয়ঙ্কর আক্রমণ করেছে, সে-সম্পর্কে আজ পর্যন্ত মমতা ব্যানার্জি একটা শব্দ উচ্চারণ করেননি। উত্তরপ্রদেশের বেনারসে জ্ঞানবাপী মসজিদ ঘিরে যে ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক দরকষাকষির খেলায় বিজেপি নেমেছে, সে-সম্পর্কে বামপন্থীরা প্রথম থেকেই সোচ্চার। কিন্তু মমতা ব্যানার্জি আজ পর্যন্ত একটি শব্দ সে-সম্পর্কে উচ্চারণ করেননি। নিম্ন আদালতের রায়কে সম্বল করে জ্ঞানবাপী মসজিদের একটি অংশে হিন্দুত্ববাদীরা ভজন-পূজন শুরু করে দিয়েছে। সেই অংশটি দখল করবার পর তাদের আরও আগ্রাসনের মানসিকতা ছিল। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট তাদের সে ইচ্ছা পূরণ করতে দেয়নি। সুপ্রিম কোর্টের এই সত্যনিষ্ঠ ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থান সম্পর্কে কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটা শব্দও উচ্চারণ করেননি।

সংবিধান-প্রদত্ত ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষার যে অধিকার, সেই অধিকারকে খর্ব করে উত্তরপ্রদেশ সরকার মাদ্রাসা-শিক্ষাকে বন্ধ করে দেওয়ার উপক্রম করেছিল। মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট, এলাহাবাদ হাইকোর্টের এই সংবিধান-বিরোধী রায়ের ওপরে স্থগিতাদেশ জারি করেছে। এ-সম্পর্কেও কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটি শব্দ উচ্চারণ করেননি। অথচ রামনবমী ঘিরে দাঙ্গার যে পরিকল্পনা হিন্দুত্ববাদীরা করছে সে-সম্পর্কে প্রকাশ্য জনসভায় মমতা সোচ্চার হয়েছেন।

সেলিম কিন্তু তাঁর নির্বাচনী প্রচারে বা তাঁর দলের নির্বাচনী কৌশলে কখনওই হিন্দুত্ববাদীদের এই মন্দির-মসজিদ, হিন্দু-মুসলমানের রাজনীতির প্ররোচনায় পা দেননি। তা বলে এই নয় যে, হিন্দুত্ববাদীরা রাজনীতির নামে অপরাজনীতির প্রয়োগের মধ্যে দিয়ে সামাজিক মেরুকরণের যে চেষ্টা চালাচ্ছে তার বিরুদ্ধে সেলিম বা সহযোদ্ধারা কোনও প্রতিবাদ উচ্চারণ করছেন না। প্রতিরোধের বার্তা দিচ্ছেন না।

তবে গোটা বামপন্থী শিবির নির্বাচনী প্রচারে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দিচ্ছে রাজনৈতিক ইস্যুগুলির উপর। তাঁরা বারবার বলছেন সামগ্রিকভাবে দেশের অনগ্রসরতার কথা। তাঁরা বারবার বলেছেন দেশের ভয়াবহ বেকার সমস্যার কথা। খাদ্যসঙ্কটের কথা। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার আর রাজ্যের তৃণমূল সরকারের বল্গাহীন দুর্নীতির কথা। বামপন্থীরা বলছেন ইলেকটোরাল বন্ডের মধ্যে দিয়ে কীভাবে বিজেপি আর তৃণমূল পরস্পর প্রতিযোগিতা করে নিজেদের আর্থিক সম্পদ বৃদ্ধি করেছে সেই কথা।

ইলেকটোরাল বন্ডের একটা টাকাও বামপন্থীরা যেহেতু নেননি, সেই কারণে বামপন্থীদের ইলেকটোরাল বন্ড নিয়ে সমালোচনা করবার যে হক আছে সেই হক বিজেপি বা তৃণমূল কোনও দলেরই নেই। তাই তারা ইলেকটোরাল বন্ড নিয়ে অদ্ভুত রকমের নীরবতা পালন করে চলেছে।

সেলিমের এই যে রণকৌশল পশ্চিমবঙ্গে, এর মধ্যে যে ব্যতিক্রমী ধারা আছে, সেই ধারাই কিন্তু বেসুরে বাজতে থাকা রাজনীতিকে একটা সুরে প্রতিস্থাপিত করবে— এটাই সাধারণ মানুষের বিশ্বাস।


*মতামত ব্যক্তিগত

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4664 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. লেখাটা বেশ ভাল। সেলিমের নেতৃত্বে বাম রাজনীতির একটা বদল ঘটেছে, এটা ঠিক। এটা আরও ইতিবাচক হয়ে উঠুক এই প্রত্যাশা

আপনার মতামত...